তারিণীখুড়ো ও কলম-চরিত মানস
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আজ দিনটা সকাল থেকেই বেশ মেঘলা করে আছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হওয়ায় বেশ শীত শীত ভাবটাও বসার ঘরে রয়ে গেছে। নেহাত আজ রোববার বলে ইস্কুল যাওয়াটা নেই। নইলে এই আবহাওয়াতেও বই পত্র নিয়ে সেজে গুজে ইউনিফর্ম চড়িয়ে ঠিক বের হতে হত।
আমরা বলতে ন্যাপলা, ভুলু, চটপটি আর সুনন্দ মিলে বাধ্য হয়ে চটপটির নতুন স্ক্র্যাবেল গেমটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি আর ঠিক সেই সময় দেখি তারিণী খুড়োর আবির্ভাব। এই বদ্ধ পরিবেশে যে ব্যাপারটা যে একটা ‘ ইয়ে ‘ যাকে বলে ‘ ফেবুউউলাআআস্’ সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
……
হাতের ছাতাটা নামিয়ে রাখতে রাখতে খুড়ো বললেন, ” কদিন যা বাদলা! একেবারে ঘরবন্দী হয়ে পড়েছিলাম! আজ বৃষ্টিটা একটু ধরতেই পালিয়ে এসিচি!নে একটা চিনি ছাড়া চা আনতে বল্ তো দেখি! ” এই বলে খুড়ো আয়েশ করে তক্তপোশের ওপর বসে চোখ নাচিয়ে বললেন –
” কি রে! বুধবার তো ন্যাপলার জন্মদিন ছিল! ছোকরা আমাকে ডেকেছিল বটে কিন্তু একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায়…”!
ওনার কথাটা শেষ হলনা, তার আগেই ন্যাপলা ঘরে ঢুকেই খুড়োকে দেখতে পেয়ে একগাল হাসি হেসে বলল, ‘ কি খুড়ো! সেদিন এলেন না যে বড়?আপনার শরীর টরীর ঠিক আছে তো?…এই দেখুন বড়মামা লন্ডন থেকে এই শেফার্স কলমটা পাঠিয়েছেন! তাই ওটাই বুকে এঁটে কদিন হল ঘুরছি!”
……
কলমটা সত্যিই দেখতে সুন্দর। সোনালী মেটালের ওপর দারুণ লতাপাতার কাজ করা আছে। খুড়ো অনেকক্ষণ ধরে দেখে টেখে বলল, ” এসব কলম বেশ বাহারের বটে! আবার নিবের লেখাও ভাল! তবে এককালে এসব নিয়ে এই শর্মারও একটা কলেক্টরস্ গুমর ছিল বৈকি! তাই এটাকে দেখতে দেখতে বছর চল্লিশের আগে একটা ঘটনা মনে পড়ল! অবিশ্যি তোরা যদি এখন শুনতে চাস্ তবেই না হয়..!”
খুড়োর এই এক সমস্যা। গল্পের লোভ দেখিয়ে সুট্ করে থেমে যান। কাজেই ভেতরবাড়ি থেকে ভজুয়াকে চা এর জন্য তাগাদা দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কি বা করণীয় থাকবে!
……
চা এল। খুড়ো চোখ বুজে চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে একটা এক্সপোর্ট কোয়ালিটির বিড়ি ধরিয়ে ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে বললেন, ” শেক্সপিয়র সাহেবের কথাটা জানা আছে তো? হোরেশিও’র নাম করে উনি যে’কথাটা বলে গেছেন সেটা আজও একই রকম সত্যি। সব ঘটনার প্রচলিত ব্যাখ্যা আবার হয় না কি! “
ন্যাপলা ফোড়ন কাটল, ” আবার সেই ভূত টূত নাকি! এবার তাহলে বেশ একটু সিরিয়াস টাইপের হলে জমত না?”
