আজ রান্না চাপাতে দেরী হল শেতলার। এক ঝুড়ি কাঠখড়ি কুড়িয়ে এনে ভাত বসালে। বড়ো তিজেল হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটছে ভাত। এর ফাঁকেই ছুটে চলল ঠাকুরঝি পুকুরে। এই পুকুরের একটা ইতিহাস আছে। সেই কবে কোন জমিদার গিন্নি তার ঠাকুরঝিকে এখানে ডুবিয়ে মেরেছিল।
দুদিন আগে তালপাতা ফেলে গিয়েছিল শেতলা। এখন ধীরে ধীরে নামল পুকুরে। পাতাগুলো তুলে দেখে সারা পাতা জুড়ে এই বড়ো বড়ো গুগলি। পাড়ে বসে গুগলীগুলো ছাড়িয়ে বালতি ভর্তি করল। এত গুগলী এই পুকুরটাতে। কিছুটা বিক্রি করবে ছাড়িয়ে। এইভাবেই তো একটা মাটির ভাঁড়ে পয়সা জমিয়েছে সে। ঘরে ফিরে ভাত নামাল শেতলা। কী সুন্দর একটা একটা ভাত। ঠিক টগরফুলের মতো। ওইজন্য তো সবাই টগরফুলকে ভাতফুল বলে। শেতলার বান্ধবীর নাম টগর। শ্মশান কালীর পুজোর থানে যে বড়ো ঝাপরিঝুপরি টগরফুলের গাছ ওখানেই নেত্যকালীর সাথে টগর পাতিয়েছে শেতলা। ওর বাবা শ্মশানের ডোম। যখন মরা আসে তখন নেত্যকালী মরদেহে ঘি মাখায়। এরজন্য দশটাকা করে নেয়। শুধুই কী তাই। এয়োস্ত্রী মরলে সোনার নাকছাবি, নোয়া কেউ কেউ খোলে না। নেত্য সব সংগ্রহ করে রাখে। সেদিন গুলো রান্না করতে সময় পায় না নেত্য। আজ আশুতোষ কে ঘি মাখাতে মাখাতেও হাঁক দিয়েছিল নেত্য “অ টগর। আজ তোর হাঁড়িতে চাল ফোটাস। বাপবেটিতে তোর কাছে খাবো”।
ভাত নামিয়ে গুগলি সেদ্ধ করে সেপটিপিন দিয়ে বার করতে লাগল থলথলে মাংস। এইসব কাজে হ্যাপা বেশি। তবুও হাসিমুখে রাঁধতে থাকে শেতলা। অনেক টা মাংস হয়েছে। এরপর নুন দিয়ে কচলাতে থাকে। পরিস্কার করে ধোয়। ফালা ফালা আলু কাটে। কী ভাগ্যিস আলু কুড়িয়ে রেখেছিল। নাহলে কী দাম আলুর। জমির আলু তুলে নিলে ছোট্ট নিড়ানি কোদাল নিয়ে টগরফুলের সাথে আলু কুড়িয়েছে শেতলা। চারবস্তা আলু। মুক্তিপদ রোজ তাই বলে “সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে”। মুক্তির সংসারে একবার রান্না হয়। জলখাবারের কোনও গল্প নেই। শুধুই দুই অক্ত ভাত। বেলা করে রান্না চাপায় শেতলা। অত কাঠ জ্বালানি কোথায় পাবে? দুপুরে পেট পুরে খেয়ে বাকী ভাতে জল ঢেলে দেয় শেতলা। রাতে পেঁয়াজ দিয়ে বেসনবড়া ভাজে। শুকনো লঙ্কাপোড়া দিয়ে তোফা খাওয়া। তবে আজ গুগলীর তরকারি রেখে দেবে কিছুটা রাতের জন্য।
এই গুগলী আবার পাঁকে হয়। আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্য হলুদ দিয়ে গুগলি ভাপায় শেতলা। তারপর শিলে বেটে নেয় আদা,রসুন, পেঁয়াজ। ছ সাতটা শুকনো লঙ্কা বাটে। বিলিতি বেগুন দিয়ে ঝোল হবে। লাল টকটকে ঝোল। সাথে রসুন ফোড়ন দিয়ে কলমী শাক ভাজা। চারদিক মাংসের গন্ধে ম ম করছে। এইসব গন্ধে খুব খিদে পায়।
দুপুরের খাওয়া মিটলে টগর এর সাথে গাঁয়ের দিকে গেল শেতলা। ছাড়ানো গুগলী বিক্রি করবে। গাঁয়ের ভিতরে ঢুকতেই একটা চিৎকার ভেসে এল। নিশ্চয়ই কোথাও ঝগড়া হচ্ছে। এই তিনসন্ধ্যা এক হতে চলল। কোথায় দিনশেষে ঈশ্বর নাম করবে। তা না। নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল শেতলা।
