✍ কাকলি ঘোষ
কবি পরিচিতি :-
লেখিকা কাকলি ঘোষের জন্ম বেলুড়।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু।
প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় নব কল্লোলে।
পেশা শিক্ষকতা।
বর্তমানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যেমন বর্তমান, সাপ্তাহিক বর্তমান, সুখী গৃৃহকোন, নব কল্লোল, কথা সাহিত্য ইত্যাদি পত্রিকায় লেখা লেখি করেন।
“অজানা সুর”
(১)
খুব দ্রুত হাতে কাজ সারছেন সুমিতা। আজ মরার ফুরসৎ নেই। মিনতি হাতে হাতে জোগাড় দিচ্ছে ঠিক ই কিন্তু ওকে নিয়ে মুশকিল হল নিজের বুদ্ধিতে একটা কাজও করতে পারে না। সব বলে দাও তবে। আচ্ছা ইলিশ এসেছে যখন সর্ষে কাঁচা লঙ্কা টা তো বেটে নিবি! ভাপা টা হবে কি দিয়ে! হাবলির মত মুখের দিকে চেয়ে থাকবে! তার ওপর না আছে কোন আন্দাজ না কিছু। আর রান্না ! সে তো কহতব্য নয়। রোজ খেতে বসা যেন এক যন্ত্রণার ! নেহাত হার্টের ব্যামোয় ইদানিং কাবু করে ফেলেছে! নইলে ওই খাদ্য কি খাওয়া যায়?
তবে আজ আর বসে থাকেন নি। ফোন আসা মাত্রই উঠে কাজে লেগে পড়েছেন। আর আশ্চর্য শরীর টাও কেমন যেন ঝরঝরে লাগছে আজ! মুখ টিপে হেসেছেন দেবতোষ। দেখেও না দেখার ভান করেছেন সুমিতা। ইস্! নিজের যেন আহ্লাদ হচ্ছে না! সব টুকু বুঝি সুমিতার ই ! বলা মাত্রই বাজার যাবার ঘটা কেন তবে! আর এই যে দু তিন রকম মাছ, মোচা, বকফুল, এসবই বা কাদের জন্য! বলে তো দেন নি সুমিতা! ঠিক মনে করে করে আনা তো হয়েছে! আর আনা যখন হয়েই গেছে তখন ওগুলোর ব্যবস্থা ও তো করতে হবে! মিনতির হাতে পড়লে আর দেখতে হবে না। রুপু টা বক ফুলের বড়া পেলে আর কিচ্ছু টি চায় না।ওর বউ দক্ষিণী মেয়ে। ওদের আবার রান্না বান্নার ধরন ই আলাদা। কি যে খায় ছেলে টা সারা বছর! আগে আগে বছরে দু বার তো আসত ই। এখন কমে এসেছে। বললেই নানা কথা! ছেলের পরীক্ষা! বউএর অফিস! ওর নিজের ছুটি নেই! দেবতোষের মতে এসব অজুহাত! ইচ্ছে থাকলে আর টান থাকলে কোন বাধাই বাধা না। সুমিতা অবিশ্যি সবটাই উড়িয়ে দিতে পারেন না ! এখনকার লেখাপড়াও যেন কেমন ধারা! সারা বছর শুধু পরীক্ষা আর প্রজেক্ট! ছেলে মেয়েগুলো নিশ্বাস নিতে পারেনা যেন! দেখছেন তো মুনিয়া কে! এত কিছু দূরে থাকে না! এই তো চন্দন নগর! ক’টা স্টেশন! আসে কবার! ওই পরীক্ষা! তার ওপর জামাইয়ের হাজার ফ্যাচাং! বউ ছাড়া তার একটি বেলাও চলে না! দেখতে শুনতে অবিশ্যি মন্দ লাগে না! বিয়ের এই দশ বারো বছর পরও দুটিতে এখনও পায়রার মত জোড় বেঁধে বকম বকম করে! কিন্তু এক এক সময় মন টা টানেও বড্ড! এক বেলার জন্য মেয়েটা এসে থাকতে পায় না। ছোলা দিয়ে মোচার ঘন্ট খুব প্রিয় ওর! করতেই হবে। যতই শরীরে না দিক । কি করা! আসে না আসে না আজ আবার দু ভাই বোন একসাথে হাজির হচ্ছেন! কি কান্ড! কি কান্ড!
সকাল বেলা ফোন বাজতেই মন টা কেমন করে উঠেছিল! কে? রুপু না মুনিয়া? শুনেই দেবতোষের বাঁকা জবাব! যেমন স্বভাব!
” জগৎ সংসারে আর লোক নেই ফোন করার? শুধু রুপু আর মুনিয়া!”
আশ্চর্য লোক যা হোক! তাই কি বলেছেন সুমিতা! আছে তো! ফোন তো কত জনাই করে ! তবু ফোন বাজলেই___
তা তাই তো হল বাপু। সেই মুনিয়াই তো!
” বাবা __ _দাদা আর এক ঘণ্টার মধ্যে দমদমে নামছে। আমি ও কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার জামাই কে নিয়ে বেরোচ্ছি। মাকে বলে দাও। ”
বোঝ! কোথাও কিছু নেই! হঠাৎ করে তিনি দিল্লি থেকে আর ইনি চন্দন নগর থেকে আসছেন! এই কাল রাতেও দুজনের সাথে কথা হয়েছে! ঘুনাক্ষরেও বলল না তো কেউ! মানে দুজনে মিলে মতলব করা হয়েছে। সারপ্রাইজ!
তখনও ঘোর কাটে নি দেবতোষের। ফোন হাতে নিয়েই চেয়ে আছেন। সারপ্রাইজ তো এখন বলল কেন! এসে পৌঁছে সারপ্রাইজ টা দিলে তো আরো ভালো হোত! কারণ টা সুমিতা জানেন। মুনিয়া
বরাবর ই বুঝদার। রুপুর মত অতটা আবেগ প্রবন নয় ও। জানে হঠাৎ জামাই ,মেয়ে, ছেলে ,বউ হাজির হলে মুশকিলে পড়বে মা_ই। কোথায় বাজার __ কি রান্না ___ তাই___
উদার হাতে ঘি ছড়াতে ছড়াতে সস্নেহে মোচার ঘন্ট এর দিকে চাইলেন সুমিতা।
“আর এক কাপ চা হবে? ”
বারান্দা থেকে হাঁক দিলেন দেবতোষ।
চা_ই করছিল মিনতি। জানাই তো এ সময় আর এক কাপ খান বাজার থেকে এসে। হাত ধুয়ে চা নিয়ে নিজেই গেলেন সুমিতা।
” বস না__”
পাশের চেয়ার দেখিয়ে ইঙ্গিত করেন দেবতোষ।
চোখ কপালে তোলেন সুমিতা! এখন বসার সময়! রাজ্যের কাজ পড়ে রয়েছে ! জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। ময়দা বার করে দেবেন মিনতি কে। এক্ষুনি এসে পড়বে ওরা!
” হঠাৎ সদলবলে কেন আসছে বলতো?”
” মানে!!! ” সবিস্ময়ে ফিরে তাকান সুমিতা, ” এ আবার কি ছিরির কথা! কেন কি আবার ! বাড়ির ছেলে মেয়েরা বাড়ি আসবে না! ”
মুখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দেন দেবতোষ। সুমিতা কে বোঝানো মুশকিল! ছেলে মেয়ে আসবে সেই আনন্দেই মশগুল! বাস্তব কিছু বোঝেও না আর বোঝাতে গেলে মানবেও না। কিন্তু দেবতোষ এত সহজে গলে যান না। পরিস্থিতি খুব খারাপ! ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের দিকে চান। একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে।
বাড়িটা ভাঙ্গা হচ্ছে বিপুল বাবুর। এই সেদিন অব্দি একসাথে বাজারে গেছেন , কত সুখ দুঃখের কথা হয়েছে ! পাশপাশি থাকা! একই রকম সংসার। তফাতের মধ্যে ওনার দুটি ই ছেলে। দুজনই বাইরে। ফলে যা হয়! এ বাড়ি ও বাড়ি বাটি যাওয়া আসা,বাটি চালা চালি। ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠতে সময় লাগে নি। হ্যাঁ। আক্ষেপ করতেন অবশ্য রায় বাবু। ছেলেদের আসা যাওয়া খুব কম! ফোন করে বটে তবে সে নিয়ম রক্ষার ই মত!
