হৃদয় দূরগামী
✍ হৈমন্তী ভট্টাচার্য্য
“জন্ম মৃত্যু বিয়ে এ তিন বিধাতা নিয়ে”, নেহাৎ কথার কথা নয়, অন্তত গড়িয়া মহামায়াতলার মধ্যবয়স্ক দম্পতি নবেন্দু আর শোভনার পুত্রলাভ কিছুটা সেরকমই ব্যাপার। প্রায় ছেচল্লিশ ছুঁই ছুঁই শোভনা যখন বুঝলেন যে তার তিন চার মাসের ঋতু বিরতিটা রজোনিবৃত্তি জনিত নয়, হেমন্তের রাতের ‘একটু অসাবধানতা’র ফল, তখন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। মেয়ে মিতালী কলেজে ভর্তি হয়েছে সবে। ছুটতে হল ডাক্তারের কাছে।
দামি রিমলেস চশমার ওপর দিয়ে হাসি মাখানো চোখে ডাক্তার সটান জানিয়ে দিলেন,”বড্ড দেরী করে ফেলেছেন আপনারা। প্রায় পাঁচ মাস । এখন আর এবর্শন সম্ভব নয়..”
পক্ককেশ দিয়ে ঘেরা ইন্দ্রলুপ্তময় মাথায় আর কুঞ্চিত চামড়ায় বাবা হওয়া যে কী বিড়ম্বনার, কত যে হাসির পাত্র হতে হবে, সেটা ভেবে নবেন্দুবাবুর রাতের ঘুম ছুটে গেল। মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারলেন না। শোভনাও মুখ চুন করে ডিম ভরা কই মাছের মত ঢাউস পেটের লজ্জা ঢাকার জন্য বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিলেন। এমনিতেও হাই রিস্ক প্রেগনেন্সি, সারাদিন বিছানায় । নিজেদের ভুল আর ভাগ্যের দোষ , শোভনা গভীর রাতে কেঁদে কেঁদে তার সিংহাসনের গোপালকে বললেন, “এই বয়সে নাক না কাটলে হচ্ছিল না তোমার, কদিন পর জামাই আসবে, ছি ছি, মরণ হোক আমার।”
গোপাল বোধহয় ওই সময় টুথপিক দিয়ে কানের খোল পরিষ্কার করছিলেন, কী ভাবে যেন শোভনার কথা গুলো সোজা তার কানে গিয়ে সেঁধিয়ে গেল। সরকারি হাসপাতালকে ভরসা করতে না পেরে প্রাইভেট নার্সিং হোমে প্রায় এক লাখ বিল বানিয়েও শেষ রক্ষা হল না। দুদিনের পুত্রসন্তান, অফিসে কলমঘষা জল গড়িয়ে খেতে না জানা স্বামী আর ছেঁড়াখোঁড়া তাপ্পিদেওয়া মধ্যবিত্ত গেরস্থালির গুরুভার অষ্টাদশী কন্যা মিতালীর ঘাড়ে ফেলে তিনি অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের কারণে তার গোপালের দেশে পা বাড়ালেন।
বাড়িতে যখন কান্নার রোল , নবেন্দু এক মুখ দাড়ি আর রক্তজবার মত চোখ নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, তখন দোলায় ঘুমিয়ে থাকা চারদিনের শিশুর দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে তার বড় শ্যালিকা নবীনা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, “এই অলুক্ষনে ছেলেই খেল মা টাকে”, সর্বেন্দুর বৌদি তাড়াতাড়ি ছেলেকে বুকে তুলে নিয়ে বলল, “ও কী কথা হ্যাঁ? বংশধর এসেছে। নিজে ছেলে বিয়োতে পারোনি বলে খুব জ্বালা , তাই না? মিতু আর এবাড়িতে কদিন? ভাগ্যিস ছেলে হয়েছে।”
এ সমস্ত কথাবার্তা ঘরের একদিকে হাঁটুতে মুখ রেখে নিশ্চল হয়ে বসে থাকা মিতালীর অসহ্য বোধ হল। কলেজের বন্ধুদের সে এসব কিছুই এখনো বলতে পারেনি, কিছুটা হয়ত লজ্জাতেই। এবার তো বলতেই হবে। সে বিয়ে হয়ে চলে যাবে, আর দোলনায় দুলতে থাকা তার হাতের তালুর মাপের অপুষ্ট মানবকটি শুধু প্রলম্বিত লিঙ্গের অধিকারে এ বাড়ির কর্তা হয়ে বসবে, এত দূর ভাবার মত মনের অবস্থা তার নয়। একটু আগে রান্না ঘরে চা করতে গিয়ে সে কিছুতেই সাঁড়াশি খুঁজে পাচ্ছিল না। কৌটো বাসন পত্র সব কিছুতে মায়ের স্পর্শ লেগে আছে। খুব কান্না পাচ্ছিল। মা যে কেন এমন করল! এভাবে একটা মস্ত সমস্যার মধ্যে তাকে একা ফেলে রেখে চলে গেল! অথচ এই কদিন আগে অবধি মা তাকে পাড়ায় কোচিং ক্লাসে অবধি একা ছাড়েনি। আগলে বড় করেছে ছোট থেকে। নীরবে একটার পর একটা বড় বড় অশ্রু বিন্দু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
