আনন্দে বুকের ভেতরটা কেমন ভেসে গেল ওর। এ যে ওর স্বপ্নের ও অতীত ! যেদিন প্রথম শিখাকে ডেকে দেখিয়েছিল ধনাই সেই দিন থেকেই তো রাতে ওই মুখ বুকে রেখে ঘুমোতে যায় ও। মনে মনে স্বপ্ন সাজায়। লাল নীল সেই সব স্বপ্নের ঘরে কত আশা, আনন্দ দুঃখ বেদনা খেলা করে শিখা কি তা কোনদিন জানবে ? কিন্তু কত টা ভালোবাসে ? শিখা কি ওকে বিয়ে করবে? ওর মুখে সেই অনুচ্চারিত প্রশ্ন সম্ভবত ভেসে উঠেছিল। মালতী উঠে গিয়ে শিখার মুখ ফিরিয়ে ধরল ওর দিকে। চোখ ভরা জল আর থরথর কাঁপা ঠোঁট নিয়ে গভীর প্রত্যাশায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে শিখা। অল্প ঘাড় নড়ল ওর। আর সেদিকে তাকিয়ে নিজের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল সুখেন। কিন্তু — হঠাৎ খুশির সঙ্গে একরাশ ভয় এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। ধনাই যদি জানতে পারে ? আর ও এখানে কাজ করতে পারবে না। কসবার কাজ টা এখনো ফাইনাল হয় নি। এটা ছেড়ে দিলে ও কী করবে ? কিন্তু শিখাকে ও তো যেভাবে ভয় দেখাচ্ছে ! যদি সত্যি ওসব কিছু ছুঁড়ে টুড়ে মারে তাহলে? বিদ্যুচ্চমকের মত পিসির মুখটা ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। হ্যাঁ। এটাই তো উপায়। শিখা যদি সাহস করে ওর সঙ্গে ওর গ্রামে যেতে পারে তাহলে আর কোন ভয় নেই। এমনিতেই ও অনেক দিন যায় না। বারবার পিসি চিঠি পাঠাচ্ছে একে ওকে দিয়ে। একবার দেশে যেতে বলছে। এই সুযোগ। কারখানা থেকে ছুটি নিয়ে চলে যাবে। অবশ্য তার আগে সব কথা নিমাাইদাকে বলতে হবে। আর কসবার কাজটা হল কিনা সেটাও জানায় যেন বলে যেতে হবে। কিন্তু শিখা কি যাবে ? ওর বাড়ি থেকে যেতে দেবে ? ওরা কতটুকু চেনে সুখেনকে ? ছাড়বে ওর সঙ্গে ? যাবে শিখা ? ওর দেশের বাড়ি? “ যাব।” এই প্রথম স্পষ্ট করে কথা বলল শিখা। “ কিন্তু তোমার বাড়িতে –” “ আপত্তি করবে। বিয়ের আগে কারুর সঙ্গে এভাবে চলে গেলে বদনামও হবে। তবু যাব আমি। তোমার ধর্মের ওপর বিশ্বাস রেখে যাব। তুমি আমায় ঠকাবে না এই ভরসা করে যাব।” বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছিল সুখেনের। আর তারপর জেনেছিল শিখার পরিবারের কথা আর সঙ্গে অন্য বিপদের কথা। শুধু ধনাই যে ওর পিছনে পড়ে আছে তা নয়। ধনাইকে ও থোড়াই কেয়ার করে। আর যারা মুখে অত ফটফট করে আসলে তাদের ক্ষমতা নেই। ওর বিপদ অন্য জায়গায়। আর সেটা ডেকে এনেছে ওর বাবা । একটা অসভ্য পাঁড় মাতাল লোক। প্রথম পক্ষের বউ মানে শিখার মা মরতে তর সয়নি। ক’দিনের মধ্যেই মেয়ের বয়েসী আর একজনকে বিয়ে করে ঘরে এনে তুলেছে। আগের পক্ষে শিখা ছাড়া আরও দুটো ছেলে। এ পক্ষে আবার একটি মেয়ে, একটা ছেলে। খাবার লোক ঘরে এক গাদা। এদিকে বাপটা যা রোজগার করে সব মদের ঠেকে দিয়ে আসে। এ পক্ষের বউটা কয়েক বাড়িতে বাসন মাজে ,কাপড় কাচে , ঘর মোছে। শিখা যা রোজগার করে তাই দিয়েই কোনরকমে চলে। এর মধ্যেই নেশা করে এসে বাচ্চাদের ঠেঙ্গায়। বউয়ের গায়ে হাত তোলে। মানে যাচ্ছেতাই একেবারে। অবশ্য বস্তির সব ঘরেই এরকম। ওদেরটাই নতুন কিছু না। তবু তারই মধ্যে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন কোথাও কিছু নেই বাপটা এক গাদা বাজার করে , শাড়ি জামা কাপড় কিনে এনে হাজির। মাছ, মাংস । দই মিষ্টি ! যাদের ঘরে তেল নুন ঠিক মত জোগাড় নেই তাদের হেঁসেলে এই এত কিছু ! এদের তো দেখে চোখ কপালে ! যে লোক এক পয়সা সংসারে দেয় না তার এরকম মতি গতি কেন ? শুঁড়ির দোকানে না গিয়ে সে গেছে কিনা বাজারে ? আর এই এত কিছু ? পেল কোথায় এত টাকা ? চুরি টুরি করেছে নাকি ? নিশ্চয়ই তাই। কারখানার টাকা হ’লে তো জেলে পুরে দেবে। সন্দেহ হচ্ছিল। বিশেষ করে শিখার মন কু ডাকছিল। তাই সবাই আহ্লাদ করে খেলে, মাখলেও ও চুপচাপ ছিল।শুধু নজরে রাখছিল বাপটাকে। ঠিক কোথাও কোন খাপলা মেরে এসেছে। বা বদ মতলব কিছু আছে। নইলে ওর দিকে ওরকম আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে কেন? একটা অদ্ভুত ভয় বাসা বাঁধছিল ওর মধ্যে। আর হলও তাই। দু দিন আর অপেক্ষা করতে হল না। আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল।