নিঃসঙ্গতা
বাসুদেব দাশ
অনল প্রকাশ শী রাজ্য সরকারের রিটায়ারড কর্মচারী l চাকরি জীবনের পুরোটাই রাইটার্স বিল্ডিং এ কাটিয়ে দিয়েছেন l লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং এ ঢুকে ছিলেন আর সেকশন অফিসার হয়ে বেরিয়ে এসেছেন l সব গুলো প্রমোশনই পেয়েছেন সিনিয়ারিটি বেসিসে l প্রায় চৌত্রিশ বছর চাকরি করেছেন l সকাল ন-টায় খেয়েদেয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতেন অফিসের উদ্দেশ্যে আর ফ্ল্যাটে ফিরতেন রাত আট-টা নাগাদ l এই দীর্ঘ সময়টা ব্যয় করতেন অফিসের কাজ আর সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প গুজব করে l অফিসের কাজটা স্টিরিও টাইপের , রোজ রোজ গদে বাঁধা একই কাজ l সরকারি চাকরির সুখটা এখানেই l চাকরির সাথে সাথে মনোরঞ্জনের জন্য আড্ডাটাও বেশ জমিয়ে করা যায় l মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের ছেলে মেয়েদের কাছে সরকারি অফিসে কেরানির চাকরির আকর্ষণটা বরাবরই একটু বেশি এই জন্য l আধিকারিকের চাকরিটা বেশ ঝনঝাঁট পূর্ণ আর ব্যবসা তো বিরাট ঝক্কিঝামেলার কাজ l সুতরাং কেরানির চাকরিটাই সব দিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে ঝনঝাঁট মুক্ত l মাইনে পত্তর একটু কম হলেও নিশ্চিন্ত জীবন আছে এই চাকরিতে l হাত খুলে খরচা করার বিষয়টা ত্যাগ করতে পারলে এর থেকে ভালো জীবন আর হয় না l একটা ছন্দে বাঁধা জীবন l অনল বাবুর স্ত্রী ত্রিধা শী কেন্দ্রীয় সরকারের পে এন্ড একাউন্টস অফিসে চাকরি করতেন l চাকরি জীবনে দুজই অফিস টাইমে বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন একটু রাত করে l ফ্ল্যাটে থাকার সময়টা ওনাদের খুবই কম l রাত্রির যে সময় টুকু ফ্ল্যাটে থাকতেন সেই সময় টুকু কেটে যেত খাওয়া দাওয়া আর ঘুমের মধ্যে দিয়ে l আবার সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই অফিসে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে যেত l তার ফলে ফ্ল্যাটে থেকে কথা বার্তা বলা বা ভালো মন্দ গল্প গুজব করার ফুরসৎ ওনাদের ছিল না বললেই হয় l যেহেতু অফিসে বসেই গল্প গুজব হয়ে যেত তাই ফ্ল্যাটে এসে কথা বার্তা না বললেও স্বস্তির কোন অভাব ঘটতো না l মানুষের কথা বলার তো একটা লিমিট আছে সেটা অফিসে বসেই ক্রস করে যেত l সম্পর্ক বেশ গতানুগতিক ধারায় বয়ে চলতো l শরীরের আকর্ষণ থেকে মনের আকর্ষণ সম্পর্ককে দীর্ঘ স্থায়ী করে বেশি l এই আকর্ষণ আস্তে আস্তে দীর্ঘ দিনের অভ্যাসর মধ্যে দিয়ে মায়া ও দায়িত্ব অর্জন করে l মায়া আর দায়িত্বকে সঙ্গে নিয়ে দুটি মানুষ সারাটা জীবন এক সঙ্গে কাটিয়ে দিতে পারে l
সমস্যার শুরু হয় অনল বাবু রিটায়ারড করার পর থেকে l অবসর নেবার আগের বছর এক মাত্র কন্যার বিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যান এই দম্পতি l সন্তান বলতে ঐ একটিই l স্ত্রী অফিসে চলে গেলে ফ্ল্যাটে উনি একা l হঠাৎ যেন একাকিত্বের সাগরে ডুবে গেলেন অনল বাবু l একাকিত্বর শাসনে পরে হাঁসফাঁস অবস্থা l তিনি উপলব্ধি করেন যে এই ভাবে বেঁচে থাকা যায় না l নিজেকে মনে হয় ডালপালা হীন একটা ন্যাড়া গাছের মতো l একাকিত্বের শাসনে শরীরের তেজ একটু একটু করে মরে যেতে থাকে l অনল বাবু ভীতসনত্রস্ত হয়ে পড়েন l এর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য অনল বাবু অবসর গ্রহনের পর প্রথম প্রথম কয়েক দিন অফিসে গেছেন সহকর্মীদের