আরো একটু বসো!
✍ কর্ণ শীল
আরও একশো বছর পরে, যখন সূর্য ওঠা বড় বড় বাড়িতে ঢেকে রইবে, আমাকে একদিনের জন্য পাখিরালয়ের গাইড করে দিও রাজা। ভয় নেই, থেকে যাওয়ার বায়না করবো না। তবে ওই অনেক জানা, চশমাগম্ভীর গাইড নয়। ফুলো ফুলো গাল যে ছেলেটা বই লুকিয়ে খেলতে যায় আর, ঘুম লুকিয়ে আনন্দমেলা পড়ে রোদের ছাপে, তার মতো কোরো।
ভোর ভোর দেখে ট্যুরিস্টের দল টুপি, বাইনোকুলার, ক্যামেরা নিয়ে রেলস্টেশনে নেমে দেখতে পাবে গাইড আসছে। হাফ প্যান্ট আর খদ্দরের সবজে চাদর পরে।চাদরটা ঘাড়ের পিছনে গিঁট দিয়ে বাঁধা। মুখ দিয়ে তার ভকভক করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসবে আর খেজুরের কাঁচা রসের গন্ধ। গাইড হঠাৎ করে পথ ভুলে ট্যুরিস্টদের নিয়ে যাবে ভুলাইদীঘির মাঠে। বাবলাগাছের মাথায় বক আর কুয়াশা জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকার গল্প শোনাবে তাদের, চারতলা রিসর্টের সামনে দাঁড়িয়ে।
তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই বড় লাল টিপ পরা কেউ থাকবেনই। লাল খোলের কালো পাড় দেওয়া শাড়ি। সিন্থেটিক লেদারের ব্যাগটি খাকি ম্যাট ফিনিশ।তার গায়ে কালো রেখায় রবীন্দ্রনাথ বা ভীষ্মলোচন শর্মা আঁকা থাকবেন। তিনি গাইডকে বলবেন, “তুমি বাপু হয় পলাশবনির গল্প কও, নয় কও স্যাটেলাইট ফোন পাবো কিনা রিসর্টের ঘরে। এই ছদ্মবেশী আধাআধি ভালো লাগেনা। ”
গাইড তখন তাঁর হাতটি ধরে কুয়াশা আর ইঁটের দেওয়াল পার করে ভোরদুপুরের মাঝামাঝি নিয়ে আসবে। ছেলেরা সেখানে মাঠ পেতেছে প্লাস্টিক ঘাসের। চারিদিক ঘেরা কংক্রীটের দেওয়ালে ছুঁচলো দাড়ি লুঙ্গি পরা লোকটা গ্রাফিক্সে একমনে এঁকে চলেছে ভুবনডাঙ্গার মাঠ আর পদ্মানদীর একলা বোট। চুল উড়ে এসে পড়বে লাল টিপের আঙিনায়। তিনি ছোট্ট গাইডের চাদরের খুঁট ধরে বলবেন, “ওগো, এও তো সেই মাঝামাঝিইই হলো। তোমার কি একটি শুধু, একটি মাত্র কিছু নেই? ”
গাইডের তো ছিল অনেককিছুই একটি মাত্র, একটি শুধু।
তার ডাকঘরের মরচে ধরা বাক্স ভেঙে কারা যেন আধা তলোয়ার বানিয়েছিল, আর তার ধারালো দিকটি সাজিয়েছিল মুগ্ধ পায়রার পালক দিয়ে। যা বনে ছিল খাঁচায় এলো, যা খাঁচায় ছিল মরচে ধরা লোহায় ডানা ঝাপটে মরলো, আর যা ছিল খাঁচা আর বনের মাঝে তা আকাশ ঢেকে চিলেকোঠা হয়ে বসলো। এখন সেখানে মেঘ হটিয়ে ধোঁয়ারা ঠোক্কর খায়।অপাত্রে ঢালা বুনো মধু খেয়ে যায় অজান্তা পিঁপড়ে। ভুলাইদীঘির কুয়াশার দেওয়ালের এপাড়ে অপেক্ষা বসে থাকে বৈতরণী আর মন্দাকিনীতে গোল পাকিয়ে।
রাজারও বোধহয় আর চেয়ে দেখা হয়না তার চোখের জলের দিকে।সে তো আর সাত বাতাসের ঘর পেরিয়ে শিশির হয়না। চিমনির মাথায় শকুন্তলা আংটির ঝুটো মুক্তো সেজে আরও আরও বেশি করে বিস্মরণের পথিকৃৎ হয় সে।
রাজা, তুমি বরং আমাকে একটা ‘আপনি বাজা ঘন্টা’ দিও। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার গাইড যখন লাল টিপটিকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাবে এ পাড়ের রিসর্টের সামনে, আর একরাশ ধুলো উড়িয়ে মোটরগাড়িটি চলে যাবে নির্ভুল পাখিদের জাদুঘরে, তুমি আমার ঘন্টাটিকে বাজতে দিও।
রোদ চড়া হয়ে উঠলে আমার ওই চাদরটি খুলে ফেলতে হয়। ঘাম বসে আমার সর্দি হয় খুব। তোমার দেওয়া ঘন্টা বাজলে কুয়াশার ওপারের রোদে আমি আবার বাড়ি যাবো। বাঁশের বেড়া। আম কাঠের চৌকাঠ। গুলের উনুনে কড়াই বসিয়ে কে যেন চলে গেছে রোগা ছেলের বুকে তেল মালিশ করে দিতে।
এই সময়টা ঘন্টা বাজিওনা যেন !
একমুঠো চিংড়িভাজা নিয়ে আমি ছুট্টে দীপককাকার মাঠে চলে যাই, তারপর ঘন্টা বাজিয়ে দিও।
উনুনের পাশে পড়ে থাকা চাদরটির গায়ে যদি ছোট্ট চাঁপার কলির ছায়াটি ফেলে এসে থাকি তো, থাক। সে ছায়াচাঁপা তার হোক। তাকে কোলে করে রোগা ছেলেকে সে গল্প পড়ে শোনাক,
“সেই আমি আসিয়াছি ছাড়ি সব লাজ
তোরে দিতে আপনার পরিচয় আজ। ”
আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করো রাজা, আমার গাইড ছাড়া কি হওয়ার মন করে, আমি বলবো, “বলবো না সে কথা। ”
–~০০০XX০০০~–