✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখিকা পরিচিতি :-
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
শিক্ষকতা করেন (পলাশী হেমাঙ্গিনী সরোজিনী বিদ্যামন্দির উচ্চমাধ্যমিক)।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার গুড়াপ এ জন্ম।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।(প্রথম শ্রেণি)
রামকৃষ্ণ সারদা বিদ্যাপীঠ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।(প্রথম শ্রেণি)
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকে ডিপ্লোমা।
শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চা করেন।
বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত
“জয়ী”
~~~~~~~
একটা চুবড়ি তে শাক নিয়ে সবিতা পুকুর ঘাটে গেল।আপনমনে গজগজ করতে করতে নিজের কপালকে দুষতে লাগল।নিবারণ স্যাকরার মা বলল কি হয়েছেরে সবু?সকাল বেলা থেকেই মেজাজ গরম করলে চলে।কী হল তোর।নাকি আমার দেওর কিছু বলল।সবিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।আর ঠিক তার পর ই চোখের জল বাগ মানলো না।
কী হবে দিদি।দোষ আমার কপালের।জয়ীর বাপ আমাকে দোষে।ওনার কলকেত্তা যাবার দিন আজ।ব্রজঠাকুরের ছেলের পৈতে।ক্ষুর কাঁচি শানাতে উনি বেরোবেন।তা বলতে হবে তো আগে থেকে।ভোম্বলা হয়ে এখন বললে মেজ বৌ আমায় ভাত রেঁধে দে।ইদিকে ক্ষার ফুট্টেছি দিদি।
সকাল থেকে নাচানাচি চলছে যেন।আর উদিকে ধিঙ্গি মেয়েকে শাকটা ধুয়ে আনতে বললাম।তা সে নড়েও না,চড়েও না।মুখ গোঁজ করে বসে আছে।কাল সনাতন কবরেজের বাড়িতে বাপের সাথে গিয়ে কী বুঝেছে কী জানি।
নিবারণের মা বলল ও!তাই বল।আমি ভাবি কী না কি।হাবা গোবা মেয়ে হলে কী হবে।ভালো বুদ্ধি।কোনো কাজে জয়ীকে আঁটে না।বড় মায়া রে সবু।
সবিতা বলল আমার গর্ভের কলঙ্ক দিদি।ওই মেয়ে নিয়ে আমার মরেও শান্তি হবে না।মাঝে মাঝে ভাবি কী হবে ওর।আর বাপের তো চিন্তা ভাবনাই নেই।লোকের একটা কিছু ভালো হয় আর আমার তো তাও নেই।নিবারণের মা প্রবোধ দেয়।কাঁদিস না বৌ।আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন তেনার উপর বিশ্বেস রাখ বৌ।তার ইচ্ছেতে চন্দর সূর্য উঠছে।
আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে শাক নিয়ে বাড়ির পথে র ওনা হল।ওর যাবার দিকে চুপ করে তাকিয়ে র ইল নিবারণের মা
বামুন পাড়ায় এই এক ঘর নাপিত।ব্রজঠাকুরের দাদু নিজের জায়গাতে সত্যানন্দ নাপিত কে বসায়।কথায় আছে হলে হাঁড়ি,মরলে ডোম।আর শুদ্ধু করতে নাপিত।
সতে নাপিতের ছেলে হল গিয়ে সবিতার শ্বশুর।উনি যদ্দিন বেঁচে ছিলেন সবুর সংসারে অভাব ছিল না।আশ্চর্যি এলেম ছিল লোকটার।অমন বাপের এমন ছেলে।আজন্ম কুঁড়েশুল।তার উপরে বোবা মেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা।মরণ দশা আমার।
গরমভাত,মানভাতে,চুনোমাছের টক আর শাক কটাকে ভেজে পাতে দিতে দিতে সবু বলল কিছু টাকা থাকে তো দাও।চাল বাড়ন্ত।দোকান পাসারি কিছুই নেই।
সদানন্দ শুনেও না শোনার ভান করে জয়ীকে ইশারা তে ডাকতে লাগল।বাপসোহাগি মেয়ের হাসি ফুটেছে।গা পিত্তির জ্বলে যায়।সব দায় ওর।নিজের লজ্জা অমন মেয়ে সে জন্ম দিয়েছে।
জয়ী বাবার গা ঘেঁসে বসে বসে চুনো মাছের টক খাচ্ছে।ওর সব ভাষা চোখে ব্যক্ত হচ্ছে।পাশের বাড়ি থেকে গানের সুর ভেসে আসছে
