“করোনা রহস্য”
¤●¤●¤●¤●¤●¤●¤●¤●¤
–:: কাকলি ঘোষ ::–
দরজা খুলে হাঁ হয়ে গেলাম। লালমোহন বাবু। এত সক্কাল সক্কাল ! উঁকি মেরে দেখি গাড়ি টা দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাথের গা ঘেঁসে। হরিপদ বাবু স্টিয়ারিং এ। চোখ তুলে তাকিয়ে হাসলেন জটায়ু,
” ইয়ে, তোমার দাদা বাড়িতে আছেন নাকি ?”
বাড়িতে থাকবেন না তো কোথায় যাবেন! আশ্চর্য তো! বাড়ি থেকে এখন বেরোনো যে মানা তা কি ভদ্রলোক জানেন না! এই অবস্থায় উনি ই বা কেন – কৌতূহল দমন করে কলিং বেলের নিচে রাখা স্যানিটাইজার এর দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাই । এক গাল হাসেন লালমোহন বাবু।
” ও বলতে হবে না ভাই। আগেই হাত ধুয়িচি। তারপর কলিং বেলে হাত লাগিয়েচি।”
দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম।
ফেলুদা সবে রোজকার স্বাস্থ্য চর্চা শেষ করে সোফায় হেলান দিয়েছে। এখনও চা খাই নি আমরা। জটায়ু ঘরে ঢুকতেই নিমেষে ফেলুদার ভ্রু দুটো প্রথম বন্ধনীর আকার ধারণ করলো। হাসি চেপে ভেতরে গিয়ে তিন জনের চায়ের কথা বলে আবার বাইরের ঘরে এসে দেখি আমতা আমতা করছেন ভদ্রলোক। ফেলুদার কড়া চোখ,
” আপনাকে পুলিশ আটকায় নি? ”
ফেলুদার ভাব খানা দেখে মনে হচ্ছে দরকার হলে এক্ষুনি পুলিশ কেই ফোন করে বসবে বুঝি ও।
” আটকায় নি আবার ? ” , একগাল হেসে স্বীকারোক্তি জটায়ুর, ” আলবাত আটকেছে মশাই”
” তো ছাড়া পেলেন কি করে? আপনার রিসেন্ট বই __ কি যেন __ ওই __” মিশরে মিসহ্যাপ ” সেই টে উপহার দিয়ে?
” দূর মশাই। ওসবে কাজ হবার নয়। কাজ হল এতে__ । দেখা মাত্রই __ বুঝলে ভাই তোপসে __ খাতির করে ছেড়ে দিলে __”
পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে দেখালেন লালমোহন বাবু। এক নজর তাকিয়েই দেখলাম ওটা ফেলুদার কার্ড। অর্থাৎ ওই টি কে হাতিয়ার করে ভদ্রলোক রাস্তায় বেরিয়েছেন। আর ফেলুদাকে চেনে না এমন লোক কম ই আছে। আজকাল বেশ নাম ডাক হয়েছে ওর। হাসিমুখে ফেলুদার দিকে চাইতেই দেখি ও তেমনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
” ভবিষ্যতে এটা আর করবেন না। কত জনকে কার্ড দেওয়া আছে মনে নেই। এখন সকলেই যদি আপনার মত___”
কঠিন ভাবে ঘাড় নাড়ল ও।
চা এসে গেছিল। ” ইয়ে মানে একটা ব্যাপার __” ঈষৎ অপ্রস্তুত মুখে চায়ে চুমুক দিলেন জটায়ু।
” হ্যাঁ। বলুন ” , বিস্কুট ভেঙে মুখে পুরে সপ্রশ্ন দৃষ্টি তে তাকায় ফেলুদা।
” আমার বাড়ির পাশে বুঝলেন মশাই __একটা কিছু ঘটছে। মানে হাইলি সাসপিশাস কিছু! কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারচি না। ”
” বোঝার দরকার নেই। ঘটনাটা বলুন। ” চা শেষ করে চারমিনার ধরালো ফেলুদা।
” ঘটনা টা মানে __ আমার পাশের বাড়ি বুঝলেন __” , চা এর কাপ নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসলেন লালমোহন বাবু, ” এখন অবশ্য আর বাড়ি বলা যায় না। রাজেন বাবু জমিটা প্রোমোটার কে দিয়ে ফ্ল্যাট করে নিয়েছেন। সাকুল্যে বারো খানা ফ্ল্যাট। বড় ছোট মিলিয়ে। রাজেন বাবুর ভাগে যেটা পড়েছিল তিনি নিজেও সেটা বিক্রি করে সোনার পুরের দিকে চলে গেছেন। দোতলা টা সম্পূর্ণ কিনেছেন বিকাশ সেন। সাজিয়েছেন ও তেমনি। যেমন প্যালেসিভ ফ্ল্যাট তেমনি ডেকরেশন। বুঝলেন মশাই। আমি তো আমার ওই ‘ গঙ্গা সাগরে রক্ত গঙ্গা ‘ বইতে ওই ফ্ল্যাট টার বর্ণনাই হুবহু তুলে ধরেছি। আর কি বলব __”
কথা শেষ করতে দেয় না ফেলুদা , ” ওই প্যালেসিভ কথা টা লিখেছেন নাকি ?”
