“ফুটেজ”
-:: শ্যামাপ্রসাদ সরকার ::-
@@@@@@@@@@@
সকাল থেকে ফোনের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছেন রত্নেশ বসু। অভিনন্দন আর অভিনন্দন। কারণ তিনি এবছরের আকাদেমী পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁর বেস্ট সেলার উপন্যাস ‘ ঈশ্বরের ভালোবাসা’ এর জন্য। বহু কট্টর সমালোচকও মানতে বাধ্য হয়েছেন এযাবৎ কালে এমন উপন্যাস আর লেখা হয়নি। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের পাতায় ফলাও করে স্তুতিগাথাও লিখেছেন তাঁর প্রকাশক, তিনি আবার কবিও একালের। একটু পরেই আবার মিডিয়া থেকে আসবে বাইট নিতে। সাফল্যের সিঁড়ি তে পা রাখার একটা আলাদা আনন্দ আছে সেটা অস্বীকার করবেন কি করে!
*****
সেই কবে থেকে লিটল ম্যাগাজিন করছেন। নিজেরাও বের করতেন একটা। তখনকার কলেজস্ট্রিটে কৃত্তিবাসের পরেই জনপ্রিয় ছিল ‘সম্ভাবনা’ পত্রিকা টি।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজকের এই জায়গায় পৌঁছেছেন। অগ্রজ সাহিত্যিক শিবতোষ রায়ের সাথে তাঁর গুরু শিষ্য সম্পর্ক গোটা বইপাড়া জানে। খালাসিটোলায় মদ্যপান থেকে পুঁটিরামের রাবড়ি সবেতেই অনুজপ্রতিম রত্নেশকে সঙ্গে রাখতেন শিবতোষ। স্যাটায়ারধর্মী লেখায় তাঁর জুড়ি নেই। অকৃতদার মানুষটি উত্তর কোলকাতায় এককামরা শরিকী বাড়িতে থাকতেন সাদামাটা জীবনযাপনে। রত্নেশ কত দিন রাত এক করে থেকেছেন যুবাবয়সে সেখানে। সাহিত্যে আড্ডায় কেটে গেছে সমৃদ্ধ সে সব দিন।
*****
টিভিটা খুললেন একনজরে খবরের হেডলাইন দেখবার জন্য। হঠাৎ চোখটা আটকে গেল একটা স্ক্রোলে। বন্ধ ঘরে হঠাৎ অকাল মৃত্যু প্রবীণ সাহিত্যিক শিবতোষ রায়ের। প্রতিবেশীরা দুদিন ধরে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে অাজ দরজা ভেঙে এই কান্ড দেখতে পায় । বয়সজনিত হৃদরোগই মৃত্যুর কারণ। একাএকা থাকতেন তো! মানুষটার শেষে এই পরিণতি ছিল! মনটা তেতো হয়ে গেল রত্নেশের। আজকের এই আনন্দঘন মুহূর্তটা পুরো মাটি করে দিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। এবার পুরোটা ফুটেজ চলে যাবে বৃদ্ধটির স্মৃতিচারণে।
অসহ্য লাগে নিজের। আকাদেমী পুরস্কার কি রোজ পাবেন ! কদিন পর মরলে চলত না ওঁর?
*****
কলেজস্ট্রীট থেকে নিমতলা অবধি শেষযাত্রায় সামিল হলেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও। গুরু মানতেন শিবতোষকে এ কথা বহু চ্যানেলে অলরেডি বলে ফেলেছেন। গলায় বাষ্প জমেছে স্মৃতিচারণার সময়। এরমধ্যে পুরস্কারের কথাও উঠছে যদিও, আজকে সেটাকে নির্দ্বিধায় গুরু দক্ষিণা বলে চালিয়ে দিতে হল ইমেজ বাঁচাতে । মুখচোখ কিঞ্চিৎ ফুলে আছে কান্না আর শোকের আবহে।
*****
শ্মশান থেকে বাড়ি ফিরতে আটটা বাজল। মুখহাত ধুয়ে একটা হুইস্কি নিয়ে লেখার ঘরে ঢুকলেন।
বিধ্বস্ত নিজের সাথে একান্তে কথা বলার দরকার । সারাটা দিনের তালেগোলে সময় পেলেন কোথায়।বইএর তাক থেকে একটা পুরনো ফাইল বের করলেন । ধূলো ঝেড়ে একটা পান্ডুলিপি হাতে নিলেন। অসমাপ্ত উপন্যাসের খসড়া। নাম নেই তবে কাহিনী টা তিনি জানেন। শেষটুকু বাদ দিলে পুরোটাই আসলে তাঁর পুরস্কৃত উপন্যাস ‘ঈশ্বরের ভালবাসা’। হাতের লেখাটাও চেনা। শিবতোষ রায়ের বহুকাল আগের এক অসমাপ্ত পান্ডুলিপি পড়তে এনেছিলেন কিন্তু আর ফেরৎ দেন নি। উনিও মনে রাখেন নি এই ঘটনা।প্রায় বিশ বছর আগের এক সাহিত্যঘন আড্ডারাতের ফসল এটি। বুকের ভিতরটা জ্বালা করে ওঠে রত্নেশের।
সবকথা স্মৃতিকথায় এমনকি আত্মজীবনীতেও লিখে যাওয়ার হিম্মত তাঁর নেই।
দুদিনের বাসি মড়া তাঁর সব ফুটেজ জিতে নিয়েছে যে।
○●○●○●○●○●○
○●○●○●○