খুড়ো কায়দা করে মুখটা বেঁকিয়ে বললেন, ” শোন! আমি মোটেও গপ্পো বানিয়ে বলিনা! হ্যাঁ! তবে গপ্পের খাতিরে একটু আধটু যেটা একটু মেশাতে হয় সেটাকে ‘আর্ট’ বলে বুঝলি! তাই বলে তুই ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা বা মেরী শেলীর লেখা ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের গপ্পে কি প্রোবাবিলিটি বা ক্যালকুলাস জাতীয় অংকের ফর্মূলা খুঁজবি ? তাছাড়া ওই রকম একটা গপ্পো একটা লিখে দেখাক দেখি আজকালকার কোন বোদ্ধা! হুঁঃ! “
……
ব্যাপারটা বিগড়ে যাচ্ছে দেখে আমরা ওদের কাজিয়া বাধ্য হয়ে থামাতেই খুড়োর মুডটা কতকটা চা এর গুণে শুধরে যেতেই উনি বলা শুরু করলেন।
” তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে থেমেছে। চারদিকে প্রচুর দেশী-বিদেশী ভাল জিনিসের মেলা। সেইসময় আমারও বয়স কম আর তোরা জানিসই যে আমি সর্বদা নতুন কোন ধান্দায় ঘুরতে ভালবাসি, তবে সেটা সেন্ট পার্সেন্ট সৎ পথেই সেটা আর নতুন করে আজ আর বলছি না। তখন আমি কলকাতার নামী নীলাম ঘর ‘ম্যাকফার্সন ব্রাদার্স এন্ড অকশন’ এর দোকানের ম্যানেজার। মোটের ওপর চল্লিশ টাকা মাইনে আর তার সাথে পুরনো জিনিসের সাহচর্য (এটাই অবিশ্যি আসল! ) এইসব নিয়ে বেশ আছি।
আমার কাজ ছিল অকশনে তোলবার আগে জিনিসটা যাচাই করা আর মালিকের সাথে দাম নিয়ে বোঝাপড়া করে নেওয়া। সেজন্য আমাদের নীলামঘরে না উঠলেও কিছু কিছু পুরনো দিনের জিনিসের একটু আধটু দর্শন আর সাহচর্য্য দুইই পেতাম।
……
এক বুধবারের সন্ধ্যেবেলা সবে দোকান বন্ধ করছি, এমন সময় এক বৃদ্ধ রহমৎ খাঁ দোকানে এল। রহমৎ এর আগেও আমাদের অনেক ভাল ঝাড়লন্ঠন বা পিয়ানো গছিয়েছে বলে আমি ও দিনের শেষমুহুর্তে এলেও খুব একটা বিরক্ত হলাম না।
বরং সামনের গুমটি থেকে দু ভাঁড় গরম চা আনাতেই বুড়ো কেমন ছলছল চোখে চেয়ে রইল। আমি বললাম, ‘ কি হল ভায়া! শরীর খারাপ নাকি? কিছু বলবে? কোন খবর আছে?’
সে তখন বলল যে ওর পেটে একটা টিউমার হয়েছে। তাই ডাক্তার বলেছে যে ওর আয়ু আর বেশিদিন নেই! ওদের আবার কোন ছেলেপুলে নেই। তাই বুড়ো মারা গেলে ওর বিবি আতান্তরে পড়বে। তাই আজ ও এসেছে কুড়ি টাকা চাইতে। যে’ কদিন ও বাঁচবে তারমধ্যে অন্তত একশোটা টাকা ও বেচারা বিবির জন্য বাঁচিয়ে রাখতে পারলে মৃত্যুর পরে দোজখে গেলেও ইবলিশের হাতে আর মুগুরের গুঁতো খেতে হবে না।
……
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল! হঠাৎ দেখি বুড়ো একটা কাপড়ের পুঁটলি খুলে দারুণ মিনে করা একটা সোনালী রঙের সাবেক ঢং এর কলম বের করে আমার টেবিলে নিয়ে রাখল। বলল আমি যেন এটার বিনিময়ে যেন ওকে কুড়ি কি পঁচিশটা টাকা যদি ওকে এখন দিই!
কলমটা সত্যিই বেশ বাহারের। গায়ে মালিকের নাম লেখা আছে হার্পার না হ্যারিসন্ কি যেন একটা খোদাই করা ! বোঝাই যায় যে কালের প্রকোপে সেটার আজ এই দশা হলেও ওটা যে জাত কলম সেটা অস্বীকার করবে কার বাপের সাধ্যি!
