রিতেশ একবার রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ দেখতে যায় l ঐ স্থানের ভৌতিক রহস্যটা শোনার পর থেকে ওর ভানগড় দেখার আগ্রহ প্রবল ভাবে বেড়ে যায় l কলকাতার কলকাতা স্টেশন থেকে অনন্যা এক্সপ্রেসে (১২৩১৫ ) চড়ে l দুপুর একটা বেজে দশ মিনিটে তিন নম্বর ফ্ল্যাট ফর্ম থেকে অনন্যা ছেড়ে যায় ভানগড়ের উদ্দেশ্যে l পরের দিন বিকাল পাঁচটায় রাজস্থান পৌঁছাবে l ট্রেনের মধ্যে আলাপ হয় বছর পঁচিশের একটি মেয়ের সঙ্গে l মেয়েটি ওর থেকে পাঁচ বছরের ছোট l মেয়েটি …. আমি প্রেয়া, প্রেয়া বর l আপনি ? রিতেশ … আমি রিতেশ পাহাড়ী l প্রেয়া…. আপনি রাজস্থানের কোথায় যাচ্ছেন ? রিতেশ …. আমি ভানগড় দুর্গের ভৌতিক রহস্য দেখতে যাচ্ছি l আপনি ? প্রেয়া….আমার বাবা প্রীয়াংশু বর ভানগড় দুর্গ এলাকায় চাকরি করেন l আমি প্রায় প্রতি বছর এই সময়ে বাবার কাছে যাই এক মাসের জন্য l রিতেশ …. তাহলে তো আপনি ভানগড় দুর্গের সব রহস্যই জানেন l প্রেয়া… হ্যাঁ, মোটামুটি জানি l রিতেশ …. তবে বলুন শুনতে শুনতে যাই l প্রেয়া….শুনবেন ? ভয় পাবেন না তো ? রিতেশ… না,পাবো না,এই বিষয়ে আপনি নিশ্চন্ত থাকতে পারেন l প্রেয়া…রাজস্থানের আলোয়াড় জেলায় আরাবল্লি পর্বতের গায়ে সবুজ প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা দুর্গটি l এই দুর্গটিই পাহাড়ের গায়ের শেষ ইমারত এর পর পাহাড়ের ওপারে রয়েছে গভীর ঘন সবুজ অরণ্য l তার মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার l দিনের বেলা ঢুকতে কেউ সাহস পায় না l কথিত আছে ওখানে ভূত প্রেত খেলা করে l দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন অম্বরের রাজা ভগবন্ত দাস সিং তার ছোট পুত্র মাধ সিং এর জন্য l মাধ সিং ছিলেন সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মান সিং র ছোট ভাই l ভৌতিক রহস্যর জন্য এই স্থানে সাড়া বছরই পর্যটকরা ভিড় করেন l শোনা যায় রাতে এখানে অশরীরিদের আড্ডা বসে l তাই সূর্যাস্তের পরে দুর্গে কেউ থাকতে পারে না আবার সূর্যোদয়ের আগে কেউ প্রবেশ করতে পারে না l সরকারি নির্দেশিকা জারি করা আছে l দুর্গে ঢুকলে গা ছমছম করে l দুর্গের ভিতর যুগ যুগ ধরে ধ্বনিত হচ্ছে আদি ভৌতিক নানা কাহিনী l কেউ কেউ শুনতে পান কোন অল্প বয়সি মেয়ের কান্না আবার কেউ কেউ শুনতে পান চুরি ভাঙার শব্দ l মাঝে মাঝে শোনা যায় অদ্ভুত অদ্ভুত গান l গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে এই সব ভাবলে l আবার সুগন্ধি ঘ্রানও কেউ কেউ পান l এরকম অনেক রহস্যে মোরা গল্প প্রচলিত আছে এই ভানগড় দুর্গকে ঘিরে l তবে সর্বাধিক জনশ্রুতি আছে দুটো বিষয়ে l একটা সাধু বালুনাথকে নিয়ে আর একটা রাজকন্যা রত্নাবতীকে নিয়ে l ভগবান সিং যখন দুর্গটি নির্মাণ করতে যান তখন সাধু বালুনাথ বাঁধা দিয়েছিলেন l পরে অবশ্য সাধু বালুনাথ তার বাঁধা তুলে নিয়েছিলেন l তিনি একটি কঠিন শর্ত দিয়েছিলেন ভগবান সিংকে যে এই দুর্গের ছায়া যেন কোন ভাবেই তার আশ্রমের উপর না পরে l ভগবান সিং এই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন l কিন্তু সেই শর্ত লঙ্গন হয়ে যায় l মাধ সিং এর পুত্র ছতো সিং এই দুর্গকে অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়ায় দুর্গের ছায়া গিয়ে পরে বালুনাথের আশ্রমের উপর l সাধু বালুনাথ তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন l তার অভিশাপে দুর্গ খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙে ধ্বংস হয়ে যায় l এতটা বলার পর ঘুম পেয়ে যায় l প্রেয়া ঘুমিয়ে পরে l রিতেশের ঘুম আসতে একটু দেরি হয় l