আমাদের কেরু’দা পেশায় দর্জি। পুরো নাম কেরু চরণ দাস। এহেন নামের উৎপত্তি এবং ব্যুৎপত্তি নিয়ে আপনাদের আগ্রহ থাকলেও নিষ্পত্তি করার কোনও উপায় আমার জানা নেই। কারণ নামকরণ সম্পর্কিত যত রীতিনীতি তা পুরোটাই মা-বাবার অভিরুচি। কেরুদার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। তাই কারোর বা কেরুর নামের পেছনে ঘাম না ঝরিয়ে আসল কাজে আসি বসুন।
***%***
তখন আমার যুবকবেলা, ভাড়া থাকি নাকতলা- রামগড় অঞ্চলের সাহা-প্লটে। বয়সের ফারাক থাকলেও কেরুদার সঙ্গে আমাদের বন্ধু-সম্পর্ক। যেমন সম্পর্ক চায়ের দোকানের পুলিন্দা আর মুদি দোকানের বিরেন্দা’র সঙ্গে। খুব দিলখোলা স্বভাবের মানুষ ছিল এই কেরুদা। মুখে হাসি লেগেই থাকত! ঘুম থেকে উঠে মনের সুখে গান করতে করতে কাজ করত! তবে সারাদিনে মেরেকেটে দু’ঘণ্টা। কারণ চাহিদা ছিল খুবই কম, আমি’টি আর স্বামীটি’র পেট চলার মতো রসদ জোগাড় হয়ে গেলেই দোকানের ঝাঁপ ঝপাস! কোনওমতে শ’খানেক টাকা হাতে এসে গেলেই থলে হাতে দৌড় লাগাত বাজারে! সেদিন মাথা খুঁড়েও আর কোনও কাজ করানো যেত না, এমনকি ডেলিভারিও নয়! এ-কারণেই ওঁর ওপরে আমরা তিতিবিরক্ত ছিলাম! ঠিক করেছিলাম- ওঁকে দিয়ে আর কোনও কাজ করাব না।
***%***
তো একদিন হলো কী, একটা জামার পিস বগলদাবা করে রওনা দিয়েছি বড় রাস্তার দিকে- ‘ইউনিভার্সাল টেইলর্স’ এ বানাতে দেব বলে। যাওয়ার পথেই পড়ে কেরুদার সেই বিখ্যাত টেইলরিং শপ “কেরুকার্য”! আমাদের ভাষায়- “ভোগান্তি অনিবার্য”! ঘরেই দোকান। ঘরটাও কেরুদার মনের মতোই দিলখোলা! অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে, যতদূর সম্ভব হাত-পা ছড়িয়ে খাবলে নেওয়া এক টুকরো জমি, সেখানেই ছোট্ট একটা বেড়ার ঘর, বারান্দাটা হলো দোকান। বউদির ঘর আর দাদার দোকানের মাঝখানে মহিলা-লজ্জা-নিবারণ-নিমিত্তে ঝুলে থাকে চিকন কোমর যুক্ত একটি আচ্ছাদন। সেটির সারা গায়ে লেপ্টে আছে খদ্দেরদের স্মৃতি বিজড়িত টুকরো টুকরো কাপড়ের চৈত্রসেল! সৌভাগ্যবশত আমার প্যান্ট-পিসেরও একটি টুকরো স্থান পেয়েছিল কেরুঘরে! পর্দাটি সম্ভবত স্ত্রী লিঙ্গ ছিল, তাই আমারও….!
যা বলছিলাম- হন-হন করেই হাঁটছিলাম বড় রাস্তার দিকে; কিন্তু কেরুদার দোকানের সামনে আসতেই পা’দুটো কেমন যেন ভারী হয়ে গেল এবং যে ভয়টা পাচ্ছিলাম ঠিক সেটাই হলো! মুখ বার করে কেরুদা বলল-
“অ বাসু যাও কই, বগলে ঐডা কী লুকাইয়া লইয়া যাও”?