আমি বললুম, ” কিন্তু মিঞা! আজ তো ক্যাশিয়ার ক্যাশ বাক্স গুছিয়ে চলে গেছে! তাছাড়া আমিও দোকানটা বন্ধ করতেই যাচ্ছিলাম। তুমি বরং কাল সকালে এস। তখন দোকানের মালকিন জেনিফার মেমসাহেবও থাকবেন, তুমি তখন না হয় দাম দস্তুর যা করবে করে নিও। তাছাড়া এতো যাকে বলে জাত কলম একেবারে। দাম নেহাত কম পাবে কি?
……
বুড়ো দেখি তাও খানিক শুকনো মুখে বসে রইল। শেষে আমার হাতটা ধরে বললে, ” সাহাব আপনি ইমানদার লোক। এতদিন জিনিস কেনা বেচা করছি আপনার সাথে। আপনি আমার টাকা মারবেন না! তাই এটা আপনি বরং আজ নিজের কাছে রেখে দিন। কাল বা পরশু যেদিন আবার এদিকে আসব হয় সেদিন হয় টাকা বা কলম যেটা ফেরৎ দেবেন নিয়ে নেব। আজ বরং ঘরে যাই। শরীরটা ভাল ঠেকছে না। এমন দামী জিনিস নিয়ে রাস্তায় ঘোরাটা সুবিধার নয়। তাছাড়া রাস্তায় আমেরিকান টমী’রা আজকাল বড় খানাতল্লাশি করে। আজ তাহলে আসি বাবু!
……
বুড়ো চলে যাওয়ার পর আমিও দোকানটার ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ি ফিরে রাতে শুয়ে পড়েছি হঠাৎ প্রথমে শুনি একটা খুট্ শব্দ আর তারপর খসখস্ করে কাগজে লেখার শব্দ। চমকে উঠে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিতেই দেখলাম এক অদৃশ্য লেখক কোত্থেকে এসে টেবিলের ওপরে রাখা লালচে একটা ডায়েরির পাতায় চোস্ত ইংরেজীতে কি সব যেন আপন তালে লিখে চলেছে। যেটা দিয়ে লিখছে সেটা একেবারে একটা নতুন হার্পার কলম! আর যেখানে লিখছে সে একশো বছরের বেশী পুরনো এক তাড়া কাগজের ওপর যা লালচে রং এর হলেও পুরনো নয়। আমি চমকে উঠে লেখাটা পড়তে শুরু করলাম।দেখি মুক্তোর মত হাতের লেখাটি যে কার সেটা অবিশ্যি প্রথমে বুঝিনি। সে যাই হোক! ভাল ভাষার বাঁধুনিতে এখন কলমটা লিখছে যে লেখকটি এই সামারের পর ইন্ডিয়া ছাড়তে চলেছে। প্রবল গরমে আর মশা-মাছি আর জলের কষ্ঠতে সে অতিষ্ঠ। আর তাছাড়া নেটিভদের নিজেদের নানা টানাপোড়েন আর ষড়যন্ত্র দেখে সে বড় অবাক। কদিন আগেই নন্দকুমার বলে একজন জমিদারকে ফাঁসি চড়িয়েছেন বড়লাট হেস্টিংস।তার হাতের তুরুপের তাসটিকে দিয়েই যে পুরো কাজটা করানো হয়েছে সেটা অনেক পরে হলেও লেখকটি বুঝতে পেরেছে। যে এসব লিখছে সে নিজেও একজন আইনের ছাত্র সেকথাও সে লিখতে ভোলেনি। সে আরও লিখছে যে পলাশীর যুদ্ধের নাটকটা একেবারে জঘন্য রুচির।
ক্ষমতালিপ্সু ক্লাইভ পিছনে থেকে আস্তে আস্তে নিজের কূটনীতিক বুদ্ধি খাটিয়ে এখানে ইংরেজদের আরেকটা কলোনী বানাতে চাইছে। আর যাইহোক এখানে ধান, গম আর নীল, পাট, তুলো নেহাত খারাপ ফলেনা। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলেতে রানী এলিজাবেথকে যে আগামীদিনের সাম্রাজ্য বাড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছে, বড়লাট হেস্টিংস এখন সেটাকে সফল করতে বদ্ধ পরিকর।
……
আমি তো উত্তেজনায় যাকে বলে পুরো থ মেরে গেছি। এই কলমটা তাহলে কোম্পানির শাসনের গোড়ার দিকে কোন হোমরা চোমরা লোকের? আর তার বিদেহী আত্মা কয়েক শতাব্দীর পর এখনও তাদের করে আসা সব অন্যায়ের কথা তাহলে ভোলেনি?
