আপন জন (পর্ব দ্বিবিংশ)
কাকলি ঘোষ
“ আর শোন। এই ঘরের ডান দিকে বাথরুম। হাত মুখ ধুয়ে নিও। আমি গেলাম”
“ তুমি কে গো ?”
এতক্ষণে কথা বলতে পারে রিন্টি।
“ আমি ? আমি কল্পনা গো। এই বাড়িতেই থাকি। বৌদির সব কাজ আমিই করি।”
“ ও। আমি তাহলে কী করব?”
মুখ ফসকে বলে ফেলে ও l
একটু যেন থমকে যায় কল্পনা। তারপর হেসে উঠে বলে, “ কত কাজ আছে। সেসব বৌদি বলে দেবে। এখন হাত পা ধুয়ে এসো তো ” বেরিয়ে যায় কল্পনা। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রিন্টি ।
একটা ঘর ! পুরো ওর একার? বিশ্বাসই হয় না। গ্রামে থাকতে রান্না ঘরে শুতে দিত বৌদিরা। আরশোলা, মশা , মাছি ,সারাদিনের রান্নার গন্ধ। দম আটকে আসতো। অবশ্য ঘুমিয়েও পড়ত। সারাদিনের অবিশ্রান্ত খাটনির পর ওইটুকুই।তো বিশ্রাম। না একটা বালিশ। না চাদর। আর এখানে ! এক পাশে তক্তা পোশ পাতা। তার ওপরে বিছানা। পরিষ্কার চাদর। বালিশ। মশারি। ঘরের অন্যদিকে একটা আলনা। ওটা বোধহয় জামা কাপড় রাখার জন্য দিয়েছে। একটা কুঁজো তার ওপর গ্লাস। হঠাৎই ভীষন জল তেষ্টা পায় ওর। জল আছে কী ? হ্যাঁ আছে। গ্লাসটা নিয়ে জল গড়িয়ে খায় ও। তার মানে ও আসবে বলে সব ব্যবস্থাই করিয়ে রেখেছে বৌদি। কৃতজ্ঞতায় মন যেন পূর্ন হয়ে ওঠে। জল উপচে আসে চোখে। কোনক্রমে নিজেকে সামলে ও। কী দিয়ে গেল কল্পনা দি। দেখা যাক।
ব্যাগ টা খোলে ও। ওমা দু খানা ডুরে শাড়ি। সায়া। ব্লাউজও আছে। একটু বড় হবে মনে হয়। সে হোক। সেলাই করে নিলেই চলবে। পরনের কাপড় টা খুলে আলনায় ভাঁজ করে রাখে ও। ব্লাউজ টা থাক। একটা ডুরে শাড়ি শরীরে জড়িয়ে নেয়। কী সুন্দর সবুজ আর লাল ডুরে। কী ভালো লাগতো দেখতে এই শাড়ি গুলো। বৌদি পরত। রং নষ্ট হয়ে গেলে ওকে দিত। আজ এই প্রথম নতুন পরছে ও। ও বাবা ! এদিকের দেওয়ালে একটা আয়নাও আছে তো। গোটা নতুন আয়না। সামনে আবার একটা ছোট্ট কুলুঙ্গি মত। তাতে চিরুনি আর সাবান রাখা রয়েছে। এই সব ওর জন্য ! কী আশ্চর্য ! ইস ! সুখেনদা আর শিখা বৌদি দেখতে পেল না। কত খুশি হতো ওরা। ওদের জন্যই তো এখানে এমন জায়গায় আসতে পারল ও। কতদিন পর আয়নায় মুখ দেখল। ও। পিসিমা মাঝে মাঝে জোর করে চুল আঁচড়ে দিতেন। মুখ পরিস্কার করে রাখতে বলতেন। ইচ্ছাই হত না। আজকে অর্চনা বৌদি কী যেন বলছিল ?
–তোর চোখ দুটো খুব মায়াবী।—
কই ! ও তো কিছু বুঝতে পারে না। শুধু জল চলে আসে চোখে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল খুলে আবার আঁচড়ায় ও। বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে মুখ ধোয়। তারপর ঘরে শেকল দিয়ে আবার আস্তে আস্তে ওপরে ওঠে।
বৌদি ওই সুন্দর লম্বা লম্বা গদি লাগানো চেয়ারে বসেছিল। ওকে দেখে হাসল।
“ বাহ ! কী মানিয়েছে তোকে শাড়িটা ! একটু সাজবি গুজবি। বুঝলি ? আমি সব দেব। এখন কিছু খা। সেই কখন তো ভাত খেয়েছিস ! ”
মাথা নামিয়ে নেয় রিন্টি। কলকাতার সব লোকেরা এত ভালো হয় ! কাজের মেয়ের সঙ্গেও এমন ব্যবহার করে ! সত্যি স্বর্গ বটে কলকাতা !
“ চা খাস ?”
পেলে তো খাবে। রোজ তৈরি করে দিত দাদা বৌদিদের। তলানি যেটুকু পড়ে থাকত সেটাই জুটত। কোনদিন বৌদি একটু জল বেশি নিতে দিত না। চিনি বেশি খরচ হয়ে যাবে। তবু ওর মধ্যেই – মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়ে ও।
“ কল্পনা – ওকে চা দে। সঙ্গে কিছু খাবার দিস। ওর ক্ষিদে পেয়েছে।” রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে হাঁক পাড়ে অর্চনা।
একটু উসখুশ করে ওঠে রিন্টি। “ আমি যাব ? রান্নাঘরে ? হাতে হাতে কাজ করে দেব ?”
মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে অলস হাসে অর্চনা।
“ না। আজ নয়। কাল থেকে করিস। কল্পনা বুঝিয়ে দেবে কী করতে হবে।”
হাতের ফোনে মন দেয় অর্চনা। চোখ।ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে থাকে রিন্টি। কত বড় ঘড়ি ! কী সুন্দর সোনালী কাজ করা চারদিকে। ওটা বোধহয় টিভি। বাপরে ! কত বড় ! ঘরের মেঝেতে কী নরম একটা চাদরের মত পাতা । পা ডুবে যায় ! ওখানে বসতেই কী আরাম ! বৌদি চেয়ারে বসতে বলেছিল। ও বসে নি। সমানে সমানে বসতে হয় না। ওটা অসভ্যতা।
ক্রমশ :
অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