নিলয় বরণ সোম
লেখক পরিচিতি :-
নিলয় বরণ সময়ের জন্ম ত্রিপুরার সালেমায়। স্থায়ী নিবাস কলকাতা।বিদ্যালয় শিক্ষা পিতার কর্মসূত্রে ত্রিপুরার মফস্বলের বিভিন্ন স্কুলে। উচ্চতর শিক্ষা কলকাতার দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে , স্নাতকোত্তর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৯০ সাল থেকে আয়কর বিভাগে কর্মরত।
শৈশবে লেখালেখি শুরু করলেও কলেজ জীবনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপিকা মৈত্রেয়ী সরকারের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় ছোটগল্প লেখা শুরু ,বর্তমানে মূলত রম্য রচনায় ব্যাপৃত, অনুবাদেও উৎসাহ আছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ,সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবজিনে লেখকের লেখা প্রকাশিত।
সৃজনাত্মক লেখালেখির পাশাপাশি আয়কর আইন সম্বন্ধে বিভাগীয় পুস্তিকা ও ওয়েবজিনে লিখে থাকেন। লেখালেখি ছাড়া পড়াশুনা , আড্ডা ও গান শোনায় আগ্রহী।
“অথ বাঙালীকথা”
আমরা বড় হয়েছি পাঞ্জাবিদের সম্বন্ধে নানাবিধ রসিকতা শুনে I সান্তা সিং বান্তা সিং হাল আমলের ব্যাপার , কিন্তু বারোটা বাজলে যে পাগড়ির মোড়কের নীচে ‘কী এক চঞ্চলতা জাগে ‘ সে সম্বন্ধে আমরা কিশোর বয়স থেকেই ওয়াকিবহাল I আমাদের বাপ ঠাকুরদারা এসব রসিকতার ব্যাপারে আরো উদারমনস্ক ছিলেন, অর্থাৎ পক্ষপাতহীন ভাবে তারা আজকের ভাষায় ‘ইউপিয়াইট’ ,অথবা সাধারণ ভাষায় বিহারী , উৎকলবাসী বা বিন্ধ্যপারের বাসিন্দা , সর্বজনীনভাবে ‘ মাদ্রাজী’ কাউকেই বাদ দিতেন না I ‘ মাদ্রাজি’ এই সাধারনীকরন ব্যতিরেকে , আর্যাবর্তের বিশেষ বিশেষ প্রদেশের লোকদের বিশেষ বিশেষ নামে অভিহিত করা হত I তবে ‘কানাকে কানা না বলিবার , খোঁড়াকে খোঁড়া না বলিবার ‘ যে পলিটিকাল কার্রেক্টনেসের পরিমণ্ডল আজ গৃহীত ও গ্রাহ্য , সেখানে ওসব অভিধা না উল্লেখ করে ভালোI
এবার যদি বলেন, আপনি মশাই বেশ চালাক তো! বলতে আর বাকি রাখলেন কী!একথা শুনলে আমার অ-সুর কণ্ঠে ‘অনেক কথা যাও যে বলি, কোনো কথা না বলি’ গানটির প্রথম কলিটি গাওয়া ছাড়া আমার আর উপায় থাকবে না I
যাই হোক, বাঙালী যখন এমন নির্দোষ আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত , বাকি ভারত গোকুলে বা উপকূলে সযত্নে লালন পালন করে এক বাঙালী বাবুকে হাজির করলো , যার ‘হ্যায় হ্যায়’ কণ্টকিত হিন্দি বুলি ছাড়াও , চ্যাম্পিয়ন দীর্ঘসূত্রীতা, মানানসই সময়জ্ঞান ও ততোধিক পন্ডিতমন্যতা তাকে, তীর্যকহাস্যে কথিত বা আলোচিত হওয়ার উপাদান করে হাজির করেছে, আপিস কাছারি বা পার্টিচত্বরে I
সুতরাং ব্যাপার গুরুবচন I এরকম বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে সবথেকে সেফ হচ্ছে সেমসাইডে গোল করা I সেই যে বলে না , ইফ ইউ ক্যানট বীট দেম , জয়েন দেম !
