নিয়তি
✍ সলিল চক্রবর্ত্তী
“প্রয়োজনে এক নিশী যাপনের মূল্য আমি দশ লক্ষ টাকা দিতে পারি, সুতরাং কমলাবাই-কে আজ আমার চাই-ই চাই।”
উদিত প্রতাপ সিংহ সুরাতে নিমজ্জিত হইয়া চাকর রাম বিলাসকে হুকুম করিল ।
উত্তর প্রদেশের প্রভাব শালী মন্ত্রী জনার্দন প্রতাপ সিংহ। ঠাকুরদা মশায়ের ছিল জমিদারী, রক্তে সেই ভাবধারা আজও বিদ্যমান। মন্ত্রীত্ব চালনা করিতে জমিদারী প্রভাব প্রকট হইয়া উঠে। প্রবাদ আছে বংশ হইতে শাখা দীর্ঘ, ঠিক তেমনি পুত্র উদিত প্রতাপ সিংহ পিতা হইতে যোজন মাইল আগাইয়া আছে। নারী ও সুরায় আসক্ত উদিত প্রতাপের উৎপীড়নে এলাকা বাসীরা তটস্থ। থানা পুলিশে অভিযোগ করিলে কোনো সুফল পাওয়া যায়না। পুলিশের ঘাড়ে কয়টি মাথা আছে যে উদিত প্রতাপের কেশাগ্র স্পর্শ করিবে? ফল স্বরূপ উদিতের উশৃঙ্খলতার বোঝা দিনে দিনে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। পিতা জনার্দন প্রতাপের কোনো হেলদোল নাই দেখিয়া মাতা মীরা দেবী অনেক ভাবে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু তাহাতেও সুফল কিছুই মিলিল না। উপরন্তু তাহার নষ্টামি ভ্রস্টাচার ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দিবারাত্র মদ্যপানে নিমজ্জিত হইয়া অপকর্ম করিতে লাগিল। এমতাবস্থায় জনার্দন প্রতাপ যখন বুঝিলেন, পুত্র তাহার হস্তের মধ্যে নাই, তখন স্বাভাবিক পথে ফিরাইবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলেন। কুলগুরুকে গৃহে আনিয়া পুত্র সম্মন্ধে সবিস্তারে জ্ঞাত করিলেন। সমস্ত বিষয়ে অবগত হইয়া কুলগুরু উদিত প্রতাপকে বিবাহ দিবার উপদেশ দিলেন। তাহাতে যদি চিত্ত চাঞ্চল্য নিবারণ হয়।
চতুর দিক অন্বেষণ করিয়া এক সুলক্ষণা রমণীর সহিত উদিত প্রতাপের বিবাহ হইলো। বিবাহের পর মাস দুই তিন নির্বিঘ্নে কাটিল বটে, তাহার পর সে আগের মতই আচরণ করিতে শুরু করিল। উদিত প্রতাপ ভুলিয়া গেলো যে সে বিবাহিত। নিশী যাপন চলে পিতার বাগান বাড়ীতে।
এই ভাবেই বছর পাঁচেক অতিক্রান্ত হইলো। উদিত প্রতাপের উৎপিরণ চরম সীমায় উপনীত হইলো। এরই মধ্যে কুলগুরু গৃহে আসিয়া উপস্তিত। কেদারনাথ যাইবার প্রাক্কালে তিনি শিষ্য বাড়ীতে ঘুরিয়া যাইতে চান। মীরাদেবী তো হস্তে চন্দ্র পাইলেন। ঈশ্বর সমো সেবা করিয়া, তার চরণে মিনতি করিলেন যে তিনি যেন তাহার পুত্রের মতি-গতি পরিবর্তন করাইয়া সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে আনিয়া দেন। এরই মধ্যে উদিত প্রতাপ বাড়ীতে প্রবেশ করিল এবং কুলগুরুর সন্মুখে পড়িয়া গেল। উদিত প্রতাপ গুরুর প্রতি কিঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ ছিল কারণ বিবাহ নামক ঝঞ্ঝাটটি উনিই তাহার