শোকের তীব্রতা সময়ের সাথে কমে যেতে লাগল। একটার পর একটা জায়গায় অসুবিধা ঠেকতে লাগল। ছেলে সারাদিন ঘুমায়, আর আয়া বসে বসে ঢোলে, বিশেষ কাজ নেই। আর রাতে যখন সে জাগে আর না না অজ্ঞাত অসুবিধায় চিল চিৎকার করে তখন অফিস আর কলেজ করে ক্লান্ত নবেন্দু আর মিতালী একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে কী করবে ভেবে পায় না। দিনের আয়া রাখতেই হবে, রাতেও রাখার মত টাকা নবেন্দুর অল্প রোজগারে কুলোবে না। একদিন গরম জলে দুধ গুলে খাইয়ে শোয়ানোর পরই ছেলের নাক মুখ দিয়ে ছিটকে ছিটকে বমি শুরু হল। ভয়ে বড় শ্যালিকাকে ফোন করলে তিনি উৎকন্ঠার সাথে বললেন, “আহ! দুধ গিলিয়েই চিৎ করে শুইয়ে দিয়েছ মনে হয়। পিঠে চাপড় মারবে, অন্তত দশ মিনিট ধরে ঢেকুর তোলাবে, ওর পেট ব্যথা হয় বলে অত কাঁদে।”
যতজন শিশুকে দেখতে এল প্রত্যেকে নানা রকম ছোটখাটো জ্ঞান দিয়ে গেল। ভাটপাড়ার মামী যদি বলেন, “এমা, কাজল টিপ নেই কেন পায়ের নিচে?” তো জামসেদপুরের কাকিমা বললেন, “তেমন গ্রোথ হয়নি”
“আহা মা নেই, কে যত্ন করবে!” আগে পরে চুক চুক আওয়াজ সহযোগে এসব শুনে মিতালীর নিজেকে বড্ড দোষী মনে হয়। মনে হয় সেই হয়ত ঠিকমত কর্তব্য করতে পারছে না।
মিতালীর কলেজ দিনের পর দিন কামাই হতে লাগল। ক্লান্ত দেহমনকে এক জায়গায় এনে তার পড়তে বসতেও ইচ্ছে করে না তেমন। নবেন্দুর বেসরকারি সদাগরী অফিসে কাজে ভুল হওয়ায় অপমানিত হতে হল বার বার। এরকম ভাবে চলতে চলতে শোভনার মৃত্যুর একবছরের কাজ এসে গেল। ছোট্ট শ্যামল এক বছরে পড়ল। এখন তার মাথার ঠিক মাঝখানের নরম জায়গাটা শক্ত, সমু বলে ডাকলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁচের মত স্বচ্ছ চোখে তাকিয়ে চারটে দাঁত দেখিয়ে দেয়, অল্প অল্প করে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করে।
মিতালী এই এক বছরে খানিকটা পাকাপোক্ত হয়েছে কাজে কর্মে, এখন আর সে ভুল করে মাছ না ধুয়েই নুন হলুদ মাখিয়ে তেলে দেয় না, ডিম না চিরে তেলে দিয়ে হাতে ফোস্কার বুদবুদ তৈরি করে ফেলে না, ঢেঁড়স কাটার আগেই ধুয়ে নেয়, নুন মিষ্টি চোদ্দবার চেখে না দেখেই ঠিক ঠাক দিয়ে ফেলে। তবে কলেজ পড়াশোনা এগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকল আগের মতই। বন্ধুরা প্রথম দিকে সাহায্য করলেও ক্রমশ কামাই হওয়া ক্লাসের নোটস পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠতে লাগল। বন্ধুরা এড়িয়ে যেতে লাগল, “না রে, সামনে পরীক্ষা, খাতা দেওয়া যাবে না।”
নীহার ছেলেটা কোনদিনই পড়াশোনার ধারে কাছে থাকে না। তবে অনেক দিন বাদে মিতালীকে ক্লাসে দেখে এগিয়ে এসে বলল, “লে হালুয়া, এদ্দিন কী ওই ভাইয়ের ক্যাতা কাচছিলি ? সত্যি মাইরি, এই যুগে..”