” হ্যাঁ। কেন বলুন তো ?”
” পরের এডিশনে শুধরে নেবেন। ওটা প্যালেশিয়াল হবে। ”
মুখটা ঝুলে যায় ভদ্রলোকের। উৎসাহ দেবার জন্য বলি , ” বিকাশ সেন ! মানে __ সেন অ্যান্ড সেন পাবলিশার ? “
“ওরা ই আপনার শেষ চার টে বই ছেপেছিল না ? ”
ফেলুদার কথায় আবার চনমনিয়ে ওঠেন জটায়ু,
” ধন্য আপনার মেমোরি মশাই। হ্যাঁ ওরাই। মানে উনি ই হলেন সেন অ্যান্ড সেন এর কর্ণধার।”
” তো? ” সপ্রশ্ন চোখে তাকায় ফেলুদা
” বলছি, ” পকেট থেকে এলাচের কৌটো বের করে দুটো দানা মুখে দিয়ে আমার দিকে কৌটো টো বাড়িয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেন লালমোহন বাবু,
” পরশু রাত সাড়ে দশ টা নাগাদ বুঝলেন খাওয়া দাওয়া শেষ করে একবার দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম । আলো জ্বালিনি। রাস্তার মোড়ের লাইট গুলো ও বেশ কিছুদিন ধরে জ্বলছে না। মোদ্দা জায়গাটা অন্ধকার ই বলা যেতে পারে। এমনিতেই লক ডাউনের জন্য লোকে ঘরে। ফলে রাস্তা ও শুনশান। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ঢুকে যাব মনে করছি এমন সময় হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি। ”
” গাড়ি ?”
” হ্যাঁ। মানে ট্যাক্সি। আর সেখান থেকে নেমে এলো একজন। লম্বায় মশাই সাড়ে ছয় ফুটের কাছাকাছি। সঙ্গে একটা সুটকেস। নেমেই এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে ঢুকে পড়ল ‘সোনার তরী ‘ তে। ”
” অ। ফ্ল্যাটের নাম বুঝি সোনার তরী ? বেশ। তারপর ?”
” আমি মশাই দাঁড়িয়ে রইলুম। লোক টা কে ? এত রাতে কোথায় কার ঘরে এলো? অমন চোরের মতই বা কেন? কি রকম যেন সন্দেহ হচ্ছিল। এখন সরকার থেকে তো ঘোষণা করে দিয়েছে ভিন রাজ্য থেকে এলেও পরীক্ষা করাতে হবে। লুকিয়ে কেউ ঢুকলে সবার বিপদ ! তাই না ! দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ দেখি বিকাশ সেন বাইরের দিকের ব্যালকনির দরজা খুলে চারদিক দেখছেন। আরো অন্ধকারে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর ই দেখি সুপ্রকাশ , মানে ওনার বড় ছেলে । বাপ ছেলেতে কি কথা হল বোঝা গেলো না তবে দুজনেই বেশ উত্তেজিত মনে হল। ওরা ঘরে ঢুকে যাবার পর আরো কিছুক্ষন দাঁড়ালাম। কিন্তু আর কিছু দেখলাম না। আমি ও ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে __বুঝলেন__ দেখি বিকাশ বাবু ছাদে পায়চারি করছেন। তো আমি জিজ্ঞেস করলুম __ কাল অত রাতে কে এলো মশাই আপনার বাড়ি ? তাতে ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কেউ নাকি আসেনি। আমি ভুল দেখেছি__”
” তো আপনার এরকম সন্দেহ হল ই বা কেন যে ওনার বাড়িতেই এসেছে। অন্য ফ্ল্যাটে __ ও তো আসতে পারে। পারে নাকি ! “