স্কন্ধে চাপাইয়াছেন। সুতরাং মুখো মণ্ডলে বক্রক্তি প্রকাশ করিয়া সে স্থান ত্যাগ করিল। উদিত প্রতাপের তাচ্ছিল্য প্রকাশের ধরন গুরুর নজর এরাইল না। ততক্ষনে তিনি উদিত প্রতাপের কুষ্ঠি বিচার করিয়া ফেলিয়াছেন। উদিত প্রতাপের স্ত্রীকে কাছে ডাকিয়া কুলগুরু তার ললাট নিরীক্ষণ করিয়া চমকিয়া উঠিলেন। তিনি দেখিলেন উদিত প্রতাপের স্ত্রীর সিন্দুর পরিহিত ললাটটি সাদা হইয়া আছে। তিনি কাল বিলম্ব না করিয়া উদিত প্রতাপ কে তাহার সন্মুখে আসিতে কহিলেন এবং নিজে কিছু হিসাব নিকাশে ব্যাস্ত হইয়া পড়িলেন। এদিকে মিরাদেবী অনেক বুঝাইয়া উদিত প্রতাপকে গুরুজীর সন্মুখে উপস্থিত করিলেন। গুরুজী উদিত প্রতাপকে আপদ মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া পুনরায় চমকিয়া উঠিলেন। এতক্ষন ধরিয়া তিনি যে গণনা করিলেন তাহা সম্পূর্ণ রূপে নির্ভুল। এদিকে গুরুজীও তাহার সহিত মা এবং স্ত্রীর আচরণ উদিত প্রতাপের নিকট নিছক যাত্রাপালা ছাড়া আর কিছুই মনে হইলো না। পিতা গৃহে উপস্তিত থাকায় সে নিরবে সবকিছু সহিতে ছিল। এবার গুরুজী ঘর হইতে উদিত প্রতাপ এবং তাহার পিতামাতা ছাড়া সবাইকে বাহিরে যাইতে অনুরোধ করিলেন। গুরুজীর নির্দেশ মোতাবেক সকলে গৃহ হইতে প্রস্থান করিলে গুরুজী উদিত প্রতপকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন – “দেখ উদিত প্রতাপ, আমি এই মুহূর্তে যে কথাগুলি বলিব তাহা আমার গণনার ফল। তোমাকে ভয় দেখাইবার জন্য নহে। জনার্দন প্রতাপ এবং মিরা দেবীর উদ্দেশ্যে বলিলেন, তোমরাও চিত্ত দৃঢ় করো কারণ পরিবারে এক জনের পাপের ফল অন্যদেরও ভোগ করিতে হয়। উদিত প্রতাপ বিরক্ত বোধ করিতে লাগিল ভাবিল গুরুজী ঝাড়িয়া কাশিলে সে প্রস্থান করিতে পারে। জনার্দন প্রতাপ উদ্বিগ্ন হইয়া অশুভ সংকেত কিনা জানিতে চাহিলেন। গুরুজী চোখ বন্ধ করিয়া গণনাকৃত ফলাফল বর্ণনা করিতে লাগিলেন, – “মানুষের জীবনে কিছু সুকর্ম, কিছু দুষ্কর্ম থাকে। উদিত প্রতাপ এই বয়স পর্যন্ত কোনো সুকর্ম করে নাই, পাহাড় প্রমাণ দুষ্কর্মই করিয়াছে। ফল স্বরূপ এই ধরাধামে উহার জীবন দ্বীপ নিভিবার সময় হইয়া গেছে”। “গুরুজী আপনি কি বলিতেছেন” – বলিয়া মিরা দেবী উচ্চ স্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন। উদিত প্রতাপ ফুৎকারে গুরুজীর ভবিষ্যৎ বাণী উড়াইয়া দিলেন, মনে মনে বলিল – “যতো সব বুজরুকি”। জনার্দন প্রতাপ কিছু একটা বলিতে উদ্যত হইতে ছিলেন। গুরুজী তাহাকে থামাইয়া বলিলেন, “আমি এইখানে কোনো প্রকার ধৃষ্টতা করিতে আসিনাই”। বলার মধ্যে তার গণনা শক্তিই যথেষ্ট প্রকট হইলো। তিনি বলিতে লাগিলেন – “তোমাদের শুনিতে ভালো লাগিবেনা জনিয়াই বলিতেছি। আগামী একশো