সুভাষনগর, দমদমের একটা বেশ পরিচিত এলাকা। এখানে প্রচুর প্রগতিশীল মানুষের বসবাস, যারা সমাজের উন্নতির জন্য নানা ধরনের কাজ করে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসে এই এলাকায়, কেউ কাজের খোঁজে, কেউ জীবনের লক্ষ্যপূরণের জন্য। এর মধ্যে একজন রুমঝুম সেন। পাড়ার মানুষ তাকে একজন সফল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জানে, একজন প্রতিষ্ঠিত নারী হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনের একটা জটিল দিক আছে, যা সাধারণ মানুষ জানে না। ভালোবাসা আর প্রেম— এই দুই শব্দ নিয়ে রুমঝুমের মনে সবসময় একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে।
রুমঝুম কলেজে পড়ার সময় থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতেন। তার সাথে অনেকেই প্রেম করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ তাকে ভালোবাসার সেই নিঃস্বার্থ স্পর্শটা দিতে পারেনি। প্রেম তাদের কাছে একটা আকর্ষণ, আর রুমঝুমের জীবনের অংশ হওয়ার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু ভালোবাসা? সেটা ছিল না। পরীক্ষার সময় সেটা সবচেয়ে বেশি বোঝা যেত। সবাই চেয়েছিল রুমঝুম কে টপকে যেতে, তার থেকে সুবিধা নিতে। নিজের স্বার্থের জন্য তারা প্রেমের মুখোশ পরেছিল, কিন্তু ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ তাদের মধ্যে ছিল না। পরীক্ষার সময়টা তাদের স্বরূপটা চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলত। যখন নিজেরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ত, তখন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রুমঝুমের সাহায্য চাইত, কিন্তু ভালোবাসা কোথায়? সেটা ছিল না। তাদের প্রেম যেন ছিল শুধুই স্বার্থের প্রতিফলন, ভালোবাসার স্পর্শ সেখানে ছিল না। এইসব অভিজ্ঞতাই রুমঝুম কে শিখিয়েছিল প্রেম আর ভালোবাসার পার্থক্য। ভালোবাসা সবসময়ই নিঃস্বার্থ হয়, সেখানে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকে না। অথচ প্রেম… প্রেমে যেন সবসময় নিজেকে প্রমাণ করার একটা প্রবণতা কাজ করে। রুমঝুম এই উপলব্ধি নিয়ে নিজের জীবনের অনেক কিছু বুঝতে শিখেছিলেন, আর সেই থেকেই তার জীবনের দর্শন হয়ে উঠেছিল— সম্পর্কের ভিত্তি ভালোবাসায় থাকতে হবে, প্রেমে নয়। রুমঝুম প্রায়ই ভাবত, প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই, কিন্তু এর মাঝে আরও একটা অনুভূতি রয়েছে, যেটা অনেক সময় চোখে পড়ে না— সেটা হলো ভালোলাগা। ভালোলাগা একটা মুহূর্তের আবেগ, যা হয়তো কাউকে প্রথম দেখেই হতে পারে, কিন্তু তা কখনো ভালোবাসায় পরিণত হয় না। কলেজে পড়ার সময়ও রুমঝুম এই ভালোলাগার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। অনেক অচেনা মুখ, যাদের সাথে হয়তো একদম শুরুতেই একটা ভালোলাগা কাজ করেছিল। তাদের চোখে, কথায় বা ব্যবহারে একধরনের আকর্ষণ ছিল, যা রুমঝুমের মনকে টেনেছিল। কিন্তু সেই ভালোলাগা বেশিদিন স্থায়ী হতো না। ভালোলাগা কখনোই গভীর ভালোবাসায় রূপ নেয়নি, বরং তা ছিল অনেকটা হালকা এবং ক্ষণস্থায়ী। “ভালোলাগা হলো একটা তাৎক্ষণিক অনুভূতি,” রুমঝুম মনে মনে বলত। “কাউকে দেখলেই ভালো লাগতে পারে, হয়তো তার ব্যক্তিত্বের জন্য, বা তার ব্যবহার, বা এক মুহূর্তের আকর্ষণের জন্য। কিন্তু সেটাকে ভালোবাসা বলা ঠিক হবে না।” “তুমি কি জানো, ভালোবাসা আর প্রেমের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?” রুমঝুম মাঝে মাঝেই এই প্রশ্নটা করেন নিজের কাছে। তার উত্তর হয়ত এখনও খুঁজছে।
“ভালোবাসা এমন একটি অনুভূতি, যা মানুষকে একে অপরের সাথে বেঁধে রাখে, সম্পর্ককে গভীর করে তোলে। কিন্তু প্রেম? সেটা যেন একটু আলাদা, যেখানে আকর্ষণ আর আবেগ মিশে থাকে, তবে তা সবসময় সম্পর্ককে স্থায়ী করে না।” সেটা ব্যক্তিগত, একটু কাছাকাছি, শরীরী স্পর্শে মিশে থাকে। ভালোবাসা সবখানে থাকতে পারে, যে কেউ যেকোনো মানুষকে ভালোবাসতে পারে। কিন্তু প্রেম? সেটা সবাইয়ের সাথে হয় না, তার একটা ভিন্ন দিক আছে।”
রুমঝুমের চিন্তাভাবনা জড়িয়ে আছে তার জীবনের বিভিন্ন সম্পর্কের সাথে। ছোটবেলায় বাবা-মা তাকে শিখিয়েছিলেন, “ভালোবাসা কখনো একতরফা হয় না, এটা মনের এক গভীর সম্পর্ক।” ভাইয়ের সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্কটা ঠিক সেরকমই। কিন্তু প্রেম? সে তো আর ভাইয়ের সাথে হয় না।
রুমঝুমের স্বামী, অর্ণব, তাকে নিয়ে খুব গর্বিত। দু’জনে মিলে সংসারটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন, যে প্রশ্নটা বারবার উঠে আসে তার জীবনে— প্রেম কি শুধু সম্পর্কের জন্য? নাকি তা ভালোবাসার থেকেও গভীর কিছু?
