[সৌভাগ্যক্রমে, করোনা বিদায় নিয়ে পৃথিবী থেকে। কিন্তু তার জলছাপ রয়ে গেছে আমাদের মনে, সে সময়কার লেখালেখির মধ্যেও। সে সময়, একটি ফেসবুক গ্ৰুপের ইভেন্টে প্রকাশিত লেখাটি পুনঃ প্রকাশের জন্য দিলাম।]
শুভ দূর থেকে সায়ন্তনীকে দেখতে পেয়েছিল, মা মনসা স্টোর্সে, মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস I সায়ন্তনী ওদের কমপ্লেক্সে অন্য একটা টাওয়ারে থাকে I সায়ন্তনীকে দেখলেই শুভর মুখে একরাশ আবির, বুকের ভিতর ঢিবঢিব। অথচ সায়ন্তনী বিবাহিতা, বছর দশেকের একটি মেয়ে আছে, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার স্বামী জাহাজেই বাস করে সচরাচর I সায়ন্তনীর আসলে কোন কালে বিয়ে হয়ে গেছে , স্কটিশ চার্চে ফার্স্ট ইয়ার ইংলিশ অনার্স পড়তে পড়তেই। বাঙালী মেয়ের আদ্যিকালের যে কাহিনী এখন ফিকে হয়ে আসছে, সায়ন্তনীর ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা সত্যি হয়ে ধরা দিল -অর্থাৎ বাবা মা এত ভাল পাত্র হাত ছাড়া করতে চান নি , হলোই বা এগার বছরের বড়I সমরের বাবা কাস্টমসের উচ্চপদস্থ অফিসার, ওদের বিয়ের সময় সদ্য রিটায়ার করেছিলেন – স্বনামে বেনামে কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে কলকাতায় আর উপকন্ঠ্যে, একটি ছেলের নামে করে দিয়েছেন I সমরের মা তার এন জি ও আর কিটি পার্টি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন I বিয়ের পর প্রায় বছরখানেক সমর কলকাতায় ছিল, তখন উইকেন্ডে নিয়মিত শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া হত , কিন্তু বিয়ের তিন বছরের মাথায় গ্যাংটক ঘুরতে গিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় সমরের মা বাবা দুজনেই শেষ। একা ফ্ল্যাটে মেয়েকে নিয়ে থাকতে কষ্ট হলেও, ভয় করলেও, এই অভিজাত রেসিডেন্সি ছেড়ে পাইকপাড়ায় বাপের বাড়ির শরিকি পরিবেশে আর যেতে ইচ্ছে করে না সায়ন্তনীর I আর এখান থেকে মেয়ের স্কুলও খুব কাছে I শুভর যা পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, তাতে এই কমপ্লেক্সে ওর থাকার কথা নয় I একেবারেই বিষয়ী ছিলেন না বাবা , কিন্তু কোন সহকর্মীর বুদ্ধিতে সিঙ্গুরের কাছে একটা জমি কিনেছিলেন কোনকালে, টাটার গাড়ি কারখানা হবে হবে এই হুজুগে দাম হয়ে গেল আকাশছোয়া , সুযোগবুঝে চিরকালের ক্যালকেশিয়াম শুভ সেই জমি বিক্রি করে বাইপাসের ধারে ‘সম্পর্ক রেসিডেন্সি’ তে একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট বুক করে ছিল I সেটা ছিল চাকরি জীবনের গোড়ার কথা , প্রজেক্ট শেষ হতে বেশ ক’বছর লেগেছিল, তারপর মাকে নিয়ে এখানেই উঠেছিল সে I প্রাইভেট