“কোথা তুমি প্রাণধন..”
————————–
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
(১)
‘মনপুর হতে আমার হারায়েছে মন/
কাহারে কহিব, কারে দোষ দিব/
নিলে কোন্ জন।
এই গানটাই গুনগুন করতে করতে কাল রাতে লিখে সুর বসিয়েছেন নিজেই।শেষরাতে শয্যাত্যাগ করে রামনিধি ধীরে ধীরে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে সূর্যোদয়ের এই নিভৃত ক্রম উন্মেষ মুহূর্তটি তাঁকে আজকাল বড় টানে। অথচ কদিন আগেও এই বৈরাগ্যের বদলে ঘরগৃহস্থালীতে একেবারে পূর্ণ ছিলেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মনোরমার চোখের সামনে তিনদিনের ভিতর ভেদবমিতে মৃত্যু হয়ে তাঁর এই খেলাঘরটির সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে। অথচ একদা নিজে বেলা করেই নিদ্রাভঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন। গৃহিণীর আদরযত্নে অভাবের সংসারটিও আনন্দময় ছিল। মনোরমার চলে যাওয়ায় অতিপরিচিত নিজের ঘরটিকেও আজকাল বড় শূন্য মনে হয়। এই অবস্থায় সঙ্গীত ছাড়া আর কিছুই তাঁর মনকে সান্ত্বনা দিতে অক্ষম।
এরপর হাতমুখ ধুয়ে একটু গঙ্গার ধারটাতে এসে বসলেন। এত ভোরে স্নানার্থীদের আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। জয় রাধে! জয়রাধে! গাইতে গাইতে সঙ্গে টুংটুং করে খঞ্জনীটি বাজিয়ে দীনু বোষ্টম বৈতালিকে বেরিয়েছে। ঝপ্ ঝপ্ করে কয়েকজন কিশোর ঘাটের পাড় থেকে জলে লাফিয়ে পড়ল। একদিকের ঘাটে দু’একজন ব্রাহ্মণ সূর্যপ্রণাম করছে। আজ পূর্ণিমাতিথি বলে কুমোরটুলির ঘাটে একটু পর থেকেই ভীড় বেড়ে যাবে। ঘাটের উত্তর দিকে দাশু ময়রা ততোক্ষণে চালার ঝাঁপ তুলে উনুন ধরাতে ধরাতে ওঁকে দেখে দন্ডবৎ করে বলল –
” খপর শুনেচেন দা’ঠাউর! জোড়াসাঁকোয় দ্বারিকা ঠাকুরের ঘরে কাল রাজপুত্তুর জন্মেচে! তাই আজ অন্নছত্তর খুলেচে ও বাড়িতে…যাবেন নাকি একবার?শুনতে পেলাম দেদার নুচি ছক্কা আর মন্ডা মেঠাইএর মোচ্ছব হচ্চে যে!” পীরেলির বামুন বলে ব্রাহ্মণ বলেও কদিন আগে পর্যন্ত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরমশায়দের ঘরে অনেকেই জল পান করতনা। আজকাল অর্থ আর প্রতিপত্তি বড় বালাই। বড়লোকিয়ানা দেখাতে তাঁর ছেলে হয়েছে বলে দ্বারকানাথ যখন জাঁক করে কাঙালীভোজন করাচ্ছেন তখন হা’ ঘরে বামুনকায়েতের দল মনে মনে নিন্দেমন্দ করলেও একবার অন্তত সেখানে গিয়ে জুটবেই! শুধু খাবেই না, ছাঁদাও বাঁধবে।
রামনিধি ঈষৎ আনমনা হয়ে দাশু মোদকের কথাগুলোকে একরকম অগ্রাহ্য করেই খানিকটা হেঁটে মিত্তিরদের রাসমঞ্চের দিক থেকে এক পাক ঘুরে এলেন।ক’মাস হল একটা ছটফটানি আজকাল মাথার মধ্যে ঘুরছে আর সেইটাই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।সেজন্যই তো ছাপরার পাট চুকিয়ে হুগলীতে ফেরা আর তারপর তো সব চুকিয়ে কলকাতায় অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন। সবার মুখে শুনেছিলেন কলকাতায় নাকি কালোয়াতি গান বাজনার কদর আছে। কিন্তু নাঃ! হাফ আখড়াই আর কদর্য খেউড় ছাড়া সাধারণের সঙ্গীত রুচিটি বড় নিম্নমানের। অবশ্য ডিহি কলকেতার কয়েকজন জমিদারবাবুদের ঘরোয়া মজলিশি আসরে যে একদম ভালো গান হয়না তাও নয় , কিন্তু তার পরিমাণ বড় অল্প। ওতে রসিকজনের মন ভরেনা। এই সেদিন গোবিন্দমিত্তিরমশায়ের নাটমন্দিরে কবির লড়াই শুনতে গেছিলেন। একেবারে জঘন্য সে সব। ইতরজনের মত আদিরসের রঙ্গকথায় রামনিধির রুচিবোধ বিপন্ন হয়। শৃঙ্গারের গানই যদি গাইতে হয় তার একটা বাগবৈখুরী থাকবে না! তাও কি হয় নাকি!
