বাইশরশি পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার অন্তরগত একটা প্রত্যন্ত গ্রাম l এই গ্রামেই বাইশ রশি জমিদার বাড়ী আছে l রহস্যে ঘেরা এই বাইশ রশি জমিদার বাড়ী l আঠেরোশো শতকের শুরুর দিকে এই বাড়ীটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয় l চোদ্দটি ভবন ও পাঁচটি সান বাঁধানো পুকুর ছিল এই বাড়ীটিতে l কালের বিবর্তনে যৌবনের সব জৌলুস হারিয়ে জড়াজীর্ণ হয়ে মুখ থুবড়ে পরে আছে l বাইশরশি জমিদারবাড়ী প্রায় পঞ্চাশ একর জমির উপর নির্মিত সুসজ্জিত একটি ইমারত l লবন ব্যবসায়ী উত্তম চন্দ্র সাহা এই বাড়িটি নির্মাণ করেন l যৌবনে এই বাড়ীটির জৌলুস ছিল দেখার মতন l এখন এই বাড়ীটি ধ্বংশ স্তুপে পরিণত হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কঙ্কাল সার দেহ নিয়ে কালের করল গ্রাসের মুখে অস্তমিত সূর্যের মত l বহু দিন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পরে থাকার ফলে গাছ পালা লতা পাতা ঝোপ জঙ্গল জন্ম নিয়েছে বাড়ীটার গায়ে l ধীরে ধীরে পলেস্তরা খসে পড়ে ইট কাঠের কঙ্কাল বেড়িয়ে পড়েছে l আরও কিছু দিন বিনা রক্ষনা-বেক্ষনে পড়ে থাকলে হয়তো প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিয়ে মিলিয়ে যেতে হবে মাটির সাথে l বাড়ীটি যেন একাকিত্ব ও নীরবতায় ডুকরে ডুকরে কাঁদছে l জমিদারদের বংশধররা এখন আর কেউ থাকেন না এই বাড়ীতে l তাই এই কঙ্কালসার অবস্থা l ১৮০০ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে এই জমিদাররা বিরাট ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছিলেন l ১৯৪৭ সালের পর কলকাতায় বসে জমিদারি চালাতেন এই জমিদারের বংশধররা l জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী ছিল l অবাধ্য প্রজার বিচার হত l বিচারে কোন প্রজা মারা গেলে তার দেহ বাড়ীর পিছন দিকে যে অন্ধকূপ ছিল সেখানে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হোত l প্রজাদের উপর প্রচুর অত্যাচার চালাতেন এই জমিদাররা l উৎপাদিত ফসলের প্রায় সবটাই নিয়ে নিত জমিদার l অনাহার ক্লিষ্ট হয়ে দিন কাটতো প্রজাদের l মাঝে মাঝে প্রজাদের শোষণ করে আনা ফসলের সামান্য অংশ প্রজাদের মধ্যে বিতরণ করে জমিদার মহৎ খেতাব লাভ করতেন l ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়ে যায় l জমিদারি হারিয়ে সুকুমারবাবু অর্থহীন ও বিত্তহীন হয়ে পড়েন l বাঁচার তাগিদে সুকুমারবাবু ব্যবসা শুরু করেন l বাড়ীর দাসী স্বর্ণ ভান্ডার চুরি করলে সুকুমারবাবু ঐ দাসীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েন l দাসী গর্ববতী হলে সেই লজ্জায় সুকুমারবাবু নিজের বন্দুকের গুলিতে এই বাড়ীর ভিতর আত্মহত্যা করেন l তারপর থেকে এই বাড়ীটা ভুতুড়ে বাড়ী হিসাবে পরিচিত হয়ে আসছে l ২০০ বছরের পুরানো এই জমিদার বাড়ীটা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুললে প্রচুর মানুষ এসে ভিড় করবে দেখার জন্য l সৌত্রিক আশ, কলতান বর আর তীর্থজিৎ পান্থী ঠিক করে যে এবার পূজোর ছুটিতে ওরা বাইশরশি জমিদার বাড়ী দেখতে যাবে l জনশ্রুতি আছে যে ঐ জমিদার বাড়ীতে ভূতের আনাগোনা আছে l ভৌতিক রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য ওদের খুব উৎসাহ l ওরা তিন জনই নাস্তিক এবং নীরিশ্বর বাদী l অপঘাতে মানুষ মরে ভূত হয় এবং ভূতের অস্তিত্বে ওরা বিশ্বাস করে না l তিন দিনের ট্যুর l সষ্টি পূজোর দিন ভোরবেলা ওদের যাত্রা শুরু হয় l ট্রেনের মধ্যে কয়েক জন প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে আলাপ হয় ওদের