দেখলাম কলমটা এবারে লিখছে যে মিথ্যে তছরুপের অভিযোগ এনে পুরো ব্যাপারটা ঘটিয়েছে লেখকটির মনিব নিজে।
খিদিরপুরের কাছে কুলিবাজার অঞ্চল, অর্থাৎ আজ যেখানে হেস্টিংস নামের এলাকা তখন সেই জায়গা ছিল লোকালয় বর্জিত। সেই নিরুপদ্রুত রাজপথেই সকলের সামনে ব্যাপারটা ঘটে। এলাকাটা সেদিন ছিল লোকে লোকারণ্য। এর আগে এরকম ফাঁসি অনেকেই দেখেনি। যদিও ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ফাঁসি দেওয়া হত রাস্তার ধারে গাছের উপর থেকে। প্রত্যেকে যাতে অপরাধীর অন্তিম পরিণতি প্রত্যক্ষ করে তাই এই ব্যবস্থা ছিল।
তাই সেদিনও নন্দকুমারের ফাঁসিও হয়েছিল প্রকাশ্যে। কিন্তু তার জন্য একটা আস্ত কূপ খোঁড়া হয়েছিল। এ যে হাইকোর্টের রায়ে ফাঁসি। সাধারণ জমিদারি মামলা তো নয়। তাই এমন ঘটনার সাক্ষী থাকতে ভিড় ভেঙে পড়েছিল। যদিও সে মামলা শুরু হয়েছিল ১৭৭৫ সালের ১২ মে।
শোনা যায় নিজের সপক্ষে যাবতীয় যুক্তি নন্দকুমার পেশ করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি তাঁর কোনো কথাতেই কর্ণপাত করেননি। হেস্টিংস সাহেবের বিশেষ বন্ধু সেই বিচারকটি শুধু ভেবেছিলেন, কী কী প্রকারে নন্দকুমারকে শাস্তি দেওয়া যায়। ফলে অবশেষে ১৬ জুন ফাঁসির রায় বেরোল এবং ৫ আগস্ট ফাঁসির দিন স্থির করা হল। তবে এর পরেও নাকি মামলা গড়িয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। কারণ ইংল্যান্ডের আইনে জালিয়াতির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও ভারতের হিন্দু আইন বা মুসলমান আইনে তা নয়, বরং তৎকালীন আইন অনুযায়ী কোনো ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত না। কিন্তু এইসব প্রশ্ন যখন ওঠে তখন পুনরায় বিচার করার আর কোনো সুযোগই নেই। মহারাজা নন্দকুমার অনেকদিন আগেই ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নিয়েছেন।
……
সে সমস্ত কথাই লেখক পরে জেনেছে বলে যেন এতদিন পরেও তার মনিবের আচরণের জন্য তার নিজের অপরাধবোধ যেন আরও বেশী।
যদিও দেশে ফিরবে বলে ভেবেও সে এক রাত্রে আর থাকতে না পেরে গলার নলি কেটে আত্মহত্যা করেছে আর তার গডের কাছে প্রার্থনা যে তাকে ও তার মনিবের সঙ্গদোষজনিত পাপের বোঝা থেকে যেন মুক্ত করেন।
……
আমি তো উত্তেজনায় যাকে বলে একদম ইয়ে হয়ে আছি। চোখের সামনে একটু একটু করে যেন বায়োস্কোপের পর্দা উঠে চলেছে। কবেকার সেই কোম্পানি আমলের দলিল, আজ যেন যাদুবলে আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে আমারই চোখের সামনে!
তবে যখন লেখক নিজের নাম সই করলেন তখন আমি তো যাকে বলে একদম স্পেলবাউন্ড! হাতের লেখাটা যে একদম পাকা সেটা আগেই বলেছি, দেখলাম লেখকের নাম এবারে যত্ন নিয়ে লেখা হল, ‘রিচার্ডসন ফ্রেডরিক ইমপে’!