বুঝিয়েছেন দেবতোষ।
” ছাড়ুন না মশাই। থাকুক না নিজেদের মত। কি খারাপ আছেন আপনি! ”
তবু ঘ্যান ঘ্যানানি যায় না। শেষে একদিন শুনলেন __ শুনলেন মানে বিপুল বাবুই বললেন দু ছেলেই এক সাথে আসছে।
ক’দিন আর লোকটার মোটে দেখাই পেলেন না দেবতোষ! সুমিতার কাছে শুনলেন ও বাড়িতে এখন খুব ধুম ধক্কার চলছে! বাড়ি ভরতি লোক! দু ছেলে , বউ, নাতি নাতনী চাঁদের হাট একেবারে! শুনে ভালই লেগেছে। যাক গে। লোকটার আক্ষেপ ঘুচলো। ভুল ভাঙলো সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। খবরটা আনলো মিনতি ই। বিপুল বাবু নাকি বাড়ি টা প্রোমোটার কে দিয়ে দিচ্ছেন। ছেলেরা বলছে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে। এখানে এত দূরে বাপ মাকে ফেলে তাদেরও মন খারাপ লাগে। আর এত বড় বাড়ি হবেই বা কি! বরং টাকা হাতে এলে তা দিয়ে ___
শুনেই অন্তরাত্মা চিৎকার করে উঠেছিল। কী ভীষণ ভুল করছে লোকটা! ঠিক নয়। এ ঠিক হচ্ছে না। এক্ষুনি বলা দরকার। বোঝানো দরকার।
কিন্তু কি ভাবে! যদি ভুল বোঝেন ! তাছাড়া সে ভাবে ভদ্রলোক কে তো একা পাওয়াই যাচ্ছে না ক’দিন। সঙ্গে হয় বড় ছেলে না হলে ছোট জন। তাছাড়া সুমিতা ও রাগারাগি করতে শুরু করল।
__তুমি কেন বোঝাতে যাবে? উনি ওনার ছেলে দের কাছে থাকতে চান। তোমার বলায় হবেই বা কি আর বললে শুনবেন ই বা কেন? ___
যুক্তি যথার্থ। থেমে গেছেন দেবতোষ। তবে তার শঙ্কা মিথ্যে যে নয় তা প্রমাণ হতে বেশি দেরী হল না। খবর পেলেন ঠিক সময় মত। বিপুল বাবু আর তার স্ত্রী কে টাকা পয়সার মতই ভাগাভাগি করে নিয়েছে ছেলেরা। এই বৃদ্ধ বয়সে দুজনে দু প্রান্তে ___
নিচে হৈ হৈ , চিৎকার চেঁচামেচি তে চমক ভাঙলো।
ওরা এসে পড়েছে সবাই। নিজের মনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যান দেবতোষ! আশ্চর্য ! সুমিতার মত তার ভেতর টা এত খুশি তে ভরে উঠছে না তো! অথচ কতদিন পরে বৌমা দাদুভাই এলো ! মুনিয়া ও এলো অন্তত মাস চারেক পর। জামাই নাতনি! ভালো যে লাগছে না তা নয়। কিন্তু একটা অদ্ভুত শঙ্কা ! প্রতি মুহুর্তে নিজের প্রিয়তম পুত্র কন্যার মুখের দিকে তাকাতে ভয়! পাছে কিছু দেখে ফেলেন! পাছে ওই সুন্দর মায়াবী চোখে লোভ নজরে পড়ে! পাছে বিপুল বাবুর মত____
” বাবা ___ ”
মুনিয়ার ডাকে সম্বিত ফিরে পান দেবতোষ। কি ভেবে মুখটা মুছে নেন হাত দিয়ে। তারপর পা বাড়ান নিচের দিকে।
(২ )
