“ছায়ামানুষ”
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
****************
রাস্তার মোড়টায় আজ অকারণ জ্যাম লেগে গেছে। গাড়ি, পায়ে চলা মানুষ, হকার, অটো, সাইকেল রিক্সা সব নিয়ে একটা জগাখিচুড়ি অবস্হা। মোড়ের মাথার ট্রাফিক কনস্টেবলটা হয়তো জায়গা ছেড়ে খৈনী- টৈনী কিংবা চা খেতে কোথাও গেছে সবে; তার মধ্যেই যত গন্ডোগোল।
রোমিলা বাস থেকে তাই একটু আগেই নেমে পড়লো আজ তাই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। ওইটুকু পথ এখন হাঁটাই যায়, তাছাড়া কোচিংএর টাইম হয়ে গেছে এতক্ষণে। দেরী করে ঢুকলে সমীর স্যার রাগারাগি করেন খুব। শুভ ওর বাবার ধাত পুরোটাই পেয়েছে। এখনই অঙ্ক-টঙ্কে খুব ভীতি। ক্লাস সেভেনেই এটা কাটিয়ে না উঠতে পারলে ভবিষ্যতে আরও অসুবিধা হবে। আর সব বাবা মা র মতো রোমিলারাও শুভর ভবিষ্যতটা মসৃণ ও কুসুমবিছানো করে রাখতে আগ্রহী ও সচেষ্ট।
বাতাসে বেশ একটা পূজো পূজো গন্ধটা এসে গেছে। একটুও শিরশিরানিও কি অনুভূত হচ্ছে না?এবারে অক্টোবরের শেষে পূজো বলে বাতাসে একটা আলগা হিমেল টান অলরেডি কিন্তু তা জানান দিচ্ছে ।
সমীরবাবুর বাড়িটা ওদের পুরনো পাড়ার খুব কাছে। ক্লাস ইলেভেন অবধি এটাই রোমিলার পৃথিবী ছিল। পরে বাবা গড়িয়ায় জমি কিনে বাড়ি বানানোর পর ওরা উচ্চমাধ্যমিকের আগেই এই পাড়াটা ছেড়ে চলে যায়। ছোটবেলা থেকে যৌবনের প্রারম্ভ অবধি অনেক লাল নীল স্মৃতি এ পাড়া জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সেদিনের রোমিলা আজ আজকের রোমিলার মধ্যে শারীরিক সাদৃশ্য প্রায় নেই বললেই চলে। সেই প্রজাপতির মতো ফুরফুরে মেয়েটাকে হাজার খুঁজলেও আজ আর পাওয়া যাবে কি?
বন্ধুমহল ক্লাবের মাঠটায় বাঁশটাঁশ ফেলে প্যান্ডেল বানানোর কাজ চলছে। সামনের সপ্তাহেই ষষ্ঠী তাই ঠুকঠাক আওয়াজ আসছে কানে। বন্ধুমহলের পূজোয় প্রথম একা একা অঞ্জলি দিতে যাওয়া সেই ক্লাস টেনে। সামনে টেস্ট পরীক্ষা, কাজেই উপোস টুপোস করে একটা হলুদরঙের পাতলা তাঁতের শাড়ি পরা কিশোরীটি বদলে গেছিল সেই আপাত সাধারণ অথচ ঘোর লাগা অষ্টমীর শারদ সকালে। তখনও পর্যন্ত টিন এজের ছেলেমেয়েরা একটু দূরে দূরেই থাকত, কেবল পূজোর কটা দিন শাসনের আওতার মধ্যেও স্বাধীনতার একটুকরো বসন্তবাতাস বয়ে যেত হাজারো দ্বিধার শিউলিফুল উড়িয়ে ।
ভীষণ রোগা আর লম্বা, পাঞ্জাবী পাজামায় আরও ঢ্যাঙা লাগা মৃদুলদা অবাক বিস্ময়ে রোমিলাকে সেদিন অপলকে দেখছিল পাথর হয়ে। সেই দৃষ্টিতে হয়তো কোন প্রেম ছিলনা, কিন্তু ছিল বিস্ময়,কিছু আবিষ্কারের চরম আনন্দ আর নিবেদন।সেই নবীন প্রাণের উৎসর্জনের ঊষাকালই ছিল ওটা আজ মনে হয়। ওর নিজের ব্যাপারটা খারাপ লাগেনি মোটেও। বাড়ি ফেরার পথে আবার সাইকেল নিয়ে পথ আটকেছিল।অত্যন্ত সংকোচে জিজ্ঞাসা করেছিল ‘ ইয়ে, মানে, কালকেও অঞ্জলি দিতে কি আবার…’ কথাটা শেষ না করেই পাঁইপাঁই সাইকেল চালিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার আগেই রোমিলা নিজের অজান্তে ঘাড়টা নেড়ে সম্মতি দিয়ে দিয়েছিল।
সেইদিনটার থেকেই রোমিলার আসল বড় হবার শুরু। সেই স্মৃতি এতদিনেও মুছে যায়নি একটুও।