রামনিধি ক্রমশ নিজের কাছ থেকে নিজেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আসলে। বসনভূষণ আর চেহারাতেও সেই যত্নহীনতার ছাপ পড়েছে।
**********************
(২)
তিনমাস আগে….
———-/—————
ছাপরার কালেক্টরীতে আজ ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন রামনিধি। নাহ্ এভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে আর চলা যাচ্ছেনা। চাকরীর ব্যস্ততায় তিনমাসে একবার হুগলী আসতে পারেন। এদিকে স্ত্রী মনোরমা এখন অন্তঃসত্ত্বা। বেচারি বামুনদিদির উপর ভরসা করে সংসার চালাচ্ছে। শুধু কটা টাকা পাঠালেই কি আর পুরুষমানুষের দায়িত্বটা শেষ হয়ে যায়! অবশ্য স্ত্রী ছাড়াও রামনিধির আরেকজন প্রেয়সী আছে। সে হল সঙ্গীত। তার প্রতিও নানা গন্ডোগোলে ঘোর অবিচার করা হচ্ছে। এতদিন ছাপরায় মহাজনটোলিতে খেয়াল গায়ক ওস্তাদ নিসার খাঁর কাছে নাড়া বেঁধে শোরী মিঞার টপ্পা আর খেয়াল শিক্ষা করছিলেন। কিছুদিন সেসব ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন সেখানেও গোল বাঁধল। রামনিধি বাংলাভাষায় টপ্পা বা খেয়াল গাইতে চান শুনে ওস্তাদজী গেলেন ভয়ানক ক্ষেপে। কিছুতেই তিনি তাঁর ঘরানাকে ইবলিসের কাছে বেইজ্জত করতে দেবেন না বলে নিজের হাতে রামনিধির নাড়াটি ছিঁড়ে দিয়েছেন। ওস্তাদজীর মতে বাংলার মত প্যানপ্যানে ভাষায় কালোয়াতি গান হতেই পারেনা। বাংলাদেশে প্রচলিত ওইসব কীর্তনটীর্তন আবার কোনো গান নাকি! সক্রোধে পায়ের লপেটাটি সজোরে রামনিধির মুখে ছুঁড়ে মারলেন ।
********************
ডেপুটি কালেক্টর ক্যাপ্টেন রিচমন্ড্ সাহেব নিজের বাসায় রামনিধিকে ডেকে পাঠালেন। এই নেটিভটি হুট করে চাকরী ছেড়ে দেওয়ায় নিজেও অবাক হয়েছেন। এই বাজারে মাসিক তেরো সিক্কার চাকরী তার সাথে আবার উপরিও আছে তবুও কিসের জন্য রামনিধির মত এক বাঙালী গৃহস্থ চাকরী ছেড়ে অনিশ্চয়তায় পা বাড়াতে চাইছে?