_” তোমায় একটা কথা এই কদিন বলি বলি করেও আর বলা হল না বাবা __ এদিকে আজ যাবার সময়ও হয়ে গেলো। ”
জুতোয় পা গলাতে গলাতে একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলে রুপু।
আজ চলে যাচ্ছে ওরা। ছিল কটা দিন। আজ যাবার পালা। বসার ঘরে ইজি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় ওদের ব্যস্ততা দেখছিলেন দেবতোষ। রুপুর কথা বুকের ভেতরে জমে থাকা বাষ্প টায় ধাক্কা দিল যেন ! চোখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে। এই ক’দিন প্রায় প্রতি মুহূর্তেই এই রকম কোন কথার অপেক্ষায় ছিলেন । কখন কোথা দিয়ে নেমে আসবে সেই আশঙ্কায় ঠিক মত প্রাণ খুলে হাসতে পর্যন্ত পারেন নি। কাঁটা হয়ে ছিলেন নিজেরই আত্মজের কাছে ! অথচ ভুলেও সেসবের ধার দিয়েও যায় নি রুপু বা মুনিয়া। কোথা দিয়ে যেন হৈ হৈ করে কেটে গেছে চারটে দিন! কিন্তু আজ যাবার সময় রুপুর কথার সুর কেমন যেন অন্য রকম না ? কী বলতে চায়! বিশেষ কিছু! আশঙ্কা যেটা করছেন সেটাই কি! এবার বোধ হয় ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোবে! হঠাৎ দুই ভাই বোন একসাথে আসা __ অপর্যাপ্ত খুশি , আনন্দ, হাসি সব কিছুরই কারণ তো একটা আছে রে বাবা! তলে তলে আন্দাজ ঠিক ই করেছেন দেবতোষ। শুধু বুঝতে পারছিলেন না আসল কথাটি বেরোবে কখন! নিজের অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। চোখ নামিয়ে নেন। যেচে কিছু জানতে চাইবেন না। বলুক না কি বলতে চায়! উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব তো তার।
“মুনিয়া __ তুই বল না বাবাকে__”
মেয়েকে তৈরি করছিল মুনিয়া। সেই অবস্থাতেই উত্তর দিল,
“তুই বল না দাদা। তুই ই তো বেশি চাইছিস __ বল না _”
মনে মনে হাসেন দেবতোষ। এটা চিরকালের স্বভাব রুপুর। বাবার কাছে কোন দিনই স্বচ্ছন্দ না ও। যে কোন কথা__ সেটা সামান্য থেকে সামান্যতর হলেও__ হয় মা নয় বোনের শরণাপন্ন হোত ও। আজ ও সেই একই প্রকৃতি রয়ে গেছে। আসলে এটা ঠিক রুপুরও দোষ না। বরাবরই রাশভারী স্বভাবের মানুষ দেবতোষ। আর কঠোর প্র্যাকটিক্যাল। যে কোন কথা ___তা যত কঠিন ই হোক অবলীলায় বলতে পারেন। আর রুপুটা হয়েছে ঠিক উল্টো। মামার বাড়ির ধরন পেয়েছে। নরম সরম। এখনও! এত বড় চাকরি করে__ দুই বাচ্চার বাপ __ তাও দেবতোষের সামনে এলে __ নার্ভাস। শুধু মুনিয়া! ওই একটি জায়গায় হার দেবতোষের। ওর সাথে এঁটে উঠতে পারেন নি কোন মতেই। বুকে একটা আঁচড় পড়ে। মুনিয়া ও কি___!
” বাবা__” অকারনেই গলা টা ঝেড়ে নিয়ে আবার ডাকে রুপু, ” বলছিলাম যে তোমরা আমার ওখানে চল এবার। অনেকদিন তো দুজনে থাকা হল ! বয়স তো হচ্ছে। কখন কি হয়! খুব চিন্তায় থাকি। মার শরীরও তো ভালো না। তোমারও একটা অ্যাটাক অলরেডি হয়ে গেছে। এদিকে আমিও তো হুট করে বললেই আসতে পারি না । তাই___ ”
কথা গুলো খুব চেনা লাগছে না! অজান্তে ই দু চারটে ভাঁজ পড়ে দেবতোষের প্রশস্ত কপালে। এইরকমই শুরু টা থাকে বোধ হয় সব ক্ষেত্রে! মনে মনে কঠিন হাসেন দেবতোষ।
” তোমার ওখানে? একেবারে? ” আলগোছে চার ফেলেন ।
” হ্যাঁ ! ” অবাক চোখে তাকায় রুপু, ” কেন ? ছেলের কাছে বাবা মা থাকে না? তাছাড়া মা’র ও ইচ্ছে___”
তাই নাকি ! চকিতে একবার দরজার পাশে বিষন্ন মুখে দাঁড়ানো সুমিতার দিকে চেয়ে নেন দেবতোষ। সুমিতার ইচ্ছে ! নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে ছেলের বাড়িতে গিয়ে থাকা ! দেখেও শিক্ষা হয় নি ! নির্বোধ মেয়েমানুষ !
” দাদা ঠিক ই বলছে বাবা। ওখানে থাকলেই তোমাদের সুবিধে। এখানে বাজার থেকে ডাক্তারখানা সব তো তোমার ঘাড়েই। তাছাড়া ওখানে দাদার অত বড় বাংলো , ভালো ডাক্তার, হসপিটাল, সব রকম সুযোগ ___”
“ও।” ছোট্ট একটা শব্দ করে চুপ করে যান দেবতোষ।
“না বলো না বাবা প্লিজ। এটা দরকার। এই বয়সে এভাবে আলাদা থাকা উচিত নয়। আর আমার ও তো ইচ্ছে করে তোমাদের কে কাছে রাখতে ”
“আমি ও খুব নিশ্চিন্ত থাকতে পারি বাবা। ” পাশে এসে পিঠে হাত রাখে মুনিয়া, ” কাছে থেকেও আসতে তো সেভাবে পারি না। খুব চিন্তা হয় গো। দাদার কাছে থাকলে কত টা ভালো থাকবে একবার ভেবে দেখো তো?”
আত্মজের স্পর্শের সুখ ! সে নাকি সর্বাধিক সুখ ! অসহ্য ! অসহ্য লাগে দেবতোষের ! এই নকল ভালোবাসা আর নকল দরদ ! হাত ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে ! রাগে চিৎকার করে ওদের মুখোশ টা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আর কতক্ষন ! এবার বলে ফেলুক না আসল কথা টা! আর দেরি কেন? ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে পড়েছেন তিনি! কতক্ষন চলবে আর এই চাপান উতোরের খেলা! বলতে তো এবার হবেই।
নাকি নিজেই খেলবেন শেষ খেলাটা? দেখে নেবেন ওদের দৌড় টা! না। তার আগে আর একটু সুতো ছেড়ে দেখা যাক!
“তোমাদের মার যখন ইচ্ছে __ নিয়ে যাও মাকে! থাকুক ওখানে। আমি ___”
কথা শেষ করতে পারেন না । তার আগেই হৈ হৈ করে ওঠে মুনিয়া,
” কি যে তুমি বল বাবা ! এ আবার হয় নাকি ! তোমাকে এখানে একা রেখে মা চলে যাবে ! শান্তি তে থাকতে পারবে একদিনও!”
“একা কই রে! ” , সহাস্যে জবাব দেন দেবতোষ, ” মিনতি আছে তো! তাছাড়া তুই ও তো আছিস ! আসবি মাঝে মাঝে বুড়ো বাপকে দেখতে !”