“এইধন যার ঘরে নাই
বৃথাই জীবন,বৃথাই জীবন।
ধনকে নিয়ে বনকে যাবো
সেথায় খাবো কী।সেথায় খাবো কী”।
আর কদিন পরেই দুগ্গোঠাকুর আসবে।বামুনঠাকুরদের বড়ো দয়া।পৈতের সিদে দেন দশ কেজি চাল।কিছু টাকা আর বামুন গিন্নী সবুকে একটা নকশা পেড়ে শাড়ি দেবেন।পুজোতে একটা সোনার নোলক গড়িয়ে দিলে জয়ীটাকে সগ্গের উর্বশী লাগবে।সকালে মেয়েটাকে কত শাপশাপান্ত করেছে ও।অভাবের সংসারে মাথাটাই কাজ করে না।
সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরেই চলেছে।আশ্বিনের ঝড়।পুজোর মুখে এমন ঝড় অনেককাল কেউ দেখে নি।এইসব দিনে প্রকৃতি কে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়।মূক প্রকৃতি যেন জয়ী নাম নিয়ে জন্মগ্ৰহণ করেছে।বিদ্যুতের ঝিলিক ওর চোখে।অমন চোখ দুর্লভ।বাড়ির পিছনে যে খানিকটা জায়গা সেখানে গাছপালা লাগিয়েছে।কথায় আছে “ঘরের গাছা,আর কোলের বাছা”।অদিন অসময়ে ওরাই দেখে।
নীরবতার একটা ভাষা আছে।যা বুঝিয়ে দেয় গভীরতা।সে যেন মহাসমুদ্র।আস্ফালন নেই।শান্ত অথচ গভীর।বুঝিয়ে দিয়ে যায় যা কিছু সুন্দর সব নীরব।এ যেন অতলস্পর্শী প্রেমের জাদু।অনুভবে কাছে টানে।নিবিড় করে পাওয়া।ফুলের মতো ভ্রমর কে ডাকে।এসো প্রিয়।আমরা হিয়ার সাথে হিয়া মিলিয়ে গান গাই।অসীম ফুলেল সুবাস পাবে জগতবাসী।
কদিন বৃষ্টিতে ভিজেছে জয়ী।জল থৈ থৈ মাঠে কাঁকড়া ধরেছে।কী সাহস!মাঠের আলের গায়ে বড়ো বড়ো গর্ত।অনায়াসে হাত ঢুকিয়ে সংগ্ৰহ করেছে দুধে কাঁকড়া।তারিণী খুড়ো চেঁচাতে থাকে।ওরে ওই গর্তে হাত দিস না।কালকেউটের বিষে মরবি নাকি।জয়ী হাসতে থাকে।ও যে ভূবন মোহিনী।
আজকাল সবিতা ভয় পায়।অমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে।এই দারিদ্রময় জীবনে এ কোন রন্ধ্রগত শনি।জয়ীর বয়স হল আঠারো।ওর বন্ধুদের একে একে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে গরম কড়াতে হাত দিয়ে ফেলেছে।উফফ।
পৈতে বাড়িতে ভালো উপার্জন করেছে সদা।সবুও শাড়ি পেয়েছে।পুজোর কটা দিন আর নেই নেই করতে হল না।জয়ী নোলক পরে বারবার আয়নাতে মুখখানা দেখছে।একগাল হেসে সদা বলল আকাশের চাঁদ আমার ঘরে।বাস্তবিক মেয়েরা বাপ অন্ত প্রাণ হয়।আর জয়ী এই মানুষ টার কাছেই বড়ো সহজ।মাকে ভয় পায়।জন্মক্ষণে মা নাম রেখেছিল জয়ী।নামটাই এখন ওর জীবনে ব্যঙ্গ।পদে পদে পরাজিত ।পৈতে বাড়িতে সবাই ওকে নিয়ে আলোচনা করে।সবু লজ্জিত হয়।জয়ী বুঝতে পারে সকলের কাছে ও বেমানান।মা এর চোখের ভাষা ও খুব বোঝে।এই জনারণ্য তার স্থান নয়।ছুট্টে চলে যায় দূর মাঠে।যেখানে কুলুকুলু নদী বয়ে যায়।প্রকৃতির বুকে ফিরে আসে।মানুষের পৃথিবী বড়ই নির্দয়।
যত দিন যাচ্ছে সবুর অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।একদিন সদাকে বলে ‘হ্যাঁ গা।কেমন বাপ তুমি।বলি মেয়েটার পাত্রস্থ করার ব্যাপারে তোমার ভাবনা নেই।”
সদা বলে কেমন কথা কস মেজ বৌ।ওর কত আর বয়স ক দিকি।তোর সবেতেই বাড়াবাড়ি।মেয়েটারে তুই হিংসে করিস নাকি।ওরে ও আমার আত্মা।আমার পরলোকে যাওয়া মা।আমার কাছে ফিরে এয়েছে।
স্বামীর কথা শুনে সবুর আত্মারাম চড়কগাছ।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল ‘হ্যাঁ, ওটাই তো বলবে এখন।বড়ো নিঠুর তুমি।বিয়ের পরপর যখন বাচ্ছা হচ্ছিল না তখন তো বুড়ো শিবের থানে মাথা কুটেছি।বলেছি ছেলে না দিলেও মেয়েই দাও একটা।আর তুমি ঘরের শত্রু।আমি জয়ীকে হিনসে করি।আমি তো মা।জন্ম দিয়েছি ওকে।”