ঊনসত্তর দিন পূর্ণ হইলে যে অমাবস্যা তিথি পড়িবে, সেই দিন দ্বিপ্রহরে দুইটা একুশ মিনিট গত হইয়া দুইটা বত্রিশ মিনিটের মধ্যে উদিত প্রতাপের মৃত্যু হইবে এবং সেই মৃত্যুর কারণ হইবে একটি সর্প। মিরাদেবী উচ্চস্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন। উদিত এক ঝটকায় উঠিয়া দাঁড়াইল তাহার পর, – “যত সব পাগলের প্রলাপ” বলিয়া স্থান ত্যাগ করিল। জনার্দন প্রতাপ গুরুজীর সন্মুখে নত মস্তকে বলিলেন “পুত্রকে ক্ষমা করিয়া দিবেন, আর একটা কথা বলুন গুরুজী এইরূপ ঘোর সংকট হইতে কি কোনো ভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় ?” গুরুজী জনার্দন প্রতাপকে আশ্বস্ত করিয়া বলিলেন – “সবে মাত্র বিবাহ হওয়া তোমার পুত্র বধূর দিকটি কি আমি চিন্তা করিনাই। কিন্তু বিধাতার লিখন কে খান্ডাইবে বলো। এই একশো ঊনসত্তর দিন প্রতাপের দ্বারা সুকর্ম করাইয়া দেখিতে পারো”।
এক হইতে একশো উনপঞ্চাশ এর দূরত্ব দিনে দিনে কমিতে থাকিল। উদিত প্রতাপের স্ত্রী যেন সহ মরণের পথে আগাইয়া যাইতে লাগিলেন। নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধের মুখে। বুঝাইয়া কিছু তরল খাদ্য খাওয়ানো হইতেছে। দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি ঠাকুর ঘরে কাটান। ঈশ্বর যদি তাহার ললাট লিখন খণ্ডিতে পারেন।
উদিত প্রতাপের মাতা পুত্র শোকে বিহ্বল। তিনি মনে প্রানে গুরুজীর ভবিষ্যৎ বানী বিশ্বাস করেন। সেই মোতাবেক তিনি দুই হস্ত ভরিয়া দান করিতে লাগিলেন। গুরুজীর কথা অনুযায়ি তাহাতে যদি কিছু পাপ খণ্ডায়।
জনার্দন প্রতাপসিংহ রাশ ভারী মানুষ। তাহাকে দেখিয়া কিছুই বুঝিবার উপায় নাই, অন্তর দহনে তিনি শেষ হইয়া যাইতেছেন। স্ত্রীকে দান ধ্যান করিতে বাধা তো দিচ্ছেনই না, বরং তাঁহার এলাকার জনহিতকর কাজ যত শীঘ্র সম্ভব করিয়া দিতেছেন। পাশাপাশি অন্য পণ্ডিত ব্যাক্তিদের সাথে আলোচনা করিতেছেন কিরূপে এইরূপ চরম সংকট হইতে মুক্তি পাওয়া যায়।
গুরুজীর সতর্ক বাণী প্রথম দিকে উদিত প্রতাপ কর্ণ গোচর করেনি। মৃত্যু ভয় বড়ো চরম অনুভূতি, যাহা উদিত প্রতাপ তিলে তিলে অনুধাবন করিতে লাগিল। প্রথমদিকে ফুৎকারে উড়াইয়া দিলেও মৃত্যুর দিনক্ষণ যত আগাইয়া আসিতে লাগিল। উদিত প্রতাপের মৃত্যুভয় ততই বাড়িতে লাগিল। এমতাবস্থায় মৃত্যুভয় মস্তক হইতে নিবারণের নিমিত্তে সুরাই সর্ব সময়ের সঙ্গী হইল।
জনার্দন প্রতাপ সিংহ এই সকল সমস্যা লইয়া অন্য কয়েকজন পন্ডিতের দারোস্ত হইলেন এবং অনেক বিচার বিশ্লেষণ করিয়া তাঁহারা এইরূপ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে – মৃত্যুর চরম মুহূর্ত নির্ধারিত একাদশ মিনিট যদি উদিত প্রতাপ রুদ্ধ দ্বারে থাকিতে পারে, তাহা হইলে উক্ত সময় অতিক্রান্ত হইয়া গেলে মৃত্যু যোগ কাটিয়া যাইতে পারে।
