শাশুড়ির ভালোবাসা সুরমার জীবন বদলে দিল। কিন্তু বিধাতা পুরুষ অলক্ষ্যে থেকে হাসলেন। দিনটা ছিল বিজয়া দশমীর দিন। সকাল থেকেই সুরমার আনন্দ। বারোয়ারীর দালানে গিয়ে সিঁদুর খেলবে। বছর ঘুরতে চলল তার বিয়ে হয়েছে। সন্ধ্যার সময় সুরমার স্বামী বিজয় বললে “আমার একটু কাজ আছে। সেটা সেরে ঠাকুর দালানে পৌঁছে যাবো। তোমার সিঁদুরে মাখা মুখ দেখব।” আজকের দিনেও কাজ। মুখভার করেছিল সুরমা। বিজয় বুঝতে পেরে সুরমার চুল গুলো সরাতে সরাতে বলেছিল “এই তো। ঠিক সময়ে চলে আসব।এখন তো শুধুই তোমার বর নই, কদিন পরে আমার সন্তান আসবে পৃথিবীতে। কত দায়িত্ব আমার সেটা ভাবো। এই তো যাবো আর আসবো”।
সন্ধ্যার সময় ঠাকুর বরণ হচ্ছে। চারিদিকে উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনি। দুর্গা মাকে সিঁদুর পরিয়ে সকল এয়োদের সিঁদুর পরাচ্ছিল সুরমা। ঠিক তখনই হঠাৎই মণ্ডপের মাইক বন্ধ হয়ে গেল। চিৎকার করে কে যেন বললে “বিজয় আর নেই। হঠাৎই দেখা গেছে প্লাটফর্ম এর উপর তার রক্তাক্ত দেহ “। নিজের কানকে বিশ্বাস করতেই পারছে না সুরমা। এ কী করে সম্ভব। হাত থেকে সিঁদুরের প্লেট পরে গেছে তার। গর্ভে বিজয় রোপণ করে গেছে ভালোবাসার বীজ। কত সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে এ কোন ঝড় এলো সুরমার জীবনে। তছনছ করে দিলে সবকিছু।
সুরমার কপাল পুড়লো। লেখাপড়াও জানে না বিশেষ। সংসার সমুদ্রে কী করবে সে এখন? ভ্যাবাচ্যাকা পাগল প্রায় সুরমা যখন বাড়িতে এল তখন আরও এক মৃত্যু অপেক্ষা করছিল। ছেলের মৃতদেহ দেখে শাশুড়ির কোনও সাড়া নেই। ডাক্তার এসে বললে “মানসিক যন্ত্রণার বলি হয়েছেন। পুত্রশোক সামলানো কী মুখের কথা”। শান্ত সমুদ্রে নাবিক যখন জাহাজে পাড়ি দেয় তখন সে জানে না গভীর সমুদ্রে কোন ঝঞ্ছা অপেক্ষা করে আছে। সুরমার মনে হল সেও মরে যাবে। তার প্রিয় দুই মানুষ যখন চলে গেছে তখন সে বেঁচে থেকেই কী করবে? কিন্তু মা ডাকটা সুরমাকে মরতে দিল না। মণির মা হয়ে বেঁচে আছে সুরমা। একটা ভয়াবহ জীবন সংগ্রাম করছে মণিকে বড়ো করে তুলবে। তারমতো বাল্যবিবাহ দেবে না। পায়ের তলার মাটিটা শক্ত হবে সেই শক্তি চাই। লেখাপড়া শেখাই সেই শক্তি। সুরমার থেকে ভালো কেউ সেটা জানে না।
সুরমার মেয়েটার নাম মণিমালা। যখন সে জন্মালে তখন পরিচিত জনেরা বললে “এ মেয়ে অপয়া।জন্মের খবরেই বাপ গেল,ঠাকুমা গেল”। সুরমার চোখ জ্বলজ্বল করে রাগে। মানুষের সাধ্য কী নিয়তিকে অবহেলা করবে। সুরমা জানে এবার সকলে মিলে ওর সন্তানের পিছনে পরে থাকবে। কে একজন বললে “মেয়েটার গায়ের রঙ তেমন ফর্সা নয়। মাথাতে চুল কম”। মানুষের বলা মুখ চলা পথের মতো। থামবেই না। থামবেই না। সুরমার মনে হয় মানুষ শুধুই নয়। দেবতাও একচোখো। ঘুমন্ত সন্তানের পাশে বসে থাকতে থাকতে মনে পড়ে বৃত্রাসুরের গল্প। শাশুড়ি বলতেন “বৃত্রাসুর পরম বৈষ্ণব। তবুও ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের পক্ষে ছিলেন। আবার দধীচি মুনির মতো ভক্ত কে আত্মবলিদান দিতে হল। সুরমার এখন একটাই শক্তি। আত্মশক্তি। শাশুড়ি কথায় কথায় বলতেন “মানুষ সব পারে বৌমা। সব পারে। অসীম ক্ষমতা ঘুমন্ত রয়েছে মানুষের অন্তরে। শুধুই জাগিয়ে তুলতে হবে। তখন তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। সঞ্চিত যা অর্থ ছিল তার বেশ কিছুটা খরচ হল। মেয়েটা একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে। এইভাবে চললে আর কিছুদিনের মধ্যেই কপর্দকহীন হতে হবে। বাপের বাড়ি থেকে ডাক এল। তারা সুরমাকে আর তার মেয়েটাকে নিয়ে যেতে চায়। বাধা দিলে সুরমা। সে কোথাও যাবে না স্বামী আর শ্বশুর এর ভিটে ছেড়ে। রান্না বসিয়েছে সুরমা। পাঁচ বছরের মেয়ের জন্য কৈ মাছ রান্না করছে। পেঁপে আর কাঁচকলা দিয়ে পুষ্টিকর রান্না। নিজেই ধরেছে কৈ মাছ। হঠাৎই পাশের বাড়ির নীলু এসে বললে “বৌদি। পাঁচটা টাকা দেবে? আমি জেরক্স করতে যাবো সেই নতুন বাজারে। মা ঘাটে গেছে কখন। অথচ আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে”।
সুরমা খুব ভালোবাসে নীলুকে। এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। অথচ এই অজ পাড়া গাঁয়ে কোনও সুযোগ সুবিধার বালাই নেই। বললে “এক্ষুনি দিচ্ছি নীলু। আর যাচ্ছো যখন আমার মণির দুধের কৌটো এনে দিও। “ বলেই নীলুকে টাকা দিলে সুরমা। হাত ধরে তাকে বসালে দুয়ারে। থালায় কৈ মাছের ঝোল আর ভাত দিয়ে বললে “ভাত কটা খেয়ে যাও নীলু। নতুন বাজার তো এখেনে নয়। পেটে তোমার খিদের বাজনা বাজবে।”। সত্যিই দশটা বেজে গেছে। নীলুর মা গেছে ঘাটে কাপড় কাচতে। নীলুর মাকে সুরমা কাকীমা বলে। এদিককার মধ্যে নীলুদের অবস্থা সবথেকে খারাপ। দুদিন আগে ওদের রান্নাশালা ভেঙে গেছে। নীলুর বাপের আবার হার্টের ব্যামো। শক্ত কাজ করতে পারে না। জমি জায়গার দালালি করে ।টাকা আসে অবরে সবরে। এই সীমাহীন প্রতিকূলতার মধ্যেই লেখাপড়া করছে নীলু। ছেলেটার প্রতি বড়ো মমতা হয় সুরমার। এমন ছেলে রত্ন।