সেই মহান উদেশ্যেই বুঝি এক বাঙালী দন্ডায়মান কৌতুকাভিনেতাকে ( stand up comedian ) একটি টিভি শোতে দেখলাম বাঙালীদের নিয়ে জম্পেশ করে হাসি ঠাট্টা করতে I অনুষ্ঠানটি যেহেতু লাইভ ছিল, সুতরাং গোলগাল চেহারার সেই ভদ্রলোক যা বলছিলেন , তাতে যে হাসির হররা উঠছিলো, তা রেকর্ডেড নয় বোঝাই যাচ্ছিল I বলে রাখা ভালো, কিছুদিন আগে অব্দি এই চেহারার বাঙালীদের শাশুড়িরা ‘জামাইয়ের ভালো স্বাস্থ্য বলে গর্ব করতেন !
ভদ্রলোকের প্রথম আক্রমনের ক্ষেত্র ,আপনি ঠিকই ধরেছেন , বাঙালির কর্মসংস্কৃতি I প্রথমে উনি বললেন এক জেরক্স দোকানের কথা I দোকানে উনি তার ঢাউস কোন নথির প্ৰতিলিপি করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই দোকানদার বলে বসেন, “পরে আসুন, দোকান খুলুক আর পর “!ভদ্রলোক নাকি বলেছিলেন, দোকান খোলা দেখেই তো এলাম ! দোকানদার ততধিক বিরক্ত হয়ে বললেন, ” দরজা খোলা মানে দোকান খোলা ! বলছি তো পরে আসুন !” দরজা খোলা ও দোকান খোলার এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কোন সমাধান না করতে পেরে ভদ্রলোক নাকি দরজা পেরিয়ে চলেই গেছিলেনI
স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানের এটি নেহাত গালগল্প কি না জানা নেই, তবে ঘটনাটি অনেকটা সৈয়দ মুজতবা আলির বহুপঠিত এক কাহিনীর মত I স্মৃতি থেকে লিখছি , সুতরাং এক আধটু পদ্মাবতী হতেই পারে !সময়কাল পার্টিশন উত্তর ধর্ম তলার অফিসপাড়া I লেখকের আপিসের কাছে একটি মনিহারি দোকান খুলেছেন, শোনা যায় , ওপর থেকে আসা এক উদ্বাস্তু ভদ্রলোক I কিছুটা কৌতূহলে, কিছুটা উপকার করার বাসনায় , মুজতবা গেলেন সে দোকানে I দেখলেন দোকানদার গভীর ঘুমে নিমগ্ন I অনেক কসরত করে তাকে জাগিয়ে তুলে, তাকে শোভিত সাবানের প্রতি দিকনির্দেশ করলেন, ক্রয়ের বাসনায় I মালিকের বিশেষ ভাবান্তর হল না ,অনেকটা ‘পি পু ফি সু ‘ কায়দায় ( নবীন পাঠক , তুমি যদি গোপাল ভাঁড় না পড়িয়া থাক, ইহার মর্ম তুমি বুঝিবে না !) একটু পাশান্তর করলেন মাত্র I আরেকটু পীড়াপীড়ি করতেই দোকানির উত্তর এলো , ” এই সাবান বিক্কিরির জন্য না ! এমনধারা কান্ড দেখলে ফিলিপ কোটলার সাহেব তার ‘মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টের’ বইতে একটি বিশেষ অধ্যায় যোগ করতেন !