সবুর কান্না দেখে মন গলে যায় সদার।বলে সব ঠিক হবে মেজ বৌ।কানছিস কেন।চুপ কর।শান্ত হ।জানিস তো তোকে কতখানি বাগ্যতা করি।
সদা উঠে বসে।পৈতে বাড়িতে টাকা পেয়ে ও রেডিও কিনেছে।আস্তে করে চালায়।সেদিনের সেই গান টা হচ্ছে।সদাও গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে
“ধন ধন ধন
মাণিকরতন
এই ধন যার ঘরে নাই
বৃথাই জীবন বৃথাই জীবন”
ব্রজঠাকুরের বোন হৈমবতী।কলকাতার মস্ত ঘরে বিয়ে হয়েছে।স্বামী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।একটাই ছেলে।ডাক্তারি পড়তে পড়তে দুর্ঘটনায় একটি পা কেটে বাদ গেছে।উপযুক্ত মেয়েরা খোঁড়া ছেলেকে বিবাহ করবে না।পৈতে বাড়িতে ছেলেটি এসেছিল।যেন ময়ূরছাড়া কার্তিক।
দুই হাতে শিউলিফুল নিয়ে জয়ী যখন মায়ের সাথে গিয়েছিল তখন নবীন ডাক্তার জয়ীকে দেখেছে।ওর সাথে ফুল চাইতে গিয়ে বুঝেছে মেয়েটি বোবা।তবু মনে ধরেছে মেয়েটিকে।বাড়ি ফিরে মাকে জানিয়েছে।
হৈমবতী আবার এসেছে ভাই এর বাড়ি।সবিতা আর সদা নাপিত কে জানিয়েছে সামনের ফাল্গুনেই শুভ কাজ সম্পন্ন হবে।
বিধাতা পুরুষ কার কী ভবিতব্য ঠিক করে রেখেছেন তা কেউ বলতে পারে না।কতরাত জয়ীর চিন্তায ঘুমোতে পারে নি সবু।আর আজ।মেয়েকে গ্ৰহণ করতে রাজপুত্র হাজির।কত মানুষের তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ তার হৃদয় কে বিদীর্ণ করেছে।আজ তার মা তার নাড়ি ছেঁড়া ধন রাজরাণী হবে।সামান্য কিছু পেলে যে মেয়ে কলকলিয়ে হেসে ওঠে সে বাড়ি,গাড়ি আর প্রচুর সম্পত্তির মালিক।
আনন্দে,দুঃখে চোখ দিয়ে অশ্রুবারি নির্গত হয়।মেয়েকে ছেড়ে থাকতে হবে।সদা নাপিত বিয়ের জোগাড় করতে থাকে।মাঝে মাঝে উদাস হয়ে চিৎকার করে বলে
“অন্নপূর্ণা দুধের সর
কাল যাবে গো
পরের ঘর”
বাবা মা এর এমন পরিবর্তন বুঝতে পারে জয়ী।ভাবে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
ফাল্গুন মাসে দেদার ঘটাপটা করে জয়ীর বিয়ে হয়ে গেল।কনের সাজে জয়ী যেন ডানাকাটা পরী।সব মিটে যাবার পর বাসরঘরে জয়ীর হাতটা ধরলো ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে সেরা ছাত্র ডাক্তার অগ্নিভ মুখার্জি।ভীত হরিণীর মতো স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে নববধূ।আবেগে তার অধর পল্লব কাঁপছে।তবু কী যে ছিল সেই পরশে।স্বামীর বুকে মাথাটা রেখে বুঝতে পারে সদানন্দের মতোই এক নিশ্চিন্ত আশ্রয় এটা।ভোর হয়ে আসে।প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে।কোকিল পঞ্চমে ধরেছে তার তান।
একটু পরেই বর কনে র ওনা হবে।আশীর্বাদের জন্য চন্দন বেটে দূর্বা তুলছে সবু।এতকান্না কোত্থেকে যে আসছে।ওই তো।যেখানে শাক পাতা আজ্জে ছিল ওর মেয়ে,জয়ী।ওখানে বসে আছে সদানন্দ।আপনভোলা মানুষ টা ।রোয়াকে এসে রেডিও টা চালিয়ে দিল।ওই গানটা আজ ও হচ্ছে।
“এই ধন যার
ঘরে নাই
বৃথাই জীবন
বৃথাই জীবন।
ধন ধন ধন
মাণিকরতন”।
গোটা গ্ৰাম আজ উঠে এসেছে।উমা পিতৃগৃহ ত্যাগ করে স্বামীর হাতটাকে শক্ত করে ধরে চলেছে।
সদানন্দ এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলল আমার মা কৈলাসে চলেছেন।
–০০::XX::০০–