হো ফাগোয়া রে
…………………….
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আজ পূর্ণিমা বলে হাঁটুটা কাল রাত থেকে টনটন্ করে যাচ্ছে। সকালটা আজ উপোস রেখেছেন। তাই বলে শ্বশুরবাড়ির একমাত্র সম্বল পিতলের বাল-গোপালের গায়ে একটু আবীর আর তার জন্য স্পেশাল নাড়ু প্রসাদে দিয়ে দেবেন যে স্নানের পরে সেটা অবশ্য আগে থেকেই ঠিক করে গুছিয়ে রাখা আছে।
এতগুলো বছরেও তাঁর এদিনটা কখনো এসব আচারপালনে ব্যর্থ হয়নি। খালি দু-টো বছর, যার একটা হল ঊননব্বই সালের। সেবার বছর চল্লিশের ঘরোয়া গৃহবধূটির চেহারায় চিরস্থায়ী বদলের অভিজ্ঞান খোদাই হল। সেদিন ভালোয় মন্দয় মেশানো স্বামীর অকালমৃত্যু আর তারপর পঁচানব্বই সালে এই তিথিতেই ওদের একমাত্র ছেলে যেদিন নিস্পন্দ ও চিরঘুমন্ত হয়ে ঘরে ফিরে এসেছিল সেদিনও কিন্তু গোপাল তার নিজের জন্য বরাদ্দ নারকেল নাড়ু আর এক পশলা আবীরের ফোঁটা কপালে নিয়ে অসার সংসারের মাঝে রঞ্জাবতী দেবীকে তার বড় বড় স্থির দু-চোখে ক্রমাগত দেখতে দেখতে তাঁর সেই অভয়পদে ঠিক স্থান করে দিয়েছিল।
সেজন্য আজ এই বছর সত্তর বছর বয়সেও এসে এই প্রচলিত অভ্যাসের বাত্যয়টি ঘটেও নি আর ভবিষ্যতেও ঘটবেও না আশাকরি।
……
পুলকেশ বাবু ছিলেন কর্পোরেশনের কেরাণী।সে যুগে ওইসব কাজে মাইনেপত্তর কম ছিল বলেই হয়ত প্রয়োজনটাও হঠাৎ করে বেড়ে উঠতে শেখেনি। সেবার কর্তা অ্যানজাইনায় হঠাৎ চলে গেলেন ঠিক দোলের দিন। সিঁড়ি দিয়ে দ্রত নামছিলেন মোড়ের দোকান থেকে রেডিওর জন্য চারটে ব্যাটারী কিনবেন বলে। কেবল সেদিন ওনার ওই দ্রুতপদে নিষ্ক্রমণটা যেন আক্ষরিকভাবেই চিরকালের হয়ে রইল। কষ্ট লেগেছিল ভীষণ।
তবু এরপর ছেলের মুখ চেয়ে একপশলা লাল আর সবুজ আবীরের আঁচড় মুছে নিদাগ সিঁথিটি আর পোড়া কপালটিকে নিয়ে একটু একটু করে সেদিনের পর থেকে বাঁচতে শিখেছিলেন। জীবননাট্য যে সেদিনও ওসবে একদম শেষ হয়ে যায়নি !
কয়েকবছর পর বিপর্যয়ের দোল পূর্ণিমা আবার ফিরে এল। এইবারে সামান্য বয়স বাড়লেও, শোক সামলে পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আবার শক্ত করে বুক বাঁধতে বাধ্য হলেন। তখন ওঁদের একমাত্র ছেলে প্রণয় কলেজের ফাইন্যাল ইয়ারে পড়ছে। ডায়মন্ড হারবার থেকে এক বন্ধুর মোটরবাইকে দু’জন ফিরছিল তাদেরই দলের একজনের পৈতৃক বাগানবাড়িতে বসা বন্ধুদের নিয়ে দোলের জমায়েত আহ্লাদ সেরে।
যদিও সেই দুই বন্ধুর আর আমতলার ওপারে ফেরা হয়নি সেদিন। সাবেকি ছাঁদের এই নফর কুন্ডু লেনের দোতলা বাড়িতে ঘটনার দু’দিন পরে রক্তলাঞ্ছিত ও পোস্টমর্টেমের আঁচড়ে ভরা একটি শবদেহ শুধু ফিরেছিল।
মনকে সেদিন বারবার বুঝিয়েছিলেন যে এ শবদেহটি ওঁদের প্রণয়ের নয়, না..না…এ হতেই পারেনা… মৃতজনটিকে স্রেফ প্রণয়ের মত অনেকটা দেখতে!