খুব খিদে পাওয়ায় সিধুদা’র রোলের দোকানে এসে একটা এগরোল অর্ডার করে দিয়ে ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে লাগলো। এখনো ঘন্টাখানেক পর ছেলের ছুটি হবে। সিধুদা’র দোকানের ছেলে দুটো নতুন, স্বভাবতই ওকে চেনার কথা নয়। কিন্তু এপাড়ায় আসলে পুরনো কারুর না কারুর সাথে দেখা হয়েই যায়। অনেককালের চেনা লোকজন সব, চেহারাগুলো বদলে গেলেও হঠাৎ দেখা হলে সেইদিনগুলোয় ফিরে যাওয়ার আনন্দটা পাওয়া যায়।
সিধুদা’র দোকানটার পাশে আগে একটা খেলার মাঠ ছিল। এখন একটা লম্বা চারতলা ফ্ল্যাট উঠে গেছে সেখানে। আগে ওরা কত খেলেছে ওই মাঠে। রূপা, পৌলমীদের সাথে জলি বলে একটা মেয়েও আসত। ওদের অবস্থা অতটা ভালো ছিলনা। জলির রঙচটা পুরনো ফ্রকের পিছনে আটকে থাকা একটা মরচে পড়া সেফটি পিন এখনো যেন চোখ বুজলে মনে ও করতে পারে।
সমীরবাবুর কোচিংএর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মা’দের জটলাটা রোমিলা এড়িয়েই চলে সাধারণত। ওই একই গল্প- শ্বাশুড়ী, ননদ, সিরিয়াল, বরের প্রমোশন, অ্যাব্রড ট্রিপ এসব বকবকানি নাগাড়ে শুনতে ওর বিরক্ত লাগে। কেউ কেউ আবার এরমধ্যে বুটিকের শাড়ি, কূর্তি কিংবা নামী কসমেটিক্সের বিজনেস করে। নিজেদের মধ্যেই ধারবাকি রেখেই এসব চলে। অনেকেই অবশ্য কেনে, রোমিলা আবার এসব উপদ্রব পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসে।
রোমিলার দুটো চোখ ইতিউতি কাউকে খোঁজে। মৃদুলদারা আর থাকেনা বোধহয় এ পাড়ায়। নইলে এতদিন আসছে একবারও দেখা হলোনা কেন?
গণেশের দোকানে মাসকাবারি বাজার করতে আসলে হাতে সাধারণতঃ সময় নিয়ে আসতে হয়। পাইকারির দাম নেয় বলে লম্বা লাইন থাকে ভালোই। আবার লুকিয়ে কেরোসিনও বিক্রী করে বলে দোকানের পিছনটায় রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে ওর ভাইপো বিশু কেরোসিনের ড্রামটা নিয়ে বসে। মৃদুলের ব্যাগটা আজ আটার প্যাকেটদুটোর জন্য ভারী হয়ে গেছে খুব। সিধু’র রোলের দোকানটার সামনে একটা দুটো রিকশা যদি দাঁড়ায় তারই আশায় একটা পা টেনে টেনে সে এগোয়।
‘মৃদুউউউল দাআআআ’ হঠাৎ ডাকটা শুনে ঘাড় ঘোরায়। সিধু’র রোলের দোকান সবে পার করেছে এতক্ষণে। এই অবস্থায় জোরে পা চালানো মুশকিল। তাও সে রোলের দোকানের দিকে একবারটি ফিরে চায়।রোমিলা দূর থেকে দেখে একটু যেন কুঁজো হয়ে গেছে মানুষটা । অনেক ঝড় বয়ে যাওয়া বৃক্ষশাখার মত নুয়ে গেছে লম্বা কাঠামোটা। মৃদুলদার এই চল্লিশ বছরের পুরনো চেহারাতেও আজ একটা ভাঙনের ছাপ খুব স্পষ্ট।
“আমি রোমি! চিনতে পারছ না?” রোমিলা হাত নাড়িয়ে মৃদুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করে।
“ওহ তুই! মানে তুমি এখানে হঠাৎ ? আমি তো ভাবতেই পারিনি ! ” ছদ্মবিস্ময় আর অভিনয়ের মাঝামাঝি মুখে একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে সামনে এসে সে দাঁড়ায়।
রোমিলাও দু চোখ ভরে তার মৃদুলদা’কে জরিপ করে। ” আমার ছেলেকে সমীরস্যারের কাছে অঙ্ক করাতে আনি সপ্তাহে তিনদিন।একদিনও তোমায় দেখতে পাইনি তো ! তুমি নিজে কোথায় থাক বলোতো আজকাল?”
