বহুযুগের ওপার হতে
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
কিছু বলব বলে –
এ লেখাটি যে বয়সের তখন উদ্যম ছিল বেশী, আত্মপ্রকাশের ছটফটানিও। একটি সদ্যজাত ছোট পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার জন্য বন্ধুরা অনুরোধ করেছিল। অর্থাভাবে সে পত্রিকা যদিও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। সেও প্রায় পনের ষোল বছর আগেকার কথা। আজকের এই কাঁচাপাকা চুলের বয়সটাতে এসে ওই সময়ের কাঁচামিঠা হাতের লেখাটিকে সকলের সামনে এনে আমার প্রথম অপ্রকাশিত উপন্যাসটিকে তার প্রাপ্য পিতৃপরিচয়টুক অন্তত আজ প্রদান করলাম।
*************
ভূগোলের একটা নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। স্থান কাল পাত্রের স্হিরতা নিয়ে তার হিসেবের নড়চড় হয়না। তবু মানুষ যেখানে কাহিনীর কেন্দ্রে থাকে পটভূমিকা সেখানে অবান্তর না হলেও গৌণ। এই গল্পের ‘গড়শ্রীখন্ডপুর’ ভারতের মানচিত্রে খুঁজলে ঠকতে হবে। কিন্তু মানুষগুলো সব আসল। ওড়িশার প্রান্তিক জনজীবনে তাদের প্রতিনিধিরা আজো আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সভ্যতাদর্পী আলোকবর্তিকার নীচেই।
একরাশ ধূলো উড়িয়ে বাসটা এসে হাটের সামনে থামল। সারা রাস্তার যত শুকনো ধূলো সবই উড়ে এসেছে জানলা দিয়ে। অখয়েরি গুন্ডিপানঅ ‘র মৌতাতে ভিতরটা ম-ম করছে। দুপুরবেলা হলেও অভিমানী নবোঢ়ার মত আকাশের মুখ ভার। ঘোলাটে লাগছে দূরের বাঘামোন্ডা পাহাড় আর স্হানীয় মানুষগুলোর চোখ। শুক্কুরবারের এই হাটটাই সারা সপ্তাহের প্রাণ। হাটটা বসে গড়শ্রীখন্ডপুরের বিখ্যাত শ্রীনাথস্বামীর মন্দিরের হাতায়। অনেকটা জগন্নাথের মন্দিরের মত আকৃতি হলেও আকারে বেশ ছোট। কাছেপিঠের গাঁ গঞ্জ থেকে দেশী মেয়ে মরদের ভীড় নেহাত কম নয়। একদিকে সবজি পাতির ডালা, বাসনকোসন, চালডাল, কোথাও ইয়াব্বড় কলার কাঁদি, ওদিকে হাতির কানের সাইজের পুরি আর চ্যাটচ্যাটে জিলিপি ভাজছে নটবর আর তারই অদূরে মহাপাত্রের কাঁচের চুড়ির দোকান। ওদিকটায় সদ্যযৌবনাদের কলস্বরে হইহই ধ্বনির মিশ্রণ। রাখালের দেশী মুরগি আর ডিমের চালা ছাড়িয়ে এগোতেই মধু’র সাথে দেখা। জন্মের সময় মাথায় চোট পেয়ে একটু জড়ভরতের মতো ও। শিশুর সারল্যে ও দৈনিক দশ টাকায় ছাগল চরিয়ে দিন গুজরান করে। এখানে অনেক মানুষই রোজ ভাত খেতে পায়না। গরমভাতের গন্ধ এখানে বিলাসিতার নামান্তর।
কদিন আগে একটা নেড়ি কুকুর পাগল হয়ে মুন্তার ছেলেকে কামড়ে দিয়েছে। সদর হাসপাতালে ডাক্তার থাকেনা। স্টোরবাবুর বয়ে গেছে এই ছোটলোক গুলোর জন্য সরকারী ওষুধ খরচ করতে।বাইরে এগুলো মোটা দামে কিনে নেবার লোক আছে। কোনওমতে ফাস্ট এইড্ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে সে। ঘা টা পেকেছে ভালোই। রাত্তিরে খিঁচুনি সহ জ্বর আসছে ছেলেটার। মুন্তা মধু’রই দিদি। মধু সর্বদা বাঁশের একটা লাঠি নিয়ে ঘুরছে সেদিন থেকে। যেকোন কুকুর দেখলেই পিঠে ঘা মেরে অস্ফূট স্বরে বিড়বিড় করছে ‘ ষড়া কুকুরঅ…’
