আয়নামানুষ
************
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আয়নার সামনে দাঁড়ালে অর্যমার ঘোর যেন কাটতে চায়না। নিজে যে খুব ডানাকাটা পরী তা নয়। তবুও আয়নাটা ওকে টানে। ছোটবেলা থেকে রূপকথার যাদু আয়নার গল্পটা অর্যমার খুব প্রিয়।
এই একটা আবিষ্কার যেন মানবসভ্যতার নান্দনিকতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে কেউই আয়নায় নিজেকে অসুন্দর দেখে নি আজ অবধি।
ওর স্বামী রক্তিম খুবই ব্যস্ত মানুষ। এই ব্যস্ততা নিয়ে অবশ্য তার কোনই অভিযোগ নেই। বেচারা ট্যুরেই থাকে মাসের পনেরদিন। ক্লোজিং, টার্গেট আর শত ডেডলাইনের মধ্যেও কিন্তু অর্যমার শরীরের সাধ্যমত খেয়াল রাখে।স্ট্রেস কাটানোর জন্য বছরে দুটো ভ্যাকেশন নির্দিষ্ট। গতমাসেই থাইল্যান্ড ঘুরে এল ওরা।
চারবছর বিয়ে হলেও অর্যমা কনসিভ করেনি। রক্তিম আসলে নিজেই বাচ্চাকাচ্চার ঝামেলায় যেতে চায় না। কারণ অর্যমার সুডোল দেহতে কোনও আঁচড় পড়ুক সেটা ওর না পছন্দ।
*********
আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে অর্যমা আস্তে আস্তে সে নিজেকে উন্মোচন করে। পেলব শরীর পেখম মেলে যেন। ত্রিশটি বসন্তেও শরীরটি এখনো পুষ্ট। মেদহীন মসৃণ প্রতিটি ভাঁজে যেন প্রাচীন ভারতের ভাস্কর্য্য। খুব আদর করতে ইচ্ছে হয় নিজেকেই।
গভীর আদরের তন্মাত্র মুহূর্ত কাটে অকস্মাৎই। একি, এ কার ছায়া এখন দেখছে সে ! ওর কপালের কাছে চুলটা পাতলা হয়ে এসেছে? রূপোলী চুলগুলোর ফাঁকে দাগ বসে যাওয়া সিঁদূরের ছাপ!কপাল থেকে সমগ্র দেহে চামড়ার মসৃণতাও উধাও। কুঞ্চিত লোলচর্মে এ যেন অর্যমার মা এখন সামনে। ছমাস আগে তার মা তো…। ও মা…মা…মাগো বলে অজান্তে একবার ফুঁপিয়ে ওঠে সে।
*********
চিৎকার করতে ইচ্ছে হলেও গলা দিয়ে স্বর বের হয়না। কেন এই বিভ্রান্তি ! অতবড় মসৃণ আয়নায় কখনোতো নিজের ভুল প্রতিবিম্ব ফোটেনি ! তবে কি সত্যিই ও এরকম হয়ে গেল ! রক্তিম এখন কোথায় ! ও তো ঘৃণায় ছুঁয়েই দেখবে না আর।
পাঁচতারায় অফিসের পার্টীগুলোয় তাহলে মধুজা নামের ওই ডিভোর্সী ডাইনী মেয়েটাই ওর গায়ে লেপ্টে থাকবে ! প্রাণ থাকতে তা হতে দেবেনা অর্যমা।
একদৌড়ে কিচেন থেকে ছুরিটা নিয়ে ও আয়নার দিকে এগোয় ! ওই ওই তো মধুজা ! দামী কাঞ্জীভরম পড়ে ঢলে ঢলে পড়ছে আঁচল খসিয়ে, রক্তিমের গায়ে। রক্তিমের নীলচে ক্লিনশেভ্ড গালে পার্কেন লাইটের ঝিকিমিকি আলো। অর্যমা নগ্ন দেহেই আয়নায় দেখতে পাওয়া মধুজাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়, তার হাতের ধারালো ছুরিটা যেন আজ রক্ত পিয়াসী। উত্তেজনায় থরোথরো কাঁপতে কাঁপতে অর্যমা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
*********
বেশ অনেকটা সময় পরে অর্যমার জ্ঞান ফেরে। কোথা থেকে একটা মায়াবী হলুদ আলো আয়নার ওপরে এসে পড়েছে । আর আয়নার ওপারে দেখা যাচ্ছে আদিগন্ত সোনালী গমক্ষেত। আর সেই ফসল ভরা ক্ষেতের ভিতর থেকে দৌড়ে আসছে একটি ফুটফুটে পরীর মত বাচ্চা মেয়ে। লাল টুকটুকে গালদুটো আপেলের মত। কি মসৃণ, কি অপার্থিব রূপ তার। অর্যমার দিকে কচি কচি হাতদুটো বাড়িয়ে দেয় সে।
*******
খুব খুশীতে অর্যমা তাকে মুহূর্তে কোলে তুলে নেয় আয়না থেকে। সে বুঝতে পারে এতদিন সে এই স্বর্গের দেবশিশুটির প্রতীক্ষায় ছিল। বিলিতি ছবির মতোই সুন্দর সে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে শিশুটির গায়ে কোন পোশাকের বাহুল্য ছাড়াই সে এক অপার্থিব অলীক সৌন্দর্য বয়ে এনেছে আর তার ছোট ছোট দুটি কোমল হাতের বেড়িতে অর্যমাকে জড়িয়ে আছে অনন্তকালের তৃপ্তিতে।
–~০০০XX০০০~–