ব্যাংকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি হলেও আই এস আই থেকে স্টাটিস্টিক্সে স্নাতক মূলত মার্কেট এনালিসিস এবং ফোরকাস্টিং এর কাজ করে, অর্থাৎ ব্যাংকের অপারেশন্স সরাসরি নেই সে, সুতরাং শনিবারটা অফ ডে, মাঝে মাঝে ফ্লেক্সি টাইমের সুবিধাও পাওয়া যায় I বছর খানেক আগে এরকম এক পড়ন্ত বিকেলে সায়ন্তনীর সঙ্গে কথা হয় প্রথমবার I এর আগে কমপ্লেক্সের সরস্বতী পুজোর কমিটিতে দুজনেই ছিল বটে , তবে শুভ ছিল কালচারাল কমিটিতে আর সায়ন্তনী ভোগের দায়িত্বেI দু চারটা মামুলী কথা ছাড়া কথা এগোয়নি তখনI সেদিন স্পেনসারসে যথেষ্ট ভীড়, শুভর একটু তাড়াহুড়া ছিল, ভাবছিল কোন কিউ তে দাঁড়াবে I আসলে মায়ের জন্য মাকে ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা, এক শনিবার মিস করলে এক সপ্তাহের ধাক্কা I এদিক ওদিক তাকাতেই সায়ন্তনী হাত দিয়ে ওকে ডেকে বলল,” আমি এদিকে আছি!” শুভ সহসা এরকম ডাক পেয়ে অবাক হল, কিন্তু সায়ন্তনীর ঠোঁটে হালকা হাসি দেখে বুঝল,শুভর থতমত অবস্থা দেখে, লেডি উইথ দ্য ট্রলি এখন লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প হয়েছেনI কিছুটা অনৈতিক হলেও শুভ এগিয়ে গেল ,সায়ন্তনীর পাশে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন তারা একসঙ্গে এসেছে I তাছাড়া, অমন করে ডাকলে, এমন ডাকসাইটে সুন্দরীর ডাক উপেক্ষা করে কে? ভ্রূ পল্লবে এ যুবতী ডাক দিলে , চন্দনবনে কেন , কচুবন কী বিছুটিবনেও যাওয়া যায় I ফিরবার সময় শুভর গাড়ি করে দুজনে ফিরল I এমনিতে এই অভিজাত কমপ্লেক্সে ‘এবসেনটি ল্যান্ডলর্ড’ প্রচুর,আর একটু কসমোপলিটান ভাব ,সুতরাং কেউ কাউকে নিয়ে খুব মাথা ঘামায় না I তার উপর শীতের সন্ধ্যা , হাতে গোনা যে দু চারটি পি এন পি সি বাহিনী আছে , তাদের সান্ধ্যভ্রমন অনেকক্ষন সমাপ্ত , তাই তারা নির্ঝঞ্ঝাটে যে যার কোটরে ফিরল। সেদিন ওটুকু পথ গাড়িতে আসতে আসতে শুভ বুঝতে পেরেছে , সায়ন্তনীর এক মাত্র ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে মেয়ের পড়াশুনা I শুভ যেটুকু আন্দাজ করেছে , সেটা হল , সায়ন্তনী পড়াশুনায় একেবারেই সাদামাটা ছিল Iআরো যেটুকু আন্দাজ করতে পেরেছিল, ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেও স্কুলপাঠ্যর বাইরে ইংরেজি গল্প কবিতা কোনদিন পড়ে নি, যদিও স্পোকেন ইংলিশে সে চৌখস I অংকে যে তার গভীর ব্যাথা , সেটাও মালুম হয়েছিল সেদিন। এর পর ওদের দুজনের মাঝে সাঝে দেখা হতে লাগল কখনো স্পেনসার , কখনো কমপ্লেক্সের উল্টোদিকের মা মনসা স্টোর্সে , কখনো কমপ্লেক্সের লনে I শুভর কাছে সায়ন্তনীর কয়েকটি জিনিস অন্যরকম ঠেকে I যে কোন বাঙালী মায়ের মত সন্তানের