“তিন পাতা গল্প”
—সুবর্ণ রুদ্র
“মানুষের মতো মানুষ”
সকালের প্রথম আলোয় ধোঁয়াটে শহরের গলিপথটা যেন জীবনের নিঃশব্দ প্রতিচ্ছবি। ইটের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে হাঁটে হাজারো পায়ের ছাপ—কেউ খুঁজছে রুটি, কেউ খুঁজছে মানুষ, কেউ খুঁজছে একটা কাজ। পিঠে পেছনে ব্যাগ নেই, গন্তব্য নেই, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত তাড়া—যেন ভবিষ্যৎ দৌড়ে পালাচ্ছে আর তারা হা করে ধাওয়া করছে।
এমনই এক শীতভোরে, যখন চায়ের কেটলি ফুটতে ফুটতে গান ধরেছে—”ঝিং ঝিং বেল বাজে, উঠ রে ধরণী”—একটা দৃশ্য চোখে পড়ল যা দেখলে অন্তত পক্ষে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে হয় না, চোখই পরিষ্কার হয়ে যায়। কাঁধে লালচে কম্বল জড়ানো ছোট্ট এক মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তাঘাটের কোণে। তার পাশে, একটু সামনে, দাঁড়িয়ে ছিল তার ভাই—চোখে ভয় আর প্রশ্নের ছায়া, যেন এই শহরের প্যাঁচপ্যাঁচে জ্যামের মধ্যেই হারিয়ে গেছে তাদের ভবিষ্যৎ। তারা রাস্তা পার হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছে যেন জাতিসংঘের অনুমোদনের।
ঠিক সেই মুহূর্তে, ইতিহাসের পাঠ্যবই থেকে যেন পৃষ্ঠা ছিঁড়ে কেউ নেমে এলো—চকচকে স্যুট পরা, মাথা ব্যাকব্রাস করা চুল, এক হাতে বেতের ছড়ি ধরা এক ভদ্রলোক এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন বাচ্চাদের সামনে। কে বলবে তিনি কলকাতার নামকরা ব্যবসায়ী, জয়ন্ত ব্যানার্জ্জী? চেহারা দেখে মনে হবে, ‘ব্যবসায়ী’ নন, যেন অচেনা কোনও ঠাকুরদা হঠাৎ ভুল করে ভবঘুরেদের গ্রহের মাঝে নেমে পড়েছেন।
তার চোখে ছিল আশ্চর্য কোমলতা আর মুখে এমন একরাশ আশ্বাস, যা শুনলে গ্যাস কোম্পানির লোকও বলবে, “এই লোকটাকে নিয়োগ করা যাক অভুক্ত গ্রাহক সান্ত্বনার জন্য।”
জয়ন্তবাবুর জীবনে টাকা-পয়সার তেমন অভাব নেই—শুধু শান্তির নামে পকেট খালি। স্ত্রীর সঙ্গে সংসারভাঙা সম্পর্ক, ছেলে-মেয়ে নেই, আর সকাল-বিকাল দারোয়ান-রাঁধুনি-ড্রাইভারদের মুখ দেখে দেখে তিনি প্রায় নিশ্চিত, এ জীবনে শান্তি পেতে গেলে গঙ্গার ধারে ধ্যান করতে হবে, অথবা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াতে হবে।
এই দুই শিশু ছিল তাঁর জীবনের সেই ‘স্পয়লার এলার্ট’, যাদের দেখা মাত্রই তিনি বুঝলেন, মোমো খাওয়া আর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের মাঝে একটা আস্ত জীবন কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।
বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে জয়ন্তবাবু বললেন,
— “এই যে ভাইসাহেব আর ম্যাডাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন বলুন তো? আমি কিন্তু GPS না, তবে আন্দাজ করতে পারি।”
মেয়েটি একটু কাঁপা গলায় বলল,
— “দাদু… রাস্তা পার হব… ওই পাশেই আমাদের মায়ের দোকান ছিল…”
ভাষাটুকু ছিল কাঁচা, কিন্তু সুরে ছিল একটা স্থিরতা—যেমন ভাঙা হৃদয়ের সুরে মেলান মায়ের গলা।
জয়ন্তবাবু একটু চমকে উঠে বললেন,
— “ছিল মানে? এখন নেই?”
ছেলেটি হালকা মাথা নেড়ে বলল,
— “না দাদু… মা আর দোকান দুটোই চলে গেছে… আগুন লেগেছিল।” আর মা আমাদের ছেড়ে অন্য মানুষকে ভালবেসে তার হাত ধরে চলে গেছে। বাবাকে আমরা কোনদিন দেখিনি।
এইবার জয়ন্তবাবুর মুখ থেকে ‘হাঁ’ শব্দটা এমন ভাবে বেরিয়ে এল, যেন তিনি ফাইলিং ক্যাবিনেট খুলতে গিয়ে হঠাৎ নিজের পুরনো প্রেমপত্র পেয়ে গেছেন।
তিনি বললেন,
— “আচ্ছা, তাহলে এখন তোমরা কি করো?”
মেয়েটি একগাল হাসল, যেন গালভরা অন্ধকারের মধ্যে আলোর টিপ পরেছে।
— “ভগবান যা দেয় তাই…”
ছেলেটা খট করে বলল,
— “কিন্তু ভগবান স্যারদের স্কুলে পড়ে না। তাই আমাদের দেয়া বেলা ভিষন ক্রিপন।”
এই কথার পর জয়ন্তবাবুর চোখেমুখে এমন একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠল, যেটা সচরাচর দেখা যায় যখন কেউ ডিম সেদ্ধ করতে গিয়ে ডিমের বদলে ঘুঘুর বাসায় হাত দেয়।
তিনি হেসে ফেললেন।
— “তবে কি জানো, আজ আমি কিছু একটা দেব। স্কুলের ভর্তি ফর্ম না, কিন্তু স্কুলের মত একটা জায়গা হয়তো…”
সেই সকালে, শীতের দমকে, কুয়াশার আড়াল থেকে যে সূর্য উঠেছিল, সে যেন একটু বেশি উষ্ণ হয়েছিল ওই তিনটে হৃদয়ের জন্য। আর পথঘাট, রুটির খোঁজ, মানুষের খোঁজ—সব মিলিয়ে এক নতুন সংলাপ শুরু হল, যার কোনো কমা ছিল না, শুধুই যতিচিহ্ন ছাড়া।
জয়ন্তবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
তাঁর চোখে ভাসছিল মেয়েটার মুখ।
ছোট্ট মুখ, তবু কত কথা! ভয় হীণ, অহঙ্কার হীণ, সাবলিল বক্তব্য।
ছেলেটার চোখেও একটাই কথা—এক টুকরো মাথার উপর ছাদ খোঁজার ব্যাকুলতা।
তিনি বললেন,
— “তোমাদের নাম কি?”
মেয়েটি বলল, “পুষ্পা।”
ছেলেটা একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি শুভ।”
জয়ন্তবাবু হালকা হাসলেন।
— “পুষ্পা আর শুভ, এখন যওয়া হবে কোথায়?”
পুষ্পা মাথা নিচু করল।
— “কোথাও না… রাতটুকু ওই পুজো মণ্ডপের চালার নিচে কাটিয়েছিলাম।”
শুভ ফিসফিস করে বলল,
— “সেইখানের কর্ম কর্তারা আজ সকালে আমাদের তাড়িয়ে দিল।”
এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন জয়ন্তবাবু।
তারপর বললেন,
— “চল দেখি, চল এবার একটু কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।”
ওরা প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর ভাই বোন নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে ভয় মিশ্রিত কন্ঠে তারপর জয়ন্তবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে, পিয়ালী আস্তে বলল,
— “আপনি আমাদের দাদু…?”