গৃহে ফিরিয়া স্ত্রীর সহিত সবিস্তারে আলোচনা করিলেন।সকলেই পন্ডিতদের সুপরামর্শ শুনিয়া আশার আলো দেখিতে পাইলেন। ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট দিন দ্বারে আসিয়া কড়াঘাত করিল।
পশ্চিম বঙ্গের লোক গাথায় বেহুলা আখ্যানের লখিন্দরের বাসর গৃহের ন্যায় একটি গৃহ নির্বাচন করা হইল। যেখানে একটি কেঁচো আকৃতির সরীসৃপ ও প্রবেশ করিতে পারিবে না, বিষধর সর্প তো অনেক দূরের প্রাণী।
প্রভাত হইলো কিন্তু ভানুর দেখা মিলিল না, মনে হইতে লাগিল গোধূলি বেলা। জনার্দন প্রতাপ সিংহের আলয় আজ যেন মশান ক্ষেত্র। অপরাধীকে যেন আজ বধ্যভূমিতে আনয়ন করা হইয়াছে। চারিদিক নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন একটা হাহাকার অনুভূত হইতে লাগিল। উদিত প্রতাপের স্ত্রী রুদ্ধ দ্বারে দেবালয়েই অধিষ্ঠান করিতেছেন। মীরা দেবীও পুত্র বধূর ন্যায় একই ভাবে দেবালয়ে মস্তক ঠুকিয়া ঈশ্বরের চরণে পড়িয়া রইলেন। নিদ্রা ত্যাগ করিয়া উদিত প্রতাপ আর্শির সম্মুখে দন্ডায়মান হইলেন এবং চমকাইয়া উঠিলেন। মৃত্যু ভয় তাহাকে এমন আবদ্ধ করিয়াছে যে মুখমন্ডলে তাহা পরিস্ফুটিত হইয়াছে। দুই হস্ত মুষ্টি করিয়া চক্ষু রগড়াইয়া ভাবিলেন, গতরাতে দুশ্চিন্তায় ভালো করিয়া নিদ্রা যাইতে পারেন নাই। ফলস্বরূপ হয়তো এইরূপ মনে হইতেছে। শূন্য জঠরে ঢক ঢক করিয়া কয়কে পেয়ালা সূরা ঢালিয়া দিলে জনার্দন প্রতাপ অকস্মাৎ উদিত প্রতাপের কক্ষে প্রবেশ করিলেন এবং তাকে মত্ত অবস্থায় দেখিয়া রাগান্বিত না হইয়া বলিলেন, – “তোমার জন্য একটি সুরক্ষিত কক্ষ নির্বাচন করা হইয়াছে। তুমি সেখানে চলিয়া যাও, মধ্যাহ্ন গরাইয়া অপরাহ্নে পদার্পন করা অবধি তুমি সেখানে অবস্থান করিবে”।
পূর্ণ মধ্যাহ্ন অতিক্রম করিল। সিংহ পরিবারে কালো মেঘের ঘনঘটা। নাওয়া খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া চাতক পাখি যেমন বর্ষার আগমনের অপেক্ষা করে, সেইরূপ সিংহ পরিবার দুইটা বাজিয়া তেত্রিশ মিনিটের অপেক্ষা করিতে লাগিল। সম্পূর্ণ বাড়ি লেঠেল দিয়া ঘিরিয়া রাখা হইলো। রুদ্ধ কক্ষে উদিতপ্রতাপ একাকী অকাল মৃত্যুর অলংঘ নির্দেশের কাল গুনিতে লাগিল। চার দেয়ালের প্রতিটি ক্ষেত্রের উপর তাহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যতই কাল ঘনিয়ে আসিতে লাগিল, উদিত প্রতাপ-এর মৃত্যু ভয় ততই বাড়িতে লাগিল। মস্তিষ্কের সাধারণ জ্ঞান ধীরে ধীরে লোপ পাইতে লাগিল। উদিত প্রতাপের মনে হইতে লাগিল এই বুঝি সর্পের প্রবেশ ঘটিল। সে মৃত্যু ভয়ে উদভ্রান্ত হইয়া পড়িল এবং ঢক