রুমঝুম বুঝেছিলেন, ভালোবাসা সম্পর্ক তৈরি করে, সেটা বাবা-মা, ভাই-বোন, বা বন্ধুর সাথে হতে পারে। কিন্তু প্রেম? প্রেম যেন আরেকটা ধাপে এগিয়ে।
“প্রেমের মধ্যে একধরনের শারীরিক আকর্ষণ প্রধান থাকে,”। “কিন্তু ভালোবাসা শুধু মনের সম্পর্ক, এতে কোনো শর্ত দেওয়া নেই।”
একদিন, পাড়ার একজন মেয়ে, রিয়া, তার কাছে এসে বলল, “দিদি, প্রেম কি সত্যি পবিত্র হয়?”
রুমঝুম একটু হেসে বললেন, “প্রেমকে আমরা অনেক রকম ভাবে দেখি। কিন্তু পবিত্রতা নির্ভর করে আমরা কিভাবে প্রেমটা করছি বা দেখছি।”
“তাহলে ভালোবাসা আর প্রেমের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?” রিয়া অবাক হয়ে জানতে চাইল।
রুমঝুম একটু থেমে, চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভালোবাসা হলো নিঃস্বার্থ। সেটা বাবা-মা, বন্ধু, কিংবা এমনকি কোনো অচেনা মানুষের সাথেও হতে পারে। ভালোবাসার মধ্যে কোনো শর্ত থাকে না। কিন্তু প্রেম? প্রেমে শরীরী আকর্ষণ মিশে থাকে, আর সেটা সবসময় পবিত্র হবে এমনটা নয়।”
প্রেমের পথ অনেক সময় কণ্টকাকীর্ণ হয়, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হলেও, প্রেমে যেন সবসময়ই একটা অদৃশ্য ঝুঁকি পূর্ণ সম্পর্ক।
রুমঝুম আরও বললেন, “প্রেমে আকর্ষণ যেমন থাকে, তেমনই থাকে সন্দেহ, অভিমান, আর কখনও কখনও হতাশা। প্রেম সুন্দর হতে পারে, কিন্তু কখনও কখনও সেটা ভেঙে যায়, আর সেই ভাঙনটা মনের গভীরে গভীর ক্ষত রেখে যায়। আর ভালোবাসা? সেটা তো ভাঙে না, বরং সময়ের সাথে সাথে আরও মজবুত হয়।”
তার কথা যেন একটা নিঃশব্দ প্রশ্নের মতো ছড়িয়ে পড়ে মনে। প্রেমের পথ যে ঝুঁকিপূর্ণ, তা সবাই জানে, কিন্তু কেউ সেটা মুখ ফুটে বলতে চায় না। রুমঝুম বলেছিলেন, “প্রেমে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা নিজেদের উপর ভরসা রাখতে পারি না। সম্পর্কের ভিত্তি যদি শুধুই প্রেম হয়, তাহলে তা সহজে টিকে থাকে না। আর ভালোবাসা? ভালোবাসা সবসময় সুরক্ষিত।”
রুমঝুম একটু থেমে আরও যোগ করল, “ভালোবাসার মধ্যে যেমন স্থিরতা আছে, তেমনই সেটা আত্মিক। আমাদের চারপাশে প্রেমে যেমন ভাঙন ঘটে, তেমন ভালোবাসায় সেটা প্রায় নেই বললেই চলে। ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী, সেটা ভাঙতে পারে না।”
রুমঝুমের এই কথাগুলো যেন একধরনের গভীর বোধ এনে দিল রিয়ার মধ্যে। প্রেম আর ভালোবাসার এই পার্থক্য সে আগে ভাবেনি। কিন্তু রুমঝুমের ব্যাখ্যায় সেটা একেবারে চোখের সামনে স্পষ্ট ।
তার মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগত, “ভালোবাসা কি সবসময় শ্রেষ্ঠ?” ও বুঝতে পেরেছিল, সমাজ ভালোবাসাকে একধরনের পবিত্রতা দিয়ে মাপে। কিন্তু প্রেম? প্রেম যেন একটু ভিন্ন, অনেকটাই দূরে থাকে, আর কখনো কখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
অর্ণব মাঝে মাঝে বলতেন, “তুমি এত ভাবো কেন? প্রেম আর ভালোবাসা দুটোই দরকার জীবনে।” প্রেম যখন ভালোবাসা পরিণত হয় তখনই জীবন সার্থক হয়ে ওঠে। আসলে “প্রেম নয় ভালোবাসাই জীবনে বড়।”
রুমঝুম শেষ পর্যন্ত বুঝেছিল, সম্পর্কের গভীরতা ভালোবাসায় লুকিয়ে থাকে। প্রেম অস্থায়ী হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা চিরন্তন। তিনি তার জীবনে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছিলেন সবসময়।
কর্ম ক্ষেত্রে সবাই তাকে সম্মান করতো, কারণ সে শুধু ভালোবাসার নয়, সম্পর্কের মূল মন্ত্র জানত। সে একজন সমাজের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিল, যিনি কিনা ভারসাম্য, সম্পর্ক এবং এনার্জির মেলবন্ধন ঘটাতে জানতেন। তার চিন্তাভাবনা অনেকের জীবনের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিল এই সমাজে।