“অ্যামেচার”
✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
গত এক সপ্তাহ ধরে পলাশপুর গ্ৰামে সাজো সাজো রব।ছেলে, বুড়ো, বৌ, ঝি, সবাই মেতে উঠেছে। নিস্তরঙ্গ গ্ৰাম্য জীবনে আনন্দের ঢেউ। কত অভাব অভিযোগ গাঁ এর এই মানুষ গুলোর। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে কলহ বিবাদের শেষ নেই। তবে রাসপুজো এখানে নতুন বার্তা আনে।
শান্তিপুরের নিকটবর্তী এই গ্ৰাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। কত যুগ আগে থেকেই এখানে যাত্রা হয়। এখান কার লোকেরা বলে অদ্বৈত মহারাজ চালু করেছেন এই প্রথা ।
নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবা দেবীর এক মণ্ত্রশিষ্য এই অঞ্চলে বাস করতেন। তাঁর বংশধর দের মধ্যে এই যাত্রা ব্যাপারে বিশেষ আগ্ৰহ। খরচাপাতির সিংহভাগ এই বাবুরাই বহন করেন। ওদের ছেলেরা সব ভিনদেশে থাকে। তবে কৌলিণ্য আর প্রথা অনুযায়ী জড়ো হয় রাসপুজোয়। এবারে পাঁচদিন টানা যাত্রা হবে। সব অ্যামেচার পার্টি।
ভূবন জেলে গঙ্গায় মাছ ধরে। ওর মা চিন্ময়ী বাবুদের বাড়ির খাস ঝি। ছোটোবাবু চিন্ময়ীকে বলল “যা টাকা চাঁদা উঠেছে তাতে পাঁচদিন যাত্রা হবে কী করে? ভূবণ কে দেখা করতে বোলো। ছেলের গর্বে মুখে হাসি আর ধরে না।
এবারে বাইরের অ্যামেচার পার্টির সাথে গ্ৰামেও একটা দল আছে। তবে ফিমেল আনতে গেলে টাকার সঙ্কুলান হবে না।বেড়ে ফিমেলের পার্ট করে ভূবণ। আগের বারে জয়দেব পদ্মাবতী পালায় যখন স্টেজে উঠেছিল তখন ছোকরাদের দলে আলোড়ন পরে গিয়েছিল। এমন সুন্দরী ওরা নাকি দুটি দেখেনি। যাকে বলে পীনোন্নত পয়ধরম্। পরের দিন খুব হাসাহাসি হয়েছিল মেয়েমহলে। বিশেষ করে ঘাটে বাসন মাজতে মাজতে খিলখিল করে হাসছিল মালতী। ভূবণ বলেছিল এই হাসির জবাব তোকে পরে দেবো।
বড়বাবু ভূবণ কে দেখতে পেলেন গঙ্গার ঘাটে ওর ডিঙিতে।বললেন “ওরে! ও ভূবনো। তোকে ছোটোবাবু ডেকেছে। ভূবন হেসে কাছে এসে পেন্নাম ঠুকে বললো জানি গো বড়ঠাকুর। ফিমেলের পার্টে অ্যাক্টো করতে হবে। এই কতা তো। বড়ো বাবু বললেন সখী নাচটাও করিস। দাঁত বের করে হাসতে থাকে ভূবন। বড়ো বিনয়ী ও। বড়ো বাবু মাঠের দিকে গেলেন। ভূবন তাকিয়ে থাকে ওই পথের দিকে।
মালতী এই গাঁ এর মেয়ে। শহরে বিয়ে হয়েছিল। বর্তমানে বিধবা হয়ে গ্ৰামে স্থিতু হয়েছে। চাল নেই চুলো নেই।বদমেজাজি মাতাল স্বামীর সাথে যে কয়েকদিন কাটিয়েছিল তাতে তাকে আইবুড়ি বলাই শ্রেয়। তবু সকলের চোখে ও বিধবা। ওকে খিলখিল করে হাসতে নেই।সাজগোজ করতে নেই। পরপুরুষের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে নেই। ওর জীবনে এখন সবার হস্তক্ষেপ। গেল গেল রব। কোন ছোঁড়ার মাথাটা চিবিয়ে খাবে। মহিলা মহলে কিছু দারোগাগিন্নী আছে। যাদের অবসর বিনোদনে মালতী মুখরোচক আলোচনা।
মালতী এই সমাজ টাকে ধিক্কার দেয়। বড়োবাবুর মতো মানুষ ছিল বলেই ও বেঁচে আছে। স্বামী চলে যাবার পর সবাই যখন দূরে চলে গিয়েছিল তখন তো বড়োবাবু মালতীকে ডেকে বললে “মালু! গঙ্গার ধারে যে খাস জায়গাটা আছে তাতে তুই ঘর বেঁধে থাক ।তোর বাপ আমার সমবয়সী । সে যখন বেঁচে নেই তখন আমিই তোর বাপ ।তোর গায়ে কাঁটার আঁচড়টি লাগতে দেবো না” ।