এরই মধ্যে একদল হনুমান কোন ফাঁকে এসে তরকারির ডালা লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে আর তাই দেখে হাটের সদাজাগ্রত প্রহরী কুকুর গুলো ভু-উ-উ-ক করে তেড়ে গেছে। মধু’র লাঠির ঘা পড়তেই কেঁউ কেঁউ করে একটা তার মধ্যে ল্যাজ গুটিয়ে পালাল মন্দিরের দিকে।
মধু আবার বলে উঠল ‘ষড়া কুকুরঅ…’।
হাট থেকে ফিরতে বেলা হয়ে গেল। বাংলোর চৌপাইতে গা এলিয়ে ডাবের জল খাচ্ছিলাম। ওদিকে সুভদ্রা রান্নাঘরে ছ্যাঁকছোক শব্দে রান্না চাপিয়েছে। ওর বাপ রামচন্দ্র এখানকার কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান। গত শীতে ওর মা মুখিয়া সাপের কামড়ে মারা গেছে। ঘরে আরো দুটি ছোট ভাই বোন আছে। সবাইকে ওই সামলে রাখে। আমাদের মহান দেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খুব সামান্যই এদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়। দারিদ্র, কুসংস্কার, আর আলো আঁধারী জীবনযাত্রায় এরা যুগের পর যুগ এমনই রয়ে যাবে।
খাবার সাজিয়ে ডাকতে এসে আমার এই অলস শয়ন দেখে সুভদ্রা অবাক হয়। উনুনের তাপে জমা ঘাম ওর নাকের ডগায় জমে আছে ভোরের শিশিরের মত। আমায় এভাবে স্হানুবৎ দেখে লজ্জায় ঘোমটা টেনে ছুট লাগালো।
কূয়োতলার ঠান্ডা জলে ভূত পালায়।তার ওপর একটু হাওয়া ছাড়লেই কলকাত্তাইয়া বাবু কুপোকাত।
সুভদ্রার রাঁধে বেশ। ছিমছাম অড়হর ডাল, আলুশিম্বভাজী আর পারসে মাছ ভাজা। আমার খাওয়া না শেষ হলে ও নড়েনা। ভুক্তাবশেষটুকু আঁচলে বেঁধে ভক্তরাম বেহরার ঘরে দিয়ে আসে। ভক্তরামের ছেলে মহাবীর নাকি গোপনে মাও বাদী রাজনীতি করে। পুলিশ একবার খুঁজতে এসে বৃদ্ধ ভক্তরামকেই উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে থার্ড ডিগ্রী মার দেয়। বিপত্নীক বৃদ্ধ সেই থেকে চলৎশক্তিহীন। রেখাই নদীর তীরের ডাহুক ফরেস্টের শাল মহুলের জঙ্গলেই এদের কথা শুধু ফুকরে ফেরে। সভ্যতাদর্পী ভারতের কাছে এসবের কোনও খবর এসে পৌঁছায় কি?
মহাবীরদের একটা গোপন সংগঠন আছে। গতবছর দেওয়ালীর রাত্তিরে ওরা কজনমিলে চড়াও হয়ে সুদখোর মহাজন নটবর মহান্তির গলাটা রাতের অন্ধকারে ধড় থেকে আলাদা করে দেয়, সিমলিখেড়ার ক্যানেলের পাশের ধানক্ষেতে, মোটরসাইকেল করে যাওয়ার সময়। আজকাল লোকাল পার্টির মাতব্বর হয়ে উঠেছিল নটবর। তারই জোরে ছোট ছোট প্রান্তিক চাষীদের জমি জমা রেখে দাদন দিত। এখানকার নিরক্ষর চাষীরা কোনওদিন সেই দাদন শোধ করে জমি ফেরৎ দিতে পারত না। খরাপ্রবণ এই এলাকায় খারিফ শস্য মাঠেই জ্বলে পুড়ে যায় বেশীর ভাগ বছর। এমনি করে আস্তে আস্তে নটবর অনেককে বাস্তুচ্যূত করেছে। ওর টাকা কখনো ব্যাঙ্কে থাকেনা। গোলাঘরে একটা আদ্যিকালের সিন্দুকে টাকার থোকগুলো থাকে। এরমধ্যে আবার সম্প্রতি সরকারী ঠিকাদারী শুরু করেছিল। এনফিল্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে ভটভট্ করে ঘুরে বেড়াত। মাসদুয়েক আগে মহাবীরদের পাশের বাড়ির একটি আদিবাসী বউকে নটবরের লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে খুন করে ওই ক্যানেলের ধারেই। লোকদেখানো একটা পুলিশী অনুসন্ধানের আড়ালে এতদিন দিব্যি গা বাঁচিয়ে ঘুরছিল নটবর।