l প্রথম পাসেঞ্জার….. আপনারা কোথায় যাচ্ছেন ? সৌত্রিক…. আমরা বাইশরশি গ্রামের জমিদার বাড়ী যাচ্ছি l প্রথম পাসেঞ্জার…. বাপরে!! কি বলছেন ? সৌত্রিক… কেন ? কি সমস্যা ? দ্বিতীয় পাসেঞ্জার…. গেলেই বুঝবেন l কলতান…. বুঝবো মানে ? দ্বিতীয় পাসেঞ্জার…. আপনারা শোনেন নি যে ওখানে ভূতের খুব উৎপাত l তীর্থজিৎ…. আমরা তো ভূত আছে বলেই যাচ্ছি l তৃতীয় পাসেঞ্জার…. এ ভূত সে ভূত না l এরা সাংঘাতিক রক্ত পিপাসু ভূত l কলতান… ঠিক আছে দেখিই না কি হয় l দ্বিতীয় পাসেঞ্জার…. আমি বলছি কি ঐ সব দেখা দেখি করতে যাবার দরকার নেই l ভালোয় ভালোয় বাড়ী ফিরে যান l তৃতীয় পাসেঞ্জার… শুধু শুধু বেঘোরে প্রাণটা দেবেন কেন ? ভগবানের এমন সুন্দর সৃষ্টিকে ভূতের হাতে তুলে দেবেন না l বাড়ী ফিরে যান l তীর্থজিৎ….আপনাদের কথা মত যদি ভূত বলে কিছু থাকে তবে তেনারাও তো ভগবানের সৃষ্টি l ভগবানের দুই সৃষ্টির মধ্যে লড়াই হবে তাতে যে বাঁচার বাঁচবে আর যে মরার মরবে l প্রথম পাসেঞ্জার…. তবে আর কি লড়ুন l লড়ে প্রাণ দিন l শহীদ হোন l দ্বিতীয় পাসেঞ্জার…. তেনারা তো আড়াল থেকে লড়াই করেন l তেনারা তো অশরীরি,নেগেটিভ এনার্জি l তেনাদের সাথে মানুষ পারবে কেমন করে ? কলতান… কে পারবে আর কে পারবে না সেটা দেখা যাবে লড়াইয়ের শেষে l কথাবার্তা বলতে বলতে ওরা বাইশরশি গ্রামে এসে পৌঁছায় l বাস থেকে নেমে ওরা একটা লজের তিন বিছানার একটা রুম বুক করে l পাশের দোকান থেকে চা আর টিফিন খেয়ে ওরা লজে ঢুকে যায় l অক্টোবর মাস শুরু হয়ে যাওয়ায় শীত কাল আসতে চলেছে l হুঁ হুঁ করে উত্তরের হাওয়া বইছে l বোঝা যাচ্ছে যে শীতকালে এখানে প্রচন্ড শীত পরে l অনুমান করে হাল্কা শীতের পোষাক যা নিয়ে এসেছে তাতেই চলে যাবে বলে মনে হচ্ছে l লজে ঢুকে হাত পা ধুঁয়ে একটু বিশ্রাম নেয় l সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই তবুও ওরা রাস্তার দিকে একটু বের হয় l শরতের আকাশে সামান্য হাল্কা হাল্কা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে l বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না l আস্তে আস্তে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে পুরো অঞ্চল জুড়ে l ওদের হাতে টর্চ ছিল l ওরা অন্ধকারের মধ্যে পথ হাঁটতে থাকে টর্চের আলোতে l বেশ কিছুটা দূর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে ওদের কানে l টর্চ জ্বালিয়ে কারোকে দেখতে পায় না l একটু পরেই ওরা দেখে এক বয়স্ক মহিলা, সাদা শাড়ি পড়া মাথা ভরা সাদা চুল তাদের একদম সামনে এসে পড়েছে l মহিলা… কোথায় যাচ্ছ বাবারা ? তীর্থজিৎ….আমরা হাঁটতে বেড়িয়েছি l কিন্তু আপনি ? কোন উত্তর না দিয়ে নিমেষের মধ্যে মহিলা ভ্যানিস হয়ে যায় l ওদের বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে l আঙুলের ফাঁকে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটের চ্যাকা লাগতে সম্বিত ফিরে আসে l ওরা তাড়াতাড়ি হেঁটে লজে পৌঁছে যায় l পরের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতকৃত্য সেড়ে ওরা বের হয় রাজবাড়ীর ভূতের রহস্য উদ্ঘাটন করতে l বাইরে থেকে বন জঙ্গলে ঘেরা জায়গাটা দেখে রাজবাড়ী বলে বোঝার উপায় নেই l মূল ফটকের সামনে একটা সাইন বোর্ডে লেখা আছে “ভূমি ও রাজস্য দপ্তর বাংলাদেশ সরকার l” আর একটু এগিয়ে যেতেই ওদের মনে হলো হ্যাঁ এটা রাজবাড়ীই বটে l বিরাট বড় অন্দর মহলটা নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা l জনপ্রাণী শুণ্য রাজপুরিটা খাঁ খাঁ করছে l ভিতর থেকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে গলগল করে l মনে হচ্ছে সবে মাত্র ইট ভাটার চুল্লি জ্বালানো হয়েছে l কিন্তু এখানে তো ইট ভাটাও নেই জনপ্রাণীও নেই তবে আগুন জ্বালালো কে? আর আগুন না জ্বালালে ধোঁয়াই বা আসছে কোথা থেকে ? তবে কি এটা তেনাদের কাজ ? ওদের মনে সংশয় দেখা দেয় l ওরা তো ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না, ভয়ও পায় না l ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা ভিতরে ঢুকে যায় l সামনে একটা খাবার দোকান দেখতে পেয়ে ওরা খেতে বসে যায় l একটা লোক খাবার খেয়ে টাকা দিতে না পাড়ায় মালিক ওকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয় l এমনি লোকটা পরে গিয়ে হার্ট এট্যাক হয়ে মরে যায় l সঙ্গে সঙ্গে দোকানটা গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায় l কেউ কিচ্ছু দেখতে পায় না l কাল বৈশাখী ঝড়ের মত প্রচন্ড বেগে হাওয়া ওঠে l খাবারের হাঁড়ি করাই বাসন পত্রগুলো সব ধূপধাপ করে পড়তে থাকে l খাওয়া মাথায় ওঠে যায় l ভয়ে চিৎকার করতে করতে যে যেদিকে পারে দৌড়ে পালিয়ে যায় l মুহূর্তে দোকান ফাঁকা হয়ে যায় l পরে ওরা জানতে পারে যে ঐ দোকানটা ভূতের আর যারা খেতে আসে তারাও ভূত l কিন্তু আজ ওরা তিন জন মানুষ বলে এমন ঘটনা ঘটেছে l ভয়ে ওদের গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে l কাঁপতে থাকে ঠক ঠক করে l ভূতে এবার একটু একটু বিশ্বাস আসছে ওদের l আজ আর কিছু দেখতে ভালো না লাগায় ওরা লজে ফিরে আসে l দ্বিতীয় দিন রাজবাড়ীর অনেকটা ভিতরে ঢুকে যায় l ওরা যখন অন্ধকূপের কাছে এসে পৌঁছায় তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে l মনে হচ্ছে একটা কালো চাদর দিয়ে ঘিরে রেখেছে জায়গাটা l যেন নিশুতি রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে l এখানে আসতেই ওদের গা ছম ছম করে ওঠে l রাজবাড়ীর এই অংশে লোকজন খুব একটা আসে না l মানুষের হাঁটা চলার পায়ের ছাপ নেই রাস্তায় l হঠাৎ দেখে অন্ধকূপ থেকে একটা ছায়া মূর্তি বের হয়ে গাছের ডালে গিয়ে বসে l ভয়ে ওদের গা শিউরে ওঠে l পা টা কিছুতেই টেনে তুলতে পারছে না l যেন কোন শক্ত আঠা দিয়ে কেউ আটকে রেখেছে মাটির সঙ্গে l হাত পায়ে খিল ধরে আসে l ওরা তড়িঘড়ি ফিরে আসে লজে l তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে হাল্কা কম্বল গায় দিয়ে শুয়ে পরে l গভীর রাতে কুকুরের তারস্বরে চিৎকার, পেঁচার ডাক নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতাকে ভয়াল করে তুলছে l ওদের হাত পা সিটিয়ে যায় l কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে নির্বাক শরীর গুলো পরে থাকে বিছানায় l ভোর রাতের দিকে দরজায় কারা যেন খট খট করে আওয়াজ করে l আস্তে আস্তে তার তীব্রতা বাড়তে থাকে l ওরা শুনতে পায় কিন্তু কেউ ওঠে দরজা খুলে দেখার সাহস পায় না l ওদের দম ফুট হয়ে যায় l সকাল বেলা কেয়ার টেকার আসলে তাকে সব গুছিয়ে বলে সৌত্রিক l শুনে কেয়ার টেকার বলে ” নিশুতি রাতে এখানে নিশি ডাকে l অনেককেই খেয়ে নিয়েছে এই নিশি l নিশির ডাক শুনে কেউ যদি দরজা খুলে নিশিকে অনুসরণ করে এগিয়ে যায় তবে নিশি তাকে রাজবাড়ীর পুকুরে ডুবিয়ে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলে l রাতে এরকম কিছু হলে দরজা খুলে বাইরে বের হবেন না একদম l “ ওদের বীরত্ব শেষ l আর একটা দিনও ওরা এখানে থাকার সাহস পায় না l ভোরবেলা উঠে সাত তাড়াতাড়ি সব ল্যাগেজ পত্তর গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পরে বাড়ী ফেরার জন্যl