বড়ো বাবুর পা দুটোকে ধরে মালতী কেঁদেছিল অঝোর ধারায় । বলেছিল “ঠাকুর দেবতা তো দেখা যায় না ।তুমিই ঠাকুর। এমন হৃদয় গড়ে তিনি তোমাকে মর্তে পাঠিয়েছেন ।
ভূবনের মা চিন্ময়ী মালুকে ভালোবাসে । ছোট্টবেলা ভূবন আর মালতী চন্ডীমন্ডপে পড়তে আসতো । সকাল বেলা ওখানে পাঠশালা বসতো । চিনু খুব ভোরে বটগাছের নীচে এই চন্ডীমন্ডপ পরিস্কার করতো । গাঁ এর সব পালা পার্বন এই জায়গায় । আবার সন্ধ্যেবেলা মোড়ল দের চুলোচুলি।কান পাতা দায় ।
চিন্ময়ী কতদিন ভেবেছে মালু হবে ভূবনের বৌ । কত মিষ্টি সম্পর্ক ।তারপর কোথা দিয়ে কী যে হয়ে গেল ।কালবৈশাখী ঝড়ের মতো দুষ্ট রাহু তছনছ করে দিল দুটো জীবন ।ভূবনটার মনে আর কোনো নারী প্রভাব ফেলতেই পারলো না ।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো চিন্ময়ীর ।দুইহাত জোড় করে বলতে লাগলো ওদুটোকে তুমি দেখো ঠাকুর ।
ভূবন আর মালতীকে নিয়ে কানাকানি চলে ।মালতীর দাদা বৌদি যারা মালতীকে ঘরে ঠাঁই দেয়নি তারা উঠেপড়ে লেগেছে মালতীকে অপদস্থ করতে ।সাথে দোসর কুট্টিনিরা ।কায়স্থ ঘরের মেয়ের জেলের ছেলের সাথে মাখামাখি অসহ্য ।তায় আবার বিধবা ।
এবারের যাত্রাপালা হবে অহল্যা ।গ্রামের কিছু মাতব্বর যাত্রা জগতের সম্রাজ্ঞী মিস সোনালী র সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দশহাজার টাকা নেবেন বলেন ।শেষপর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় ।ভূবনের আশ্চর্য এলেম আছে ।কদিনেই বেশ গড়গড় করে পাঠগুলো বলছে ।
ডিঙিনৌকোটা নোঙর করে মালতীর রোয়াকে এসে বসে ভূবন ।বড়ো টান ওই চোখদুটো তে ।মনে মনে কত কী ভাবে ভূবন ।মালতী চা করে ।পাঁপড় ভাজে ।দুজনের মনে আনন্দধারা ।হাসি ঠাট্টা চলতে থাকে ।সেই এক বছর যাত্রাপালার কথা ।গ্ৰীনরুমে বসে বিড়ি খাচ্ছিল হনুমান বেশী সোমনাথ কাকা ।যেই স্টেজে উঠতে হবে বিড়িটা ফেলতে ভুলে গিয়েছিল ।আর একবার রাজা সেজে সমীর কাকু হাত পা নেড়ে আস্ফালন করতে করতে ইলেকট্রিক তার এ হাত লেগে কেমন শক খেয়েছিল ।আর সেই যে যাত্রাপালায় বন্দুকে করে মেরে ফেলার বদলে তরবারি দিয়ে মারতে হল ।তাড়াতাড়ি করে বন্দুক নিতে ভুলে গিয়েছিল ভূবন ।অথচ বন্দুকের আওয়াজ বোঝাতে বাইরে দুম করে বোম ফোটানোর আওয়াজ ।
মালতীর হঠাৎ মনে পড়ে যায় গিরীন কাকার কথা ।হাসতে হাসতে তার চোখে জল চলে আসে ।বুড়ো বয়সে ফিমেলের পার্ট ।তাও আবার রাজকন্যা ।দুই রাজা সুন্দরী সুন্দরী করে ডাকছে ।রাজকন্যার গোঁফ দাড়ি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।
মালতীর প্রাণখোলা হাসি ভূবন কে অস্থির করে তোলে ।অনেক টা কাছে গিয়ে মালতীকে শুধায় সেই ছোট্টবেলার খেলনাবাটির মতো আমরা বর বৌ হতে পারি তো ।লজ্জা আর ভয়ে কুন্ঠিত মালতী ছুট্টে পালায় ।এ কী বলছে ভূবন ।সমাজ তার দিকে দন্ড উঁচিয়ে আছে ।কামনা বাসনা সব জলাঞ্জলি দিয়েছে সে ।ভীত হরিণীর মতো ছুট্টে পালিয়ে যায় ।