প্রসঙ্গে ফিরি I ভদ্রলোকের দ্বিতীয় আক্রমনের ক্ষেত্র ছিল উচ্চবিত্ত বাঙালীর খুঁতখুঁতে আভিজাত্য I ওঁর বন্ধু নাকি আজকাল যেমন অমুক সিটি তমুক সিটি হয় , সেরকমই কোন বিল্ডিং প্রজেক্টে নিয়ে গিয়েছিলেন I এই সিটি নামের অনুপ্রেরণা অবশ্য হকিন্স কুকার থেকে আসে নি , এককালে বামপন্থীরা কোন সভা সমিতি হলে সেই স্থানটির নাম অমুক নগর বা তমুক নগর দিতেন, সে থেকেও এসেছে কিনা সন্দেহ I তবে সব প্রজেক্টই , এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটি কলকাতার মতই ‘সিটি ‘I
প্রজেক্টের প্রজেক্টের প্রতিনিধি , মানে সাদা কথায়, প্রচন্ড দাবদাহে গলায় টাই নামক ফাঁস ঝুলিয়ে কোনো অনন্যোপায় গ্র্যাজুয়েট ছোকরা , তাকে সোৎসাহে প্রজেক্ট দেখান শুরু করতেই ভদ্রলোক বলেন – ২৩ তলার উপরে কিছু দেখান ! ছেলেটি দ্বিগুন উৎসাহে বলে ওঠে, “আসুন স্যার , ২৪, ২৫, ২৬ তলা সবকটি ওপেন আছে , আপনাকে সাউথ ফেসিং ঘর দেখাচ্ছি !”কমেডিয়ানের বন্ধুবর বলে ওঠেন,আর ২৭ তলা ? ” আমাদের প্রোজেকট তো ২৬ তলা অব্দি” , ছেলেটির কাতরোক্তি ! এবার বন্ধুর বিস্ময়, “ও বাবা, আমিতো ২৭ তোলার বারান্দায় বোগেনভালিয়ার গাছ লাগাব ভেবেছিলাম ! দূর আপনাদের ২৭ তলাই নেই ! তাহলে আর কী হবে !”
অনুষ্ঠানটির শেষ পর্যন্ত দেখা হয় নি, সুতরাং ভদ্রলোক আর কী কী বলেছিলেন, জানি না I অনুমান করতে পারি, বাঙালীর রাজনীতিচর্চা , সংস্কৃতি নিয়ে আকচাকচি বা ক্রিকেটপ্রিয়তা নিশ্চই উনি ছুঁয়ে যাবেন I ক্রিকেট বা বড়সড় কোন ফুটবল ম্যাচ হলে সবচেয়ে মজা হয় পরের দিন বাজার করতে গেলে I দোকানিরা খেলার এমন মাইক্রোএনালিসিস শুরু করে দেন, মনে হয় ট্যালেন্ট হান্ট বাজার থেকেই শুরু হোক না কেন!
তবে বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ দুর্বলতা হল বাঙালীর সর্বজনীন কবিত্বI একসময় বলা হত ,বাঙালী গোঁফ বেরোলেই কবিতা লিখতে শুরু করে I কথাটিতে একটু জেন্ডার বায়াস আছে, বয়ঃসন্ধির চৌকাঠে দাঁড়ান বাঙালী কিশোরীরাও আদি কাল থেকে তাদের মনের ভাব রুল টানা খাতায় প্রকাশ করত কবিতার আকারে , তবে, ছেলেদের মতো তাদের এরকম কোন সমতুল শারীরবৃত্তিয় প্রবাদপ্রতিম বাক্য নেই, থাকলেও সেটা খুব শোভন হত না !
সেই বালকের বা কিশোরের কবিতাগুলো অবশ্যই উদ্দিষ্ট যাদের প্রতি , সেই গম্ভীর বা চঞ্চলা বা ভীরু বালিকাগন সেগুলোতে কতখানি ইম্প্রেসড হন বা হতেন সে অন্য গল্প , তবে তাদের মধ্যে ‘এক্সপোর্ট কোয়ালিটি ‘ যারা , তারা কোভিড -পূর্ব পৃথিবীতে এসব বাল্যখিল্য কবিতার ডাক উপেক্ষা করেই চলে যেতেন সাগরপাড়ে , যতদিন না সেখানে শাড়ি গয়নায় শোভিত হয়ে, সেখানকার প্রবাসী সম্মেলনে নিজেদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করার সুযোগ পাচ্ছেন !