এবার জটায়ুকে মাথা চুলকাতে হল। কিছুক্ষণ পরে বললেন , ” কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটেই তখন আলো জ্বলছিল। ওরাই বারবার বাইরে এসে দেখছিল। তাই___”
” সেটা অন্য কারণেও হতে পারে। ”
” কিন্তু লোক টা? যে ফ্ল্যাটেই আসুক বাইরের লোক তো! এখন তো বাইরের কারুর আসা নিষেধ! তাহলে __ ”
” পুলিশে খবর দিন ”
” গণ্ড গোল টা তো ওখানেই। যদি বিকাশ বাবুর ই লোক হয় __মানে ___ যদি উনি সত্যি না বলে থাকেন ___ ”
বুঝলাম। ধর্ম সংকটে পড়েছেন ভদ্রলোক। নিজের পাবলিশার এর বিরুদ্ধে যেতে ও মন সরছে না এদিকে বিবেক ও বাঁধ মানছে না। সাত সকালে সেই কারণেই তাড়া হুড়ো করে ছুটে এসেছেন ।
ফেলুদাকে অবশ্য বিশেষ ব্যস্ত হতে দেখলাম না। দিব্যি চারমিনার এর প্যাকেট আঙ্গুলের টোকা দিতে দিতে গুন গুন করে একটা রাশিয়ান ফোক গাইছে । আজকাল লোক সংগীত নিয়ে খুব পড়া শুনো করছে ও। কিছুক্ষণ পরে নিজেই বলল ,
” আচ্ছা দেখছি। আপনি বাড়ি যান। যা করার আমি করব। ”
এক গাল হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন লালমোহন বাবু, ” বাঁচালেন মশাই। চলি তাহলে। ও বেলা ফোন করে নোব অখন। চলি ভাই তোপসে। “
দরজা বন্ধ করে এসে বসতে যাচ্ছি ফেলুদা ইশারায় স্যানিটাইজার দেখিয়ে দিল। অর্থাৎ হাত ধুয়ে বোস।
( ২)
ভেবে ছিলাম ফেলুদা ব্যাপার টা নিয়ে ভাবছে ই না। দুপুরে খাবার টেবিলে ও দেখলাম চুপচাপ খেলো। তারপর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। বাইরে থেকে শুনলাম কোথায় একটা ফোন করছে । বিকেলে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম , ” পুলিশে খবর দিলে নাকি ?”
” পুলিশে খবর তো লালমোহন বাবুই দিতে পারতেন। দেন নি অসুবিধে বলেই না! তাহলে আমি দিলে সেই একই তো হল! যদি ধরে নি যে বিকাশ বাবুর বাড়িতেই লোক টা এসেছে তা হলে না করলেও সন্দেহের তীর লালমোহন বাবুর দিকেই যাচ্ছে। যদিও জটায়ু এখন প্রসিদ্ধ লেখক তবুও কোন মূল্যেই কোন লেখক ই প্রকাশক চটাতে চান না। ”
তাহলে! আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসল ও।
” তাহলে ভাবতে হবে। কি করলে সাপ ও মরে অথচ জটায়ু তথা রাজ্য রক্ষা পায়__”
” বিকাশ বাবুর এটা কিন্তু অন্যায়। যদি কেউ এসেই থাকেন জানানো উচিত। পরীক্ষা করানো উচিত। “
” এই সব উচিত কাজ গুলোই তো করছে না রে লোকে। তাই তো এত ঝামেলা ! ”
” তুমি কি করবে ? বেরোবে ? যাবে নাকি একবার লালমোহন বাবুর বাড়ির দিকে ? ”
” বেরোলে তোর খুব সুবিধে হয় তাই না ? বেশ ঘুরে আসতে পারিস! জানিস না লক ডাউন! বাড়িতে থাকতে হবে! ”
” তবে ?”
” তবে ঘরে বসেই করতে হবে। ব্যাপার টা শুনে তো আর চুপ করে থাকা যায় না ! ”
ঘরে বসে ফেলুদা কি করবে ভেবে পেলাম না। তবে এটুকু বুঝলাম এতে আমার কোন ভূমিকা সম্ভবত নেই। বিমর্ষ মুখে টিভি খুলে নিউজ দেখছি। ফেলুদা ও তাই। দু একবার উঠে গেলো ফোন টা নিয়ে। লালমোহন বাবুর অ্যাড্রেস টাও যেন দিতে শুনলাম। কাকে কি বলল কিছুই বুঝলাম না। শুধু ফেলুদার ঘাড় নাড়া, আর ” হ্যাঁ হ্যাঁ । ” ব্যস ব্যস “, আ্যাকটিং টা কিন্তু খুব ___ ” ” হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই ক্রসিয়াল ” এটুকুই কানে এলো। কাকে কি নির্দেশ দিচ্ছে জিজ্ঞেস করলাম না। কারণ উত্তর পাবো না।
ইদানিং কথা বলা বেশ কমিয়ে দিয়েছে ও। দিন রাত পড়াশোনায় ডুবে থাকে। এই লক ডাউন যেন ওর বেশ সুবিধেই করে দিয়েছে।
” অনেক বাকি রে তোপসে! সব পড়ে ফেলতে হবে। একটাই জীবন ! ” এই ওর মুখের বুলি এখন।
বসে থেকে থেকে শেষে গিয়ে ল্যাপটপ খুললাম। কাজ গুলো করে নেওয়াই ভালো। প্রায় ডুবেও গেছি কাজে হঠাৎ ফেলুদার গলা শুনে চমকে তাকালাম। সহর্ষে ফোনে কথা বলছে ও। হাত মুঠো করছে আবার খুলছে। এ লক্ষণ আমার চেনা। নির্ঘাত লক্ষ্য ভেদ করে ফেলেছে ও। কিন্তু ফোন টা কার ? কার সাথে কথা বলছে? শুনে তো মনে হচ্ছে জটায়ু! কি বলছেন ! কান পাতলাম ফেলুদার কথায়,
” হ্যাঁ। বলুন । কখন ? আচ্ছা ! এই সন্ধেবেলায় ! আপনি __ ! অ__ ! চিৎকার শুনে বাইরে এলেন ! তারপর তারপর ! বেরিয়ে এলো মূর্তিমান ! চিনতে পারলেন ! হা হা হা ! এলো তাহলে ! আর না এসেই বা কি করবে ? হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকার শুনলে কেই বা ঘরে বসে থাকতে পারে বলুন ! প্রাণের ভয় সবারই আছে ! কি বলছেন ? বিকাশ বাবুর ফ্ল্যাট থেকেই ! হা হা হা! আপনার অনুমান সঠিক তাহলে ! ফেলু মিত্তিরের এদ্দিনের সহযোগী __ আরে বাবা ! কিছু ইন্টিউশান তো বাড়বেই ! হ্যাঁ ! কি বলছেন ! যারা আগুন আগুন বলে হঠাৎ বাড়ির সামনে এসে চিৎকার করেছে আসলে তারা পুলিশের লোক ! সিভিল ড্রেসে ছিল ! ধরেছে ব্যাটাকে ! কোথা থেকে এসেছে ! দুবাই! বিকাশ বাবুর শালা ! যাক কিছুদিন ঘুরে আসুক কোয়ারান্টাইন থেকে ! যাক আপনার কোন অসুবিধে হল না তো ! বুঝতে পারেনি তো এর মধ্যে আপনি আছেন ! পারেনি। পারবে ও না। নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার পরের বই ” করোনায় কোরোনা ” নির্ঘাত হিট হবে। রাখছি তাহলে ! হ্যাঁ! কি? আর্সেলানে বিরিয়ানি ! আপনি খাওয়াবেন ! বেশ তো! সব মিটে যাক। লক ডাউন শেষ হোক। আমার কোন আপত্তি নেই। তোপসে আবার খায় কি না জিজ্ঞেস করি । হ্যাঁ রাখলাম। ”
হাসিমুখে ফিরে তাকালো ফেলুদা। “এনি কোয়েশ্চেন?”
” না। বুঝেছি। শুধু একটু মিলিয়ে নেব। তুমি তার মানে পুলিশেই ফোন করেছিলে?”
” হ্যাঁ। কিন্তু আন_ অফিসিয়ালি। ও এলাকার ওসি তাপস রায় আমার ক্লাস মেট। ওকেই পুরো প্ল্যান টা বলে দিলাম। কিছু সিভিল ড্রেসে পুলিশ অ্যারেঞ্জ করতে বললাম। ব্যস। হয়ে গেল। ”
” তাহলে জটায়ুর জটিলতা কাটল। কি বল ?”
“এটা আর বলতে যাস না। তাহলে ঐ নামে আবার একটা বই বেরিয়ে যাবে।”
—০০ সমাপ্ত ০০—