তথাকথিত এই আধুনিক কৃষির কথা বলার আগে ভারতে প্রচলিত কৃষির ধারাবাহিক অধোগমনের ইতিহাসটা জেনে আমাদের এগোতে হবে। পুঁজিবাদী উন্নয়নের চিরাচরিত খপ্পরেই পরলো ভারতের কৃষি ব্যবস্থা এবং সেই ছাঁচে ঢেলে সাজাবার কাজটি শুরু করলো ‘সবুজবিপ্লব’ – ষাটের দশকে। তারপর ধারাবাহিক যে চক্রান্ত চলতে থাকলো যার পরিণতি আজকের ভারতের কৃষির এই বদ্ধজলা – তারই একটা বর্ণনা সংক্ষেপে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
ভারতীয় কৃষিতে ক্রমশ দখলদারি :
কয়েকটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছে দেশের কৃষি ব্যবস্থা। প্রথম পর্যায় ছিল PL 480 – পঞ্চাশের দশক। আমরা দেখবো, ‘জনমুখী’ লেবেল লাগিয়ে পঞ্চাশের দশকে যে সব প্রকল্পগুলি নেওয়া হয়েছিল তার সবই ছিল পশ্চিম দুনিয়ার বাণিজ্যিক স্বার্থেরই অনুকূলে।1954 সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার সূচনা করেছিলেন এই Public Law 480. আমরা একবার দেখে নিই কিছু ভালো কথার আড়ালে কি কি ঘোষণা ছিল এই পাবলিক ল-তে। ১) ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ; ২) স্থায়ী উন্নয়ন,বিশেষত কৃষি উন্নয়নে উদ্যোগী হতে সাহায্য করা ; ৩) বিশ্ব বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। ৪) মার্কিন কৃষিপণ্যের এবং কৃষিজাত বাজার, বাণিজ্য, রপ্তানির উন্নয়ন এবং প্রসার ঘটানো ; ৫) ব্যক্তিমালিকানাধিন উদ্যোগীদের গণতান্ত্রিক অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করা ; ৬) উদ্বৃত্ত মার্কিন পণ্য বিদেশের বাজারে লাভজনক শর্তে সরবরাহ করা। উপরে উল্লেখিত খাদ্য সুরক্ষার অজুহাতে আমেরিকা ধীরে ধীরে ভারতীয় কৃষির উপর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। ওদের যেটা আরও সুবিধা করে দেয় সেটা হল ভারতের শাসকশ্রেণীর পরনির্ভরশীলতার মানসিকতা এবং আত্মসমর্পণবাদী চরিত্র, বর্তমানে যেটা এসে মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। এটার ভিত করে গিয়েছিল সেই ইংরেজরা 1947-এ তথাকথিত স্বাধীনতার বকলমে একদল আপোষকামী ব্যক্তিবর্গের হাতে যখন ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল। এরপরপরই আমেরিকা তাদের মোক্ষম চালটি চালে। সেটি হল ‘সবুজ বিপ্লব’ – ষাটের দশকে। একটা জিনিষ আমাদের মাথায় রাখতে হবে এইসব কথাবার্তায়। সামনে দেশ-ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল ; পিছনে ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি-শিল্পপতি এই ছকেই কিন্তু চলছে গোটা দুনিয়াটা। বাইরে থেকে আমরা দেখি আলাদা আলাদা কিন্তু তারা একটাই শ্রেণী আমাদের দেশও তার বাইরে নয়। জনগণ সরলমনা মানুষ – অরাজনৈতিক। কোনো একটি দলকে আপন ভেবে ভক্ত হয়ে পড়ে।যাই হোক, আমেরিকাকে ‘সবুজবিপ্লব’ আনতে হল কেন ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। যুদ্ধে যেসব কোম্পানি রাসায়নিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করত তাদের ব্যবসার মুনাফা কমতে শুরু করলো। এখন এই যে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি হত তার উপাদান ছিল নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশিয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি।যেদিন থেকে কোম্পানিগুলো জানতে পারলো উদ্ভিদেরও পুষ্টির মূল উপাদান এইসব জিনিস, সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাথায় চলে এলো ব্যবসায়ীক পরিকল্পনা। শুরু হল কৃষিতে দখলদারির দ্বিতীয় পর্যায়। বিজ্ঞানীদের সাহায্যে এমন বীজ তারা তৈরি করালো যা তাদেরই তৈরি নাইট্রেট সার সহজেই উদ্ভিদ হজম করতে পারে। শুরু হল পণ্য উৎপাদনের মত কৃষিপণ্য উৎপাদনের পলিসি – রাসায়নিক শিল্পকে একই সঙ্গে সামরিক এবং অসামরিক শিল্পে ব্যবহার করার কায়দা। এই ভাবেই বেশ কয়েকবছর কৃষিকে ভাঙিয়ে তাদের ব্যবসা চললো। তারপরই ফলতে শুরু করল রাসায়নিক চাষের কুফল। প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে এল পরিবেশ দূষণ। খাবারে বিষ। আক্রান্ত হল মানুষ। পরিবেশের যে সর্বনাশগুলো হতে থাকলো সেগুলো হল মাটিতে জৈব উপাদানের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া,ফসলে মাত্রাতিরিক্ত বিষ, মাটির নিচে সংকটজনক স্তরে জল নেমে যাওয়া, আর্সেনিক ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর যখন দেখা গেল চাষের খরচ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, আগের মত উৎপাদনও আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, চাষিরাও আত্মহত্যা করছে,চাষজনিত অসুখবিসুখও বেড়ে যাচ্ছে – তখন এতো সব ভুলত্রুটি,দূষণ থেকে দৃষ্টি সরাতে এবং সর্বোপরি কৃষিটাকে আরও শক্তপোক্ত ভাবে দখলের লক্ষ্যে “দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব”-এর তত্ত্ব আমদানি করলো। এটা জিনশস্যের চাষ।এর বিপদের কথায় পরে আসছি। ইতিমধ্যে ভারতে শুরু হয়ে গেছে নয়া উদারবাদী জমানা। সাম্রাজ্যবাদী-মুনাফা চক্রান্তের পরবর্তী পলিসি। ভারতীয় শাসকদের ধারাবাহিক আত্মসমর্পণজনিত কারণে সহজেই তারা দেশের উপর চাপিয়ে দিতে পারলো। তথাকথিত স্বাধীনতার শৈশবে যারা শুরু করেছিল আপোস, বর্তমানে এসে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদেরই বংশধরদের বানিয়ে ফেললো পাপোশ। ভারতকে দিয়ে GATT চুক্তিতে সই করালো। বিদেশে গিয়ে সই করে এলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জী মহাশয়-১৯৯৪ সালে। GATT চুক্তিতে সই করার সঙ্গে সঙ্গেই পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে গেল ভারতের কৃষিক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাসমূহের সর্বাত্মক কর্তৃত্ব কায়েমের রাস্তা। সুতরাং তাদেরই তৈরি করা বিশ্বব্যাঙ্ক ও IMF-এর মডেল মানতে ভারত বাধ্য। তাতে অবশ্য ভারতীয় শাসকদের কিছুই যায় আসলো না,যায় আসলো দেশের জনগণের। কিভাবে ? বিশ্বব্যাঙ্ক বা IMF প্রথমেই সরকারকে বাধ্য করালো বিভিন্ন সরকারিখাতে ব্যয়-বরাদ্দ কমানো বা ছাঁটাই করা। অর্থনীতির যেসব ক্ষেত্র এই ব্যয়-বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের কবলে পড়লো সেগুলি হল কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবহন ছোট ও মাঝারি শিল্প ইত্যাদি ইত্যাদি।ব্যয় সংকোচের অজুহাতে জরুরী পরিষেবা থেকে সরকার সরে এল এবং সেগুলো বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। পরিণতিতে এই জমানায় এইসব পরিষেবা হয়ে পড়লো দামি। একই ভাবে কৃষিক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি কমার অর্থ হল কৃষি পরিকাঠামোয় সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনা। ফলে সেচের জল, সার, বিদ্যুৎ সহ কৃষির যাবতীয় উপকরণ আরও চড়া দামে চাষিকে কিনতে হয়। সুতরাং চাষবাসের খরচ মিটিয়ে সংসার চালাতে হলে তাঁকে ফসলের ন্যায্য দাম পেতে হবে। কিন্তু নয়া উদারনীতির শর্ত মেনে চাষিদের ফসলের সহায়কমূল্য ঘোষণা করতে অস্বীকার করে সরকার।তাই দেখা যাচ্ছে বর্তমানে গোটা ভারতের সমগ্র কৃষক সমাজটাই সংকটে পড়েছে যার পরিণতিতে আমরা দেখলাম বিগত একবছরব্যাপী কৃষক আন্দোলন।
