“নতনেত্র”
–::কাকলি ঘোষ ::–
স্তব্ধ চোখে দরজার দিকে চেয়ে বসে আছেন সুনেত্রা। সাক্ষাৎপ্রার্থীরা আর কেউ নেই। শেষ পর্যন্ত অমল মিত্র ও। অনেকক্ষন মাথা নীচু করে বসে থেকে বিনা সম্ভাষনেই চলে গেছে লোকটা। তবু বসে আছেন সুনেত্রা। পাশের ঘর থেকে টাইপ ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেক্রেটারি দীপক। উশখুশ করেছে কিছুক্ষন। চোখ তুলে তাকান নি। স্নানের সময় হয়েছে। মোক্ষদা দুবার এসে উঁকি দিয়ে গেছে। মুখ দেখে বলার সাহস হয়নি সম্ভবত। বুঝতে পারছেন সবই। সোনাই এসেছে। মেয়েটা হোস্টেল থেকে আসেই বা কদিন। এই মুহূর্তে উঠে যাওয়া উচিত আর স্নান সেরে একসাথে খেতেও বসা।
তবু পারছেন না। এক অপরিসীম ক্লান্তি ( না কি ক্লান্তি নয়) এক বিষন্নতা পাকে পাকে যেন জড়িয়ে ধরে রেখেছে সর্বাঙ্গ। একটা তুচ্ছ লোক ! তার অর্থহীন কিছু প্রলাপ! অথচ তাই কী করে যে নাড়িয়ে দিয়ে যায় সুনেত্রা চৌধুরীকে!
প্রথম ধাক্কায় তো অপমানে রাগে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল কান। আশ্চর্য স্পর্ধা তো লোকটার! সাহস হয় কী করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথা উচ্চারন করতে! পারতেন তো সুনেত্রা দারোয়ান ডেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে! অনায়াসেই পারতেন।
অথচ কেন যে পারলেন না? কী ভাবে যে এত দুর্বল হয়ে পড়লেন, আবেগ যার হাতের মুঠোয় মাপা সেই সুনেত্রা! আশ্চর্য সেটাও।
লোকটা কাঁদছিলো। বিহ্বল , হতচকিত সুনেত্রা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছেন ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে লোকটার দুচোখ বেয়ে। বুকের ভিতরটা ছটফট করে ওঠে যেন। পারছেন না। একটা উটকো লোক আর তার কিছু অবান্তর কথা কিছুতেই সরাতে পারছেন না মন থেকে। বিকল কেমন বিবশ হয়ে পড়ছে দেহ , মন।
লোকটা কখন এসেছিল খেয়াল করেন নি। এমন তো কতজনাই আসে। কথা ,কাজ দুইই চলে পাশাপাশি। বড় পর্দা, ছোট পর্দ প্রযোজক,পরিচালকদের ভীড় তো লেগেই থাকে। সকলকেই যে অনুগ্রহ দেখান এমন নয় তবে শিষ্টতার অভাব ঘটেনা কখনো। কাউকে মিষ্টি কথায় ,কাউকে ভবিষ্যতের প্রত্যাশা দেখিয়ে বিদায় দেন। আশা তো মানুষের থাকেই। তবুও বছরে দুই থেকে চারটে হিট ছবির গল্প যার লেখনী থেকে বে’র হয় তাকে তো একটু সতর্ক হতেই হয় এ ব্যাপারে। এতসবের মধ্যে কখন যে লোকটা ঢুকেছে লক্ষ্যই করেন নি। নজরে পড়ল অনেক পরে যখন অনেকেই বিদায় নিয়েছে দু চারজন ছুটকো ছাটকা কাগজের নাছোড়বান্দা সম্পাদক ছাড়া। কী মনে হতে নিজেই ডেকে নিলেন সুনেত্রা।
” আপনি অনেকক্ষন বসে আছেন । বলুন”
কেমন যেন ভয়ার্ত চোখে তার দিকে চেয়েছিল লোকটা। পরে ভীরু ,কুন্ঠিত গলায় বলেছিল
” আমি না ম্যাডাম। আমি সবার পরে। আমার কোন তাড়া নেই। ”
তখনই যদি বুঝতেন সুনেত্রা। তখনই যদি বলে দিতেন সময় নেই। অথচ তা না করে উল্টে বাকীদের বিদায় করে ওকেই আবার ডেকে নিলেন। আর নিলেন তো নিলেন কথা শুরুর পরক্ষনেই কেন উঠে দাঁড়ালেন না! কেন বললেন না এসব পাগলের প্রলাপ শোনার সময় নেই তার । অথবা বলতেই পারতেন—-“- কার সঙ্গে কথা বলছেন আশা করি ভুলে যান নি আপনি?”
