উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ ( শেষ পর্ব )
✍ কাকলি ঘোষ
পৌঁছে গেছি উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের একেবারে শেষ পর্যায়ে। গতকাল বক্সা, জয়ন্তী দেখা শেষ। এবার বাকি কোচবিহার। তার আগে বাদল বীনা রিসর্টের কর্ণধার রানা বোস জানালেন এত কাছে এসে ভুটানের ফুন্ট শোলিং না দেখে যাওয়া নিতান্তই অর্বাচীনের কাজ হবে। সুতরাং ঠিক হলো সকালে চিলাপাতা হয়ে সোজা ফুন্ট শোলিং । ফিরে এসে লাঞ্চ। তারপর দ্বিতীয়ার্ধে কোচবিহার দর্শন।
সেই মত সকালে রেখা দির হাতের পুরী, চমৎকার আলুর সবজি, ডিম সেদ্ধ আর মিষ্টি পেটে বোঝাই করে উঠে বসলাম গাড়িতে।
চিলাপাতার সবুজ জঙ্গল দু পাশে রেখে গাড়ি ছুটে চলল। কিছুদূর গিয়েই বিপত্তি। রাস্তার ওপর গাছ ভেঙ্গে, ঘর দোর চুরমার হয়ে পড়ে আছে। পথ বন্ধ। জমায়েত হওয়া স্থানীয় মানুষ জানালেন গতকাল রাতে হাতির উপদ্রব হয়েছিল। ভাবছি ফিরে যেতে হয় বুঝি! আর বোধ হয় হল না বাকি টুকু দেখা।
না। ড্রাইভার পরান ভাই বাহাদুর। ঠিক গলি ঘুজি দিয়ে ঘুরিয়ে গাড়ি নিয়ে এসে তুলল মেন রাস্তায়। আর তারপর শুধুই চলা।
ভুটানের ফুন্ট শোলিং অতি পরিচ্ছন্ন সুন্দর শহর। রাস্তা ঘাটে এতটুকু আবর্জনা, প্লাস্টিক পড়ে থাকতে দেখা যায় না। সব চেয়ে মজার কথা এখানে গাড়ির হর্ন দেয়া নিষিদ্ধ। ভাবা যায়!! আশ্চর্য নিঃশব্দে ছুটে চলেছে সব গাড়ি। ফুটপাথ ধরে পথচারী। কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই! ভুটানি পুরুষ মহিলারা যে যার আপন আপন কাজে চলেছেন। কর্তব্য রত পুলিশ। রাস্তার ধারে ধারে দোকান। সকাল বেলার কর্ম মুখরিত ভুটান ।
গাড়ি এসে থামলো গুমফার কাছে। পাহাড়ের কোলে চমৎকার একটি ছোট্ট উপত্যকায় নিভৃতে অতি মনোহর এক বৌদ্ধ গুহা। বৌদ্ধ স্থাপত্যের এক চমৎকার নমুনা। ভিতরে ধ্যান গম্ভীর গৌতম বুদ্ধের শান্ত স্থির মুখশ্রী মনে শুধু ভক্তি নয় এক আশ্চর্য শান্তি এনে দেয়।এক আবেশে ভরে ওঠে দেহ , মন। ফিরে আসার সময় ও বার বার চোখ ছুয়ে যেতে চায় ওই নিভৃত স্থানটি। মনে হয় যেন এক টুকরো শান্তি বুকে করে কুড়িয়ে আনাগেল।
ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে দুপুর। এদিকে আবার কোচবিহার যাবার তাড়া। কোন রকমে লাঞ্চ শেষ করে ছুটলাম রাজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।
১৮৮৭ সালে কোচ রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন এই রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন। ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের অনুকরণে তৈরী এই প্রাসাদ অতুলনীয় সুন্দর!! সামনের সবুজ লন , রং বেরঙের ফুল , ঝাউ, দেবদারু, ইউক্যালিপটাস, গাছের সজ্জা ! আর সবার ওপরে অপূর্ব বর্ণ সুষমায় সজ্জিত প্রাসাদ পর্যটকদের মন এক অসামান্য ভালো লাগায় ভরে তোলে। রাজ পরিবারের ব্যবহৃত জিনিস, পোশাক, অস্ত্র শস্ত্র, ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে মন চলে যায় সেই সুদূর অতীতে। ফেলে আসা পুরাতন ঐতিহ্যে।
কোচ রাজাদের প্রতিষ্ঠা করা মদন মোহন মন্দির ও কোচবিহারের আর এক দ্রষ্টব্য । ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন এই মন্দির সম্পুর্ণ সাদা পাথরে তৈরী। সোনার তৈরি মদন মোহন , হাতে সোনার বাঁশি রুপোর ছত্রে র নিচে রুপোর সিংহাসনে দন্ডায়মান। মদন মোহন এখানে রাধা বিহীন। দু চোখ ভরে দেখলাম সোনার মদন মোহন। বাড়তি লাভ হল সন্ধ্যা আরতি দেখার সুযোগ পাওয়া। অসাধারণ সে আরতি! অবিস্মরণীয় সে মুহুর্ত!
এখানেই আলাপ হল দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের সাথে। তাদের কাছে শোনা গেলো মন্দিরের ইতিহাস। কোচবিহারের অতীত এবং বর্তমানের কিছু কথা। টোটো দের জীবন যাত্রা। এরাই জানালেন এই মদন মোহন মুর্তি আসল অর্থাৎ রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেই বিগ্রহ নয়। সেটি চুরি গেছে। বর্তমান মুর্তি ভুটানের রাজা কর্তৃক প্রদত্ত। তবে এখন মন্দিরে কড়া পাহারা।
বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম।
মন আজ কানায় কানায় পূর্ণ। যা চেয়েছি তার অনেক বেশি পেয়েছি। যেটুকু পেলাম না তা না পাওয়াই থাক।
মন প্রাণ ভরপুর করে বাঁচার রসদ নিয়ে ফিরব কাল। শুধু স্মৃতিতে রয়ে যাবে এই সময় টুকু, এই মানুষ জন, এই প্রকৃতি ।
–~০০০XX০০০~–