এই রকম ছ্যাবলামি আগে করলে মিতালী দুটো কড়া কথা বলে বসিয়ে দিত। তবে জীবনের সমস্যাসঙ্কুলতা তাকে অনেক ধৈর্যশীল নিস্পৃহ করেছে। তাই সে চুপ করে রইল। তাছাড়া এই ছেলেটার কথা বলার ধরণই এরকম পালিশ বিহীন, আগেও দেখেছে মিতালী, একটু এড়িয়েই চলে তাই।
নীহার এবার সামনের বেঞ্চ টেনে নিয়ে বসে পড়ে বলল, “ছবি দেখা পুঁচকুটার”।
মিতালী ব্যাজার মুখে মোবাইলটা এগিয়ে দিল। নীহার একটা হালকা শীষ দিয়ে বলল, “ইল্লি, আগের ছবি গুলোয় কীরকম হাড় জিরজিরে মুরগির ছানার মত লাগছে, রিসেন্ট গুলোতে একদম লালটুস।”
হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে নীহার বলল, “দেখ, ক্লাস তো করিনা, ক্লাসের নোট আমার কাছে হবে না। তবে বি ডি স্যারের কোচিং এর সব নোট আছে। চলবে?”
মিতালী কী বলবে ভেবে পেল না। এভাবে নেওয়াটা ঠিক কীনা সে বুঝতে পারল না। ক্লাস ইলেভেন টুইলভ এ বাড়ির স্যারদের নোট সে প্রাণের বন্ধুদেরও দিত না। এমনকী অনেক বন্ধু প্রাইভেটে কোথায় পড়ে সেটাই বলতে চায় না। অথচ নীহার না চাইতেই প্রাইভেট কোচিংএর সব নোট দিতে চাইছে! অবাক হয়ে সে নীহারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝতেও পারল না, কৃতজ্ঞতা, অসহায়তা তার দৃষ্টিতে মিলেমিশে গিয়ে নীহারের চোখে কত অপূর্ব হয়ে উঠল।
সেদিন একটা হালকা রুচির আড্ডাবাজ ছেলে বন্ধুদের আড্ডায় একটু চুপচাপ রইল। শারীরবিদ্যা বলে, অনুভূতির উৎস নাকি হৃদয় নয়, মস্তিস্ক। কিন্তু কিছু বোকা তবুও কেন যে বুকের বাঁ দিকে হৃদপিন্ডে লাব ডুব ছাড়া অন্য কিছু অনুভূতি , অন্য কারোর নাম শুনতে পায় তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে খুঁজলে মিলবে না।
****
দেখতে দেখতে স্নাতক পার্ট ওয়ানের পরীক্ষা এসে গেল। পুয়র এটেন্ডেন্সএর জন্য একটু সমস্যা হচ্ছিল, নীহারের হস্তক্ষেপে সেটা মিটে গেল। কোনো রকমে সব কটা পরীক্ষা উৎরে গেলেও শেষ পরীক্ষার দিন গোল বাঁধল। সকাল নটা বেজে গেছে, আয়া আসার নাম নেই। নবেন্দু কে অফিস যেতেই হবে, ম্যানেজার সমানে ফোন করছে। মিতালী ঘেমে টেনশন করে একশা। শেষে নবেন্দুকে ফোনে একরাশ গরম কথা শুনে অফিস কামাই করতে হল।
হুড়োহুড়ি করে যখন হলে পৌঁছাল, তখন লেখা শুরুর ঘন্টা পড়ে গেছে। উত্তপ্ত টেনশন জারিত মন আর কাঁচা প্রস্তুতি নিয়ে তিন ঘন্টা যুদ্ধ করে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে নীহারের মুখোমুখি।
-“কী রে, দেরী? ভুলে গেছিলি আজ পরীক্ষা আছে?”