সাথে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে l প্রথম এক দু দিন সহকর্মীরা পাশে বসিয়ে কথা বলেছেন চা খাইয়েছেন l তারপর আস্তে আস্তে এই সাক্ষাৎকারটা বিরক্তির পর্যায়ে চলে যায় l অনল বাবু সেটা বুঝতে পেরে অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন l জীবন ঠিক বহমান সময়ের মতো না l সময় শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে জানে,এক মুখি ধাবমান স্রোত পিছনে তাকাতে পারে না কিন্তু জীবন সামনে পিছনে চারি দিকে সঞ্চালিত হতে থাকে l নদীর ময়লা বা পলি মাটি স্রোতের টানে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে নদীকে পরিশ্রুতো রাখে কিন্তু মানুষের কষ্টের প্রলেপ মনের দেওয়ালে জমে থেকে মানুষকে অশান্ত ও বিমর্ষ করে তোলে l তবে যে জীবনকে সুন্দর করে দেখতে জানে তার জীবন আনন্দ মুখর হয় l মাঝে মাঝে মনের আকাশে মেঘ অবশ্যই জমে তখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লেই আবার পরিষ্কার হয়ে যায় l জীবনকে পতিত থেকে ভগ্ন স্তুপে পরিণত হতে দিতে নেই l
এক সময়ে স্ত্রীর পায়ের ছন্দ ও শরীরী বিভঙ্গ তাকে সারা রাত মাতিয়ে রাখতো l আজ সে ছন্দ আর তাকে সেই ভাবে টানে না l শরীরের তাপমাত্রার গতি নিন্মমুখি l দীর্ঘ দিন অনাভ্যাসের ফলে স্ত্রীর সাথে তার কথা বার্তার রসায়নটা নষ্ট হয়ে গেছে l অনেক চেষ্টা করেও সেটা আর ফিরিয়ে আনতে পারছেন না l এমতোবস্থায় অনল বাবু নিঃসংগতা কাটাতে ফ্ল্যাটে একটি কাজের মেয়েকে রাখেন l মেয়েটি সর্বক্ষণ থেকে কাজ করে l অনল বাবুর পরিকল্পনা হলো মেয়েটি ঘরের কাজ কর্ম যেমন করার তেমন করবে আর তার সঙ্গে কথা বলার সঙ্গীও হবে l এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাকে বলে l অনল বাবুর স্ত্রী ত্রিধা কিন্তু বিষয়টাকে সাদা মনে মেনে নিতে পারেন নি l তিনি এর মধ্যে একটা রঙিন গল্পের লক্ষণ আছে বলেই মনে করলেন l কিন্তু তিনি কিছু না বলে নীরব থেকে গেলেন l অনেক সময় কথা না বলা কথা বলার থেকেও বেশি অর্থ প্রকাশ করে l সেটা বুঝতে অনল বাবুর বেশি সময় লাগেনি l সংসার হচ্ছে একটা উপভোগ করার জায়গা কিন্তু মানুষ সংসার থেকে ভোগের সন্ধানই বেশি করে l ভোগ আর উপভোগের মধ্যে পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করে না l তার ফলে সম্পর্কে তিক্ততা আসে l
আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে রটে যায় যে অনল বাবু ফ্ল্যাটে কাজের মেয়ে রেখে তার সঙ্গে প্রেম পর্ব চালাচ্ছেন l সবাই বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়েছেন l অনেকের ধারণা হয় স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকার কারণে অনল বাবু কাজের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে সেই ঘাটতিটা পুষিয়ে নিচ্ছেন l এটা তাদের কাছে একটা নিন্দার বিষয় বলেই মনে হয় l চারি দিকে একটা নিন্দার ঝড় বয়ে যেতে থাকে অনল বাবুকে নিয়ে l অনল বাবুর মেয়ের শ্বশুর বাড়িতেও নানা রকম জল্পনা চলতে থাকে l মেয়ের স্বামী, রিতেশ এক দিন বলেন…. দ্যাখো তোমার বাবার সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের তো সমাজে একটা স্ট্যাটাস আছে তাই আমরা ওনার এই ভীমরতি মেনে নিতে পারবো না l ওনার জন্য আমরা সম্মান বলি দিতে পারবো না l মেয়ে, রুশী বলে…মান সম্মান শুধু পুরুষদেরই একচেটিয়া ? আমি মেয়ে তাই আমার কোন সম্মান নেই ? আমাকে এর জন্য কি করতে হবে শুনি ?
