অনুত্তমা
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
দ্বিপ্রহর হইতে প্রবল বর্ষণে বেত্রবতী তীরস্হ প্রাচীন জনপদটি এক্ষণে প্রায় জলমগ্ন। দূরদূরান্ত হইতে ভেকের কলস্বরের শব্দ ক্রমাণ্বয়ে বারিধারার সহিত উচ্চরোলে বাজিতেছে। পথঘাট জনশূন্য। নিশিবাসরের রসিকগণ আজ অনুপস্থিত। পল্লীর স্কন্ধাবারে দীপ সকল ক্রমে স্তিমিত হইয়া আসিতেছে। নৃত্যপটিয়সীনী মালবিকা আর তাহার সখীবৃন্দ তা লইয়া বড়ই চিন্তামগ্ন হইয়া শূন্য গৃহে বসিয়া হা হুতাশ করিতেছে। শৌন্ডিকালয়গুলিও বন্ধ হইবার উপক্রম। আজ আর তাহাদের বিপণিতেও ক্রেতাণণ আসিবে না। শীধু ও মাধ্বী এই অঞ্চলের উত্তেজক পানীয়ের মধ্যে প্রসিদ্ধ। গুপ্ত উপায়ে প্রস্তুত এই বস্তুটিতে কোহল সংযোগ করিলে তাহা দেবভোগ্য সোমরসের তূল্য হইয়া পড়ে। নগরবিলাসীনীগণ ইহা সর্বদাই পান করিয়া ঢলোঢলো আবেশে প্রণয় পরিবেশন করিয়া থাকে। কর্পূর ও সুগন্ধী মশলা সমণ্বিত তাম্বুলে তাহাদের রক্তিম অধরোষ্ঠ ও সর্পিণীর ন্যায় লাস্যময় ভঙ্গিমা ‘অরসিকে’ষু দিগকেও মদনউৎসবের হোমানলে আহুতি প্রদান করিয়া থাকে।
**********
ঈষৎ পৃথুলা হইলেও মালবিকা রাজনর্তকী। চক্ষের ইশারায় সে তাহার সখী অপালাকে বলিয়া ওঠে-
“দেখলি সই! আজ বোধহয় স্বর্গপুরীতে বরুণদেবতা আর রতিকান্তের মধ্যে ঝগড়া হয়েচে। তাই সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে!”
সান্ধ্যকালীন সাজ খুলিতে খুলিতে তাহার কন্ঠে উষ্মা প্রকাশ পাইল। অপালা কটাক্ষ করিয়া কহিল- ” আজ এই প্রলয়ে কে আর আসবে বল সই! বরুণদেবতা মদনানলে জল ঢেলে দিয়েচে যে!”
তাহাদের মধ্যে অনুত্তমা বলিয়া এক সদ্যস্ফূটিতা নবাগতা আসিয়াছে। এই বনিতাপল্লীতে তাহার জড়তা এখনো কাটে নাই। উহাদের চটুল হাস্য ও পরিহাসে সে ভীতা হরিণীর ন্যায় বসিয়া থাকিলেও মনে মনে খুশি হইয়াছে। অন্তত একটি রাত্রি তাহাকে ছদ্মপ্রণয়ের অভিনয়ে করিতে হইবেনা।
সে এই নাগরিকার জীবনে সন্তুষ্ট নহে। অরালি পর্বতের পাদদেশে তাহাদের গ্রামখানির কথা সে ভুলিতে পারে নাই ।
রোহিত নদীর মায়াময় রূপরেখা তাহাদের গ্রামটির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করিয়াছে। কিছুমাস পূর্বে শোণ নদীর অপরপ্রান্ত হইতে মগধের সৈন্য আসিয়া কোশলরাজ্য আক্রমণ করিয়া তাহাদের গ্রামটি ছারখার করিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে। কোশলের অধিপতি মহারাজ বিশাখদেব যুদ্ধকর্মে অপটু হইবার কারণেই এই দূরবস্থা।
*********
বিজিত সৈন্যদলের এক পরাক্রমী সেনানায়ক তাহাকে গ্রাম হইতে বর্বরের ন্যায় লুন্ঠন করিয়া আনয়ন করিয়াছিল। অনুত্তমার সদ্য জাগৃত যৌবনশ্রীকে সে হিংস্র পশুর ন্যায় ভক্ষণ করিয়া বর্তমানে এই পল্লীতে একশত নিষ্কের বিনিময়ে মালবিকার নিকটে বিক্রয় করিয়া চলিয়া গিয়াছে। বর্তমানে মালবিকার সখীবৃন্দের মধ্যে সে সর্বকনিষ্ঠা। অপালা ও যাজ্ঞসেনীর নিকট সে এখন চৌষট্টিকলার শিক্ষালাভ করিতেছে। তাহার মায়াময় মুখশ্রীটি দেখিলে মায়া জন্মায়। মালবিকা তাহাকে ছদ্মকোপানলের আধারে কনিষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় একটু বেশী স্নেহ করিয়া থাকে।
অনুত্তমা তাহার পিতা মাতা ও ছোট ছোট ভ্রাতাদের কত দিন হইয়া গেল চক্ষে দেখে নাই। তাহারা বাঁচিয়া আছে কিনা তাহাই বা কে বলিতে পারে? মগধের নৃপতি মহীপাল যুদ্ধোন্মাদ। সমস্ত আর্যাবর্তকে সে তাহার পদতলে আনিয়া শাসন করিতে উন্মুখ। কোশলের ন্যায় অকিঞ্চিৎ জনপদের তাহার বশ্যতা স্বীকার না করিয়া থাকিবার উপায় নাই।
**********
বিশাখদেবের আমলে গান্ধার প্রদেশ হইতে এক ভাস্কর আসিয়া কিছুদিন তাহাদের গ্রামে আসিয়া বাস করিত। তাহার নাম দেববর্মা। রোহিত নদীতে জল আনিতে যাইবার সময় সে তাহার শিল্পকীর্তি নির্মাণ মুগ্ধ হইয়া দেখিত। শিল্পীটির দেহসৌন্দর্য স্বর্গের দেবতাদের ন্যায় বলিষ্ঠ ও সুকুমার। তাহাদের পরিচয় হইতে বিলম্ব হয় নাই। দেববর্মা ভগবন্ বুদ্ধের বিভিন্ন মূর্তি তৈয়ারী করিত। সে কহিত যখনই কোন নূতন শিল্প সৃষ্টি করিতে বসে তখনই তথাগতের দিব্য আনন ভিন্ন সে কিছুই গড়িতে সক্ষম হয়না। তাঁহার শান্ত অর্ধনীমিলিত নয়নদ্বয় দেববর্মাকে আবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছে।
ইহা শুনিয়া অনুত্তমা তাহার নাসা স্ফূরিত করিয়া একদিন কহিয়াছিল – ” আমাকে এত কাছে দেখেও কি তোমার মূর্তি গড়তে ইচ্ছে করেনা দেববর্মা?” দেববর্মা সপ্রেমে সেইদিন তাহাকে কাছে টানিয়া আনিয়া অনুত্তমার ষোড়শী প্রেমের যাদুতে আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। তাহার পর এক প্রভাতকালে গুহাগাত্রে একটি মনোরম নারীমূর্তি নির্মাণ করিয়া দেববর্মা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইয়া যায়। মূর্তিটি অনুত্তমার। তাহার মনোবাসনাটি পূর্ণ করিয়াই কেন যে সে অন্তর্ধান করিল তাহার কোনও উত্তর অনুত্তমার জানিবার অবকাশ হয় নাই। কিন্তু দেববর্মার এই নিষ্ঠুর আচরণে অনুত্তমা কষ্ট পাইয়াছিল ভীষণ। প্রতিটি রাত্রি দয়িতের জন্য সে তাহার কিশোরী হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া দুটি চোখের জল ফেলিত।
*********
রোহিত নদীর যে প্রান্তে দেববর্মা কুটির নির্মাণ করিয়া থাকিত সেইখানেই এক পর্বতগুহার ভিতরে অনুত্তমার মূর্তিটি সে ভালোবেসে গড়িয়াছিল।
তাহার পর হইতে পারতপক্ষে অনুত্তমা সেই স্থানে ভুলেও যাইত না। অবশ্য এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই তাহার সদ্য কৈশোরোর্ত্তীণা সুকোমল জীবনটিও মগধের সৈন্য দ্বারা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল।