জয়ন্তবাবু একটু থেমে বললেন,
— “হ্যাঁ, হয়তো তাই, তোমাদের নতুন দাদু।”
তারপর তিনজন একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল।
শহরের গলিপথ পেরিয়ে, এক পুরোনো চায়ের দোকানে গেলেন জয়ন্তবাবু।
চায়ের গন্ধে পুষ্পার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
শুভ ততক্ষণে এক কোণে বেঞ্চের উপর বসে পড়েছে।
জয়ন্তবাবু দোকানদারকে বললেন,
— “দু’টো করে গরম লুচি-তরকারি, আর এক কাপ করে দুধ দাও। কিন্তু চিনি কম দেবে।”
দোকানদার একটু অবাক।
এতদিন পরে এই ভদ্রলোক কাউকে সঙ্গে করে এনেছেন!
সাধারণত তিনি চুপচাপ এসে এক কাপ লেবু চা খেয়ে চলে যান। খুব একটা কথা তিনি কারো সাথে বলেন না।
খাওয়ার সময় পুষ্পা থেমে থেমে বলছিল—
মায়ের কথা, দোকানের কথা, আগুন লাগার দিনটা।
সব যেন সিনেমার দৃশ্য।
কিন্তু চোখের জল থেমে ছিল।
“ওদের কান্না গোপন করতে ওরা শিখে গেছে। ওরা শিশু হতে পারে, কিন্তু অভাব, অনিশ্চয়তা আর তাচ্ছিল্য মিলে ওদের শিখিয়ে দিয়েছে—কান্না সবসময় চোখ দিয়ে ঝড়ে না, অনেক সময় সেটা গলায় দলা হয়ে বসে থাকে, কথা না বলেও বোঝাতে হয়।”
খাওয়ার পরে, জয়ন্তবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন,
— “চলো, আজ আমার বাড়ি চলো। কিছুদিন থেকো। তারপর ঠিক করব স্কুলে ভর্তি করানো যাবে কি না।”
শুভ একটু ইতস্তত করল।
পিয়ালী পেছনে তাকাল।
একটা দ্বিধা, একটা বিশ্বাস—একসঙ্গে ওদের চোখে জ্বলজ্বল করছিল।
অবশেষে পুষ্পা বলল,
— “আপনি যদি আমাদের আপনার বাড়িতে ডাকেন, তবে আমরা চলি।”
শহরের পথ তখনো ছিল গন্ধমাখা কুয়াশায় ঢাকা।
কিন্তু ওদের মনে এক নতুন সকাল ফুটে উঠেছিল।
তিনজন মিলে রওনা দিলেন জয়ন্তবাবুর বাড়ির দিকে।
সে বাড়ি অনেক বড়।
কিন্তু এতদিন ফাঁকা।
আজ জয়ন্ত বাবুর মনে হল, বাড়িটা যেন এতদিন পরে শ্বাস নিচ্ছে।
জীবনের শব্দে, ছোট ছোট পায়ে দৌড়ের শব্দে, হাসির ধ্বনিতে। ছোট ছোট হাতের নড়াচড়ায় বাড়ির পরিবেশ এক নিমেষে বদলে গেল।
পিয়ালী রান্নাঘরের দিক তাকিয়ে বলল,
— “এত কিছু! আপনি কি একা থাকেন?”
জয়ন্তবাবু হাসলেন।
— “হ্যাঁ, এতদিন একাই ছিলাম। কিন্তু আজ থেকে নয়।”
শুভ আলনা থেকে একটা পুরোনো টুপি মাথায় চাপিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,
— “এটা আমার হবে?”