ঢক করিয়া কণ্ঠে পেয়ালা দুয়েক সুরা ঢালিয়া লইল। চরম সময় আসিতে আর কিঞ্চিৎ বাকি। নেশার ঘোরে ঢুলু ঢুলু চোখে সে ঘরের ছয়টি তল নিখুঁত ভাবে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অকস্বাৎ তাহার চোখে পড়িল দেয়ালে একটি চিড় ধরা হালকা ফাটল। যেটি একটি সর্পের ন্যায় বক্র রেখায় লম্বা হইয়াছে যে রেখার একটি প্রান্ত ফণা বিশিষ্ট সর্পের মাথার ন্যায় আকার ধারন করিয়াছে। যেইমাত্র উদিতপ্রতাপের ফাটলটিকে সর্প বলিয়া মনে হইলো, তৎক্ষণাৎ সে ফাটলটিকে বিষধর সর্পই দেখিতে লাগিল। শুধুমাত্র দেখিতে লাগিল এমন নয়, তাহার মনে হইতে লাগিল – সর্পটি যেন তাহার পানে হিল হিল করিয়া আগাইয়া আসিতেছে। উদিত প্রতাপ ভয়ে উন্মত্ত হইয়া গৃহমধ্যে এদিক ওদিক করিতে লাগিল। সে ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া দেখিতে পাইলো সর্পের ফণাটি যেন তাহারই মুখমন্ডল। লক লকে জিভ বাহির করিয়া তাহার পানে ধাইয়া আসিতেছে এবং নিজ ভয়কে মনে হইতে লাগিল অসহায় নারী যেন তাহার নিকট সম্মান এবং প্রাণ ভিক্ষা করিতেছে।
এমতবস্থায় জনার্দন প্রতাপের পরিবার রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে উত্তেজনায়, আতঙ্কে দুইটা তেত্রিশ মিনিটের অপেক্ষায় ছটফট করিতে লাগিলেন। কক্ষ মধ্যে উদিতের প্রলাপ হটাৎ স্তব্ধ হইয়া গেল। ততক্ষনে দুইটা বাজিয়া বত্রিশ মিনিট উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সকলে চিৎকার করিয়া কহিলেন – “উদিত দ্বার খোল”! কক্ষ মধ্য হইতে কোনো সাড়া মিলিল না। সবাই উচ্চ স্বরে ডাকিয়া উদিতপ্রতাপকে দ্বার খুলিতে বলিল, তাহাতেও সাড়া মিলিল না। জনার্দন প্রতাপ সিংহ দ্বার ভঙ্গিতে হুকুম করিলেন। দ্বার ভাঙ্গিবার পর কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাওয়া গেলো, উদিত প্রতাপ মেঝেতে চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে। চোখ দুইটি উন্মীলিত যেন ভীষণ ভয় পাইয়াছে এবং দুই ঠোঁটের মিলিত স্থান হইতে রক্ত মিশ্রিত লালা বাহির হইয়া আসিতেছে।
গৃহ মধ্যে উচ্চ স্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন উদিতের মা, স্ত্রী ও অন্য সকলে। পাহারারত পালোয়ানরা কক্ষ এবং তাহার চারিপাশ সর্পের অস্তিত্ব খুঁজিতে ব্যাস্ত হইয়া পড়িল। জনার্দন প্রতাপ অনেক আগেই গৃহ চিকিৎসককে গৃহে আসার জন্য খবর পাঠাইয়াছিলেন। তিনি আসিয়া উদিত প্রতাপের নাড়ি নিরীক্ষণ করিয়া, উন্মীলিত নয়ন যুগল বাম হস্ত দিয়া বন্ধ করিয়া কহিলেন – “সম্ভবত প্রচণ্ড ভয় পাইয়া উহার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে, ময়না তদন্তের পর তাহা পরিষ্কার হইবে”।
–~০০০XX০০০~–