কিছুক্ষণ চোখ বুঝে পড়ে থাকে l পুরো কামরা অন্ধকার হয়ে যায় l একটু পরে আশপাশ থেকে নাক ডাকার আওয়াজ আসতে থাকে l রিতেশ দেখে প্রেয়া ওর সিটে নেই l কোথা দিয়ে কিভাবে উধাও হয়ে কোথায় চলে গেলো ও কিছুই বুঝতে পারলো না l ট্রেনের গেট পুরোপুরি বন্ধ l এটা দেখে রিতেশ সাড়া রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি l সাড়া রাত প্রেয়া ওর সিটে ছিল না l ভোর হবার আগে আবার ওকে দেখা যায় চাদর মুড়ি দিয়ে সিটে ঘুমাতে l বিষয়টাকে রিতেশের অদ্ভুতুরে কান্ড বলে মনে হয় l পরের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুঁয়ে প্রেয়া বলে ….. হ্যাঁ রে রিতেশ চা খাবি না কফি ? রিতেশ…. চা l প্রেয়া দু কাপ চা কেনে l রিতেশ…. কাল রাতে তুই কোথায় চলে গিয়েছিলিস ? প্রেয়া…. না, কোথাও যাই নি তো l তোর দেখার ভুল হয়েছে l রিতেশ…. এর পরের কাহিনী বল l প্রেয়া…. শোন l আর একটা জনশ্রুতি হলো সুন্দরী রাজকন্যা রত্নাবতীর যখন আঠেরো বছর বয়স হয় তখন দেশ বিদেশ থেকে অনেক রাজ কুমাররা আসতে থাকেন রত্নাবতীকে বিবাহ করতে l অনেকেরই পছন্দ হয় রাজ কুমারীকে l তন্ত্র সাধক সিন্ধিয়াও রাজ কীমারীকে পছন্দ করতেন l সিন্ধিয়া জানতেন রত্নাবতী কিছুতেই তাকে পছন্দ করবেন না l তাই তিনি সুগন্ধি সেন্টের মধ্যে মন্ত্র দিয়ে রেখেছিলেন l যখই রাজ কুমারী সুগন্ধি নাকে শুকবেন তখনই সুগন্ধির সাথে ঐ মন্ত্র ঢুকে যাবে রাজ কুমারীর মাথায় l তাতে রাজ কুমারী এক সময়ে তান্ত্রিককে বিবাহ করতে রাজি হবেন l সেই সুগন্ধি কিনে এনে দু একবার ব্যবহার করেই রজ কুমারী তান্ত্রিকের চালাকি ধরে ফেলেন l তিনি বুঝতে পেরে ঐ সুগন্ধি আছাড় মেরে ফেলে দেন একটা পাথরের উপর l সেই পাথর গিয়ে পরে তান্ত্রিক সিন্ধিয়ার উপর l সেই আঘাতে সিন্ধিয়া মারা যান l তবে মারা যাবার আগে তান্ত্রিক অভিশাপ দিয়ে যান যে এই রাজ বাড়ীর কেউ বাঁচবে না l তার অল্প দিনের মধ্যেই ভানগড়ের সাথে আজম গড়ের যুদ্ধ বাঁধে l সেই যুদ্ধে রাজ কুমারী সহ ভানগড় দুর্গের সবাই মারা যান l ধুলিস্যৎ হয়ে যায় ভানগড় দুর্গ l রটে যায় যে তান্ত্রিক আর রত্নাবতীর অতৃপ্ত আত্মা দুর্গের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় l তারাই ভুত হয়ে মাঝে মাঝে দেখা দেয় l ভারত সরকার এবং আরকীয় লজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া অতিপ্রাকৃত ঘটনার জন্য নিরাপত্তার কারণে দুর্গে প্রবেশের কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করেন l সেই থেকে ভানগড় দুর্গ ভুতুড়ে টুরিস্ট স্পট হিসাবেই পরিচিত হয়ে যায় l এখানে রাতের বেলা শোনা যায় নুপুরের শব্দ আবার কান্নার আওয়াজও পরিবেশকে ভারী করে তোলে l শোনা যায় অনেকেই রাতের বেলা এখানে প্রবেশ করে আর ফিরে আসতে পারেনি l রিতেশ….খুব খিদে পেয়ে গেছে l চল কিছু খাই l প্রেয়া….. কোথায় আর যাবো l ব্যাগে যা আছে তাই খাই l ওদের কাছে বিস্কুট আর কেক ছিল l সেটা ভাগাভাগি করে দুজনে খেয়ে নেয় l নিরামিশ সবজি ভাত অর্ডার দেওয়া ছিল l একটু বাদে রেলের প্যান্টি কার থেকে খাবার দিয়ে যায় l ভাত খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের ট্রেন থেকে নামার সময় হয়ে যায় l ফ্ল্যাটফর্ম থেকে প্রেয়া রিতেশকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যায় ভানগড় দুর্গে l দুর্গের কাছে গিয়ে প্রেয়া রিতেশকে একটা লজ দেখিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় চলে যায় l চলে যাবার আগে একটা কফি শপে ঢুকে দুজনে কফি খায় l খেতে খেতে প্রেয়া রিতেশকে বলে….. তুই বিয়ে করেছিস ? রিতেশ….. না l তবে দেখাশোন চলছে l আর তুই করিস নি কেন ? প্রেয়া…. আমিও করবো l একটা কথা বলবো ? রিতেশ…. হ্যাঁ, বলনা l প্রেয়া…. আমাকে তোর পছন্দ হয় l রিতেশ…হ্যাঁ,হয় l প্রেয়া… আমিও তোকে পছন্দ করে ফেলিছি l তাহলে একটা কাজ করলে হয় না ? রিতেশ… কি কাজ ? প্রেয়া….