ছোকরা স্বয়ং এলিজা ইমপে যিনি এই বিচার প্রহসনের নায়ক তথা বিচারক তারই খুড়তুত ভাই। সে আইন পড়তে এসেছিল কেমব্রিজে তারপর দাদা’র সাথে ভারতে চলে আসে আইন ব্যবসা জমানোর সাথে স্বয়ং বিচারপতির পার্সনাল এ্যসিসটেন্ট হয়ে। তাহলেই বোঝ! সে বিদেহী হয়েও যা যা এখন লিখে দেখাচ্ছে তা কতটা সত্যি!
……
এবারে দেখলাম কলমটা তার চলা বন্ধ করল আর কাগজের বান্ডিলটা যেন উবে গিয়ে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া খানিক এসে আমার পুবের ঘরটাকে যেন কাঁপিয়ে দিয়ে গেল, সাথে বাতিটাও যে নিভে গেল সেটাও আশাকরি তোরা বুঝতে পারছিস!
সারারাত আর ঘুম এল না। যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে বাকী রাতটা জেগেই কাটিয়ে দিলাম।
……
পল্টু এবারে খুড়োকে জিজ্ঞাসা করল, ” তা খুড়ো! ওই পেন টার কি হল? “
খুড়ো আবার একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে বলল,
” গপ্পের মাঝে অযথা ফোড়ন কাটা টা যে ক্রিমিনাল অফেন্স সেটাও কি তোরা ভুলে গেছিস? “
শোন তাহলে, ” আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে কলমটা সকাল থেকে বাড়ি থেকে একদম উধাও! অনেক খুঁজেও যখন পেলাম না তখন ঠিক করলাম বুড়ো এলে ওকে কুড়িটা টাকা আমাকে নিজে থেকেই দিয়ে দিতে হবে। সে গরীব মানুষ, অভাবের তাড়নায় আমাকে ভরসা করে আছে যে কলমটার বদলে যদি কিছু টাকার বন্দোবস্ত করা যায়!
যাইহোক এরপর দিন সাতেক সেই বুড়ো বা কলমের নো-পাত্তা!
আট দিনের মাথায় কলুটোলার বোসেদের বাড়ি থেকে একটা হিগিনস্ কোম্পানির গ্র্যান্ড পিয়ানো নিয়ে সবে দোকানে ফিরছি দেখি একজন মুসলমাল বুড়ি মহিলা বোরখা-টোরখা গায়ে আমার টেবিলের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। বললে, সে আমার নাম তার বরের কাছে শুনেছে আর তার বর এখানে অনেক জিনিস কেনা বেচা আগে করেছে বলে দোকানের নামটাও সে জানে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার খসমের কি নাম? “
এর উত্তরে বুড়ি যা বলল সেটা তোদের আরব্য উপন্যাসের চেয়ে কিছু কম নয়। তার স্বামীর নাম হল রহমৎ। দিন পনের আগে সে বুড়ো হার্টফেল করে মারা গেছে আর মারা যাবার আগে বুড়িকে বলে গেছে যে আমাদের দোকানে এসে একটা জিনিস আমার হাতে দিলে কুড়ি কি পঁচিশ টাকার একটা বন্দোবস্ত হবে। আমার তো সেটা শুনে মাথা গুলিয়ে গেল। বুড়ো তো তাহলে দিন সাতেক আগে আমার কাছে এল! সেটা তাহলে কি করে সম্ভব?
……
এবার যা যা হল সেটা শুনে তোরা ব্যোমকে যাবি। দেখি বুড়ি এবারে তার কম্পিত হাতে একটা মোড়ক খুলে পুরনো অথচ বাহারের একটা হার্পার কোম্পানির একটা ফাউন্টেন পেন আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
এতো অবিকল সেই কলম যেটা মৃত্যুর পরে তার পুরনো মালিকের বিদেহী আত্মার মিডিয়ম হয়ে তার জীবনের একটি অনুশোচনার কাহিনি আমার সামনে খসখস করে লিখে দেখিয়ে হঠাৎ করে সে রাত্রে উধাও হয়ে গেছিল। আর সেটা অবিশ্যি আমায় এর আগে একবারই দেখা দিয়েছিল দিন পনের আগে হার্টফেল করে মৃত এন্টিক সাপ্লায়ার রহমৎ খাঁ এর বিদেহী আত্মার হাত ধরেই।
—oooXXooo—