-“সেই, ভুলেই গেছিলাম”, ব্যথা ফুটে উঠল স্মিত হাসিতে।
নীহার হাতের সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে ডলতে ডলতে বলল, ” তোর বাপ মা তো বস পুরো চাঙ্গা , নাহলে এই বয়সে.. তুই সব সময়ে কীরকম বাংলা আর্ট ফিল্মের নায়িকার মত ম্যারমেরে হয়ে থাকিস কেন বল দেখি?”
মাড় ইস্তিরিবিহীন রঙচটা সালোয়ারের ওড়নায় মুখের ঘামটা মুছে নিয়ে মিতালী বলল -” তো কী করব? আমার বাড়িতে গিয়ে একদিন থাক, বুঝবি, সবই আমার কপাল।”
-“লোকে তোর বাড়ি গিয়ে থোড়াই দেখবে। সাজবি, এই ধর একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরলি, লাল লিপস্টিক সবার থাকে, তোরও নিশ্চয় আছে। একটু সুন্দর করে চুল বাঁধবি। দেখবি চারপাশটাও বদলে গেছে। চমকিলা হয়ে গেছে।”
-‘”চমকিলা’ হয়ে গেছে, কী রকম ভাষা রে? ওরকম হিংলা ভাষা শুনতে বিরক্ত লাগে।”
-“আচ্ছা, সরি দিদিমণি”। নীহার সত্যিই মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল।
মিতালী নীহারের দিকে সরু চোখে তাকাল । চৌকো ধরণের মুখে হালকা চাপদাড়ি, খুবই বৈশিষ্ট্য হীন চেহারা, উচ্চতাও মাঝারি, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গিতে ওপর চালাকি নেই, ওর কথায় একটা যেন আশ্বাস দেবার সুর মিতালীর কানে বাজে। একটু বাদামী ধাঁচের কোচকানো চুলগুলো ব্রণওয়ালা কপালের ওপর এসে পড়েছে। মুখে একটা মায়াবী ছায়া ফেলেছে ফুরিয়ে আসা দুপুরের রোদ। ডান হাতে গোটানো শার্টের হাতার নীচে একটা সবজেটে ডানা মেলা পাখির উল্কি। ডানা মেলে আটকে আছে হাতে, উড়ে যাবার উপায় নেই, অনেকটা মিতালীর মত।
-“আমি আর পারছি না রে। একদিকে সংসারের চাপ, আরেকদিকে কলেজ…আমি বোধ হয় পাশ করতে পারব না” , গলাটা তিরতির করে কেঁপে উঠল ,”কেন আমার ভাগ্যেই এমন হল!” এক বছরে এই প্রথম নিজেকে কারোর সামনে দূর্বল হতে দিল সে। সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলা তার স্বভাববিরুদ্ধ। মা বলতেন, “মিতু আমার বড্ড চাপা মেয়ে।” রাতে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে তার কান্না বাইরের পৃথিবীর কেউ জানেনি। আজ তার বেদনা একদম মনের ভেতর থেকে বাধাহীন ভাবে বেরিয়ে এল।
অনামিকায় রূপোয় বাঁধানো প্রবালের আংটিপরা একটা পুরুষালি হাত অনুমতির তোয়াক্কা না করে তার হাতের উপর উঠে এসে সান্ত্বনার উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল। সে বাধা দিল না। চারদিকের আলোটা একটু মায়াময় হয়ে উঠল, সাদা ক্যানভাসে অনেক রঙের ছিটে এসে নিজের মত করে ছবি তৈরি করে নিল। একবুক তৃষ্ণা নিয়ে হেঁটে চলা পথিক গভীর নলকূপের মৃৎগন্ধী জলে যেরকম তৃপ্তি পায় সেই তৃপ্তি ছড়িয়ে যেতে লাগল মিতালীর মনে। তবু সে মনের ভেতরে দুর্বল হয়ে যাওয়া অনুভূতির আলগা সুতোগুলোকে দৃঢ় সংযমে বাঁধবার চেষ্টা করতে লাগল।