পড়াশুনা নিয়ে আদিখ্যেতা করলেও সায়ন্তনী কিন্তু মেয়েকে ট্যাঁকে নিয়ে ঘোরে না I বেশিরভাগ দিন সে একাই আসে , মেয়েকে সহায়িকার কাছে রেখে I আরেকটা জিনিস হল , তার বাইরের পোশাক শাড়ি , যা আজকের দিনে ওর বয়সী মহিলাদের দেখায় যায় না I কিন্তু ওর শাড়ি পরার ধরণে একটা বুক কাঁপানো ঔদ্ধত্য আছে I আরো অবাক কান্ড, ক্যাম্পাসের দু’- চারটি প্রলুব্ধ দৃষ্টি বা ক্যাম্পাসের বাইরে টর্চ ফোকাস চোখগুলোকে কেমন মরালগ্রীবা উপেক্ষা ছুঁড়ে সে হেঁটে চলে যায় , অথচ শুভর মুখোমুখি হলেই কেমন অমায়িক , কিছুটা প্রগলভ I একদিন স্পেনসারসে দুজনে টুকিটাকি কেনাকাটা করার পর শুভ সাহস করে আইসক্রিমের প্রস্তাব দিল , সায়ন্তনী রাজিও হয়ে গেল একবারেই I উল্টোদিকের আইসক্রিম পার্লারে রঙ্গীন ছাতার নিচে গল্প করতে করতে শুভ আবিষ্কার করল , সমরকে নিয়ে একটা ভয় আছে মেয়েটির I অতটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি তাই জিজ্ঞাসা করতে পারেনি , ভয় কী সমরের কোনো বিবাহ বহির্ভুত প্রেম নিয়ে, নাকি জাহাজডুবির আশঙ্কা , না অন্য কোন ইনসিকুউরিটির ভয়!শুভ বুঝতে পারে না কেন, কিন্তু খুব ইচ্ছে হয় বলে সায়ন্তনীকে, ভয় কোর না, আমি আছি তো! এতদিন শুভ ওকে মিসেস দত্ত ডেকে এসেছে , আইসক্রিম খেতে খেতে সায়ন্তনী হেসে বললো , মিসেস দত্ত ডাকটা কেমন একটু ভারী ভারী লাগে না ? আপনি আমাকে সায়ন্তনী ডাকতে পারেন ,আর আমার ডাক নাম টুইঙ্কেল Iশুভ মনে করল , লিটল স্টার অব্দি পৌঁছে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি হবে , সায়ন্তনীই ঠিক আছে I আর মনে মনে একটা নাম ঠিক করে নিল , তন্বী ! এরপর এক পা দু পা করে শুভঙ্করের সিঁড়ি ভাঙা শুরু হল I আপনি থেকে তুমি , হোয়াটসআপ নাম্বার বিনিময় , সবুজআলোর হাতছানি I সায়ন্তনীর কথা সাধারণত শুরু হত এভাবে , ‘আমাকে তো তোমার মনেই পড়ে না !” এটিকে একটি স্বাভাবিক মেয়েলি ন্যাকামি জেনেও তার একটি কথা, একটু হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকা , একটু রিংটোন বেজে ওঠার জন্য শুভ ছটফট করত I দিন দিন শুভর এই অস্থিরতা মায়ের চোখ এড়ায় না Iসারাদিন অফিসে আগের মতই কাটতো শুভর, কিন্তু বাড়ি এলেই স্মার্টফোন নিয়ে সে বসে যেত , মাঝে মাঝে পায়চারী করত অস্থিরভাবে I পরিণতিহীন এই গড়তে চাওয়া সম্পর্ক একদিকে চিন্তিত করত তাকে, অন্যদিকে সায়ন্তনীর একটু পরশখানির জন্য তার মন উতলা হত খুব I নিজের মনেই গুন্ গুন্ করত সে, একবারই এসেছিল নীরবে .. অহোরাত্র বালগোপালে ব্যস্ত শুভর মা , মিসেস সবিতা বসু সায়ন্তনীর ব্যাপারটা ঘুনাক্ষরেও জানতেন না , কিন্তু ওঁর মনে হল , একটা জীবনসঙ্গিনী পেলে শুভর এই