জয়ন্তবাবু মাথা নেড়ে বললেন,
— “তোমার। আর এ বাড়িটাও তোমাদের মত লোকের জন্যই অপেক্ষায় ছিল।”
বিকেলের দিকে জয়ন্তবাবু একটা ছোট্ট খাতা বার করলেন।
সেখানে তার ব্যবসার খরচ পত্র লেখা থাকে।
সেই খাতার এক পৃষ্ঠায় লিখলেন—
“নতুন বিনিয়োগ: দুই অনাথ শিশু। বিনিময়ে লাভ: শান্তি।”
খাতার নিচে একটুখানি হাসির চিহ্ন আঁকলেন।
তাঁর জীবন এখন নতুন করে শুরু হচ্ছে।
জয়ন্ত বাবু যে স্কুলে পড়তেন, সেই পুরনো লাল ইটের দোতলা ভবনটা আজও দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক আগের মতোই। শুধু তাঁর কিশোর বয়সটা যেন হারিয়ে গেছে ঐসব বেঞ্চির ফাঁকে।
তিনি সোজা প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে বললেন,
— “দু’জন বাচ্চা আছে, পড়াশোনায় ওদের মন আছে, শুধু ঠিকমতো সুযোগ পায়নি। আমি চেয়েছি, ওরা এখানেই পড়ুক। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি।”
প্রিন্সিপাল প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলেন, কিন্তু জয়ন্তবাবুর চোখে সেই দৃঢ়তা দেখে আর প্রশ্ন করেননি।
তবে বলেছিলেন—
— “আপনার চোখে যেন ঠিক যেন আমার বাবার মত দৃষ্টি! তিনিও একবার এমন দু’জন বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিলেন।” আমি তাদের একজন, সুতরাং আপনি দায়িত্ব নিলে আমি প্রস্তুত।
পুষ্পা আর শুভর জন্য স্কুল ইউনিফর্ম, জুতো, ব্যাগ—সব নতুন কেনা হল।
পুষ্পা ইউনিফর্ম পরে আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,
— “দাদু, আমি দেখতে কি স্কুলের মেয়ের মতো লাগছি?”
জয়ন্তবাবু মাথা নেড়ে বললেন,
— “তুই তো এখন আমার ছোট্ট প্রিন্সেস!”
শুভ একটু গম্ভীর, বইয়ের গন্ধেই সে মুগ্ধ।
জয়ন্ত বাবু ওকে একটা নতুন জ্যামিতি বক্স কিনে দিলেন, শুভ তা হাতে নিয়ে বলল,
— “এরকম জিনিস আমি সিনেমায় দেখেছি, কিন্তু হাতে ধরিনি কখনো!”
এখন রোজ সকাল সাতটায় জয়ন্তবাবুর গাড়ির হর্ন বাজে।
দুটো ছোট্ট বাচ্চা হইহই করে নেমে আসে সিঁড়ি দিয়ে।
গাড়িতে বসে শুভ জানলা দিয়ে বাইরের গাছ দেখায়—
— “দাদু, ওই গাছে কাল একটা শালিক বসেছিল!”
পুষ্পা বলল,
— “দাদু, গতকাল ক্লাসে আমি গুনে গুনে দশটা উত্তর ঠিক করে বলেছি!”
জয়ন্ত বাবুর হাসির রেখা মুখে ফুটে ওঠে।
এ হাসি অনেকদিন পরে তার জীবনে ফিরে এসেছে।
স্কুল ছুটি হলে তিনি গিয়ে ওদের নিয়ে আসেন।
সেই সময়ে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে তার বেশ ভালোই লাগে।
ছোটদের ভিড়ে নিজেকে তিনি এক অভিভাবক ভেবেই ফেলেছেন।
একদিন স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, পুষ্পা আবৃত্তি করল “আমার সোনার বাংলা…”
জয়ন্ত বাবু সামনের সারিতে বসে ছিলেন।
তার মুখ ঝলমল করছিল, গলা একটু কাঁপছিলও।
পরদিন পুষ্পা তাকে বলল,
— “আমার জন্য আপনি হাততালি দিয়েছিলেন তো, দাদু?”
তিনি বললেন,
— “শুধু হাততালি না, মনে মনে তোমার জন্য একটা পদক ও বানিয়ে ফেলেছি!”