একটু এগিয়ে আসতেই অবাক হয়ে গেল শেতলা। মানুষ গুলো ভীষণ চেনা। এই তো এদের সকালেই চা খাইয়েছে সে। একটা মানুষ মরেছে ।একটা পুরো দিন পেরোয় নি। এরমধ্যেই এরা ঝগড়া করছে সম্পত্তির হিসাব নিয়ে। আর ওই যে কালো সুড়ুঙ্গু ছেলেটা ।ওটা তো রোজ ঠাকুর ঝি পুকুরে মাছ ধরে। ও এখানে কী করছে! পাশেই সাদা থান পরিহিতা একজন। নিশ্চয়ই ওর মা হবে। আহা। সদ্য বিধবা ।কত কষ্ট এদের। শেতলা বৃদ্ধাকে চেনে। কতদিন দেবীর মন্দিরে গিয়ে মানত করত এই মহিলা। তখন রঙীন শাড়ি পরত। হাতে শাঁখা পলা। কিন্তু ওরা বাড়ির বাইরে এই সাঁঝের বেলা কী করছে? কৌতুহল বাড়তে লাগল ওর। বুঝতেই পারল এই বাড়িতে বৃদ্ধার আর ঠাঁই হবে না। ঘরে ফিরে আকুল হয়ে পড়ল শেতলা। ওই মহিলার জন্য তার চোখের জল যেন বাঁধ মানে না। মুক্তিপদ মেয়েটার ভাবগতিক দেখে অবাক। বুঝতে পারে আশুতোষ ঘোষ এর দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য চিন্তায় পড়েছে তার শেতলা। মেয়েটার বড় মায়া।
মানুষের মন বড় বিচিত্র। সমজের নিয়ম দিয়ে তাকে বাঁধা যায় না। কুসুমের প্রতি ভালবাসার টান উপেক্ষা করার শক্তি আশুতোষ এর ছিল না। যতদিন আশুতোষ বেঁচেছিল ততদিন কেউ কুসুমের প্রতি অবিচার করতে পারেনি। তাছাড়া প্রথম পক্ষের পাল্লা ভারী। বাপের সম্পত্তির সবটাই আইনের চোখে তাদের। আশুতোষ নিজেই প্রচুর পরিশ্রম করে সম্পত্তির বহর করেছিল। শেষজীবনে শুধুই অশান্তির মধ্যে কেটেছে তার। কুসুমের জন্য, তার ছেলের জন্য ভদ্রাসন টুকু আলাদা করেনি আশুতোষ। অবশেষে অপুষ্টির শিকার হয়ে চিরনিদ্রায়। এখন কুসুমের অবস্থা যেন রাস্তার ভিখারী। রাত বাড়তে থাকে। আকাশের অবস্থা একদম ভালো নয়। মাঝে মাঝেই চিকুর হানছে। ঘরের মধ্যে কুপিটা জ্বলছিল। দমকা হাওয়াতে সেটাও নিভে গেল। অন্ধকার রাত। ভয় পায় শেতলা। পাশের ঘরটাতে দাদারা শুয়ে আছে। রান্নাশালের কাছে বিছানা করেছে বাবা। আর এই ছোট্ট ঘরটা শেতলার জীবনের ঘর। ছোট্ট খুপরি। সেখানে ছোট্ট আয়না আর চিরুন। প্রসাধন বলতে সিঁদুরের টিপ। কতটুকুই চাওয়া। তবুও কত আনন্দ এই শ্মশান ধারে। যাদের অনেক আছে তাদের আহিঙ্কে আর মেটে না। আশুতোষ ঘোষ কত বড়লোক। তবুও মুখ দে রক্ত উঠে মরল। অশান্তির বীজ বিষবৃক্ষ হয়ে গেছে। তবুও একটু আশ্রয় মানুষ পেতে পারত বৈকি। ঘুম আসে না শেতলার। চৈত্রমাস। ফাল্গুন মাস থেকেই পাখার কদর বাড়ে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে বাপ ভাইরা। কত তালপাতা জলে ডোবানো। এরপর পাখা হবে। ঝাঁটাকাঠির জন্য নারকেল পাতা চেঁচে রাখতে হয় শেতলাকে। একটা পাতায় দুটো পাখা। পাখা হরেক রকমের। রঙ করে দিলে দাম বেশি পাওয়া যায়। এইসব কাজ শেতলাকে করতে হয়। শেতলার মা যদি বেঁচে থাকত তবে শেতলাকে এতকাজ করতেই দিত না। শেতলার মা নেই। সেই ছোট্ট থেকেই বাবা শিখিয়েছিল ওই যে গাধার উপরে বসে আছে দেবী ওটাই বিশ্বজননী। ওটাই তোর মা।”