এই কমাসে রামনিধির কাছে পঞ্চাশ সিক্কা জমেছে। এছাড়া সম্বল বলতে একখানি তানপুরা আর তবলা জোড়া। নৌকো করে ছাপরা থেকে গুপ্তিপাড়া পৌঁছাতে দিন সাতেক লাগবে। তা লাগে লাগুক। রামনিধি আপাতত গানের দরিয়ায় নতুন উদ্যমে উজান বাইতে চায়।
*******************
হু হু করে জোলো হাওয়া আসছে পুবদিক থেকে। শোবার ঘরটি প্রায়ান্ধকার। একটি রেড়ির তেলের প্রদীপ দমকা বাতাসে নিবু নিবু। মন্দ্রস্বরে তানপুরার তারে অাঙুল বোলাচ্ছেন রামনিধি। যেন প্রেয়সীকে প্রতিটি স্পর্শে সোহাগ করছেন আলতো ছোঁয়ায়। খানিক্ষণ স্বরশুদ্ধি আর আলাপ করে নিয়ে জিভের নীচে একটু এলাচ রাখলেন বটুয়া থেকে বের করে। তারপর গেয়ে উঠলেন – “নানান দেশের নানান ভাষা/বিনে স্বদেশীয় ভাষা, পুরে কি আশা?/কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর ধারাজল/ বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?’ রামনিধি গাইতে গাইতে টের পাচ্ছিলেন তাঁর অন্তরের সুপ্ত ইচ্ছাটিকে। আসলে যে যাই বলুক, একমাত্র মাতৃভাষা দ্বারাই সম্ভব মনের সব ভাব, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, মিনতি বা আবদার নিখুঁতভাবে প্রকাশ করা যায়। ভিনদেশি ভাষার সহায়তায় যদিও সম্ভব মনের ভাব বা ইচ্ছার প্রকাশ ঘটানো তবে তা কিছুতেই পরিপূর্ণভাবে মূর্ত হয় না। পরিপূর্ণ ও নিঁখুত প্রকাশশৈলীতে তা উত্তীর্ণ হতে গেলে প্রতিটি শব্দ, বাক্য সবটাই মাতৃভাষায় উচ্চারণ করতে হবে। নইলে সে ভাবপ্রকাশ অসম্পূর্ণ!
টের পাননি কখন রিচমন্ড্ সাহেব ঘরে এসে চুপটি করে তার সাধনার ধারাটিতে ডুব দিচ্ছিলেন। সাহেব ভাঙা ভাঙা বাঙলা বলতে শিখেছেন যদিও ফারসী আর হিন্দিটা ভালোই বলেন তবুও এখনো উচ্চারণকালে ‘ট’ বর্গীয় শব্দের বেশ হাস্যকর উচ্চারণ করে থাকেন।
হঠাৎ ওদিকে চোখ পড়তে রামনিধি তানপুরা নামিয়ে করজোড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
রিচমন্ড্ সাহেব ধীরপায়ে রামনিধির দিকে এগিয়ে এসে ওঁর হাতটা আলতো করে চেপে ধরলেন। সাহেবের দু’চোখ ছলছল করছে। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সাহেব বললেন – ” হেই বাবু! হামি টুমার ল্যাংগোয়েজ বুঝিটে পারি নাই! বাট্ টুমার ডেডিকেশন টুক মাই মাইন্ড ইনটু অবলিভিয়ন্! আই উইল নট রিকোয়েস্ট টু ইউ টু স্টে ব্যাক হিয়র্। প্লিজ্ গো অ্যাহেড ডিয়ার ফ্রেন্ড। ইউ উইল হ্যাভ আ ব্রাইট ফিউচার ইন মিউজিক….মে দ্য গড্ ব্লেস ইউ…!
********************
বর্ধমানের রাজার নাতির মুখেভাত উপলক্ষে লাটবাহাদুরকে নেমন্তন্ন করে বিরাট মজলিশ বসেছে কলকাতায় । মূর্শিদাবাদের স্বনামধন্য জমিদার মহানন্দ রায় রামনিধিকে সঙ্গে করে এনেছেন এই আসরে। মহানন্দ রায় রসজ্ঞ ও সঙ্গীতের সমঝদার। পূর্ণিয়াতেও ওঁদের দেওয়ানীর মহাল আছে। সেবার ছাপরাতেই রামনিধির গান শুনে টুনে একেবারে মোহিত হয়ে বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন। আদর করে তিনি রামনিধি কে ‘নিধু বাবু’ বলে আসরে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রামনিধি সঙ্গীতচর্চা করলেও বড়মানুষের এমন আসরে কখনো গান করেন নি। ঝলমলে ঝাড়বাতির নীচে পুরু লাল রঙা জাজিমের ওপর বসে এইভাবে গাইতে হবে, ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। অবশ্য বন্ধুকৃত্যে এসব ভয় টয় পেলে চলেনা। খানিকটা সাহস বুকে করে আর রাজা মহানন্দের মান রাখতেই আসরে এসে বসলেন তিনি। সিন্ধু কাফিতে তানপুরা বেঁধে গেয়ে উঠলেন –
” আমি আর পারি না সাধিতে এমন করিয়ে |
কত মত কহিলেম মিনতি করিয়ে ||
তাহার কি করি বল, না শুনে শুনিয়ে |
যত দুঃখ মোর সখি তাহার লাগিয়ে ||
বৃথায় কি ফল বল সে কথা কহিয়ে……..”