****
পার্টওয়ান পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর দেখা গেল মিতালী কোনোমতে পাশ করে গেলেও অনার্স কেটে গেছে। নম্বরও খুব ভালো নয়। মিতালী ক্যান্টিনে চুপ করে বসে ছিল। নীহার ছুটতে ছুটতে এসে পাশে ধপ করে বসে বলল, “কোথায় ছিলি? আমি খুঁজে খুঁজে হাল্লাক…শোন মন খারাপ করিস না। আরে, আমার যে টায়ে টায়ে অনার্স রইল তাতে কী পরমহংসত্ব লাভ হল ! বসব তো সেই বাবার সোনার দোকানেই।”
-“সমুর জ্বর, বাড়ি যাই রে। গিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর রেজাল্ট? নিজের পড়াশোনা নিয়ে ভাবব, কেরিয়ার নিয়ে ভাবব, সেরকম নষ্ট করার মত সময় আমার নেই রে। ”
নীহার কিছু বলার আগেই মিতালী উঠে দাঁড়িয়ে গট গট করে বেরিয়ে গেল।
***
ঘরে ঢুকতে গিয়ে মিতালী দাঁড়িয়ে গেল। বড় মাসি বেশ হাত পা নেড়ে বলছে, ” ছেলের রোজগার পাতি ভালো, শুধু মা আর ব্যাটা। ছবি দেখে পছন্দও করেছে, দিয়ে দাও সোনাদা। একটা বছর পর তো ও গ্রাজুয়েট হয়েই যাচ্ছে। কথাবার্তা অন্তত এগিয়ে রাখো।”
মিতালীর মনের মধ্যে চাপা অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। এখনো গ্রাজুয়েট হতে প্রায় এক বছর বাকি। এক্ষুনি সে বিয়ে করতে মোটেই রাজি নয়। সে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পেতে রাখল বাবার কথা শোনার জন্য।
-” সবই তো বুঝলাম রে ননী, কিন্তু মিতুর বিয়ে দিলে আমাদের কী করে চলবে বল তো? না মানে ওইটুকু বাচ্চা নিয়ে আমি কীকরে অফিস করব?”
একটু চুপ করে থেকে বললেন, ” ও একটু ট্রেনিং ফেনিং নিয়ে একটা চাকরি টাকরি পাক, এতদিন ধরে একা চালালাম, একটু এদিকটাও তো ওকে দেখতে হবে।”
বাসে যেতে যেতে হঠাৎ ব্রেক খেলে যেরকম ঝাঁকুনি লাগে, মিতালী ঠিক সেরকম অনুভব করল। এই প্রতিক্রিয়া সে আশা করেনি। মনে হল সামনে গিয়ে বলে, ” একবারও তো বললে না, মিতুর পড়াশোনার কী হবে? বললে না তো, মিতুকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে! বললে না তো, মিতু চাকরি করুক, ওর নিজের জন্য, স্বনির্ভর হবার জন্য! সবাই স্বার্থপর। শুধু নিজের চিন্তা! মায়ের মালা পরা ছবির দিকে তাকিয়ে বুক ঠেলে অভিমান উঠে এল একরাশ। গলার কাছে উথলে ওঠা কান্নাটা কোনো মতে পিছু হটিয়ে দিয়ে চা নিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে ট্রে রেখে বেরিয়ে এল মিতালী।
সমুর খাবার সময় হয়ে গেছে। ঘর থেকে কোলে করে এনে আসনে বসিয়ে দুধে ভিজিয়ে রাখা রুটি নিয়ে সামনে রাখল মিতালী,
-“গম্প”
-“আজ গল্প বলতে পারছি না, এমনিই খেয়ে নে সোনা।”
সমু সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, “আত্তা”