বড়োবাবুর সাথে ভূবন সাজঘরে গিয়েছিল ।ফেরার পথে মালতীর জন্য একটা লাল শাড়ি কিনলো ভূবন ।খুব সুন্দরী দেখাবে ওর মালুকে ।তারপর একদিন বুড়োশিবের থানে সিঁদুর পরিয়ে রাঙা বৌ করে দেবে ।ফেরার পথে এইসব জিনিস কেনার অর্থ বড়োবাবুর বুঝতে বাকি থাকে না ।ভূবনটার প্রতি ভালোবাসাটা দ্বিগুণ হয়ে যায় ।রাস্তার পাশে দোকানে তখন গান বাজে “ও জীবন জীবন রে
ছাইড়া না যাস মোরে
তুই জীবন ছাইড়া গেলে
মাইনসে কৈবে মড়া জীবন রে ”
ভূবন গান শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যায় ।মনে মনে ভাবে একথা মালতী কে ও কী করে বোঝাবে ।
রাসপুজো থেকে শুরু করে ভাঙারাস পর্যন্ত পলাশপুর সেজে ওঠে ।প্রতিটি বাড়িতে কুটুম আত্মীয়ের ছড়াছড়ি ।সুপ্রাচীন কাল থেকে এই দিন গুলোতে আলু খাওয়া নিষিদ্ধ ।শাক,শুক্তো,অম্বল,পায়েস ,ঘি ভাত ভোগ দেওয়া হয় ।মহাপ্রভু নাকি এগুলো ভালোবাসতেন ।এক একদিন শোভাযাত্রা হয়।সং সাজে ।আর চন্ডীমন্ডপে রাসপুজো হয়।গোটা গ্রাম ভেঙে পরে ।বাবুরা একদিন গোটা গ্ৰামকে খাওয়ায় ।
পুজোর দিন অহল্যা চরিত্রে অভিনয় করবে ভূবন।মালু ভয় খায়।পুজো দেয় ।মনে মনে প্রার্থনা করে ওর ভূবনের যেন বদনাম না হয় ।সকালে ভূবন এলে আদা দিয়ে চা দেয়।গলাটা পরিস্কার থাকবে ।যাত্রা শুরুর আগে গরম এক গ্লাস দুধ নিয়ে খাইয়ে আসে ।
মালুকে নিয়ে শুরু হয় কানাকানি ।এমন ছিনালি গ্ৰামে বসে চলতে পারে না ।এ নোংরামি র শেষ দেখবে ওরা ।এদের কিছু কথা ভূবনের কানে যায় ।চোয়াল টা দৃঢ় হয়ে ওঠে ।এদিকে যাত্রার বাঁশি শুরু হয়ে যায় ।
আজ ভূবন অহল্যা সেজেছে ।পুরুষ শাসিত সমাজ যার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছিল কলঙ্কের বোঝা ।আবার আর এক পুরুষ রামচন্দ্র ।তাকে উদ্ধার করে ।ভূবনের বার বার মনে হয় মালু হলো অহল্যা ।অসহায়,নিষ্পাপ আর নিষ্কলুষ ।ভালোবাসার আবেগে যখন অহল্যারূপী ভূবন আকুল তখন ধন্য ধন্য পরে গেল ।এমন হৃদয়স্পর্শী অভিনয় ।কে বলে অ্যামেচার ।অভিনয় শেষে ভূবনে পোশাকে সেফটিপিন করে টাকা এঁটে দিল অনেকেই ।
যাত্রা শেষ হল ।কিন্তু আশ্চর্য।মালু তো এখানেই ছিল ।গেল কোথায় ।সন্দেহ দানা বাধলো ।বাক্যবাণে বিদ্ধ মালু চলে গেছে ।ভূবনের বুঝতে বাকী থাকলো না ।ছুট্টে চলে গেল মালতীর বাড়ি ।অভিমানে বিছানায় উপুর হয়ে কেঁদে কেঁদে বালিশটাও ভিজে গেছে। হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এল চন্ডীমন্ডপ তলায়। যেখানে গোটা গ্ৰাম এইমাত্র হয়ে যাওয়া যাত্রা নিয়ে আলোচনা করছে । অহল্যার উপরে ঘটে যাওয়া অন্যায় নিয়ে আস্ফালন করে।যারা একটু আগে মালুকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছিল।
এদিকে আরেক চমক। পুজো মন্ডপে নিয়ে এসে মালুর সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছে ভূবন ।এখন ভূবন জেলের স্ত্রী মালু।অশ্রুজলে সিক্ত চোখ দিয়ে মালু ভূবনকে যখন দেখছিল তখন তাকে রামচন্দ্র মনে হচ্ছিল ওর।
◆◇◆◇◆◇◆◇◆◇◆
◆◇◆◇◆