কিন্তু সে আপ্তবাক্য আর সত্যি হল কই!
তবে দোলের নাড়ু আর আবীরের আদর ওনাদের গোপাল কিন্তু সেদিনও কিন্তু তার হিসাবমত পেয়েছিল সকালবেলাতেই।
……
এইবছর গোপালকে একটা নতুন জামায় খানিক সাজিয়ে আর খেতে দিয়ে এবার জানলায় এসে খানিক দাঁড়াতেই বাইরের রং খেলার হুল্লোড় কানে এল।
আজ একটা বেলা কাজের মেয়েটিও ছুটি নিয়েছে বলে রাতে আবার উপোস করে শুয়ে পড়বেন বলেই ভেবে রেখেছেন। যদিও দু’বেলার জন্য আর কয়েকটা বেশী রুটি আর সুজি বানিয়ে রেখে দিলেই হত; তাও আর ইচ্ছা করেনি!
রঞ্জাবতী তাঁর স্বামী আর পুত্রের চিরহাস্যমুখ নিন্দিত ছবির সামনে এসে ও দু’টোর কাঁচে আলতো করে আঁচল বোলালেন। একচিমটে ধূলো উঠে ফ্রেমটা ঝকঝকে লাগছে বটে ; তবে তার অনেক পরে নিজেই আরো বেশী অবাক হলেন।
দুপুরে স্নানের সময় কলঘরে কাপড় বদলে অন্য কাপড় পরেছিলেন ; কই তখন তো এটা দেখেন নি! তখন যে স্পষ্ট দেখেছিলেন ওই ছবিদুটোর ফ্রেম আর তার কাঁচের ওপরে জমা একটু কালচে ধুলো আঁচল দিয়ে মোছার সময় যেন একটু কোণটায় এসে লাগল!
কিন্তু এখন যেটা দেখছেন সেটা তো অবিশ্বাস্য!
ধবধবে সাদা আঁচলের একটা কোণা জুড়ে খানিকটা খানিকটা করে ছিটকে এসেছে লাল আর সবুজ আবিরের টাটকা দাগ।
তখুনি অবাক হয়ে ছুটে গিয়ে গোপালের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন বছর সত্তরের রঞ্জাবতী দেবী।
আজ যদিও গোপালের কপালে তো গেরুয়া আবীরের ফোঁটা, লাল বা সবুজ রঙের নয় তো!
……
জানালা দিয়ে একটা মাতাল করা নাম না জানা ফুলের গন্ধ হঠাৎ আসা একটা চৈতালী ঘূর্ণির হাওয়ার সাথে বারবার পাক খেয়ে যাচ্ছে। আর ভীষণরকমভাবে তা যেন অনেকবছর আগের এক দোলের দিনে রঞ্জাবতী দেবীর কপালে আর গালে লেগে থাকা লাল ও সবুজ আবীরের রঙটাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আচ্ছা! কেউ কি সেদিন জানত? আর কিছুক্ষণ পরেই ওঁর সমস্তটাই এরপর থেকে পুরো নিদাগ হয়ে মরা নদীটির বুকের শুকনো খাতের মত হয়ে বাদবাকি জীবনটা ধরে শুধু একইরকম হা-তপ্ত ও অবিচল হয়ে থেকে যেতে চলেছে !
—oooXXooo—