মিতালীর বুকটা আবার মুচড়ে উঠল, অনেক বার তার মনে হয়েছে এই ছেলেই যত ঝামেলার গোড়া। ও না এলে তো কোন ঝামেলাই হত না। আজ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল হুবহু যেন মায়ের মুখ বসানো। চোখে সেই একই রকম মায়া।
মিতালী চামচ দিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে গল্প বলা শুরু করল। সমু রুটি গিলে নিয়ে বলল, “আয়েত্ত গম্প।”
মিতালী শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাস্তবতার বাইরে কল্পলোক গড়ে তুলতে লাগল, রাজা রানী ব্যঙ্গমা ব্যাঙমি আর ইচ্ছাপূরনের গল্প। আর সমু জগৎ ভুলে কোল ঘেঁষে বসে সরল বিশ্বাসে সেই গল্প শুনে যেতে লাগল।
**
“বিয়ে? মাথা খারাপ না পাগল?”
মিতালী প্রায় ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল নীহারের কথা।
-“কেন রে, যারা বিয়ে করে সবাই পাগল? এই দেখ, বাবার দোকানে বসে ভালো করে কাজ শিখে নেব, চাকরি খুঁজতেও বেরোতে হবে না আমায়।”
-” আমায় খুঁজতে হবে চাকরি। বাবার একার রোজগারে..”
-“করবি চাকরি, বিয়ের পর। তাছাড়া এক্ষুনি তো নয়, আগে তো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে হবে, ততদিনে আমারও একুশ বাইশ বছর বয়স হয়ে যাবে।”
মিতালী এবার হো হো করে হেসে উঠল, “তুই কী ক্ষেপে গেলি? বিয়ে , তাও আবার তোকে?”
নীহারের মুখে একটুও হাসি নেই, মিতালীর হাতটা চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল “তুই সত্যি বল, ভালোবাসিস না আমায়? আমার দিকে তাকিয়ে বল”।
মিতালীর লালচে মুখে সিঁদুরে ছোপ পড়ল হয়ত। কফি হাউসের হলুদ আলোয় তার লজ্জাবনত সুন্দর মুখের দিকে নীহার এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। একটা সাধারণ টিপ পরেছে । বাকিদিনের চেয়ে এটুকুই বেশী সাজ।
-“আমি বাড়িতেও বলেছি তোর কথা। মা আপত্তি করেনি। বাবাকেও ম্যানেজ করে নেব।”
মিতালীর মুখ থেকেও হাসি মুছে গেল, “আমার বিয়ে হয়ে গেলে সমুকে কে দেখবে? বাবা অফিস করবে না সমুকে আগলে বসে থাকবে?” নবেন্দুবাবু কথা বলে উঠলেন মিতালীর মুখ দিয়ে।
-“সেটা তোর বাবার আগে ভাবা উচিত ছিল”, নীহারের স্বর চড়ছে। “তুই কী সারা জীবন ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা হয়ে ভাই মানুষ করে যাবি?”
-“তুই বল সমাধান? সমুর কী দোষ? আমি না থাকলে বাবা হয়ত ওকে কোনো বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেবে। ওকে শাস্তি দেব কেন ?”
নীহারের হাতে ঠিক যেখানে ডানা মেলা পাখিটা আছে, সেখানে স্পর্শ করল মিতালী, নরম গলায় বলল “আমি পারব না রে, সমু একটু বড় না হলে, একটু রোজগার করে বাবার হাতে না দিয়ে..”
-“ততদিন যদি অপেক্ষা করি?”
-“না নিজের স্বার্থে আমি তোকে আটকে রাখব না। আমি আদৌ জানি না কবে আমি এই সমস্যা থেকে বেরোতে পারব, কিংবা আদৌ পারব কীনা। সমুকে বড় করতে হবে, এটা এক দুবছরের ব্যাপার নয়। বাবার শরীরের যে অবস্থা..এত হাই প্রেসার। ..”
