মৈনাক দা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী l সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছেন দীর্ঘ দিন ধরে l খুব চালু দোকান l বাজারে একটা মাত্র দোকান , টেইলারিং এর মেটেরিয়াল বিক্রি করার জন্য l বাগুইআটি অঞ্চলের সমস্ত টেইলারিং এর দোকানদার মৈনাক দার দোকান থেকেই মেটেরিয়াল কিনতো l অশ্বিনী নগর , হাতিয়ারা, ঘুনি , দক্ষিণ পাড়া, কেষ্ট পুর, নারায়ণ তালা, জ্যাংড়া এই বিরাট অঞ্চল জুড়ে প্রসার লাভ কোরেছিলো মৈনাক দার ব্যবসা l তখন রেডি মেড পোশাকের চল ছিল না l সেই নব্বই এর দশকের কথা l তখন সবাই থান কাপড় বা পিস কিনে শার্ট প্যান্ট তৈরি করাতো টেইলারিং এর দোকান থেকে l ভিড় উপছে পড়তো মৈনাক দার দোকানে l দু জন কর্মচারী কাজ করতো l স্টক ও ছিল প্রচুর l দিনে প্রায় দশ হাজার টাকার মত বিক্রি ছিল l এই দোকান করেই মৈনাক দা তিন কাঠা জমি কিনে দোতালা বাড়ী বানিয়েছেন l দুটো ছেলেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করিয়েছেন l বেশ স্বচ্ছল পরিবার l ছেলেদের পকেটে সব সময় টাকা থাকতো l এত সবের পরেও মৈনাক দাকে কখনো হাসি মুখে থাকতে দেখা যেত না l সব সময় একটা দুশ্চিন্তা ঘিরে থাকতো মৈনাকদার চোখে মুখে l ইদানিং কালে আরও বেশি গম্ভীর হয়ে গেছেন l এক দিন সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম…… মৈনাক দা কি ব্যাপার বলো তো তুমি আজকাল ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছ ? মৈনাক দা…. কি আর বলবো l ঘরের কথা বাইরে বলাটা ঠিক না l কিন্তু আজ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না l তুমি তো শুধু কাস্টমারই না, ছোট ভাইয়ের মত তাই তোমাকে বলতে কোন সমস্যা নেই l ……. হ্যাঁ মন খুলে কথা বলো তো, মনটা একটু হাল্কা হউক l মৈনাক দা….. আসলে তোমার বৌদি বলছে যে বাড়ীটা তার নামে লিখে দিতে হবে l দুই ছেলেও আছে তার সঙ্গে l তিন জনে মিলে খুব চাপ সৃষ্টি করছে আমার উপর l …….. আচ্ছা , তোমার নামে থাকায় তাদের কি অসুবিধা হচ্ছে ? মৈনাক দা…. আমিও তো তাই বলেছি যে আমার নামে থাকায় তোমারদের কি অসুবিধা হচ্ছে l তোমরা তো স্বাধীন ভাবেই থাকতে পারছো l আমি তো শুধু রাত্রি বেলা বাড়ীতে থাকি l তাতে তোমার বৌদি বলছে… আমার নামে থাকলেই বা তোমার অসুবিধা কোথায় ? ……. বুঝতে পেরেছি এটা একটা ক্রিটিক্যাল পারিবারিক সমস্যা l আমি মনেমনে ভাবলাম যে বৌদি হয়তো সব কেড়ে নিতে চাইছে l তাও আমি বল্লাম যে আমি কি এক বার বুঝিয়ে বলবো বৌদিকে ? মৈনাক দা….. বলতে পার তবে তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না l ……. তথাপি আমি এক দিন মৈনাক দার বাড়ী গিয়ে বৌদিকে বুঝিয়ে বললাম কিন্তু বৌদির সেই এক কথা যে…. আমার নামে দিলে ওনার অসুবিধা কিসে ? পরে আরও জানতে পারলাম যে বৌদি মৈনাক দাকে ঠিক মত খেতে দেয় না যেটুকু খেতে পারে তার থেকে বেশ কম দেয় এবং সব সময় দুর্ব্যবহার করে, অকথা কুকথা বলে l এই সব কারণে মৈনাক দা সব সময় মন মরা হয়ে থাকে l মুখে হাসি থাকে না কখনো l উঠতে বসতে যদি গালি গালাজ করে তবে কাহাতক মন মেজাজ ঠিক রাখা যায় l স্ত্রী ও দুই ছেলের নিষ্ঠুর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে মৈনাকদার জীবন l মাঝে মাঝে পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে ইচ্ছা করে মৈনাকদার l সংসারকে জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডের মত মনে হয় l এতো ভাল ব্যবসা,এতো ভাল রোজগার এই পরিবারে কোন সমস্যাই হবার কথা না l সুখের সংসার হওয়া উচিৎ l কিন্তু .. একটা কথা আছে না… সুখে থাকতে ভুতে কিলায় l জানি না কোথায় মৈনাক দার ত্রুটি l এতো ভালো নম্র ভদ্র মিষ্টি ভাসি লোকটার কপালে এতো অশান্তি কেন সেটা আমি ভেবে পাই না l মৈনাকদার মত এক জন ভাল লোকের এমন দজ্জাল বৌ হওয়া ঠিক হয় নি l অবশেষে মৈনাকদা বাড়ীটা বৌ এর নামে লিখে দিতে বাধ্য হলো l এর ফলে মৈনাকদার স্থান হলো চিলেকোঠা ঘরে l বৌদি যেহেতু দু ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে জোট বেঁধেছে তাই সে সংসারে প্রাধান্য ফলিয়ে যাচ্ছে অবলীলায় l দুই ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে মগজ ধোলাই করে বাবার বিদ্বেষী করে তুলেছে l তাই ছেলেরা যে কোনো ব্যাপারে মাকে সাপোর্ট করে l এর জন্য ছেলেদের সব অন্যায় আবদার মাকে মেনে নিতে হয় l ছেলে দুটি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলেও মানুষ হয়ে ওঠা হয় নি ওদের l মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ওরা দু ভাইও বাবাকে কথায় কথায় অসম্মান করতে,তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে কসুর করতো না l বাবা যেন একটা অবাঞ্চিত ,হাসির খোরাক মাত্র l বাবার দোষের কোন সীমা নেই l কারও পায়ে একটা মশায় কামড়ালেও সেই দোষ বাবার l যা কিছু হউক দোষ বাবার l একটা ইট কাঠেরও কিছুটা সম্মান আছে কিন্তু মৈনাকদার কোনো সন্মান নেই ঐ পরিবারে l যেন এক্কেবারে ইতর শ্রেণীর একজন মানুষ l তাই তাকে লাথি ঝাঁটা মারতে, অবজ্ঞা,অবহেলা করতে দ্বিধাবোধ হয় না, বরং আনন্দ হয় l অথচ সেই মানুষের রোজগারের টাকায় খেতে পড়তে সংকোচ বোধ হয় না l যাদের জন্য দিনাতিপাত করা তারাই আজ খড়গহস্থ l মৈনাকদা বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন যে এই সংসারে তার ঠাই আর বেশি দিন হবে না l তবুও মায়ার বন্ধন কাটিয়ে উঠতে না পেরে লাথি ঝাঁটা খেয়েও পরে থাকা l প্রথম আধ্যায়ের খেলাটা মা দুই ছেলেকে নিয়ে বেশ সফলতার সঙ্গেই সম্পন্ন করতে পেরেছে l এবার দ্বিতীয় অধ্যায়ের খেলার পরিকল্পনা শুরু করেছে ছেলেদেরকে সঙ্গে নিয়ে মা l দুই ছেলেকে মা বুঝিয়ে দিয়েছে যে দোকানটা তোদের বাবার নামে আছে সেটাকে তোদের নামে আনতে হবে l……যেহেতু বাড়ীটা আমার নামে করেছি তাই দোকানটা আমার নামে করা ভালো দেখাবে না l লোকে নিন্দা করবে l তাই দোকানটা বাবার নাম থেকে তোদের নামে আনতে হবে l তোরা বড় হয়েছিস তাই তোদের তো কিছু একটা করতে হবে সেই জন্য দোকানটা তোদের নামে করা যেতেই পারে l সেটা করতে গেলে এই দোকানটা বিক্রি করে আর একটা নতুন দোকান তোদের দুই ভাইয়ের নামে কিনতে হবে l তাই বাবাকে চাপ দিয়ে এই দোকানটা আগে বিক্রি করাতে হবে l দোকান বিক্রির প্রস্তাব আসতেই মৈনাক দা বুঝতে পেরে যান যে….. আমাকে ওরা ভিটে মাটি ছাড়া করার পরিকল্পনা করেছে l তাই আর বেশি দিন হয়তো এখানে থাকা হবে না l অচিরেই উৎখাত হতে হবে l আমাকে আর পালাতে হবে না ওরাই আমাকে তাড়িয়ে দেবে l আমি যতই ওদেরকে বাঁচাতে চেষ্টা করি না কেনো ওরা আমাকে ওদের কে বাঁচাতে দেবে না l ওদের ভালো করতে দেবে না l তাই আমি এখানে থেকেও ওদের জন্য কিছু করতে পারবো না l আর এই অত্যাচার অপমান সহ্য করে এখানে পরে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে l এতে মনুষত্বের অবমাননা হচ্ছে l মৈনাক দার মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে থেকে থেকে l কখনো মনে হচ্ছে যে…… আমাকে তো তাড়িয়ে দেবে ঠিকই কিন্তু আমার অবর্তমানে ওরা নিজেদেরকে বাঁচাতে পারবে তো ? আবার মনে হয় যারা আমাকে উদয় অস্ত অপমান করে শান্তি পাচ্ছে তাদের ভালো মন্দ আমার মনে আসছে কেন ? এটা কি মোহ-মায়া ? যদি এটা মোহ-মায়া হয় তবে সেটা আমি কেন কাটিয়ে উঠতে পারছি না ? আসলে সম্পর্কটা একটা মায়া বৃক্ষ l মাঝে মাঝে মনে হয় এই যন্ত্রনাময়, লাঞ্ছনাময় জীবন বয়ে বেড়ানোর থেকে স্বর্গ লাভ করা অনেক ভাল l কিন্তু মরতেও তো পারছি না l অবশেষে স্ত্রী পুত্রদের চাপকে প্রতিহত করতে না পেরে মৈনাকদা এই রকম রমরমা দোকানটা বিক্রি করতে বাধ্য হলেন l সেই টাকা দিয়ে কাছাকাছি আর একটা দোকান কেনা হোল পরিকল্পনা মাফিক ছেলেদের নামে l তবে তার পজিশন আগেরটার মত ওতোটা ভাল না l মা আর ছেলেরা ভীষণ খুশি l মা খুশি কারণ এবার সে তার স্বামীকে পথে বসাবার সব ব্যবস্থা পাঁকা করতে পেরেছে l আর ছেলেরা খুশি নিজেদের নামে দোকান পেয়ে l নতুন দোকান চালু করা হয়েছে l তবে মৈনাকদাকে দোকানে বসার জায়গা দেওয়া হয় নি l তাতে এক দিকে মৈনাক দা বেকার হয়ে গেলো l আর অন্য দিকে ছেলেরা বড় হলেও দোকান চালাবার মত উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি l তার ফলে খরিদ্দার আসন্তুষ্ট হচ্ছে পদে পদে l মাল পত্র স্টক করেছে ভালোই কিন্তু যোগ্যতার অভাবে দোকানটা মার খাচ্ছে l আস্তে আস্তে খরিদ্দার কমে যাচ্ছে l মৈনাক দা বেকার হয়ে যাওয়ায় বাড়ীতে তার খাওয়া পড়ার টাকা দিতে না পাড়ায় বিরাট ঝামেলা বাঁধালো তার স্ত্রী l তাকে বার বার বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে l কিন্তু যাবে কথায় ? মৈনাক দার স্ত্রী তার কোন কথা সোনার পক্ষপাতী না l স্ত্রী তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে ….. কাল থেকে তোর এই বাড়ীতে থাকা খাওয়া বন্ধ l আর যদি তু্ই এই বাড়ী ছেড়ে না যাস তবে তোর কপালে মৃত্যু আছে এটা বলে দিলাম l উপায় অন্তর না থাকায় মৈনাক দা বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে আরতি সিনেমার সামনে নর্দমার উপর একটা চায়ের দোকান করলেন টালির চাল আর কেচার বেড়া দিয়ে l এই দোকান থেকে যা রোজগার হয় তা দিয়েই মৈনাক দার খাওয়া পড়া কোন রকমে হয়ে যায় l আর রাতে এই দোকানেই ঘুমিয়ে পড়েন l এই ভাবে বেশ চলছে l মৈনাকদা বুঝে নিয়েছেন যে এখন থেকে আমার জীবন শুধু আমারই l মৈনাকদার মাঝে মাঝে মনে হয় সবই ভেসে যায় নিয়তির নিষ্ঠুর ইঙ্গিতে l ঐ দিকে মৈনাক দার ছেলেদের দোকান ক্রমে ক্রমে বন্ধ হয়ে গেলো l তারপর এক দিন দোকানটা বিক্রি হয়ে গেলো l মৈনাকদার স্ত্রী বুঝতে পারলো যে তার স্বামীকে তো কোন মতেই জব্দ করা যাচ্ছে না l যতই যা করা হউক না কেন সে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে যাচ্ছে l না এটা তো মেনে নেওয়া যাবে না l তাকে ভালো থাকতে দেওয়া যাবে না l তাকে জব্দ করতেই হবে l তাকে জব্দ করতে পারলে তবেই তো শান্তি l তাই এক দিন দুই ছেলেকে নিয়ে মৈনাকদার স্ত্রী গভীর রাতে ঐ চায়ের দোকান বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় l তাতে দোকান সহ মৈনাকদা পুরে মারা যান l এত নির্মম মানুষের মন হতে পারে কল্পনা করা যায় না l মানুষ মনের দুঃখে বনে যায় কিন্তু বনে গিয়ে যদি বাঘের সামনে পরে তবে তাকে ভাগ্যের পরিহাস ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে ? এর অল্প দিন বাদে দুই ছেলেই চাকরি করতে দুবাই চলে যায় l মৈনাকদার স্ত্রী এই বাড়িতে একা হয়ে গেলো l স্বামীকে তো জব্দ করলেন তারপর এখন তার মনের মধ্যে স্বস্তি বিরাজ করছে তো ? নাকি মহা শুন্যের মধ্যে ঘুঁরপাক খেতে খেতে অন্ত সার শুন্য জীবন নিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছেন ? সেটা তিনিই জানেন l কথা বলার মত কেউ আর রইলো না l নিঃসঙ্গ ,একাকীত্ব জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া যে কি যন্ত্রণাময় সেটা এক মাত্র ভুক্ত ভুগিই জানেন l আইনের বিচারে ওনার কি শাস্তি হয়েছে বা আদোও কোন শাস্তি হয়েছে কিনা সেটা জানতে পাড়া যায় নি , কিন্তু জীবনের বিচারে ওনার যে শাস্তি ধার্য হয়েছে সেটা সহ্য করে কত দিন বেঁচে থাকতে পারবেন সেটাই এখন দেখার বিষয় l পরিস্থিতির ভয়াবহতায় বাকশক্তি স্তব্ধ হয়ে গেছে , কণ্ঠ নালীর শত দোলনেও আর স্বর বের হয় না l মনে হয় প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য সুচ ফুটছে সারা শরীরে l এই কষ্ট শরশয্যার চেয়ে কোনো অংশে কম না l অন্যকে জব্দ করতে গেলে নিজেকেও জব্দ হয়ে যেতে হয় এটাই হয়তো বিধাতার বিধান l