কী যে হোল! কিছুই করলেন না। স্হানুর মত বসে বসে শুনলেন এক অদ্ভূত মানুষের কিছু অবান্তর কথা!
বেশ নাটকীয় ভাবে কথা শুরু করেছিল লোকটা।
“আমার পরিচয় খুব সামান্য ম্যাডাম। নাম অমল মিত্র। আমি—”
মনে মনে তখন হাসছেন সুনেত্রা। ভদ্রলোক একই সঙ্গে পাঠক এবংলেখকও বোধহয়। এখন ব্যাগ থেকে লেখা বার করে শোনাতে বসলেই — কিছুটা আতঙ্ক ও বোধ করছিলেন। তাই ওকে শেষ করতে না দিয়ে নিজেই বলে উঠলেন
“আমার তো ভাই এখন অন্য কারোর লেখা দেখার সময় নেই। এখনো অনেকগুলো—-“
প্রবলবেগে বাধা দিয়ে উঠেছিল অমল মিত্র।
” না না ম্যাডাম। আমি সেরকম কিছু উদ্দ্যেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি”।
ওঃ। একটা অবরুদ্ধ নিঃশ্বাস যেন মুক্তি পেয়েছিল কথাটায়। তবে লেখার প্রশংসা বা আর কিছু। কতরকম যে পাগলামি থাকে পাঠকদের! দেখা যাক এর আবার কী বক্তব্য।
এর পরেও বেশ কিছুক্ষন চুপ করেই ছিলো লোকটা। তখনো বোঝেননি সুনেত্রা আসলে সময় নিচ্ছে অমল মিত্র। মনে মনে অস্বস্তি বোধ করেছেন। কিছু বলেনা কেন লোকটা! অস্বস্তি যখন প্রায় বিরক্তিতে পরিনত হতে চলেছে ,যখন স্হিরই করে ফেলেছেন এবার উঠেই পড়বেন তখনই হঠাৎ কথা বলে উঠল অমল মিত্র।
” আমি আপনার লেখার অন্ধ ভক্ত ছিলাম ম্যাডাম”
কানে কী কম শুনলেন সুনেত্রা? “ভক্ত ছিলাম”! মানে ! রগের পাশদুটোয় হঠাৎই এক ঝলক আগুনের হলকা যেন ছুঁয়ে যায় ।লোকটা পাগল নাকি! কই দেখে তো মনে হচ্ছে না তবে এরকম অদ্ভূত কথা বলে কী করে! তা ও এখানে দাঁড়িয়ে! উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় ই লোকটা——-
” দিদি, স্নান করবে না ? অনেক বেলা হোল। সোনাই বসে আছে যে।”
মোক্ষদার ডাকে চমক ভেঙে ফিরে তাকান সুনেত্রা। দ্রুত সামলান নিজেকে। এমা! ছি ছি ! কত বেলা হয়ে গেল।মেয়েটা না খেয়ে বসে আছে! দীপকও বোধহয় ওর জন্যই আটকে আছে।
” হ্যাঁ যাই । তুমি খাবার দাও। আমি এখুনি আসছি।”
আর না দাঁড়িয়ে সোজা বাথরুমের দিকে পা বাড়ান সুনেত্রা।
(দুই)
টক মিষ্টি দিয়ে রুই মাছটা ভালো রেঁধেছে মোক্ষদা। সোনাইয়ের প্রিয় পদ। সুনেত্রার ও পছন্দ। তবু খেতে পারলেন না। ভাতের ওপর আঙুলগুলো নড়ছিলোই শুধু। মাংঁস তো পাতে নিলেনই না। মাথা নেড়ে খেতে খেতে অনর্গল বকছিলো সোনাই।
” উঃ। মোক্ষদা পিসী মাছটা যা রেঁধেছো না! ওটা কী! বাব্বা¡ আবার চিংড়িীর মালাইকারি! এরপরও মাংস! তুমি কি আমাকে একদিনই সব খাইয়ে দেবে ? আমি তো দুদিন থাকবো বলে এসেছি গো!”