এইবার আমরা ভারতসহ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের সেইসব মানুষ তথা গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে তাকাবো যাদের উপর ভরসা করে কৃষিটাকে সুস্থায়ী করতে চাইছি বা বিষমুক্ত। “১৯০১ সালে ভারতের ৭৫ শতাংশ কর্মরত মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল ছিলেন।১৯৫১ সালেও এই সংখ্যা ছিল ৭৬ শতাংশ (সূত্র: এলিস থরনার)। এখন ভারতের জিডিপিতে কৃষির অবদান ইতিমধ্যেই ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। সেই সঙ্গে সারা দেশেই কমছে কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা।যেখানে ২০০৪-২০০৫ সালেও দেশের ৫৮.৫ শতাংশ কর্মরত মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, ২০১১-২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৮.৯ শতাংশ।২০২২ সালে কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৪ শতাংশ।এর প্রায় ৬৩ শতাংশই মহিলা। একথা বলা এখন আর বাড়াবাড়ি হবে না যে ভারতের কৃষি ক্রমশ পূরুষশুণ্য হয়ে পড়ছে এবং কর্মক্ষম পুরুষেরা তুলনায় বাড়তি উপার্জনের আশায় ক্রমেই অকৃষি কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ২০২০-২০২১ সালে ভারতে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মানুষের মোট সংখ্যা ছিল ৪৯.৩ কোটি (যদিও কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছিল ১০২ কোটি)।এর মধ্যে কৃষিকাজে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ২১.১ কোটি আর অ-কৃষি কাজে যুক্ত ২৮.২ কোটি (মুক্তিপথ অক্টোবর-নভেম্বর,২০২৩ সংখ্যা)। এবার পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা দেখা যাক। “২০২১-২০২২ সালের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য দেখাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে এখন কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী এবং জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা এরাজ্যের মোট কর্মরত মানুষের মাত্র ৩৬.৩ শতাংশ।এর মধ্যে আবার মাত্র ৩৩.৭৫ শতাংশ পুরুষ এবং বাকিরা মহিলা। অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। তখন জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ প্রধানত কৃষি থেকেই জীবিকা অর্জন করতেন। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করলে পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা আরও পরিস্কার হবে। আমাদের রাজ্যের মাত্র ৩৬.৩ শতাংশ কর্মরত মানুষ যখন চাষবাস, মাছধরা এবং জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল, তখন ছত্তিশগড়ে এই পরিমাণ হল ৬৫ শতাংশ। ঝাড়খন্ডের ৫১.৬২ শতাংশ, তেলেঙ্গানার ৫০ শতাংশ এবং মধ্যপ্রদেশের ৬১ শতাংশ কর্মরত মানুষ এখনও কৃষি, মাছধরা এবং জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল। কৃষির উপর নির্ভরশীলতা কমে আসার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ১৬.৫৮ শতাংশ মানুষ এখন শ্রমিক হিসাবে Manufacturing-এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ১১.৪৬ শতাংশ”।(পত্রিকা একই) এতোক্ষণ উপরের আলোচনায় আমরা মোটামুটি ভারতের চালু কৃষি ব্যবস্থার একটা শ্রেণীচরিত্র এবং বর্তমানে দেশের সাধারণ জনগণের জীবন জীবিকার একটা আন্দাজ পেলাম। তার সাথে সাথে সবুজ বিপ্লব কর্তৃক পরিবেশ প্রকৃতি এবং স্বাস্থ্যের পরিণতি কোন জায়গায় পৌঁছিয়েছে দেখলাম। তবে সবুজ বিপ্লব বেকায়দায় গিয়ে পড়লো মানে এই নয় যে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থান্বেষীদের ক্রিয়াকলাপ থেমে গেল ! সবুজ বিপ্লবের শ্লোগানগুলিই ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’-এর মতো ‘দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব’ বা ‘চিরসবুজ’ বিপ্লবের নাম নিয়ে হাজির করলো যথারীতি সরকারি বদান্যতায়।