তখন সকল দশটা হবে। জগত্ সিনেমার পেছনে সেই পুরনো বাড়িটায় পূজো হতো, যার ঠাকুর ঘরটা যেন মিশে ছিল মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামে। প্রতিবার যেতাম, আর সেদিনও গেছি ঠাকুর দেখবো বলে। পুজোর মণ্ডপটাও যেন ঘরের মধ্যেই—আলাদা কোনো জাঁকজমক নেই, শুধু একটুখানি ভালো থাকার চেষ্টা। ঠাকুর ঘরের গন্ধটা ভিজে কাপড়ের মতো জড়িয়ে থাকত সবাইকে। বাড়ির লোকগুলো সাজগোজে ঠিকঠাক, কিন্তু দেখতে পেলেই মনে হতো যেন দেবীর পরিবারেরই কেউ। সাজের মধ্যে কোনো বাহুল্য নেই, শুধু ঘরের মেয়ে-ছেলে, যারা দেবীকে খুঁজে পায় তাদের দৈনন্দিনতার মধ্যে। তারা একমুখে হাসে, কিন্তু ভেতরে একটা ক্লান্তি—চিরদিনের শূন্যতা আর পারিবারিক বাঁচার লড়াই। সবকিছুতেই যেন একটা বঞ্চনার ছাপ, কিন্তু তার মাঝেও কোথাও একটুখানি শান্তি—যে শান্তি পূজোর থালার প্রসাদে মেলে। সামনের বড় গেটটা পেরিয়ে আমি ভিতরে ঢুকলাম, চারপাশে সুনসান পরিবেশ। বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই দেখলাম, আগেই যাঁরা এসে পৌঁছেছেন, তাঁরা সব ধীর পায়ে জুতো খুলে রেখেছেন গেটের পাশে। পায়ের ধুলো আর মাটি যেন একবার মুছে ফেলে মণ্ডপে প্রবেশ করছেন। মাটির সোঁদা গন্ধে ভিজে থাকা উঠোনে সবুজ শ্যাওলার ছাপ, যার উপর দিয়ে সবাই ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে। কিন্তু আমি… আমি যেন অজান্তেই, বা হয়ত ইচ্ছে করেই, জুতো খুললাম না। পায়ে রয়ে গেল সেই ধুলো, রয়ে গেল মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীনতা। গেটের পর, ধুলো মাখা উঠোনের দিকে তাকিয়ে, আমি যেন নিজেকে আলাদা করেই রাখলাম। একটা ছোট্ট অপরাধবোধ মনের কোণে উঁকি দিল, কিন্তু আমি হেঁটে গেলাম ঠাকুরের দিকে, যেন সেই সামান্য ভিন্নতার বোঝা বয়ে নিয়ে। মনে হলো, বাকি সবাই এক রকম নিয়ম মেনে চলেছে, আর আমি যেন নিজেই সেই নিয়ম ভাঙার ইচ্ছা নিয়ে এসেছি। হঠাৎ করেই পরিবেশের শান্তি ভেঙে গেল। কোনো একটা খুঁতখুঁতে গলার চিৎকার কানে আসতে শুরু করল—কে যেন কারো প্রতি রাগে গলমন্দ করছে। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না কাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো, আর চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে সেই কটু কথা গুলো যেন বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে না গিয়ে মণ্ডপের শান্ত পরিবেশকে কেমন করে দিচ্ছে। মনে হলো, কোথাও কিছু ঠিক নেই। গালমন্দ যেন ক্রমাগত বেড়েই চলল, কিন্তু কোথা থেকে আসছে, বা কার উদ্দেশ্যে, সেটা স্পষ্ট নয়। ঠিক তখনই পূজোর মণ্ডপ থেকে এক ভদ্রমহিলা ধীরপায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তাঁর চোখে-কপালে মিশে ছিল ভ্রুকুটি। কাছে এসে কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “তুমি দরজার পাশে তোমার পায়ের জুতো খুলে এসো। না হলে ওই উপরে কাকাতুয়া পাখি তোমায় ছাড়বে না।” আমি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথার উপরে তাকিয়ে দেখলাম এক বড় কাকাতুয়া পাখি ঠায় বসে আছে। সে ঘর দুলিয়ে রাগে একবার মাথা নামচ্ছে, একবার মাথা দুলাচ্ছে। মহিলার কথায় একটা রহস্যময় সতর্কতা ছিল—পাখিটার চোখে কি কোনো শাস্তির ছাপ লুকিয়ে? মনের ভেতর অদ্ভুত এক অস্বস্তি এসে বাসা বাঁধল। আমি ধীরে ধীরে দরজার দিকে ফিরে গেলাম। পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখলাম মাটি ধরা জুতোজোড়া, যেন ওগুলোই সমস্ত সমস্যার কারণ। জুতো খুলে উঠোনের পাশে রাখলাম, মনে হলো মাটি আর মানুষের নিয়ম মেনে চলার একটা শর্ত পূর্ণ হলো। ভেতরে একটা হালকা স্বস্তি অনুভব করলাম, যেন কোথাও কোনো ভুল শুধরে নিচ্ছি। জুতো খুলে আবার ঠাকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পূজোর মণ্ডপে ঢোকার সময় সেই কাকাতুয়া পাখিটার দিকে চোখ পড়ল। পাখিটা এবার ঠায় বসে নেই, যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই, অদ্ভুত এক নিঃশব্দের মধ্যে সে গলায় স্বর তুলল—“ধন্যবাদ, বাবু।” কানে বিশ্বাসই হচ্ছিল না! পাখির কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। মুহূর্তের জন্য সবকিছু থমকে গেল, যেন চারপাশের বাস্তবতা এক ধাক্কায় বদলে গেল। পাখির চোখে একধরনের শীতল শান্তি, আর কথাগুলো যেন তার নিজের নয়, কিন্তু আমার দিকেই নির্দেশিত। আমি কাকাতুয়ার কথা শুনে কিছুটা অবাক, কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও, আবার ঠাকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার মনের মধ্যে কোনো ভার নেই, শুধু একটা শান্তি আর স্থিরতা। মণ্ডপের পাশেই এক কোণে কল ছিল, যেখানে আগে থেকেই কয়েকজন হাত-পা ধুচ্ছিলেন। আমিও সেখানে গিয়ে হাত, পা ধুয়ে নিলাম। ঠান্ডা জলের স্পর্শ যেন শরীরের ক্লান্তি মুছে দিল, আর একধরনের পরিচ্ছন্নতার অনুভূতি মনের গভীরে ছড়িয়ে পড়ল।
জল মুচ্ছতে মুছতেই পূজার মণ্ডপের দিকে এগোলাম, তারপর সোজা ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলাম। দেবীর মূর্তির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তিনি যেন সবকিছু দেখছেন—আমার মনের সমস্ত ছোটখাটো ভাবনা, আমার অস্থিরতা, এমনকি সেই কাকাতুয়ার সাথে আমার অদ্ভুত মোলাকাতও। দেবীর চোখে যেন একধরনের গভীরতা, যা আমার সমস্ত চিন্তা-বিভ্রান্তি ঢেকে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর মনের ভেতর কোথাও একটা শান্তির ছোঁয়া পেলাম। ঠাকুর প্রণাম করার পর, পূজাদালান থেকে একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। তাঁর হাতে একটা সালপাতার থালা, ভেতরে পূজার প্রসাদ সাজানো। তিনি থালাটা আমার হাতে তুলে দিলেন, আর আমি ধীরপায়ে মাথা নত করে দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম। প্রসাদ গ্রহণ করার মুহূর্তটায়, মনের ভেতর একধরনের শুদ্ধতা আর শান্তির অনুভূতি এলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই প্রসাদ গহন করলাম, কিন্তু হঠাৎ আবার সেই অস্থির করা চিৎকার কানে এলো—”ডানদিকে! ডানদিকে!” মনে