“আর চিন্তা নেই, ট্রেনে যখন উঠেই পড়েছি, এইবার সিট খুঁজে বসতে কোন অসুবিধা হবে না” – কথা গুলো বলতে বলতে দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে নিজের মাকে মালপত্রের মতো সতর্ক হয়ে সামনে রেখে ভিড়ের মধ্যে এগুতে থাকেন অনুপ চক্রবর্তী।
মায়া চক্রবর্তী, বয়স পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই, বৈধ্যব্য জীবন। পাঁচ সন্তানের জননী। পাঁচ সন্তান কে মানুষ করা আর ঈশ্বর চিন্তা ছাড়া তৃতীয় চিন্তা কখনো করেনাই। মুসলমান সম্প্রদায় বছরে একমাস রোজা করেন, তাই আমরা বলি সত্যি ওরা কত ধার্মিক, সারাদিন থুথু পর্যন্ত না গিলে সেই সন্ধ্যা বেলা খায়। আর মায়া চক্রবর্তী সারা জীবন সকাল থেকে না খেয়ে থুথু পর্যন্ত না গিলে সংসারের সমস্ত কাজকর্ম করে নিয়ে – স্নান করে ঘন্টা খানিক ঠাকুরের সেবা করে, তারপর ভাত খান। সেই সময়টা হয়তো বিকাল পাঁচটা বেজে যায়। এখন বৃদ্ধার সংসারের হাল ধরতে হয় না। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেরা স্ব-যোগ্যতায় সংসারী হয়ে গেছে। এখন মায়া দেবীর একটাই চিন্তা ঈশ্বর আর ঈশ্বর। বড় একটি ঘর, তাতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী অধিষ্ঠান করছেন। ভারতবর্ষে যত তীর্থস্থান আছে সবই ওনার ঘরে আছে, এটা ওনার চরম বিশ্বাস। তাই কখনো কোন তীর্থস্থান-এ ছেলেরা নিয়ে যেতে চাইলেও উনি যেতে চাননি। এমনকি বাড়ির পাশের শিবমন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢালতেও যাননি। উনি একটি কথাই বলেন “মন যদি জাগ্রত হয় তবে ঈশ্বর ঘরে এসে অধিষ্ঠান করেন। কোন তীর্থক্ষেত্রে যেতে হয় না। মা সারদা ওনার আদর্শ নারী। মায়া দেবীর মুখে কখনো কারোর সমালোচনা শোনা যায়নি সমস্যায় পড়লে বলেন “মনে হয় আমারই ভুল”। ছোট ছেলে মাকে অনেক বুঝিয়ে একরকম জোর করে এই অদূর ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছেন। শিয়ালদহ থেকে রামপুরহাট প্যাসেঞ্জার, মাত্র ঘন্টা ছয়েক এর ভ্রমণ। অনুপ বাবু তার মাকে নিয়ে সংরক্ষিত সিটে বসলেন। ট্রেনের মধ্যে প্যাসেঞ্জারদের হুড়োহুড়ি আস্তে আস্তে স্তিমিত হল এবং এক সময় ট্রেন ছাড়লো।
ট্রেন ছাড়তেই রঘুরাজ ভাদুরী নামে এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক উচ্চস্বরে “জয়… তারা…” বলে উঠলেন। জানা গেল উনি সখের তান্ত্রিক। সেন্ট্রাল গভর্মেন্টে চাকরি করেন। বছরে কয়েকবার তন্ত্র সাধনার জন্য তারাপীঠ যান। পাশের সিটে বসেছেন অনুপ বাবু। মায়া দেবী কপালে হাত ঠেকিয়ে একগাল হেঁসে রঘুবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনি তারা মায়ের বড় ভক্ত – না”? রঘুবাবু উচ্চস্বরে কথা বলেন। মুচকি হেঁসে রঘুবাবু বলেন “না দিদি, আমি একা নই। আমরা সবাই, যারা এই ট্রেনে করে মায়ের কাছে যাচ্ছি। তবে এটা ঠিক, মা তারা কিন্তু অন্তরযামি – আমরা মুখে যাই বলিনা কেন, কার মনে কি আছে তা উনি বোঝেন। যার যা ফল প্রাপ্য তাকে তাই দেন।” রঘু বাবুর কথা সকলের শুনতে বেশ ভালই লাগছিল।