“সেটা কথা না। ” বাধা দেয় রুপু, ” তোমরা দুজনেই থাকো __ এটাই আমার ইছে । প্রথমেই একেবারে না হলেও কিছুদিনের জন্য চল। পরে ভালো লাগলে___ ”
” আমার পক্ষে তা কি করে সম্ভব ? ”
” কেন ?”
” এই এত খানি বাড়ি ! বাগান ! এসব কার ভরসায় রেখে যাবো? দেখাশুনা করবে কে?”, শেষ চাল দিয়েই দেন দেবতোষ।
কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকে রুপু। তারপর মৃদু স্বরে বলে ওঠে, ” তুমি চাইলে তার ও একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে!”
এক বুক হাসি খলবল করে ওঠে বুকের মধ্যে ! এ তো জানাই ! ব্যবস্থা করা হয়েও গেছে হয়ত! শুধু বুড়ো বাপকে সরাবার অপেক্ষা! মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়া! তারপর তো সব হাতের মুঠোয়! সব __ সব এক গল্প! এক চেনা গৎ! জোরে __ প্রচণ্ড জোরে হাসতে ইচ্ছে করে ! তবু আর একটু পরিহাসের লোভ ছাড়তে পারেন না দেবতোষ।
” ব্যবস্থা!”
” হ্যাঁ। কিছুই না বাবা। একটা শুধু__”
” সই ! তাই না! হা হা হা ! তা সেই ব্যবস্থা করতেই দু ভাই বোন হাত মিলিয়ে এসেছ বুঝি! ভেবেছ! বুড়ো বাপ মা ___ যেমন বলবে তেমনটাই তো করবে! তাই না! ”
” বাবা !”
রুপুর আর্ত কণ্ঠে দৃকপাত করেন না দেবতোষ। বলেই চলেন, ” তা কী ব্যবস্থা করলে? কোন প্রোমোটার এর সাথে কথা হল? কত টাকায় রফা হল শুনি?”
” কি যা তা বকছ? ” মৃদু কন্ঠে তিরস্কার করে ওঠেন সুমিতা, ” ছেলে মেয়ে দুটো চলে যাচ্ছে আজ ! এ সব কী কথা!”
“যেতে তো হবেই! সুবিধে হল না যে। যা তা বকছি! আমি যা তা বকছি! তো জিজ্ঞেস করো না তোমার পুত্র কন্যাদের ____ কি উদ্দেশ্যে এসেছিল দুজনে জোট বেঁধে? কোন ব্যবস্থার কথা ভেবে এসেছে ? কর কর জিজ্ঞেস কর!”
” বাবা। ” এই প্রথম সাবালক রুপুর কঠিন কণ্ঠস্বরে চমকে যান দেবতোষ।
” থামো। অনেক বলেছ তুমি! আর বল না। তুমি যা ভাবছ সে কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কখনো। এখন টাকার বিনিময়ে সিক্যুরিটি গার্ড পাওয়া যায়। আমি সেই ব্যবস্থার কথাই ভাবছিলাম। আর কেন এসেছি দু ভাই বোন মিলে জোট বেঁধে ? এমনি বাবা! এমনি। শুধু তোমাদের দেখব বলে ! একসঙ্গে ক’দিন কাটাব বলে ! তোমাদের মুখে হাসি ফোটাব বলে! বিশ্বাস কর এমনি ই এসেছি। সত্যি ই এমনি ! ”
গলা ধরে আসে রুপুর। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত সামনে থেকে সরে যায় মুনিয়া। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন সুমিতা।
স্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকেন দেবতোষ। ব্যাথা করছে গলাটা! ভীষণ ব্যাথা করছে ! কি যেন একটা ডেলা পাকিয়ে উঠছে গলার কাছে ! প্রাণপণে যন্ত্রণা টা কে গিলতে গিলতে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে থাকেন দেবতোষ।
–০০ সমাপ্ত ০০–