আমরা কলকাতায় ফিরে বিয়ে করে নি l রিতেশ…..সে তো খুব ভালো প্রস্তাব, খুব ভালো হবে l আমি রাজি l তুই বাবার সঙ্গে কথা বল l আমিও বাড়ী ফিরে মাকে তোর কথা বলবো l প্রেয়া…. ও হ্যাঁ আর একটা কথা তুই কি করিস ? বাবাকে বলতে হবে তো তাই l রিতেশ…. আমি জিওলোজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চাকরি করি l গ্রুপ-B অফিসার l প্রেয়া… ওকে l এর আগে যাদবপুর বাঘাযতীনের একটা ছেলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল কিন্তু কোলকাতায় ফিরে ও আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নি l জানি না তুই কি করবি l জানিস তো আমার খুব ইচ্ছে হয় স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে গুছিয়ে সংসার করতে কিন্তু আমার সেই ইচ্ছে অতৃপ্তই থেকে যাবে কিনা বুঝতে পারছি না l রিতেশ… আমি তোকে ভুলতে পারবো না নারে l যোগাযোগ করবো l কফি খাওয়া শেষ হতেই নিমেষের মধ্যে প্রেয়া কোথায় উবে যায় l রিতেশের অদ্ভুত লাগে কিন্তু ওকে ভুলতে পারে না l ওকে অতি প্রাকৃতিক মনে হলেও রিতেশ ওর মায়ায় পরে গেছে l ওর ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে মন চাইছে না l রিতেশ ওখান থেকে বেড়িয়ে একটা লজ বুক করে ঢুকে যায় l ট্রেনে অনেক ধকল গেছে এবং সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় রিতেশ ঐ দিন রুমে শুয়ে রেস্ট নেয় l পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে একজন গাইডকে নিয়ে দুর্গের ভিতরটা ভালো করে ঘুরে দেখে l এখন প্রায় ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে l এটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এক দিন দুর্গটা কেমন কোলাহল পূর্ণ এবং ঝা চকচকে ছিল l তার পরের দিন দুর্গের বাইরের দিক গুলো ভালো করে দেখে নেয় l দিন তিনেকের মধ্যে সব দেখা হয়ে যায় l বাড়ী ফেরার আগের দিন রিতেশ প্রেয়ার দেওয়া ঠিকানায় যায় ওর সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু সেই ঠিকানায় কারোকে পায় না l আশেপাশের মানুষ জনকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানান বেশ কয়েক বছর আগে এখানে প্রীয়াংশু নামে এক বাঙালি ভদ্রলোক ভাড়া থেকে চাকরি করতেন l একবার উনি এবং ওনার মেয়ে দুর্গের মধ্যে ঘুরছিলেন তখন হঠাৎ করে বড়ো একটা পাথরের চাঁই উপর থেকে ভেঙে ওনাদে মাথায় পড়ে এবং দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে মারা যান l ডেড বডি নিমেষে ভ্যানিশ হয়ে যায় সবার সামনে l এলাকার লোকেরা বলেন ওনাদের অশরীরি আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে l রিতেশ শুনে তো থঃ হয়ে যায় l ভয়ে অচৈতণ্য হবার মতো অবস্থা রিতেশের l কোন রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে আসে l আর দেরি না করে বাড়ী ফেরার ট্রেন ধরে l ট্রানটা ছাড়ার একটু পরে প্রচন্ড জোরে কাঁপে ওঠে ট্রেনটা l মনে হচ্ছে বিরাট ভূমিকম্প হচ্ছে l হাওয়ায় সব উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে l মিনিট তিনেক বাদে ঝাঁকুনিটা বন্ধ হয় l ভয়ে রিতেশের আত্মারাম খাঁচা হয়ে যাবার উপক্রম হয় l কলকাতায় ফিরে রিতেশ বহু বার প্রেয়ার মোবাইলে কল করেছে কিন্তু প্রতি বারই নট রিচেবল রিমার্কস শুনিয়েছে l রিতেশ সাড়া জীবন প্রেয়াকে মনে রেখে বিয়ে করতে পারেনি l