*********
গভীর রাত্রিতে এক মনুষ্য কন্ঠস্বর শুনিয়া নিজের কক্ষে অনুত্তমা উৎকর্ণ হইল। বৃষ্টি থামিলেও তাহার দূর্যোগের প্রকোপ বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় নাই। শব্দটি যন্ত্রণাকাতর কোনও এক অসহায়ের গোঙানির মত তাহার কানে আসিয়া বাজিল। শয্যা ত্যাগ করিয়া চুপিচুপি প্রদীপটিকে তাহার নীলাম্বরীর আঁচলের আড়াল করিয়া গৃহ হইতে সে বাহিরে আসিল। মনুষ্যস্বরটি ক্রমে ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে। সে শব্দটিকে লক্ষ্য করিয়া কিছুদূর যাইতেই শব্দের উৎসটিকেও দেখিতে পাইল। এক শ্রমণ কর্দমাক্ত অবস্থায় পথে পড়িয়া আছে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট স্বরটি তাহারই কন্ঠ হইতে নির্গত হইতেছে। কোনওমতে শ্রমণটিকে ধরিয়া সে গৃহাভ্যন্তরে লইয়া আসিল। অনুত্তমা বুঝিল বর্ষার অন্ধকারে পথে চলিতে চলিতে হঠাৎ শ্রমণটিকে সর্পাঘাত করিয়াছে। বিষের জ্বালায় তাহারই কন্ঠ হইতে এই ক্লিষ্ট স্বরটি ম্রিয়মাণ হইয়া প্রকাশ পাইতেছিল।দ্বিরুক্তি না করিয়া অনুত্তমা প্রদীপটি তুলিয়া সে ক্ষতস্থানটিকে নির্ণয় করিয়া তাহার পরণের কাপড় দু ভাগ করিয়া শক্ত বাঁধন দিল ঠিকই কিন্তু ততোক্ষণে শ্রমণটি বিষক্রিয়ায় প্রায় অর্ধচেতন হইয়া পড়িয়াছে।
সে একবার ভাবিল পল্লীর অপর সঙ্গিনীদ্বয়ের মধ্যে অপালা বা রঙ্গিনীকে একবারডাকিয়া আনে, কিন্তু পরক্ষণেই সে নিবৃত্ত হইল। তাহার সংগ্রহ হইতে পরম স্নেহে সে একটি পাত্রে করিয়া মধু ও উষ্ণ দুগ্ধ মিশাইয়া শ্রমণটিকেপান করাইতে গিয়া অনুত্তমা চমকিয়া উঠিল।
*********
এই শ্রমণ আর কেহ নহে এ যে তাহার দয়িত দেববর্মা! বুদ্ধের বাণী প্রচার করিবার জন্য সেদিন অনুত্তমার মূর্তিটি গড়িয়া রাখিয়া এক অন্য মহাআদর্শের আলোকবর্তিকাকে সম্বল করিয়া সে মোহ-সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া যায় তাহা এতদিনে সে বুঝিতে পারিল। পরিবর্তে
অনুত্তমার প্রতি তাহার ঐহিক প্রণয়টিকে সে প্রস্তরগাত্রে অঙ্কিত করিয়া চিরকালের জন্য অমর করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। যুবক ভাস্কর দেববর্মা জাগতিক বন্ধনকে বিদ্রুপ করিয়া এক অন্য বৃহত্তর জীবনের পথে পা বাড়াইয়াছিল ঠিকই কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাহাদের প্রণয়কুসুমের ছিন্ন মাল্যটি তাহাকে অন্তিম সময়ে আবার অনুত্তমার নিকটেই আনিয়া দিয়াছে। অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে সে দেববর্মাকে তাহার দুটি হাতে সজোরে জড়াইয়া থাকে।
***********
ঊষাকালের সামান্য পূর্বে অনুত্তমা টের পাইল তাহার বাহুমধ্যে দেববর্মা নিস্পন্দ নিথর হইয়া ঘুমাইতেছে। তাহার সুকুমার আননে মায়াময় চক্ষুদুটি আজ চিরদিনের সুপ্তিতে অর্ধনীমিলিত। দেববর্মার নির্মিত ভগবন্ মহাকারুণিক তথাগতের ধ্যানমূর্তির আয়ত চক্ষুদ্বয়ের মতই তাহা অনন্ত প্রশান্তিতে আজ উদ্ভাসিত।
–~০০০XX০০০~–
Thanks ☺️