সন্ধ্যের কফি হাউসে হলদেটে আলোয় নীহারের চোখদুটো চকচক করে উঠল। দুজন নীরবে কফি শেষ করে পাশাপাশি নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। বাসস্ট্যান্ড অবধি একসঙ্গে আসার পর নীহার সূর্য সেন স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে গেল। মিতালী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। ভীষণ ফাঁকা লাগছে মনটা। একটা অদ্ভুত ফাঁপা শূন্যতা যেন তার ভেতরে, একটা অদ্ভুত কাঁচের ঘর, যেখানে শব্দ আলো কিছুই যাচ্ছে না, অনন্ত একাকীত্ব। সে সমুর ঘুমন্ত মুখটা কল্পনা করে শান্তি খুঁজতে লাগল মনে মনে। সমু বড় হয়ে যাবে, একটা ভালো চাকরি …
-” এই”
-“কীরে? ফিরে এলি?” মিতালী চিন্তার জাল ছিঁড়ে চমকে তাকাল।
রাস্তার সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের উজ্জ্বল হলুদ আলোয় নীহারের ঘামে ভেজা মুখটা চকচক করছে।
-“সমাধান চাইছিলি না? পেয়ে গেছি।”
-“কী শুনি?”
-“আরে, তোর ওই পুচকে ভাইটাকেও তত্ত্বে পাঠিয়ে দিতে বলবি তোর বাবাকে। আমার মা, কাকিমা সারাদিন একই সিরিয়াল দশ বার করে দেখে, মানুষ করে দেবে। তুই আমি তো আছিই।” একটা হাততালি দিয়ে বলল, “এত সহজ সমাধান সামনে থাকতে তুই হাতড়ে মরছিস,পাগলী!! আর চাকরি তুই করবি, বিয়ের পরই করবি। না পেলে আমার সঙ্গেই দোকান সামলাবি। বাবাকে টাকাও দিবি, মিটে গেল।”
-“সব কিছু কী এতই ছেলেমানুষি তোর কাছে?” হেসে ফেলল মিতালী, “তোর সত্যিই মাথায় ক্যাড়ার চাষ আছে রে।”
-” না না শোন…
-” আচ্ছা .. ভেবে দেখব…
-“…সিরিয়াসলি বলছি এটাই একমাত্র উপায়…”
-“সত্যিই , তোকে সাধ করে বুদ্ধির গুদাম বলি!..”
-” সে তুই যাই বল, আমি যেটা বললাম সেটাই বেস্ট..বিয়ে তো করে নিই, তারপর…”
কলকাতার ব্যস্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে দুজন জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ যুবক যুবতী একে অন্যের হাতে হাত রেখে রঙিন ইচ্ছেসুতোয় স্বপ্ন বুনে চলল। অফিস ফেরত যাত্রীদের ঘেমো জামার গন্ধ, ফুটপাথের ধারে সস্তা মোজার দোকানের দরদস্তুর, রুটির দোকানের উনুনের পাক খেতে থাকা মিহি তুলোর মত ধোঁয়ার মধ্যে তাদের হাসি আর গল্পের মদিরা ফোঁটায় ফোঁটায় সুধা সঞ্চার করতে লাগল। কল্লোলিনী কলকাতার বুকে এরকম উপসংহারহীন গল্প রোজ তৈরি হয়। মিতালী আর নীহারের কথা শুনেও হয়ত শহরটার জড় শরীরের পাথুরে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। ধুলোমাখা রাজপথ দিয়ে একটার পর একটা বাস বেরিয়ে গেল, হয়ত সেগুলোর মধ্যে অনেক কটাই মিতালী কিম্বা নীহারের যাত্রাপথের । কিন্তু ওরা তো ব্যস্ত জীবনের জটিলধাঁধার সহজ সমাধান খুঁজতে। কে বলতে পারে, জীবনের জটিল অঙ্ক হয়ত সহজ ফর্মুলাতেই মিলে গেল, হতেও তো পারে এমন!
–-~০০০XX০০০~–