রবিবারগুলো হয়ে উঠল বিশেষ দিন।
ওরা নিজেরা ঠিক করল—রবিবার মানেই “দাদুর দিন”।
ওরা তিনজন মিলে গঙ্গার ধারে ঘুরে আসে, বইয়ের দোকান ঘেঁটে গল্পের বই কেনে, আর সব শেষে “ওল্ড কলকাতা কেবিন” নামের এক পুরনো দোকানে খিচুড়ি-আলু ভাজা, ডিম ভাজা খেয়ে তবে বাড়ি আসেন।
খাওয়ার সময় শুভ বলল,
— “দাদু, এই দোকানে কি আপনি ছোটবেলায় খেতেন?”
জয়ন্ত বাবু মুচকি হাসলেন,
— “আমি এখানে খেতাম না, আমি এখানে খাবার স্বপ্ন দেখতাম।”
পুষ্পা বলল,
— “স্বপ্ন খাওয়া যায়, দাদু?”
তিনি বললেন,
— “হ্যাঁ, খাওয়া যায়—যদি তুমি জানো সেটা কোথায় বানায়।”
এভাবেই কাটছিল দিন।
দু’টো ছোট মুখ আর এক বুড়ো মানুষ—তিনটি জীবন একসঙ্গে বুনে চলেছে এক নতুন গল্প।
একদিন রাতের খাবারের পর পুষ্পা হঠাৎ বলল,
— “দাদু, আমি বড় হয়ে তোমার মতো একজন মানুষ হতে চাই।”
শুভ বলল,
— “আমি কিন্তু বিজ্ঞানী হবো, তবে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে, দাদু!”
জয়ন্ত বাবু ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “তোমরা আমার জীবনের সেই অধ্যায়, যা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন আবার লিখতে পারছি।”
সেই রাতে, ঘরের কোণে রাখা পুরনো পিয়ানোটা যেটা বহুদিন ধরে বন্ধ ছিল, হঠাৎ করেই খোলা হল।
জয়ন্ত বাবু কয়েকটা চাবি টিপে পুরনো সুর বাজালেন।
পুষ্পা আর শুভ দু’পাশে বসে, চুপ করে শুনছিল।
সে সুরে ছিল না কোনো আড়ম্বর।
ছিল শুধু শান্তি, আর ভালোবাসা।
এ গান এক হারানো জীবনে আবার ফিরে আসার গান।
বছরের শেষ বিকেলটা যেন একটু বেশিই নরম হয়ে আসে। কলকাতার আকাশে তখন মৃদু লালচে ছায়া, আর বাতাসে মেলা আর চিনেবাদামের গন্ধ।
সেই বিকেলে গঙ্গার ঘাটে তিনটি মানুষ পাশাপাশি বসে ছিল।
এক বৃদ্ধ, যার সাদা চুলে সূর্যের আলো পড়লে চকচক করে ওঠে, আর দুটো শিশু—একটি মেয়ে, একটি ছেলে।
তাদের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই, তবু চোখে মুখে যেন এক অদ্ভুত মিল।
তিনজনেই চুপচাপ।
তবে এই নীরবতা ভয়ের নয়—এ যেন এক নির্ভরতার নীরবতা।
দূর থেকে দেখলে কেউ বলত—
“এরা বুঝি দাদু আর দুই নাতি-নাতনি।”
কেউ আবার বলল—
“এ যেন একটা ছোট সংসার, যাদের কাছে রোজকার জীবনের হিসেব-নিকেশের চেয়ে ভালোবাসাটাই বড়।”
শুভ একটা ছোট পাথর ছুঁড়ে মারল গঙ্গার জলে।
জল ছিটকে উঠলো—পুষ্পার গায়ে দু’ফোঁটা পড়ল।
সে চট করে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— “দেখো না, দাদু! ও জল ছিটাল!”
জয়ন্ত বাবু মুচকি হেসে বললেন,
— “আর আমি বলছি, এটা গঙ্গার আশীর্বাদ!”
তারা একসঙ্গে হেসে উঠল।
সে হাসি যেন একটা ছায়াছবির শেষ দৃশ্য—চুপচাপ দর্শক দেখছে, আর মনের ভিতরটা ভারী হয়ে উঠছে।
পুষ্পা মাঝে মাঝে জয়ন্তবাবুর হাত ধরে হাঁটে।
আর বলে,
— “তুমি তো একা ছিলে, তাই না, দাদু?”
তিনি বলেন,
— “হ্যাঁ, একা ছিলাম, ঠিক যেমন খালি কাগজে কিছু লেখা থাকে না। এখন তো তোমরা দু’জনেই আমার পাতায় পাতায় ছাপা হয়ে গেছ।”
শুভ হঠাৎ একদিন বলল,
— “তুমি যদি আমাদের না পেতে, তাহলে কি করতে?”
জয়ন্ত বাবু থমকে গেলেন।
তারপর মাথা নিচু করে বললেন,
— “তাহলে বোধহয় এই শীতে আমিও কোনো কম্বলের নিচে গুটিয়ে থাকতাম, কাঁপতাম… শুধু শরীর নয়, মনও।”
শুভ কিছু না বলে দাদুর হাত ধরে বসে থাকল।
পুষ্পা এবার নিজের ডায়েরি খুলে একটা ছবি দেখাল।
তিনটি মুখ—এক বুড়ো মানুষ, একটি মেয়ে, আর একটি ছেলে।
নিচে লেখা—
“আমাদের তিনজনের পৃথিবী।”
সে ডায়েরি দেখে জয়ন্তবাবুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
সেই চোখে আনন্দ ছিল, কৃতজ্ঞতা ছিল, আর একটা আশ্চর্য বিশ্বাস—
“ভালবাসা রক্তে খোঁজে না, চোখে খোঁজে না। ভালবাসা খোঁজে মন দিয়ে, আর মন যেখানে মিশে যায়, সেখানেই তৈরি হয় আসল পরিবার।”
দিন যায়, রাত যায়।
জয়ন্ত বাবুর জীবনের ঘড়িতে এখন আর কাঁটা নেই, সেখানে শুধু ছন্দ আছে।
এই তিনজনের মাঝে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত ভারসাম্য।
পুষ্পা যতটা আবেগ, শুভ ততটাই যুক্তিবাদী।
জয়ন্তবাবু মাঝে দাঁড়িয়ে সবকিছুকে বোঝেন, সামলান, ভালোবাসেন।
দূর থেকে যদি কেউ চুপচাপ দেখে, বুঝবে না এই তিনজনের মধ্যে কে কার কি।
কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলেই বুঝবেন—
এই তিনজন, একে অপরের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করেছে।
তাইতো সেদিন কাজের মাসি বলে ছিল, শুধু বাগান থাকলে হয় না, সেখানে ফুল ফোটাতে হয়। তবেই তাকে বাগান বলে।
একদিন স্কুল থেকে ফিরেই পুষ্পা বলল,
— “দাদু, আমাদের কি কেউ এখান থেকে নিয়ে যাবে কখনও?”
জয়ন্ত বাবু মৃদু হেসে বললেন,
— “জীবন কাউকে কোথাও নিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু তুমি আর শুভ আমার জীবনেই থাকবে। তোমরা আমার গল্পের শেষ বাক্য। আর শেষ বাক্যটাতেই তো সব কথা বলা থাকে, তাই না?”
সেই রাতে, খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা তিনজন আকাশের তারা দেখল।
পুষ্পা বলল,
— “ওই তারা আমাদের দেখছে, দাদু।” দেখ দেখ কেমন মিটি মিটি করে তাকিয়ে হাসছে!
জয়ন্ত বাবু বললেন,
— “হয়তো তারা হাসছে—ভাবছে, এই পৃথিবীটা এখনও শেষ হয়নি… কারণ এমন ভালোবাসা এখনও বেঁচে আছে।”
—শেষ—