নিশুত রাত। কাদের যেন পায়ের শব্দ। মাঝে মাঝেই ঝুম ঝুম আওয়াজ। ননীর মা বলেছিল দেবী শীতলা রেতের বেলায় বের হন। গাধার পিঠে চড়ে। একহাতে ঝাঁটা থাকে। আর হাতে অমৃত কলস। আবার হাতপাখাও থাকে। সংসারের মানুষ যখন জ্বলে পুড়ে মরে তখন দেবী অমৃতকলস থেকে অমৃতবারি ঢেলে দেন”।
ননীর মা কত গল্প জানে। সেই যখন কুমোরবাড়ির দুই জা প্রতিদিন ঝগড়া করত তখন দেবীর অভিশাপ ওদের বলদ বানিয়েছিল। দেবীর কথা হল কর্তব্য অবহেলা করা চলবে না। ওই যে দুই সতীনের ঝগড়া। একদিন ওদের ও পুকুর বানিয়ে দেবে। এমন পুকুর যার জল সমুদ্রের মতো নোনা। কেউ যাবে না সেই পুকুরে। চোখের জল এর মতো নোনা। বিস্বাদময়। ঘর থেকে বেরিয়ে এল শেতলা। কিন্তু মন্দিরের বাইরে কীসের আলো! তবে কী আবার কেউ মরল। গোটা গাঁয়ে এখন বসন্ত রোগ। যদিও এই রোগে মৃত্যু এখন হয় না। বাবার মুখে শুনেছে এখন টীকা আবিষ্কার হয়েছে। আগের দিনে এই রোগে গাঁ লোপাট হয়ে যেত।
পা টিপে টিপে মন্দিরের দিকে যাচ্ছে শেতলা। কীসের আলো জানতেই হবে। কাছে আসতেই অবাক হল সে। সেই বৃদ্ধা। চাতালে বসে কাঁদছে। একটু দূরে তার ছেলেটা শুয়ে আছে। শেতলার মনটা ভারী হয়ে গেল। চৈত্রমাস। লোকেরা বাড়ি থেকে কুকুর বিড়াল পর্যন্ত তাড়ায় না। আর এদের এভাবে তাড়িয়ে দিলে। চোখের জল আটকাতে পারল না সে। বলল “তোমরা এখন থেকে এখানেই থাকো। একপাশে ছিটেবেড়ার ঘর করলে কেউ আপত্তি করবে না”। কুসুম সম্বিত ফিরে পেল। বললে “তুমি কে গো মা। এখানে তুমি কী করছ। এটা তো শ্মশান “।
“আমি তো শেতলা। আমি এখানেই থাকি”। শেতলার মুখে এই কথা শুনে চমকে উঠল কুসুম। চিরকাল অবহেলিত সে। ভালোবাসার টানে আশুতোষ কে বিয়ে করে আজ কপর্দকহীনা। তবুও দেবদ্বিজে ভক্তিটুকুই সম্বল। আর আজ এই অদিন অসময়ে স্বয়ং দেবী বুঝি তার কাছে এসেছে দহনজ্বালা মেটাতে। ডুকরে কেঁদে উঠল কুসুম। শেতলা বলল “ওই তো কাছেই আমার বাড়ি। তুমি আমার ঘরে চলো।”।
কুসুম আশ্চর্য হয়ে গেল। কে এই মেয়েটা। এমন করে ঘরে ডাকছে। তাকে তো কেউ এমন করে কখনও আপন করেনি। সেই কবে তখন সে ছোট্ট ছিল, তার সুন্দর জীবন ছিল। হাড়কেপ্পন বাপ দুবেলা খেতে পরতে দিত। কী সুন্দর দেখতে ছিল তাকে। অমন রূপ তার অভিশাপ হয়ে গেল। ঠাকুর মা নাম রেখেছিল কুসুম। কুসুমের মতোই নরম ছিল মনটা। লেখাপড়ার বালাই ছিল না । ঠাগমার সাথে কথকতা শুনতে যেত। তখন সেও শুনেছিল শেতলামঙ্গলের কাহিনী। প্রকৃতির সাথে তার ছিল নিবিড় যোগ। দুপুরে সব যখন নিথর নিথর তখন বামুন দের আমবাগানে শীতল ছায়ায় বসে খেলনাপাতি সাজাতো। তারপর কাঁচা আমের ছেঁচকি বানাতো। মাটির পুতুলের বিয়ে দিতো। সেসব দিন আর ফিরে আসবে না। যা চলে যায় তা আর ফেরে না কখনও।