রিতেশ …. তুমি তোমার বাবাকে বলে দেবে ওনি যেন এই সব বন্ধ করেন আর প্রয়োজন হলে ওনি যেন নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে ওনার প্রয়োজন মিটিয়ে আসেন l
বাবার সম্মন্ধে এই সব কথা শুনতে রুশীর একদম ভালো লাগে নি l বুকে ভীষণ ভাবে বিঁধেছে কথা গুলো l তার মন ভেঙে যায় এবং হতাশ হয়ে পরে l রিতেশের সাথে এই নিয়ে তার এক প্রস্ত ঝগড়া হয়ে যায় l সে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে বাবার কাছে চলে যায় l বাবার কাছে সে জানতে চায় কাজের মেয়ের সাথে তার এতো আদিখ্যেতা কিসের ? তার জন্য চারি দিকে যে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে না কেনো ? বাবা তাকে বলেন….দ্যাখ ” মা ” একা একা থাকতে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, একাকিত্ব আমার অসহ্য হয়ে উঠছিল l আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম l আমি ঘুমাতে পারছিলাম না, খেতে পারছিলাম না তাই বাধ্য হয়ে কাজের মেয়ে রেখেছি l ওর সঙ্গে কথা বলে আমি একটু স্বাভাবিক থাকতে পারছি l সেটা যে কারো সহ্য হবে না এটা আমি বুঝতে পারিনি রে l আমার এই বয়সে আর কি পাবার আছে ? যখন পাবার বয়স ছিল তখনোই পাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি l এখন আর কি ? আগে মনে হতো তোর মা যেন আমাকে কিছু না বলে এখন মনে হয় কিছু বললে শুনতে ভালো লাগবে l কিন্তু তোর মা অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে আসে l কিছুক্ষন বিশ্রাম নেবার পর টিফিন খেয়ে শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটতে শুরু করে তখন তার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়া মানে তাকে ডিস্ট্রাব করা হয়ে যায় তাই আমার কিছু বলার ইচ্ছা হয় না l ইচ্ছা না হয়ে হয়ে ইচ্ছা গুলো সব মরে গেছে l আর একটা কথা হলো কথার সুর একবার কেটে গেলে তাকে যে আর ফিরিয়ে আনা যায় না l কথা বলে তৃপ্তিও পাওয়া যায় না l বয়স্ক লোকদের আড্ডায় কয়েক দিন গিয়েছিলাম সেখানেও আমার পারিবারিক জীবন নিয়ে সবাই কথা বললে আমি যাওয়া ছেড়ে দিই l আমি যন্ত্র নিয়ে বেশিক্ষণ নাড়াচাড়া করতে পারি না l আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগে l রক্ত মাংসের মানুষের সাথে কথা বলে যে স্বস্তি বোধ হয় যন্ত্রের সাথে কথা বলে সে তৃপ্তি আমার আসে না l তাই মোবাইলে সরগর হবার ইচ্ছাও আমার হয় না l
রুশী…. তুমি আমাকে বলতে পারলে না বাবা ? আমি সপ্তাহে এক দিন এসে তোমার সঙ্গে কথা বলে যেতাম l আমি যে আর পারছি না l ব্যথায় আমার বুকটা টনটন করছে l
অনল বাবু….. তোর সংসার আছে,স্বামী শ্বশুর শ্বাশুড়ি আছেন l তাদের প্রতি তোর অনেক দায়িত্ব তাই তোকে আমি বিরক্ত করি কি করে ?
l রুশী….. তুমি জান না সবাই তোমাকে ছিঁড়ে খাবার জন্য দাঁত নখ বের করে আছে l কেউ কোন রকম সহানুভূতি দেখাচ্ছে না l প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে না l চেনাজানা মানুষগুলো যে হিংস্র জানোয়ারের থেকেও ভয়ঙ্কর আচরণ করছে তা তুমি বুঝতে পারছো না l
অনল বাবু…. জানি রে মা জানি কিন্তু নিজেকে বাঁচাবার জন্য আমি এইটুকু স্বার্থপর যদি আমি হয়ে থাকি তাতে অন্যায় কোথায় ? আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস মা l
রুশী…. আমি ক্ষমা করলে কি হবে ? তোমার আত্মীয় সজনরা কেউ তোমাকে ক্ষমা করবে না l তারা রসিয়ে রসিয়ে তোমার মিথ্যা কীর্তির সুবাস চারি দিকে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে l বাবা আমার মতে তুমি কোন দোষ করোনি তাই আমার ক্ষমা করার প্রশ্ন আসে না l
অনল বাবু…. তুই যদি আমাকে দোষী না ভাবিস তবে আমি ঠিক আছি l তুই ঐ সব চিন্তা ছেড়ে দে l আমি ভালো থাকবো l রিতেশ কে এক দিন নিয়ে আয় আমার কাছে আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো তাতে যদি ও না বোঝে আমি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবো l
রুশী…. আমার ভাবাভাবিতে কিছুই আসে যায় না বাবা l কিন্তু তোমার এই ভাবে হেরে হয়ে যাওয়া আমার বুকের ভিতরের ব্যথাটা দলা পাকিয়ে উঠছে l
অনল বাবু… আসলে একটা মানুষের মধ্যে অনেক গুলো সত্তা থাকে কখন যে কোনটা জেগে ওঠে আগে থেকে তা টের পাওয়া যায় না l
মেয়ের সংসার অক্ষত রাখতে অনল বাবু পরিবার ছেড়ে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাই নিলেন l
সমাপ্ত