মৃদুল ধীর গলায় বলে “কোথায় আবার এখানেই ! বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছিল বছরখানেক আগে চৌবাগা মোড়ে। তখন থেকে বাঁ পাটায় আর জোর পাইনা। ভেলোরেও দেখিয়েছিলাম। ওই একরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছে আর কি !”
” মাসিমা কেমন আছেন? তুমি বিয়ে করেছ?” রোমিলা আসলে দ্বিতীয় প্রশ্নেরই উত্তরেরই প্রত্যাশী হয়ে প্রথম প্রশ্নটা করে তার গলার কাছের উৎকন্ঠাটাকে সে চাপা দেয়।
” করেছিলাম ! টেকেনি। যূথীকা এখন আলাদা থাকে নন্দীবাগানের দিকে। বিধবা মা, পাগল দাদা, অল্প বিত্তের সংসার, এত কিছুর বিসদৃশ বেমানান বন্ধনে সে হাঁপিয়ে উঠছিল, থাকতে পারেনি।”
মৃদুলের গলায় ছাতিম ফুলের বুনো গন্ধের মনখারাপটা যেন ভেসে আসে। ” দাদার মাথাটা তো আর ঠিক হল না কোনওভাবেই। কেবল ছবি আঁকতে এখনো চেষ্টা করে যায় আঁকিবুঁকি হিজিবিজি কেটে। মা এখনো শক্তপোক্ত আছেন, তাই দুবেলার রান্নাবান্নাটা চলে যায়।”
রোমিলা সেই উদাসী শরতের পুষ্পাঞ্জলির সকালটায় পাঞ্জাবী গায়ে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মৃদুলকে আজকের মৃদুল’দার সঙ্গে মেলাতে পারেনা কোনওমতেই। অবশ্য ও নিজেও তো অনেকটাই বদলে গেছে সময়ের সাথে। তবুও বুকের মধ্যে সময় এসে নখ দিয়ে আঁচড়ায়। পেঁজা তুলোর মতো স্মৃতির মেঘ গুলো এখনো ভাসমান। হাত বাড়ালেই যেন ধরা যাবে । কিন্তু আজকে মুঠো গলে সব ছড়িয়ে পড়েছে স্বাভাবিক কারণেই।
‘আমি আসি তবে ! ভারী জিনিস নিয়ে একটানা দাঁড়াতে কষ্ট হয়। এগুলো রেখেই আবার দোকানে বসব। একটা স্টেশনারী দোকান আছে আমার, বাড়ির নীচটায়। ‘ মৃদুলের কথায় যেন আলগা বিষণ্ণতার আমেজ।
রোমিলাও হাতঘড়িতে সময় দেখে। আর পাঁচ মিনিটের পর শুভর ছুটি হবে। নিরুত্তর মুখে সেও উশখুশ করে।
দীর্ঘ ছায়া ফেলে মানুষটা ততোক্ষণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ল্যাম্পপোস্ট এর মৃদু আলো পার করে বাড়ির পথে চলে যায়। তার সেই অপসৃয়মান ছায়াটিতে রোমিলাদের ফেলে আসা কৈশোরবেলার পুষ্পাঞ্জলির রূপকথাগুলোও আবর্তিত হতে থাকে চক্রাকারে।
যদিও হাতের মুঠো থেকে আজ সত্যিই সব গলে গেছে সময়ের অবহেলায়।
–~০০০XX০০০~–