মহাবীররা জীবনে ‘ডস্ ক্যাপিটাল ‘ পড়েনি কখনও। কিন্তু অধিকার আর সম্মান বস্তুটা যে জোর করে কেড়ে না নিলে কেউ এমনি দেবেনা, সেটা ওর মত আজ ডাহুক ফরেস্টের প্রতিটা বাসিন্দাই জানে। রঘুনন্দন রাও এর জনমুক্তি মোর্চার সদস্যদের প্রায় সবাই এই প্রান্তিক জনগণের প্রতিনিধি। সরকার, পতাকা, নেতা বদলালেও যারা জানে এই একবিংশ শতাব্দীতেও কিছু মানুষের গরম ভাতের থালা এখনো বিলাসিতার বস্তু। ওই ঘটনার পরে পরে দু কোম্পানি সিআরপিএফ নামে এখানে। ওরা ফেরারী মহাবীরের বাবাকেই ধরে নিয়ে যায় ইচ্ছা করেই। দিনদশেক হল ভক্তরাম প্রায় পঙ্গু হয়ে ফিরেছে। মহাবীরের প্রাণের বন্ধু যুগলের বউ সীতা আর সুভদ্রার সেবায় এখন কোনওমতে সে একটু উঠে দাঁড়াতে পারে।
মহাবীরের সাথে সুভদ্রার আসলে অনেককালের ভাব। ছোটবেলায় রেখাই নদীর বালুময় তীরে পরস্পরকে হলুদ বুনোফুলের মালা পড়িয়ে যে খেলাচ্ছলে ওরা নিজেদের আঁকড়ে ধরেছিল, আজও যৌবনগন্ধী চৈত্রপবনে কালো পাথরের মত মহাবীরের দৃঢ় বুকে মাথা রাখলে সেই ধুকপুকানিটুকু সুভদ্রার জন্য তোলা আছে অপরিবর্তনীয় হয়েই। উপবাস, ক্ষুধার কষ্টসাধ্য বেঁচে থাকার প্রতিবর্তে এরা সাবলীল ছন্দে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার মন্ত্রটা এখনো ভোলেনি।
গতরাতের আকাশটা রূপোলী মলমলে জ্যোৎস্না মেখে অভিসারিকার আঁচল হয়ে আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। কেঁদ, বহেড়া আর ইউক্যালিপটাসের মাথার উপর দিয়ে রাতচড়া পাখিগুলো টি টি টি করে উড়ে যাচ্ছিল। ওই ঘোলাটে অন্ধকারের একটা বন্ধন আছে। নির্লিপ্তির সাথেই একটা নিশিবাসর যেন। রেখাই নদীতে জল কমে গেছে। সাদা চর বিধবার সিঁথির মত বিস্তৃত হয়ে আছে যেন আদিগন্ত জুড়ে। নদীর ধার থেকে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে এসে বাংলোর হাতায় আমার চৌপাইটাতে খোলা আকাশের নীচে চাঁদের আলোয় শহুরে মনটাকে ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। কয়েকটা কুকুর ছানা জন্মেছে আশে পাশে। সেগুলোর কুঁইকুঁই ডাক কানে আসছিল। আজ সুভদ্রার এবেলা ছুটি। দুপুরের ক’টা পরোটা আর বেগুন পোড়া কাঁচা পেয়াজ, তেল আর লংকা দিয়ে মেখে রাখা আছে। ওতেই হয়ে যাবে। চান্দু গাহকের গান কানে আসছিল দূর থেকে।কখন যে দুচোখ বুজে এসেছে টের পাইনি।
পরের দিন থেকে বেশ জ্বর। চরণ কিছু আনাজপাতি রেখে গেছে। দাম নেয়নি অবশ্য। এই বন পাহাড়ের দেশে ভালবাসা কিনতে পাওয়া যায়না। শুধু একাত্ম হয়ে মিশলেই তা হৃদয় ভরে অপর্যাপ্ত পাওয়া যায়। সুভদ্রা বেশ ব্যস্ত পথ্য বানানোয়। গম্ভীর মুখে আদা দেওয়া চা দু দফায় খাইয়ে গেছে আর সঙ্গে মধু আর মিছরীর টোটকা।
(এরপর… ক্রমশ…)