হলো কাকাতুয়ার সেই খুঁনখুঁনে স্বর আবার ফিরে এসেছে। প্রথমে বুঝতে পারলাম না, কোথা থেকে আসছে এ আওয়াজ। আমি কাকাতুয়ার দিকে তাকাতেই দেখি, সে আমার দিকে ইশারা করছে, যেন আমাকে কিছু নির্দেশ দিতে চাইছে। তার ছোট্ট চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আর ঠোঁটের ইশারা স্পষ্ট। সে গলায় আবার ডাকল, “ওই এঁটো পাতাটা ডানদিকের মায়লা ফেলার ড্রামে ফেলতে হবে।” মনে হলো, পাখিটা যেন নিয়মরক্ষার এক অদ্ভুত প্রহরী! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, কিন্তু এরপর হাসি চাপতে পারলাম না। আস্তে আস্তে ডানদিকের মায়লা ফেলার ড্রামের দিকে এগোলাম, আর কাকাতুয়ার সেই কথাগুলোই যেন চারপাশের শূন্যতা ভেঙে একটা বাস্তবতার ছাপ রেখে গেল। আজ আমি অনেক বয়সের মানুষ, জীবনের বহু পূজো মণ্ডপ, মেলা, আর আনুষ্ঠানিকতার সাক্ষী হয়েছি। কিন্তু সেই জগত্ সিনেমার পেছনের বাড়ির পুজোর মতো এমন অভিজ্ঞতা আর কখনো পাইনি। অনেক বছর কেটে গেছে, অনেক কিছু বদলে গেছে, কিন্তু কাকাতুয়ার সেই আশ্চর্য ভূমিকা—এক দরোয়ান হিসেবে, নিয়মের এক কঠোর প্রহরী—কোথাও আর দেখিনি। জীবনের পথে বিভিন্ন মানুষ আর ঘটনা এসেছে, চলে গেছে, কিন্তু সেই পাখিটার কথা আমার মনে রয়ে গেছে। যেন সে ছিল ওই ছোট্ট পুজো মণ্ডপের রক্ষক, অদৃশ্য এক দায়িত্ব পালন করছিল নীরবে। আর তার সেই সাদা-ধূসর পালকের নিচে লুকিয়ে থাকা বুদ্ধি, যা আমাকে শুধরে দিয়েছিল, নির্দেশ করেছিল নিয়মের পথে চলতে। এখনও যখন কোনো পুজোর মণ্ডপে যাই, সেই পুরনো স্মৃতি মনের কোণে ভাসতে থাকে। কিন্তু আর কোথাও কাকাতুয়া পাখির মতো দরোয়ান দেখিনি—যে শুধু মানুষের নয়, যেন দেবতারও রক্ষক। আজকের দিনে পুজোর মণ্ডপগুলো কত রকমের থিমে সাজানো হয়—আকাশচুম্বী কাঠামো, ঝলমলে আলো, আর শিল্পকলা দিয়ে ঢেকে ফেলা হয় পুরো আয়োজন। প্রযুক্তির ছোঁয়া পুজোগুলোকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি, সিনেমা থেকে শুরু করে কল্পনার নানা দুনিয়া পর্যন্ত থিম হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই একেবারে প্রাকৃতিক, ঘরোয়া থিম নির্ভর পুজো—যেখানে দেবীর কাছে যাওয়া মানেই প্রকৃতির মাঝে থাকা—সেই পুজোগুলো আজ আর তেমন দেখা যায় না। আজও যখন পুজোর মণ্ডপে যাই, নানা আড়ম্বর দেখে বিস্মিত হই ঠিকই, কিন্তু মনে মনে খুঁজে ফিরি সেই হারিয়ে যাওয়া কাকাতুয়া পাখিটাকে। তার সেই সহজ অথচ গভীর নজরদারি, মানুষের ভুল শুধরে দেওয়া—সবকিছু যেন এক ধরনের অলিখিত প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে বাঁধা ছিল। জানি না, তারা আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। মনে হয়, কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই সরল পুজোগুলোও, যেখানে কৃত্রিমতার চেয়ে বেশি ছিল মাটির গন্ধ, গাছের ছায়া আর সহজ প্রাণবন্ততা। সেই কাকাতুয়ার মতো প্রহরীরা কি আজও কোথাও আছে? নাকি তারা সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে?