“ফিরে দেখা (প্রথম পর্ব)”
✍ কাকলি ঘোষ
আমাদের ছেলেবেলায় চারপাশে নাটক, থিয়েটারের একটা আবহাওয়া ছিল। প্রায়ই শুনতাম অমুক ক্লাব নাটক আয়োজন করেছে,অমুক সংঘ টিকিট বিক্রি করতে এসেছে। কলকাতা থেকে কী সব কুমার নামধারী বিশেষ বিশেষ শিল্পীদের আগমন হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর যাত্রার তো কথাই নেই। চারদিক খোলা মঞ্চে সামনে বসে যাত্রা দেখার সে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা যারা কখনো দেখেছেন তারাই বুঝবেন সেই অনুভূতি। যাত্রা শুরুর আগে সেই রক্তে দোলা লাগানো কনসার্ট ! বুকের ভিতর কী উত্তাল ঢেউ! বিস্ময়, মুগ্ধতা,আনন্দ যেন মিলেমিশে একাকার।
এই সব কিছুর মধ্যে বড় হয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম বাংলা খাতায় প্রশ্ন উত্তরের বদলে নাটক লিখেছি। সেই বয়সে এই আবিষ্কার কলম্বাসের আবিষ্কারের চেয়ে কম বলে বোধ হয় না। মা এর হাত ঘুরে সেই নাটক যখন বাবার হাতে পৌঁছালো , ভেবেছিলাম এবার আর রক্ষা নেই। শুকনো কাঁচুমাচু মুখে মাথা নীচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন ভাবছি মাটিটা এবার ফাঁক হয়ে গেলে কেমন হয় ; আর কিছু না হোক সদ্য দেখা রামলীলার সীতার পাতাল প্রবেশের মতো একেবারে নাটকীয় ভঙ্গিতে মা’র এই নিদারুন,অকারন শত্রুতার একটা যোগ্য জবাব অন্তত যে দেওয়া হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঠিক তখনই বাবার অবাক জিজ্ঞাসা ‘এ নাটক তুমি লিখেছো? ‘. কোন উত্তরে বাবা সন্তুষ্ট হবে বুঝতে না পেরে ফাঁপরে পড়ি। শেষে মরীয়া হয়ে সত্যি জবাব টাই দিয়ে ফেলি। আর অবাক চোখে দেখি স্বভাব গম্ভীর বাবার মুখে অনাবিল প্রশ্রয়ের হাসি।
‘আরো লেখো। যা মনে আসে তাই লেখো।’ ব্যাস! ঢালাও হুকুম ! চালাও পানসি! খাতা দ্রুত ভরে উঠতে লাগল। নাটক আর নাটক। কিন্তু শুধু লেখাতেই তো লেখিকার মন ভরে না। নাটক যদি অভিনয় না করা যায় তবে নাটক লেখার সার্থকতা কোথায় ? অতএব এবার অভিনয়ের ব্যবস্হা দেখতে হয়।
আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় খেলুড়ের অভাব ছিল না। এখনকার মত তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশান, কম্পিউটার, মোবাইল ছিলো না। একই সঙ্গে ছিলো না ভিডিওগেমস বা নানা আধুনিক খেলার উপকরন। ছিল চোরচোর(চোচ্চোর) , ধাপ্পা, বুড়িবসন্ত , ছোঁয়াছুঁয়ি এইসব গ্রাম্য খেলা। আর এর জন্য প্রয়োজন হোত একপাল ছেলেপুলে। তা বলতে নেই মামাতো, পিসতুতো,পাড়াতুতো মিলে দলটা আমাদের বেশ পরিপুষ্টই ছিল।
এইরকমই খেলার ছলে একদিন প্রস্তাব দিলাম. নাটক করলে কেমন হয়? এও তো কম মজার খেলা নয়!
সত্যি বলতে কী কোন খেলাতেই আমি সেরকম পটু ছিলাম না। কিন্তু আশ্চর্যভাবে সবকিছুরই নেতৃত্ব থাকত আমারই হাতে। কেন, কীভাবে, আর কোন গুনে যে সবার উপর ছড়ি ঘোরানোর অধিকার পেয়েছিলাম আজ তা বলতে পারব না। কিন্তু এমন অধীনস্হ ,বাধ্য, বিনীত একটি দলের নেত্রী ছিলাম যাকে দেখলে রাজা মহারাজারাও হিংসে করতে বাধ্য হবেন।
(এরপর ….ক্রমশ…)