” থাকো না”
মালাইকারির বাটিটা সামনে এগিয়ে দিতে দিতে হৃষ্ট মুখে বলে মোক্ষদা।” আরো অনেক কিছু করে খাওয়াবো। ”
খুশী উপচে পড়ে ওর কালো মুখ বেয়ে।
” হি হি — আমার বন্ধুরা কী বলে জানো ?/বলে পিসীর বাড়ী থেকে ফিরে এলে তুই
হুমদো হয়ে যাস। হ্যাঁ পিসীমনি আমি
হুমদো? ” গাল ফুুলিয়ে পিসীর দিকে চায় সোনাই। হেসে ফেলেন সুনেত্রা।.উত্তর দেয় মোক্ষদাই।
” ওসব কথায়কান দিয়ো না তো। হোস্টেলে কী ভালো করে খাওয়া হয়? তুমি খাও। আর একটা রুই মাছ দিই? “
” মাপ কর বাবা। আর নয়। এগুলো আগে উদ্ধার করি” বলতে বলতেই থেমে যায় সোনাই।
” কী এত ভাবছ পিসীমনি? তখন থেকে দেখছি।কী হয়েছে?”
” কই কিছু না তো। তুই কী বলছিলি দুদিন থাকবি?”
” খুব অন্যমনস্ক লাগছে তোমাকে । খাচ্ছো ও না ঠিকমত”
“কই? এই তো! তুই বল” নিজেকে সামলে নেন সুনেত্রা।
” পিসীমনি ” এক ঢোঁক জল গিলে একটু অন্য রকম সুরে ডেকে ওঠে সোনাই।
“কী রে?”
” আমি তোমাকে জিজ্ঞেস না করেই একটা কাজ করে ফেলেছি”
বিস্ময়ে ভ্রু তোলেন সুনেত্রা। ” কী?”
” তুমি রাগ করবে না বলো”
চোখের কোন দিয়ে ওর মুখখানা জরীপ করে নেন সুনেত্রা। তারপর গম্ভীর মুখে বলেন
“সেটা না শুনে বলা সম্ভব নয়”
“আসলে ” অনাবশ্যক দুটো ঢোঁক গেলে নেয় সোনাই,” আমাদের কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশান তো। চীফ গেষ্ট কে হবেন তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। সবাই তোমার নামই করছিলো। আর তারপর আমি তোমার—-“
” তুই কি বলে দিয়েছিস নাকি রে?” আঁতকে ওঠেন সুনেত্রা
” প্লীজ পিসীমনি । ওরা আমাকে এমন করে ধরল যে আমি না করতে পারিনি। বিশ্বাস কর আমি বলেছিলাম তুমি এসব পছন্দ করো না
ওরা সবাই পাগলের মত ভক্ত তোমার! কী বলে জানো ? বলে তোমার মত একজন রাইটার——“
চুপচাপ ওর মুখের দিকে চেয়েছিলেন সুনেত্রা। আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছিল সোনাইএর গোলগাল মিষ্টি মুখখানা। আর সেখানে ফুটে উঠছিল যন্ত্রনায় ভাঙাচোরা,বেদনায় ক্লিষ্ট একখানা অতি সাধারন মুখ। না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ির ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো জলের ধারা। স্পষ্ট দেখছিলেন সুনেত্রা,শুনছিলেন ও পরিস্কার।
” আমাকে মাপ করবেন ম্যাডাম। আমার বোধহয় এভাবে এখানে আসা উচিত হয়নি। আসলে এক নিদারুন যন্ত্রনা আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে”
” যন্ত্রনা!” নিজের কন্ঠস্বর নিজের কাছেই অপরিচিত সুনেত্রার”কিসের !”