এমন গান এর আগে গোটা বাংলাদেশে কেউ শোনেনি। টপ্পার মেজাজে এমন কোমল বুলি? তানকর্তব থাকলেও তা যেন বুকের ভিতরটা মুচড়ে দিচ্ছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা মিশ্রিত ভাললাগায়। আসরে সবাই চুপ। রাজাবাহাদুর গজমোতির মালা নিজের কন্ঠ থেকে খুলে রামনিধির গলায় পড়িয়ে দিলেন সাশ্রুনয়নে।
************
রামনিধির এখন বেশ নাম ডাক হয়েছে, শ্রোতা হয়েছে, কিঞ্চিৎ অর্থযোগে অবস্থারও উন্নতি ঘটেছে। বাগবাজারের রসিকচাঁদ গোস্বামীর বাড়িতে আজকাল রোজই আসর বসে।
‘নিধু বাবু’ নামেই তিনি আজকাল বিখ্যাত ও সম্মানিত। কদিন আগেই শোভাবাজারের রাজবাড়িতেও বিজয়ার দিনে গান গেয়ে এসেছেন তিনি। ছাপরার ঘরে বসে যে স্বপ্ন একদিন দেখেছিলেন যে মাতৃভাষায় সঙ্গীতসরস্বতীর সেবা করবেন তা আজ সফল হয়েছে। কিন্তু এবারে চাই সেই সৃষ্টির পরম্পরাসাধন। নিজে গাইলেই শুধু হবেনা, উপযুক্ত আধারে ঢেলে যেতে হবে এই প্রাণসুধা। ভবিষ্যত কি ভুলে যাবে এই গায়নরীতি?
কে আসবে তাঁর সঙ্গীতকে আপন করে নিতে? রাতে চোখ বুজলে একটি নারীর মুখ ভেসে ওঠে। বড় চেনা আর শ্রীময়ী সেই দৃষ্টি। কিন্তু কে সে রমণী? নারীটি যেন এই গীতসুধারসে ডুবতে চাইছে কিন্তু লোকলজ্জায় ওঁর কাছে আসতে পারছেনা। সেই অদেখা অজানা নারীটিকেই নিয়ত খুঁজে চলেছেন রামনিধি। একবারও কি ইহজীবনে দেখা হবেনা তাঁদের? তাঁর অসমবয়সী এই প্রেমের প্রতিদানে সেও কি ওঁকে একটুও ভালবাসবেনা ? কোথায় থাকে সে? কিছুই তো জানেন না তিনি।
গঙ্গার ঘাটে গোধূলির গৈরিক বিকেল আলো ছড়িয়ে দিনান্তের ঘোষণা করছে। চবুতরা থেকে উঠে বাড়ির পথ ধরলেন রামনিধি। এইমাত্র একটা গান খুঁজে পেয়েছেন কালাকালের স্রোত থেকে। এখুনি না লিখে ফেললে সুর আর কথা দুটোই হারিয়ে যাবে। সুরটা আগে ভেবে নিলেন।
এরপর তাতে কথার সাজ পড়াতে পড়াতে চলতে লাগলেন রামনিধি গুপ্ত-
” সে কেন রে করে অপ্রণয় ও তার উচিত নয়। জানি আমি তার সনে কভু ত বিচ্ছেদ নয় ॥ কখন কি বলেছি মানে, আজ কি তা আছে মনে, তা বলে কি মানে মানে অভিমানে রইতে হয়। সখি গে৷ আমার হয়ে, বল তারে বুঝাইয়ে, পীরিতি করিতে গেলে সুখ দুঃখ সব সয় ॥ দিনান্তে প্রাণান্ত হ’ত, একবার যদি দেখা দিত, তবে কেন অবিরত হৃদয়-মাঝে উদয় হয়…”
–~০০০XX০০০~–