“আমি যা-ই নিয়ে যাই, তা দিয়ে তোমার কী চাই? কুঁড়েদাকে দিয়ে আর কোনও আর কাজ করাচ্ছি না, এটা তুমি জেনে রেখো”! কেরুদা সকাল সকাল দোকান খুলে বাজারের থলে হাতে নিয়ে বসে আছে বউনির আশায়, কাজেই আমার যে নিস্তার নেই তা বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি।
কেরুদা একরকম উড়ে এসে ছোঁ মেরে আমার প্যাকেটটাকে খাবলে ধরে আমাকে টানতে টানতে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেল!
“আমি থাকতে তোমরা অন্যখানে জামা কাপড় সিলাইবা, এইয়া কক্ষণও হইবে না”! আমার কোনও কথাই কানে তুলছে না, ব্যস্তবাগীশ পেশাদারী চালে নিজের কাজ শুরু করে দিল- আদ্দিকালের সেই রদ্দি ফিতেটা আমার গায়ে ফেলে মাপজোক শুরু করে দিল আর গুণগুণাতে লাগল কিশোর কুমারের বিখ্যাত সেই গান- “তুম বিন…… জাউ কাহা.….”!
উহঃ……! কেরু দাও সেই ‘শাহজাহান-সেলুন’ এর টনিদার মতো, আমার চুল কাটচ্চে না পেম করচ্চে ঠিক বোজা যাচ্চে না!
যতই গান শোনাক, বেরোবার সময় ওঁর নাকের সামনে ঘুষি উঁচিয়ে বললাম- “এবারেও যদি ডেলিভারি দিতে দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকো তাহলে তোমার এই নাকটা আমি ফাটিয়ে দেব”! সে’বাবুও ‘হো-হো’ করে হেসে উঠে বলল- “আমি যখন আসি তোমার কোনও ভরসা নাই! নিজের কথায় নিজেই আবার হাসতে শুরু করে দিল!
আমি আর কথা না বাড়িয়ে পঞ্চাশ টাকা ছুঁড়ে দিয়ে বাড়ি চলে এলাম। আসলে ওঁকে বাদ দিয়ে অন্য ‘কেরুর’ কাছে আমরা কেউই যেতে পারতাম না! তাই ইচ্ছে করেই ওঁর ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমারও তো ওঁর মতো দশা, “তুম বিন জাউ কাহা…….”!
আমার জামাটা নির্দিষ্ট দিনে না হলেও, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দিয়েছিল। কিন্তু বলাইদার সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটেছিল তা আজও ইতিহাস হয়ে আছে!
***%***
ওঁদের বস্তির কাছেই থাকে বলাইদা, সময় কাটাতে মাঝেমধ্যেই যায় কেরু-কুটিরে। সেই বলাইদার একদিন বিয়ে ঠিক হলো; আর ঠিক হলো, বন্ধুর বিয়ের পাঞ্জাবিটা বানাবে কেরুকার্য-র এক এবং অদ্বিতীয় কর্ণধার কেরু-খলিফা! এই সিদ্ধান্তটা ঠিক হলো, না কি বেঠিক, সেটাই এখন আসল টপিক!
“বোকার মতো কতা কইস না; কাপড়টা তো কাটা হইয়া গেসে, শুধু সিলাইটুকুন বাকি। কাজেই ফেরত নিয়া তুই করবিটা কী! কেউ দেবে তোরে সিলাইয়া? সবারই তো এট্টা মান সম্মান আসে না কি? তাই বলি, এত দিন যখন ওয়েট কল্লি; আর এট্টু কর, কাইল সকাল সাতটার মইদ্দে আমি নিজে গিয়া তোর বাড়িতে দিয়া আমু!
বলাই ওর মুখের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের রাগ নিজের দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ি চলে এল!
পরেরদিন বলাইদা আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কেরুর হাতের পাঞ্জাবি পরার আশা ছেড়েই দিল! আজ বাদে কাল বিয়ে, তাই মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিল- রেডিমেড পাঞ্জাবি পরেই বিয়েটা সেরে ফেলবে। তাই-ই হলো, লজ্জায় কেরুদাও বউভাতে খেতে যায়নি! শুধু তাই নয়, পাড়ায় এ-কথা জানাজানি হওয়াতে বেশ কয়েকদিন বাড়ি থেকেও বের হয়নি!
তারপর অবশ্য যে-কে-সেই! বলাইদাও সবকিছু ভুলেঠুলে কেরুদাকে লজ্জার হাত থেকে একদিন নিষ্কৃতি দিল!
কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর….।
কেরুদার ঘর বহরে না হলেও বাহারে বেড়েছে বেশ! বেড়ার জায়গায় উঠেছে ইট, সামনের চওড়া রাস্তায় সিইএসসি’র আলো। আর দেখতে দেখতে বলাইদার ছেলেও বিয়ের উপযুক্ত হল। না না, পাঞ্জাবির অর্ডার আর কেরুদা পায়নি, ন্যাড়া বেলতলায় দ্বিতীয়বার আর যায়নি। বাবা-ছেলে মিলে একমাস ধরে সব কেনাকাটা করেছে। বরের পাজামা পাঞ্জাবিও চলে এসেছে কনে বাড়ি থেকে। এখন শুধু পরে দেখে নেওয়া। তাই বাবার কথা মতো বেণু পাজামা-পাঞ্জাবিটা গায়ে গলিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এ… বাবা……! এ তো অনেকটাই ছোটো হয়েছে! এত করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও……! এখন কী হবে! বেণু ওর বাবার মতোই লম্বা, তাই সম্ভাবনা কম হলেও একটা চান্স নিতে ক্ষতি কী!
“কাকু, খুব বিপদে পড়ে গেছি গো, মেয়ের বাড়ি থেকে আমায় যে পাঞ্জাবিটা দিয়েছে সেটা অনেকটাই ছোটো। তাই বলছিলাম, বাবার নাকি একটা পাঞ্জাবি তোমার এখানে নতুন অবস্থায় পড়ে আছে? ওটা দেও না গো প্লিজ”!
“শোনো সেলের কতা, তগো জিনিস তরা নিবি হেয়াতে আবার এত সংকোচের কী আসে! ঐটা তো কাইটটা সিলাই কইরা অতি যত্নে রাইখ্যা দিসি। শুধু বুতাম কয়খান লাগানো বাকি; তুই এক কাম কর, কাইল সকালে এমন সময় চইল্লা আয়, পাইয়া যাবি”।
“ঠিক বলছো তো? দেখো; এবারে কিন্তু আর কথার নড়চড় কোরো না, আমি বাবার মুখে সব শুনেছি। তোমরা বন্ধু বলে এতদিন কিছু বলিনি। আমি আজ আসছি, কাল ঠিক এই সময় আসব”!
পরদিন সকালে বেণু এসে দেখে কেরুদা বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি, বেণুকে দেখেই ঘাবড়ে গিয়ে বলল- “কাকু আইসো; মুশকিল হইসে- কতদিন আগের কতা, খুঁজতে এট্টু টাইম লাগবো! বাজার থিকা আইস্যাই তর কাকিমারে সঙ্গে লইয়া খোঁজাখুঁজি শুরু করুম”।
একথা শুনে বেণুর তো মাথায় রক্ত উঠে গেল, চিৎকার করে যা মুখে এল তাই-ই বলে গেল!
“গতকাল তুমি আমায় বললে যে আজকে দেবে, আর এখন আজেবাজে বকছো”!
কেরু-বউদি ঘরের ভিতর থেকে বেণুর এই কথাটা শুনতে পেয়ে আলতো করে পর্দাটা সরিয়ে শুধু মুখটুকু বার করে মিষ্টি গলায় বলল-