” সে যন্ত্রনা আপনি দিয়েছেন । আপনি”
” আমি! ” বিস্ময় তখন অপমান বোধকেও ছাড়িয়ে চলে গেছে। চেয়ার ছেড়ে ততক্ষনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সুনেত্রা, ” মানে!”
ধপ করে নীচে প্রায় ওর পায়ের কাছে বসে পড়েছিল লোকটা
” আমায় মার্জনা করবেন। আমি ঠিক মানে বুঝিয়ে বলতে পারছি না ”
আশ্চর্য এর পরও সুনেত্রা তাড়িয়ে দেননি লোকটাকে। তখনও নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বোঝবার চেষ্টা করছেন। যেভাবে এতদিন মানুষ চিনে এসেছেন। জেনেছেন সবার ভেতরেই থাকে এক একটা গল্প। ঠিক জায়গায় সুর লাগাতে পারলেই বাইরের মুখোশের আড়াল থেকে ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে আসে। সেই আশাতেই তখনো লোকটাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন সুনেত্রা। প্রতি মুহূর্তেই আশা করছেন এবার ভেঙে পড়বে লোকটা , হাউমাউ করে বলে ফেলবে আসল কথাটা।
ভেবেছিলেন ঠিকই। এবার সত্যি সত্যিই বলতে শুরু করেছিলো অমল মিত্র। থেমে থেমে ,জড়িয়ে জড়িয়ে ,কিছুটা দ্বিধায় ,কিছুটা আবেগে। কিন্তু যা শুনলেন তাই কী আশা করেছিলেন সুনেত্রা! অতি বড় দুঃস্বপ্নেও! কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছিল স্নায়ুতন্ত্র। শেষের দিকে বোধহয় প্রায় বধির ই হয়ে গিয়েছিলেন নইলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কন্ঠস্বর আর কেন পৌঁছোচ্ছিল না তার শ্রবনে! শুধু দুটো তীব্র চোখ আর প্রসারিত তর্জনী——–
” পিসীমনি পিসীমনি”
কে ডাকছে না! সোনাই । হ্যাঁ হ্যাঁ । সোনাই ই তো। সম্বিত ফিরে পান আবার
” হ্যা বল”
” কী এত ভাবছো বসে বসে? তাহলে যাবে তো?”
” তুই তো জানিস সোনাই আমি এসব ভালবাসি না। এসব ফাংশান টাংশান আমি—“
” প্লীজ পিসীমনি। একবার । আমার বন্ধুরা তোমাকে দেখার জন্য পাগল। কী বলে জানো ? বলে যে হাত দিয়ে অমন লেখা বেরোয় সেই হাতখানা একবার ছুঁয়ে দেখবে ওরা”
নিমেষে বুকের রক্ত তোলপাড়। ধড়ফড় করে ওঠেন সুনেত্রা। ” আমার লেখা সব পড়িস নাকি তোরা?”
যুৎসই করে ধরে একটা মাংসের হাড় চুষছিলো সোনাই। প্রশ্ন শুনে চোখ গোল করে তাকালো
” কী যে বল তুমি ? তোমার লেখা পড়ব না? সব সব। একটাও বাদ নেই। কোন কোনটা তো বার বার পড়েও—-”
চোখের সামনে থেকে দুলতে দুলতে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল সব। শুধু আবেগে আপ্লুত এক কন্ঠস্বর একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছিল সবটুকু চেতনা।
” আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ম্যাডাম আপনার প্রথম উপন্যাস “বোধন “এর কথা। আঃ। কত রাত আমি সে বই বুকে করে কাটিয়েছি। প্রথম লেখাতেই প্রমান করে দিলেন কতখানি শক্তি ধরে আপনার লেখনী। আর আমরা ,আপনার পাগল, অন্ধ ভক্তরা দিন গুনতে শুরু করলাম কবে বেরোবে আপনার পরের বই। বেশীদিন নয়। জন্ম নিলো জাগরী। শুধু সাহিত্যকে নয় যেন তার পাঠককেও আপনি পৌঁছে দিলেন অমৃতলোকে! এরপর আর হুঁশ ছিলো না জানেন? মুখ গুঁজে পড়ে থেকেছি শুধু আপনাতেই। খেয়ালই করিনি কবে একটু একটু করে সরতে শুরু করেছেন আপনি। কবে আপনার সেই অমৃতে মিশতে শুরু করেছে ——–“
” অনেক খেয়েছো। এবার ওঠো দিকি”
মোক্ষদার ধমকে হুঁশ ফিরে পান সুনেত্রা। সোনাই নেই । উঠে গেছে। কখন? চোখ ফিরিয়ে চাইতেই আবার ঝাঁজ মোক্ষদার।
” সে তো হাঁ করে তোমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে থেকে উঠেগেল। কী যে তুমি আজ ভাবতে বসেছো আকাশ পাতাল?”