অস্থিরতা কমবে I এক আধ বার উনি বিয়ের কথা পেড়েছেন , কিন্তু শুভ আমল দেয় নি মোটে I অস্থিরতা বাড়লে কোনো কোন দিন ঘর অন্ধকার করে জর্জ বিশ্বাসের কণ্ঠে ডুবে যেত সে , ” প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে , অথবা ‘ন্যায় অন্যায় জানি নে ‘ …. গানের সুরের সেই অবগাহনকালে, স্মার্টফোনের ছোট্ট একটা মেসেজ শুভর মুখে হাসি ফিরিয়ে আনত, দীপ্তি এনে দিত একরকমI তবে রণে বনে জঙ্গলের মত, শপিং মলই হোক, লনেই হোক, বা ভার্চুয়াল জগতেই হোক, সায়ন্তনীর কথাবার্তায় মৌলির পড়াশুনা আসবেইI কোন ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ, কোন লেখার মালমশলা, অংকের শর্টকাট অনেক কিছুই শুভর দায়িত্বে চলে এলI একদিন লনে মর্নিং ওয়াক করতে করতে বলল,’জান তো আমি একটা সিক্রেট জেনে গেছি!’ শুভ একটু অবাক হল, কার সিক্রেট, কিসের সিক্রেট! গড়গড় করে সায়ন্তনী বটে লাগল, মৌলির ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল পারমিতা অমুক অমুক বই ফলো করেI তারপর শুভর গায়ে আলতো টোকা মেরে বলল, “‘অ্যাই, তোমার অফিস তো কলেজ স্ট্রিটের কাছে, আমাকে বই ক’টা এনে দাও না!” সায়ন্তনীকে চাক্ষুষ দেখামাত্র এখনো বুকের ভিতর ঢিব ঢিব করলেও কথাবার্তায় অনেক সহজ হয়ে গেছে শুভI বলল, -হ্যাঁ ম্যাডাম, তা আর পারব না কেন! জান , তোমার একটা স্পেশাল নাম দিয়েছি আমি ? আবার সেই ভ্রু পল্লবে ঢেউ খেলাল সায়ন্তনী , -স্পেশাল নাম – কি সেটা? এক নিঃশ্বাসে শুভ বলে ওঠে – তন্বী ! – বা: কি সুন্দর নাম ! কিন্তু আগের মতন তন্বী আর থাকতে পারছি কোথায় ! আই হ্যাভ গেণ্ড ১.২ কেজি ওভার দ্য পাস্ট কাপল অব মান্থস! আর বোঝ কান্ড, আমার না, ওই অনলাইনে অর্ডার করাটা ঠিক আসে না – এখানকার স্পেন্সারেও পাচ্ছি না, আমার জন্য এক বটল আপেল সিডার আর দু চার প্যাকেট ফ্ল্যাক্সসীড অর্ডার করে দেবে অনলাইন? এই নামগুলি শুভ এই প্রথম শুনল, বস্তুত , এগুলো খায় না মাথায় দে সে জানে না, তবু বলল, নামগুলো আর কোয়ান্টিটি আমাকে হোয়াটস্যাপ করে দেবে, আমি আনিয়ে দেব! এরপর দুচার দিনের মধ্যেই মৌলির বই ও সায়ন্তনীর অর্ডারি মাল শুভর কাছে এসে গেল I শুভ জিনিসগুলোর ছবি তুলে, টুং করে মেসেজ দিয়ে দিল, থিংস আর এট ইয়োর ডোরস্টেপ !জবাবে সায়ন্তনী দুটো স্মাইলি পাঠালো , সঙ্গে , দুর্জন বানানে হ্রস -উ না দীর্ঘ উ জিজ্ঞাসা করে নিল! শুভ ভাবছিল , সায়ন্তনী হয়ত তাকে চায়ের জন্য ডাকবে , বা নিজেই চলে আসবে টুক করে I তাই যখন কলিং বেলের টুং করে আওয়াজ হল, একটা ভদ্রস্থ জামা গলিয়ে দৌড়ে গেল দরজা খুলতে I দেখে, মালতিমাসী , অর্থাৎ সায়ন্তনীর সহায়িকা দাঁড়িয়ে I ভদ্রমহিলা বললেন, দিদিমনির কী জিনিস আছে বলল !আর জিনিসগুলোর দাম বলে দিতে বলল , উনি তোমাকে দিয়ে দেবে ! মুখে কিছু না বলে হতাশ শুভ তার হাতে ব্যাগটি ধরিয়ে দিল I এরপর রাগ করে সায়ন্তনীর সঙ্গে কোন যোগাযোগই করে নি শুভ Iচার পাঁচ দিন বাদে , এক ক্লান্ত দিনের শেষে , টুং করে তন্বীর মেসেজ ,বাবুর রাগ হয়েছে বুঝি ? শুভ পাল্টা জবাব দিলো- রাগ !সে কেন?আমি রাগ করবার কে ! এবার ফোন করে সায়ন্তনী খিলখিলিয়ে হেসে দিল , “জানো , সামনের ইয়ারে মেয়ের আলজেব্রা আছে I ওকে হয়ত টিউটরের কাছে দিতে হবে , কিন্তু প্রথমত, মেয়ে টিউটর খুঁজে দিতে হবে, তারপর আজকালকাল টিউটরগুলো মহা ফাঁকিবাজ I সে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা আমি কী করে বুঝবো , আমি তো সব ভুলে মেরে দিয়েছি ? শুভ বললো , তা ম্যাডাম কী করতে হবে ? শোনো না , আমাকে একটু আলজেব্রা ধরিয়ে দেবে ? শনিবার তো ২৪ তারিখ – , এই ঘন্টাখানেক সময় দিলেই হবেI আর তোমার হিসেব দাও নি, তুমি টাকা পাবে তো আমার কাছে! – ঠিক আছে, আলজেব্রা পড়াব ,তারপর একসঙ্গে বাইবেল পড়ব, তারপর ফিরে যাব , তাই তো ? – একদম, তোমার আবার কী ধান্দা আছে শুনি ? -কিচ্ছু না , রাখি এবার , আমি এসে যাব! সেদিন শুভ রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। সন্ধ্যে নাগাদ সে গেছে তন্বীর ফ্ল্যাটে , ফ্লাট নো ৬এ , টাওয়ার সি I টুংটাং বেল বাজতেই সাধারণত মৌলি ছুটে আসে, সেদিন এল না , দরজা খুলে দিল সায়ন্তনী I শুভ জিজ্ঞাসা করল, মৌলি কোথায় ? তার স্বভাবসিদ্ধ রহস্যময় হাসি হেসে বলল , ” তোমার ছাত্রী তো আমি ! মৌলি কে দিয়ে কি করবে ? ও মামাবাড়ি গেছে , আদর খেতে , শুভর হঠাৎ কেমন একটা সাহস বেড়ে গেল , বলে ফেলল , আদর বুঝি শুধু মৌলি খায় ? মনে মনে ভাবল, আজ সায়ন্তনীর থেকে সে জেনেই নেব, কিসের ভয় তার, কিসের নিরাপত্তাহীনতা? তারপর স্বপ্নটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল – দেখল সায়ন্তনী আর শুভ একটা ঝর্ণার ধরে বসে আছে – একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্যদিকে উৎরাই Iসায়ন্তনী আরেকটু পরে লিজা রের স্টাইলে ঝর্ণার সামনে নাচ শুরু করল , আর হাতের মোবাইলটা দিয়ে শুভ ছবি তুলতে লাগল I ছবির এঙ্গেলটা আরেকটু ভাল করার জন্য শুভ পিছোতে লাগল -পিছোতে লাগল , তারপর হঠাৎ পা পিছলে পরে গড়াতে লাগল মৃত্যুমুখে খাদের দিকে I নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল তার , ঘাম হতে লাগল , সেই সময় ঘুমটা ভেঙেও গেলI খাটের কাছে ট্রাইপডে রাখা জলের বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল খেল শুভ খানিকটা I তারপর কী মনে করে, শিয়রে রাখা মোবাইলটা অন করল