যেমন প্রথম সবুজ বিপ্লবের সময় সরকারি প্রচারযন্ত্রেই নিম্নলিখিত শ্লোগানগুলিই প্রচারিত হয়েছিল। “ক্ষুধার কবল থেকে মুক্তি”, “আধুনিক কৃষির জয়যাত্রা”, “বিজ্ঞানের অগ্রগতি” ইত্যাদি ইত্যাদি।আর দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব তো বিজ্ঞানের চূড়ান্ত প্রয়োগ (অপ?)। এটার বিরোধীতা করলে তো “বিজ্ঞান বিরোধী” বলেই দেগে দেবে। এমনকি “রাষ্ট বিরোধী” তকমাও জুটতে পারে। এটা জিন শস্যের চাষ। এখন এই চাষের বিপদটা ঠিক কোথায় ? সেটাই আলোচনা করা যাক। এই চাষে এক প্রজাতির জিন ভিন্ন প্রজাতিতে চালান করে দেওয়া হয়।যে প্রযুক্তির মাধ্যমে এই কাজটি করা হয় তার নাম হল ‘জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং’। এই প্রযুক্তির অনেক সুফল আমরা পেয়েছি।যেমন ইনসুলিন, DNA Vaccine ইত্যাদি। Covid Vaccine কিন্তু এই গোত্রে পরছে না। এটা অন্য এক আলোচনা।জিন-চাষের মৌলিক বিপদটা ঘটবে প্রকৃতি তথা বাস্তুতন্ত্রে। বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশটা কিভাবে ঘটতে পারে সেটা জানার আগে প্রকৃতিতে জিনের ভূমিকাটা আমাদের আর একবার বুঝে নিতে হবে।যে কোনো জীবকোষে জিন থাকে এবং সমস্ত জীবের বৈশিষ্টের নকশা লুকিয়ে থাকে তার জিনে। জীবজগতের স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে এক প্রজাতির সঙ্গে ভিন্ন প্রজাতির জিনের বিনিময় ঘটে না। প্রকৃতিতে কোটি কোটি বছরের জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জীবজগতের পারস্পরিক আদান-প্রদান ও জীবন-যাপন দ্বারা মিথস্ক্রিয়া গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থা তৈরিতে প্রজাতির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ একটি পক্ষ এবং তার চারপাশের জড় ও জৈব পরিবেশ আর একটি পক্ষ। আজকে আমরা প্রকৃতির যে একপ্রকার সুস্থায়ী রূপ দেখছি তা এই দুই পক্ষেরই পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ারই ফল এবং এই ব্যাপারে জিন বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখন কোনো প্রজাতিতে আচমকা জিনের পরিবর্তন ঘটানো হলে আগামীদিনে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে কিরকম প্রভাব ফেলবে তা বলা সম্ভব নয়। কারণ জীবকোষে জিনসজ্জা স্থিরকৃত হয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, ল্যাবরেটরিতে তাড়াহুড়ো করে নয়।জিন-চাষের বিপদ নিয়ে অনেক গবেষকই সাবধান বাণী করে গেছেন। আমরা একজনের কথা শুনবো।ইনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন। নাম জর্জ ওয়ান্ড (George wald)।তিনি বলছেন, “ডি.এন.এ টেকনোলজি আমাদের যে সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা শুধু বিজ্ঞানের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর বুকে প্রাণের ইতিহাসেও অভূতপূর্ব। তিনশো কোটি বছরের মধ্য দিয়ে উৎপাদিত আজকের যে জীববৈচিত্র তাকে ইচ্ছে মতো ভাঙ্গা-গড়ার ক্ষমতা মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে এই টেকনোলজি।