উঠেই পড়লেন। মোক্ষদা তখনও গজগজ করেই চলেছে
” কতদিন পর মেয়েটা এলো । কোথায় একটু গল্পগাছা করবে তা না——-“
মনে মনে যথেষ্ট লজ্জিতই হন সুনেত্রা। মোক্ষদার কথা ঠিকই। বেশী আসতে পায় না মেয়েটা টুকটাক ছুটি থাকলেই ছুটে আসে এখানে। নিজেরও তো আপন বলতে কলকাতা শহরে ওই ভাইঝিটিই। ভাই থাকে শিলিগুড়িতে।সুনেত্রার বড় হওয়াও সেখানেই। পরে চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসা। এ বাড়ী আরও অনেক পরে। চাকরি করা কালীন ঠিকানা ছিলো গার্লস হোস্টেল। পরে মানে অনেক পরে যখন চাকরি ছাড়লেন , লেখার জগতে পাকাপাকি স্হান করে নিলেন প্রয়োজন হোল কলকাতায় থাকার একটা সুবিধাজনক আস্তানা—-এই বাড়ি সেই তখনকার। বাবা , মা বিয়ের আশা করতে করতে গত হলেন। আর নিজেও নিশ্চিন্ত মনে ঢুকে পড়লেন লেখার জগতে। বয়স পেরিয়ে গেছে কখন খেয়ালই হয়নি। হুঁশ যখন ফিরল তখন রগের দুপাশের চুল সাদা। ভাইয়ের বেলায় সতর্ক ছিলেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছেন ভাইপো ভাইঝি দুজনেই আদরের। তার মধ্যে সোনাই বেশী কাছের। কলকাতায় হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। সুনেত্রা চেয়েছিলেন এ বাড়িতেই থাক। ছিলো ও প্রথম দিকে। পরে যাতায়াত, কোচিংক্লাশ, মেয়েটা টানতে পারছিলো না আর। শেষে সুনেত্রাই ব্যবস্হা করলেন। এখনও ছুটি পেলেই এখানে পালিয়ে আসে মেয়েটা। এ বাড়িতে একটা ঘর ওর জন্য সারা বছর সাজানোই পড়ে থাকে।
পর্দা সরিয়ে সেখানেই এখন পা দিলেন সুনেত্রা। পিঠ কাটা ছোট্ট একটা টপ আর শর্ট স্কার্ট পরে ওর দিকে পিছন ফিরে উপুড় হয়ে বই পড়ছে সোনাই।
” কী রে হঠাৎ উঠে চলে এলি?”
” কী করব? খাওয়া হয়ে গেলেও বসে থাকব?”
” কী পড়ছিস ? এত মন দিয়ে?”
উত্তর দেবার আগেই মোবাইলটা বেজে উঠল ওর। মুখ ফিরিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয় ও। আর পরক্ষনেই ওর স্পষ্ট ভাবান্তর চোখে পড়ে সুনেত্রার। আড়চোখে পিসীর দিকে তাকিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাইরে। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকেন সুনেত্রা। কার ফোন! বাইরে নিয়ে যাবার কারন! বিশেষ কেউ বোধ হচ্ছে! খবর নিতে হবে। উঠতে গিয়েও আবার ফিরে তাকালেন। কী পড়ছিলো মেয়েটা? ওরকম নিবিষ্ট হয়ে! ঝুঁকে পড়ে দেখতে গিয়েই কান গরম। ওর সাম্প্রতিক উপন্যাস খানাই ধরেছে সোনাই।.কিন্তু পাশে পড়ে থাকা লাল পেনসিলটার দিকে তাকান সুনেত্রা। এটা! এটা কেন? মাথার ভেতরে কেমন একটা অস্হিরতা নাড়া দিচ্ছে। দ্রুত হাতে ওর পড়ে আসা পিছনের পাতাগুলো ওল্টাতে থাকেন ।রক্ত জমছে মুখের দুপাশে। বুকের ভেতর যেন ঢেঁকির পাড়! পাতায় পাতায় লাল মার্কিং। এক একটা রক্তাভ লাইন যেন তীক্ষ্ণ ছুরির মত বুকে এসে বেঁধে———-
” নাইট ল্যাম্পের মায়াবী আলো যেন পিছলে পড়ে তন্দ্রার ব্রোঞ্জ রঙা নিরাবরন শরীর বেয়ে । ওর দুঃসাহসী বিভাজিকা , কামনানীল কটি যেন দুবাহু বাড়িয়ে আমন্ত্রন জানাচ্ছিল দীপ্তকে। এক উদগ্র লালসায় সে দিকে মন্ত্র মুগ্ধের মত এক পা এক পা করে ——“
দম বুঝি বন্ধ হয়ে আসে। শিরায় শিরায় উন্মত্ত রক্তস্রোতের দাপাদাপি। এক তীব্র বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ যেন নিমেষে ধাঁধিয়ে দিয়ে যায় চোখ। চোখের সামনে এক এক করে উন্মোচিত হচ্ছে ওরা। তার সৃষ্টি , তার সর্বস্ব। নগ্ন , বড় প্রকট ,সর্বাঙ্গে অশ্লীলতার ঘা। ” গঙ্গার উন্মুক্ত পিঠে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে আস্তে আস্তে শরীরটাকে মিশিয়ে দিচ্ছিল শান্তনু। একটু একটু করে নিজেকে নিরাবরন করছিলো গঙ্গা। ওর সুগভীর নাভি, দুধ সাদা মসৃন উরুর নীচের বেপরোয়া ——-” সমস্ত শরীর জুড়ে এক তীব্র দাহ। চোখ তুলতে ভয় করছিলেন সুনেত্রা। তুললেই বুঝি ওর চোখের সামনে জেগে উঠবে একটা আঙুল । ” আপনি কিএকবারও ভাবেন এই লেখার পরিনাম? আপনার সন্তান নেই কিন্তু সন্তান সম যারা তাদের কথা? ভাবেন কি তারা যখন এই বইগুলো বুকের ওপর ধরে গোগ্রাসে গেলে কী জন্ম নেয় তাদের ভেতর? জানেন কী?
শিউরে ওঠেন সুনেত্রা। একজোড়া অপলক ,আকুল চোখ, চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা জল যেন বারবার প্রতিধ্বনি করে” ম্যাডাম এ লেখা আপনার! এই ভাষা আপনার?
আঃ। একবারের জন্যও কি সত্যি সত্যি বধির হয়ে যেতে পারেন না সুনেত্রা¡ পারেন না কী এক মুহূর্তের জন্যও অহরহ বাজতে থাকা ওই কন্ঠস্বরের গলা টিপে ধরতে!
” পিসীমনি”
পলকে স্হির হয়ে যান সুনেত্রা। সোনাই ঘরে ঢুকছে।
” কীগো? নিজের বই নিয়ে নিজেই ডুবে আছো? অবশ্য হতেই পারে। যা লেখা একখানা——”
মাথার ভেতর সশব্দে ফেটে যায় বোমাটা। সপাটে বই বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ান সুনেত্রা। তারপর সজোরে থাপ্পড় কষান ওর নরম নিটোল গালে
” তুই এই বই পড়লি কেন ? বল কেন পড়লি?”
-:: সমাপ্ত ::-