সে I সায়ন্তনীর নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলছে না , হোয়াটস আপে , তন্বী বলে সেভ করা নামে দেখল , লেখা আছে লাস্ট সীন ১১ -৩০ পি এম I এরকম আজগুবি স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল শুভরI তার দু একদিন থেকেই খবর কাগজ আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়ছিল এক রোগের খবরI যেদিন সায়ন্তনীর সঙ্গে ফোনে কথা হল, তার পরদিন থেকে কলকাতা শহরে ও সারা দেশে চালু হয়ে গেল জনতা কার্ফু , দুদিন বাদে শুরু হল লকডাউন I আজন্ম দেখে ওঠা শহরটা বদলে যেতে দেখল শুভ Iশহরটা যেন হয়ে উঠল রূপকথার সেই নগরী , দুষ্ট জাদুকরের কারসাজিতে যে ঘুমিয়ে পড়েছে হঠাৎ I লকডাউন হওয়ার দিন রাত্রে শুভর প্রথম মনে পড়ল সায়ন্তনীকে , তার কিছুর দরকার আছে কিনা , আর সমর কোথায় আছে I কাঁপা কাঁপা গলায় সায়ন্তনী জানাল, সমর অস্ট্রেলিয়াতে নিরাপদ আছে ,আর ওর জ্যাঠতুতো ভাই এসে বেশ কিছুদিনের রেশন দিয়ে গেছে I লকডাউন শুরু হওয়ার পর সবাই ঘরবন্দী I শুভর অফিস থেকে ওয়ার্ক টু হোম চালু হয়ে গেল , সারাক্ষন ল্যাপটপের সামনে বসে থাকা এ এক বিরক্তির Iঅফিসেও কখনো এ কিউবিকল সে কিউবিকল করে খানিক সময় কাটে , ছোট দু একটি বিজনেস মিটিং বা ব্রিফিং সেশনে ডাকেন বসেরা , এতটা বড় হতে হয় না I সন্ধ্যার দিকে অভ্যেস মত শুভ ফেসবুক খুললো , দেখল সায়ন্তনী অন নেই , হোয়াটস আপেও কোন খোঁজ নেই তার ,এমনকী সাত সকালে যে গুড মর্নিং মেসেজ পাঠিয়েছিল শুভ, সেটাও দেখেনি সে I কেমন একটু লাগল শুভর I ফোন লাগাল সায়ন্তনীকে I কেমন নিস্পৃহ গলায় সে জবাব দিল , “এখন স্কুল বন্ধ তো মৌলির, আমি আর ও কানামাছি খেলছি ঘরের মধ্যে I তুমি ভাল তো ?” শুভর মনে হল , সায়ন্তনীর জবাবটা যেন দূর , কত দূর থেকে ভেসে আসছে I ড্রয়িং রুমে টিভিতে তখন আলোচনা চলছে , সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং এর উপরে I তার দিন তিনেক পরে , মা মনসা স্টোরের সামনে দাগ কাটা বৃত্ত গুলোর একটিতে দাঁড়িয়ে শুভ লক্ষ্য করল সায়ন্তনীকে , মুখে মাস্ক , চোখে সানগ্লাস I শুভর মনে হতে লাগল , এই নতুন পৃথিবীতে , সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং প্রাকটিস করতে করতে মানুষের আবেগ , ভাললাগা আর ভালোবাসার ছোঁয়াগুলো এক একটি অনতিক্রম্য বৃত্তে আটকে পড়ে যাবে I কিন্তু তার পরেই দেখল, পিছনে তাকিয়ে সায়ন্তনী তাকে দেখতে পেয়েছে, একটা ছোট হাত ঘুরিয়ে হাই করছে সে I শুভর ভাবতে ইচ্ছে হল , সানগ্লাসের নিচে তার তন্বীর চোখ দুটো আর মুখোশের নিচে তার ঠোঁট দুটো হাসছে , ভ্রু পল্লবে ডাক দিয়ে সেই প্রথম দিনের মতই বলছে , আমি এখানেই আছি !