বাইরে হঠাৎ মুসলধারে বৃষ্টি শুরু হল। তার মধ্যেই ট্রেন চলছে রামপুরহাটের উদ্দেশ্যে। রঘুবাবু মানুষ আর ঈশ্বরের যোগসূত্র নিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। আর সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন। আস্তে আস্তে শ্রোতাও বাড়ছে। রঘু তান্ত্রিক বল্লেন “একটা সত্যি ঘটনা বলি শুনুন। সমস্যায় পড়লে আমার কাছে এক প্রোমোটার আসতেন, কথাবাত্রা ভীষণ ভাল, অসম্ভব দূরদর্শী সম্পন্ন মানুষ। মানুষকে মেপে বিশ্বাস করেন। উনি জানতেন আমি নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কখনোই কোন কাজ করিনা বা কথা বলিনা। এই আসা-যাওয়ার মাধ্যমে ওনার সাথে আমার সম্পর্কটা গভীর হয়ে উঠল। জন্মছক এবং ওনার কথা-বাত্রায় আমি বুঝেছিলাম উনি খুব প্রতিহিংসা পরায়ন। নিজের সমস্যা মেটাতে খুবই উদ্গ্রীব, কিন্তু অপরকে সমস্যায় ফেলে রাখেন। নেতিবাচক কথাবাত্রা তো সবসময় বলা যায়না, তাই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে বলেছি, তাতেও কাজ হয়নি। একবার একটা মামলায় উনি গ্রেফতার হলেন, এবং মাসখানিক জেল খাটলেন। তখন আমি ওনার মতিগতি ফেরানোর জন্য তারামায়ের কাছে গিয়ে মায়ের চরনে অর্ঘ্য নিবেদন করতে বললাম। গেলেনও তাই। একবার দুইবার যেতে যেতে ওনার তারাপীঠ যাওয়ার একটা মন তৈরী হয়ে গেল। সময় সুযোগ পেলেই উনি তারাপীঠ চলে যান। তারপর একসময় একটা দামি গাড়ি কিনলেন। নুতন গাড়ি পূজা দেবেন বলে স্ত্রী, সন্তান এবং ড্রাইভার নিয়ে উনি তারাপীঠ গেলেন। মায়ের পায়ে সবাই মিলে পূজা দিলেন। দুইদিন থাকলেন। তারাপীঠ সঙলগ্ন অনেক ছোট ছোট মন্দির আছে সেগুলোও দর্শন করলেন। তারপর ফেরার সময় ঘটল এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। দৈবক্রমে ঠিক সেই সময় সেখান দিয়ে একটা খালি এ্যম্বুলেন্স ফিরছিল, সঙ্গে সঙ্গে স্হানীয় লোকজন ওনাদের চারজনকে হাসপাতালে পাঠালেন। মায়ের অসীম কৃপা, চারজনই প্রাণে বাচলেন। তবে প্রোমোটার ভদ্রলোক বেচেঁও মরে আছেন। উনি গাড়ির সামনে বসেছিলেন, সিটবেল্ট বাধেননি। এখন উনি চার দেয়ালের মধ্যে বিছানায় বন্দি, ক্রাচ নিয়েও হাটতে পারেন না। বাকি তিনজন ভালোই আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু দৈবক্রমে তারা একদম সুস্থ।
এখানেই আমার প্রশ্ন। উনিতো মাকে পূজা দিয়েই ফিরছিলেন, তাহলে এমন হলো কেন? আসলে মা ওনার পূজা গ্রহন করেননি। পূজার পুণ্যের থেকে পাপের বোঝাটা অনেক ভারি ছিল। রঘু তান্ত্রিক দুই হাতে নিজের দুই হাটুতে দুটো থাপ্পড় মেরে বল্লেন “তাহলে মোরাল অফ দা স্টোরি কি হলো ? আমাদের কাজ কর্মের মধ্যে স্বচ্ছতা, সততা, সংযম, ধৈর্য্যশীল মনো ভাব হতে হবে। কাজে, কথায় প্রতিবন্ধকতা থাকলে চলবে না। আমরা আত্ম বিশ্লেষণ করিনা। ভালো কাজের আনন্দ মন উপলব্ধি করে। কিন্তু খারাপ কাজের সুখ শরীর ভোগ করে, মন নয়।”
ট্রেন চলছে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ট্রেন অনেকটা পথ চলে এসেছে। সবাই মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে রঘু তান্ত্রিকের গল্প শুনছেন। ট্রেনের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হকার এসে হেঁকে ভাব বুঝে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। চা ওয়ালা আসতেই সবাই এক বাক্যে বলে উঠলেন “একটু চা খাওয়া যেতে পারে”। তাপস মন্ডল সখের মুভি ক্যামেরাটা নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন “চা খান সবাই কিন্তু চায়ের দাম আমি মেটাবো”। সবাই একটু আপত্তি করায় তাপস বাবু বললেন “এখন আমরা আর আলাদা নই, এমন সুন্দর পরিবেশে সবাইকে এক কাপ করে চা খাওয়াতে পারলে আমি ধন্য হয়ে যাব। রঘু তান্ত্রিক – “তাই হোক” বলে সমর্থন জানিয়ে, জোরে হেসে উঠলেন। তাপস বাবুর পাসের সিটে বসেছেন দুই জন মধ্য বয়স পার করা দম্পতি। কার্তিক বসু ও স্মৃতি বসু। তাঁরা এতক্ষন চুপচাপ বসে রঘু তান্ত্রিকের কথা শুনছিলেন। এবার কার্তিক বাবু ধূমায়িত চায়ের কাপে ঠোঁট স্পর্শ করে সকলের কাছে অনুমতি নেয়ার সুরে বললেন “আমি সবার সাথে আমার জীবনের একটা ঘটনা শেয়ার করতে চাই”। রঘু তান্ত্রিক বললেন – “নিশ্চয়ই… বলুন”। বাইরে মুসলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কার্তিক বাবু শুরু করলেন “বছর কুড়ি আগের ঘটনা। আমি তখন এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার ক্লাস থ্রী স্টাফ ছিলাম। আমি তারামায়ের ভক্ত কিন্তু ওটা আমার মনে ছিল। সামান্য মাহিনা পাই, পাঁচ সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা কে নিয়ে আমার সংসার। ওভার টাইম নিয়ে যা পেতাম তাতে কোনো রকমে চলে যেত। ইচ্ছা থাকলেও মায়ের জন্য কিছু করে উঠতে পারিনি। একদিন আমার এক সহকর্মী অফিসে এক ভদ্রলোককে আমার কাছে নিয়ে এলেন। ভদ্র লোকের নাম সত্য নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। ভদ্র লোককে দেখে মনটা যেন ভক্তি ভাবে ভরে উঠলো। উনি বললেন তারাপিঠের তারা মায়ের একটা পালার ভার যেন আমি নেই। পালা মানে একদিনের পূজার সমস্ত খরচ। আমি আমতা আমতা করে জানতে চাইলাম টাকার পরিমাণ কত ! যখন জানলাম দশ হাজার টাকা, আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কারণ ওই টাকা আমি মাহিনাই পাই না। আমি অপারগ জানাতে, সৌম্য দর্শন শান্তশিষ্ট মৃদুভাষী সত্যবাবু বললেন, আমি সেই তারাপীঠ থেকে কোলকাতায় এসেছি, এটা মায়ের ইচ্ছে ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।”
“আমি বাড়িতে এসে স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে দশ হাজার টাকা অনেক কষ্টে জোগাড় করলাম এবং নির্দিষ্ট দিনে তারাপীঠ-এর উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলাম । সেই আমার প্রথম স্বপরিবারে তারাপীঠ যাওয়া। মায়ের পাশে থেকে নিজের হাতে মায়ের আসল মূর্তিতে ঘি মাখিয়ে স্নান করানো, শাড়ি গহনা পড়ানো, পূজা করা – ওঃ সে যে কি তৃপ্তি বোলে বোঝাতে পারব না। তারপর যখন পূজার শেষে গরিব দুঃখী দের বসিয়ে খাওনো হচ্ছিলো (যাকে ভান্ডারা বলে), সেই গরিবদের মধ্যে মুসলমান ছিল বেশি, ওরা হয়তো আল্লার কাছে পেটপুরে খাওয়ার প্রার্থনা করে ছিলো। ঈশ্বর তো সবই এক, তাই ওদের এখানে টেনে এনেছেন। সেই পরিস্থিতিতে আমার মনে হচ্ছিলো মা যেনো আমাকে দিয়েই কাজটা করিয়ে নিলেন। তারপর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে গেলাম। এই দশহাজার টাকার ধারটা আমি কি ভাবে যে শোধ করলাম সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না। তার পরেই ঘটলো আমার জীবনের কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা। যার ব্যাখ্যা আজও আমি খুঁজে পাই নি। ভাবলে মনেহয় স্বপ্নের মতন সময়টা কেটেছে। মা তারার ইচ্ছে ছাড়া কখনোই এটা সম্ভব নয়। সেই জন্য এই বৃদ্ধ বয়সে, অসুস্থ শরীরে বছরে এক বার হলেও মা কে দর্শন করে আসি। হয়তো মা-ই আমাদের টেনে নিয়ে যান।”
“এবার ঘটনা গুলো বলি। আমার দুই মেয়ের হঠাৎ এক সাথেই বিয়ে ঠিক হলো। এক মেয়ের বিয়ের টাকা নেই তো দুই মেয়ে! মহা চিন্তায় পড়লাম স্ত্রী তো সরাসরি বলেই দিলেন যে ভাবেই হোক টাকা জোগাড় করতে হবে, এই পাত্র উনি হাত ছাড়া করতে পারবেন না। এতো দু এক হাজার টাকার গল্প নয়, দুটো মেয়ের বিয়ে একসাথে সোনার গহনা কিছুটা তৈরি করা ছিলো সেটা বাদেও লাখ দুয়েক টাকা তো লাগবেই। আত্মীয় স্বজনকে না বলে পরিচিত মহলে কথাটা পারবো ভাবছি, এমন সময় অফিসে গিয়ে শুনলাম আমাদের ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। আমি অফিসার পদে উন্নীত হয়েছি। আমার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা, আমি কি ভাবে অফিসার হোলাম বুঝতেই পারলাম না। মাইনে হয়ে গেলো চারগুন, এরিয়ার নিয়ে ব্যাংকে লাখ দেড়েক টাকা ঢুকলো। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। দুই মেয়ের বিয়ে সুন্দর ভাবেই মিটল, বিয়ে মিটতেই মেয়ে জামাইদের নিয়ে তারা মায়ের কাছে পুজো দিয়ে আসলাম। তারপর ঘটলো তৃতীয় ঘটনা, আমি তখন থাকতাম একটা ভাড়া বাড়িতে। বৃদ্ধা মালকিন তার নিজের কেউ নেই। উনি বেশ কিছুদিন হলো আমাদের উঠে যেতে বলছিলেন। কারণ তার ভাইপো ভাইজিরা বাড়ি বিক্রয় করে ওনাকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। দরদাম করে বাড়িটা আমি নিয়ে নিলাম। চুরি ডাকাতি করিনি, হঠাৎ কিছু শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতা পেলাম। ধারদেনা অনেকটাই হয়েছে, কিন্তু তারা মায়ের ইচ্ছায় কয়েক বছরের মধ্যে সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।”
রঘুবাবু এতক্ষন চোখ বন্ধ করে কার্তিক বাবুর বলা ঘটনাগুলো শুনছিলেন। এবার চোখ খুলে বললেন – “একদম তাই, এই যে আত্ম বিশ্লেশন করেছেন, তাই তো এত সহজে চাওয়া পাওয়ার হিসাবটা বুঝে নিতে পেরেছেন”। এতক্ষন কার্তিক বোসের স্ত্রী স্মৃতি বোস স্বামীকে সমর্থন করে শুনছিলেন কথাগুলো এবার উনি বললেন “জানেন তো আমি কিন্তু একদম সুস্থ নই, হাঁটুর মালাইচাকির জেলি শুকিয়ে গেছে, ভালো ভাবে হাঁটতে পারি না, দশ মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, সুগারে ধরেছে। কিন্তু কি আশ্চর্য বছরে একবার তারা মায়ের চরণে অর্ঘ্য নিবেদন করতে যাই, আমার কিন্তু কোনো কষ্ট হয় না। একবার তো শীতকালে তাড়াপীঠে গিয়ে পাথরের মেঝেতে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে পুজো দিয়েছি। তবুও কিছুই হয় নি, সবই তাঁর ইচ্ছা”। রঘুবাবু বললেন “আমরা কিছুই করি না সবই তিনি করান, এই যে অসুস্থতা নিয়ে যাচ্ছেন এটা আপনি যাচ্ছেন না, আপনাকে মা নিয়ে যাচ্ছেন তাই আপনি যেতে পারছেন, মা না ডাকলে কেউ কখনো মায়ের দর্শন পায়না।”
তাপসবাবু এতক্ষন মুভি ক্যামেরাটা নিয়ে ভিডিও রেকডিং করছিলেন। উনি বললেন, এই রকম পরিবেশ তাঁর একটি ঘটনার দায় স্বীকার করতে ইচ্ছা করছে। সবাই অনুমতি দিলে উনি বলতে পারেন। সবাই শুনতে চাওয়ায় তাপস বাবু শুরু করলেন -“বছর দশেক আগের ঘটনা, আমার এক বন্ধু, সংসারী, ছোট খাটো একটা কাজ করে। মা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে পাঁচ জনের সংসার। নিজের একটা দোতলা বাড়ি আছে, ফলে ঘর ভাড়া গুনতে হয়না এই যা। দ্রব্যমুল্য আগুন হওয়ায় সংসার খরচে পেরে উঠছিল না। এমন সময় এক টাওয়ার কোম্পানি বাড়িতে এসে উপস্থিত, তারা ছাদ ভাড়া নেবে, কোম্পানির প্রতিনিধিরা একটা তারিখ ঠিক করে কিছু ডকুমেন্টস জেরক্স করে রাখতে বললেন। বন্ধু যেন হাতে চাঁদ পেলো, মনে উৎফুল্লতা নিয়ে জানতে সে চায় ছাদ ভাড়া কত পাবে? সাত হাজার টাকা ভাড়া হবে জানিয়ে কোম্পানির লোকেরা বিদায় নেয়। সেদিন বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা ছিল, বন্ধুর মা খুশি মনে বললেন, “মা লক্ষ্মী এবার তোর কিছুটা অভাব দূর করে দেবেন”। নির্দিষ্ট দিনের কয়েক দিন আগে কোম্পানির প্রতিনিধিদের তরফ থেকে ফোন করে একটা মোটা টাকার ঘুষের প্রস্তাব এলো। বন্ধুর তো অত টাকা নেই, সে জানিয়ে দিল কোম্পানি যে এডভান্স – এর টাকা দেবে সেটা দিয়ে দিতে রাজি আছে। যাইহোক নির্দিষ্ট দিনে আমার বন্ধু স্ব-কাজে না গিয়ে, কোম্পানির বলে দেয়া ডকুমেন্টস হাতে অপেক্ষা করতে থাকলো। সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু টাওয়ার কোম্পানির প্রতিনিধিরা এলো না। বহুবার ফোন করলো, কিন্তু ফোন ধরলো না। একসময় তারা ফোনের সুুইচ অফ করে দিলো। হাতের লক্ষ্মী সরে যাচ্ছে এই ভেবে বন্ধু খুব হতাশ হয়ে পড়লো। সপ্তাহ দুই পর দেখা গেল সেই টাওয়ার পাশের দুটো বাড়ির পরের বাড়িতে বসছে। আমার বন্ধু একদম ভেঙে পড়ল। বড় আশা করেছিলো যে। তারপর একটু হতাশা কাটিয়ে নিয়ে ও আদা-জল খেয়ে বিভিন্ন কোম্পানির টাওয়ার এর খোঁজ করতে লাগলো। ঠিক করলো, ধার করে হলেও ঘুষ দেবে। পরে বিশ-তিরিশ বছর তো নিশ্চিন্ত। এত খোঁজ খবরে নিমগ্ন ছিল যে আমরা পেছনে ওকে টাওয়ার পাগলা বলে ব্যঙ্গ করতাম। এক দিন বন্ধুরা সবাই মিলে খানিকটা ব্যাঙ্গের সুরে বললাম – যা তারাপীঠে গিয়ে মাকে পুজো দিয়ে তোর মনের ইচ্ছাটা নিবেদন করে আয়”।