লেখা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে ? ভাবছেন কোন ব্যথার ব্যাথার স্মৃতি উঠে আমাকে তাড়া করছে কিনা ? ঠাকুরঘর ও কদলি সম্বলিত আপনার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করেই আমি চলে যাই পরের ঘটনায়, সদ্য প্রত্যক্ষ I
বেশ কয়েকবছর আগের কথাIদিনটি ছিল রবিবার I বাজারশেষে রিকশা করে ফেরার মধ্যে একটা আধা রাজসিক আধা তামসিক ভাব আছে , সেটা উপভোগ করতে আমি রিকশাবাহনে সওয়ারী হয়েছিলাম I কথায় কথায় রিকশাচালক সুসংবাদটি জানালো, গত ১৭ জুন তারিখ থেকে সে কবিতা লেখা শুরু করেছে I সদ্য বা প্রবীণ কোন কবিরই কবির উৎসাহকে কখনও উপেক্ষা করার জো নেই, সুতরাং আমার রিক্সাভ্রমণ বেশ কাব্যিক হয়ে গেল I রাম রহিমের উপর তীব্র কশাঘাতে সে একটি কবিতা লিখেছে , যদিও, তার জবানিতে , কবিতাটি শুরু করেছে,” স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, ‘ সবার উপর মানুষ সত্য , তাহার উপরে নাই ‘ দিয়ে I আমার জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে কথাগুলি চন্ডীদাসের,বিবেকানন্দের নয়, তবে সেটি বলে কবির ভাবাবেগে আমি আঘাত করতে চাই নি I একটি দুটি কবিতা প্রকৃতিমূলক, কারণ ‘আমরা তো প্রকৃতির কোলেই বেড়ে উঠি I তবে কবি সমাজ সচেতন ও বটে, ‘কলকাতা মস্ত শহর / উড়ছে টাকা উড়ছে নারী / দুপাশেতে মস্ত বাড়ি / রাস্তাজুড়ে বড় গাড়ি – পয়ার ছন্দে, অন্ত্যমিলযুক্ত লেখাগুলির কয়েকটি বেশ কয়েকটি উৎরে গেছে বেশ I তবে ‘মা ভগবান বৌ শয়তান ‘ মডেলে তার আক্ষেপও রয়েছে – পিতামাতাকে করছো গঞ্জনা/ পরের মেয়েকে দিচ্ছ গহনা ইত্যাদি I এমন কাব্যিক পরিভ্রমণের পর আমার মনে হলো, টিভিতে বাঙালীর চরিত্র বিন্যাস আর তার পরে পরেই এমন কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ -ও কী এক সমাপাতন? না আমার লেখার রেডিমেড মেটেরিয়াল ?
এবার উঠতি কবিকে ছেড়ে একটু প্রতিষ্ঠিত কবির কথায় আসি। আধা সরকারি আপিসের এই মেজকর্তার লেখা লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত বেরোত। ওনার গিনিপিগ ছিল আপিসের এক অধস্তন অফিসার। একদিন সেই যুবক মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিল, ” স্যার অনেক কাজ রয়েছে যে আজ ! বস অভয়বানী দিলেন , ” ছাড় তো ! তোমার কাজ দেখব তো আমি! “বাকিটা অনুমেয়।
বাঙালী বাবুর হয়তো আরো অনেক দিক আছে -যেগুলো বিশদ ভাবে শোনার জন্য চোরাগোপ্তা হাজির হতে হবে অবাঙালীদের আড্ডায় I
লেখার শেষে একটা ডিসক্লেমার দিয়ে দেই – আমার যত বন্ধু, বা সম্ভাব্য বন্ধু আছে , তাদের লেখা কবিতা কিন্তু আমার খুব ভাল লাগে !
–০০::XX::০০–