জীব বৈচিত্রের যে প্রাকৃতিক নিয়মে আগে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে,যেমন পশুর বা গাছের সংমিশ্রণ, তার সঙ্গে আজকের হস্তক্ষেপ গুলিয়ে ফেললে চলবে না। আগের প্রতিটি কাজের পদ্ধতি ছিল একটি বিশেষ প্রজাতি বা কাছাকাছি দুটো প্রজাতি নিয়ে। এতোদিন আমাদের নৈতিকতা ছিল – প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা যা শিখতে পারি, তার সর্বক্ষেত্রে বিনা বাধায় এগিয়ে যাওয়া। প্রকৃতিকে পুনর্গঠন করার কোনো বাজি আমরা খেলিনি। আজকের নতুন ধারণা শুধুমাত্র প্রাজ্ঞতার অভাব নয়, এটা বিপজ্জনকও বটে। এটা ক্যান্সারের নতুন উৎস, নতুন মহামারীর কারণ হতে পারে।” আসলে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের লক্ষ্যই হল ভারতের কৃষিটাকে সম্পূর্ণ রূপে নিজেদের কব্জায় আনা। ইতিমধ্যে তারা তৈরি করিয়েছে ‘বাঁজা’ বীজ অর্থাৎ যে বীজ থেকে পরের বছর আর চারা গজাবে না এবং সেটা এই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করেই। খুবই সংক্ষেপে এবং অল্প কিছু উদাহরণ সহযোগে আমাদের দেশের কৃষি সহ সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে গ্রাস করে রেখেছে তার একটা রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এখনো অনেক কিছু বাকি রয়ে গেল। সেগুলো আলাদা আলাদা ভাবে প্রবন্ধ লেখা দরকার।যত সেগুলো জানতে থাকবো তত পুঁজিবাদের স্বরূপ এবং তার সঙ্গে দেশের শাসন ব্যবস্থার আন্তঃসম্পর্ক পরিস্কার হতে থাকবে। আমার মূল বক্তব্য এটাই যে আজকের পুঁজিবাদী সমাজকে অপরিবর্তিত রেখে বা তাকে কিছু মাজাঘষা করে যেমন সমাজটাকে সুন্দর করা যায় না, ঠিক তেমনি শুধুমাত্র সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আলোচনা চালিয়ে কৃষিটা একদিন বিষমুক্ত হয়ে যাবে – এই ধারণাটাও অবাস্তব।সেমিনারগুলো ফলপ্রসূ তখনই হবে যখন সমস্যাগুলো জানার পর সেই অনুযায়ী সংগঠন বানিয়ে যদি এগোনো যায়। নাহলে একই কথা বারে বারে গিয়ে শুনতে হবে। বিষমুক্ত চাষ সেটা কৃষিই তো নাকি ? প্রচলিত কৃষির সমস্ত বিপদ রয়ে যাবে আর চাষটা বিষহীন হতে থাকবে তা তারা হতেই দেবে না।আমি দুটি বৃহদাকার কোম্পানির ছোট্ট করে তাদের চরিত্রের পরিচয় দিচ্ছি।যেমন মনসান্ট।এরা গোটা বিশ্বের বীজের নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৪৫ সালের ৬ই এবং ৯ই আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে পরমাণু বোমা ফেলা হয়েছিল সেই বোমা তৈরিতে যে দুটি কোম্পানি অর্থ বিনিয়োগ করে ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম এই মনসান্ট,অন্যটি ডুপন্ট।নোভার্টিস কোম্পানি ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করে। একই সঙ্গে কীটনাশক বিষও তৈরি করে যে বিষ ব্লাড ক্যান্সার সৃষ্টি করে।তারপর যেটা করে সেটা আরও নিষ্ঠুর। তাদের তৈরি বিষ কতটা ক্ষতিকর পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তারা গরীব মানুষ ভারা করে। দ্বিমুখী ব্যবসা। এরপরেও দুটি আলোচনা থেকে গেল।১) GMO ফসলের প্রভাব, ২) জৈব চাষ করে কি সব মানুষকে খাওয়ানো যাবে ? বড় আলোচনা এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়।অন্য একদিন এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। সুতরাং এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে একদম উল্টোপথে আমাদের হাঁটা শুরু করতে হবে। এখানে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে, আমাদের ক্ষমতা কতটুকু যে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভ করবো ? জনগণের শক্তির উপর ভরসা যদি আমাদের থাকে তাহলে নিজেদের শক্তি নিয়ে সন্দিহান কখনোই হব না। প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলির সাথে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে তারা রাজনীতির কথা বলে না কিন্তু সংগঠনটা করে ; আর আমরা রাজনীতির কথা বলি কিন্তু সংগঠনটা করি না।