-কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?
-আমি যদি তোমার সঙ্গে চলে যেতে পারতুম তো যেতুম।
-আমার সঙ্গে!
-হাঁ। তুমি কত দূর থেকে হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছ শুনে আমার মন কেমন করছে।
(দধির বাঁক নামাইয়া) বাবা, তুমি এখানে বসে কী করছ?
-কবিরাজ আমাকে বেরোতে বারণ করেছে, তাই আমি সারাদিন এখেনেই বসে থাকি।
-আহা, বাছা তোমার কী হয়েছে?
-আমি জানি নে। আমি তো কিচ্ছু পড়িনি, তাই আমি জানি নে আমার কী হয়েছে। দইওয়ালা, তুমি কোথা থেকে আসছ?
-আমাদের গ্রাম থেকে আসছি।
-তোমাদের গ্রাম? অনে―ক দূরে তোমাদের গ্রাম?
-আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।
-পাঁচমুড়া পাহাড়― শামলী নদী― কী জানি, হয়তো তোমাদের গ্রাম দেখেছি― কবে সে আমার মনে পড়ে না।
-তুমি দেখেছ? পাহাড়তলায় কোনোদিন গিয়েছিলে নাকি?
-না, কোনোদিন যাইনি। কিন্তু আমার মনে হয় যেন আমি দেখেছি। অনেক পুরোনোকালের খুব বড়ো বড়ো গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম― একটি লাল রঙের রাস্তার ধারে। তাই না?
-ঠিক বলেছ বাবা।
-সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়াচ্ছে।
-কী আশ্চর্য! ঠিক বলছ। আমাদের গ্রামে গোরু চরে বই কি, খুব চরে।
-মেয়েরা সব নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসী করে নিয়ে যায়― তাদের লাল শাড়ি পরা।
-বা! বা! ঠিক কথা। আমাদের সব গয়লাপাড়ার মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে তো নিয়ে যায়ই। তবে কিনা তারা সবাই যে লাল শাড়ি পরে তা নয়― কিন্তু বাবা, তুমি নিশ্চয় কোনোদিন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলে!
-সত্যি বলছি, আমি একদিনও যাইনি। কবিরাজ যেদিন আমাকে বাইরে যেতে বলবে সেদিন তুমি নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?
-যাব বই কি বাবা, খুব নিয়ে যাব!
-আমাকে তোমার মতো ঐরকম দই বেচতে শিখিয়ে দিয়ো। ঐরকম বাঁক কাঁধে নিয়ে― ঐরকম খুব দূরের রাস্তা দিয়ে।
-মরে যাই! দই বেচতে যাবে কেন বাবা। এত এত পুঁথি পড়ে তুমি পণ্ডিত হয়ে উঠবে।
-না, না, আমি কক্খনো পণ্ডিত হব না। আমি তোমাদের রাঙা রাস্তার ধারে তোমাদের বুড়ো বটের তলায় গোয়ালপাড়া থেকে দই নিয়ে এসে দূরে দূরে গ্রামে গ্রামে বেচে বেচে বেড়াব। কী রকম করে তুমি বল, দই, দই, দই― ভালো দই। আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও না গো।
-হায় পোড়াকপাল! এ সুরও কি শেখবার সুর!
-না, না, ও আমার শুনতে খুব ভালো লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে যেমন পাখির ডাক শুনলে মন উদাস হয়ে যায়― তেমনি ঐ রাস্তার মোড় থেকে ঐ গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল― কী জানি কী মনে হচ্ছিল!
-বাবা, এক ভাঁড় দই তুমি খাও।
-আমার তো পয়সা নেই।
-না না না না― পয়সার কথা বোলো না। তুমি আমার দই একটু খেলে আমি কত খুশি হব!
-তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল?
-কিচ্ছু দেরি হয়নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয়নি। দই বেচতে যে কত সুখ সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।
********২০২৪*******
অমল জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, পথচারী নজরে পড়লেই দাদুর কথা জিজ্ঞাসা করছে- এক যুবক রথে চেপে রাজার বাণী প্রচার করতে করতে এগিয়ে চলেছে। প্রচারের সুবিধার্থে সঙ্গে রেখেছে রাজার অনুকরণে তৈরি বেশকিছু মাটির-পুতুল।
-পুতুল চাই― পুতুল― ভালো পুতুল নেবে গো…..!
অমল:-পুতুলওয়ালা,পুতুলওয়ালা, ও পুতুলওয়ালাআআআ!
যুবক:- ডাকছ কেন? পুতুল কিনবে?
অমল:- কেমন করে কিনব! আমার তো পয়সা নেই।
-কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার রথ থামালে কেন?
-আমি যদি তোমার সঙ্গে যেতে পারতাম তাহলে আমার দাদুকে খুঁজে পেতাম।
-আমার সঙ্গে!
-হাঁ গো। পুতুল ফেরি করতে করতে তুমি যে কত জায়গা ঘুরে বেড়াও, তোমার সঙ্গে গেলে কোথাও না কোথাও আমার দাদুকে ঠিক খুঁজে বেড়াতাম!
অমলের কথা শুনে যুবকটির মনে হলো- ‘এই ছেলেটিকে রাজার শিষ্য করা যেতে পারে’! সে রথ থেকে নেমে এসে অমলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
-তোমার দাদু কোথায় গেছেন?
-সেটাই তো জানি না; মা আমায় বেরোতে বারণ করেছে, তাই কোত্থাও যাই না, দিনভর এখানেই বসে থাকি আর ভাবি- এই বুঝি দাদু আসে!
-মা কেন বারণ করেছেন, তোমার কী হয়েছে?
-তাও জানি না। আমি তো কিছু পড়িনি, তাই জানি না আমার কী হয়েছে। পুতুলওয়ালা, তুমি কোথা থেকে আসছ গো?
-আমি তো ‘রাজপ্রাসাদ’ থেকে আসছি। রাজার পরম ভক্ত আমি!
-তোমারের রাজপ্রাসাদ অনে―ক দূরে বুঝি? মনে হয় আমি দেখেছি….। কবে দেখেছি, তা অবশ্য আমার মনে নেই।
-তুমি দেখেছো!
-অনেক পুরোনোকালের খুব বড় বড় গাছের তলায় তোমাদের রাজার ঘর, সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়ায়। গ্রামের মেয়েরা লাল শাড়ি পরে নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসী নিয়ে ঘরে ফেরে―
‘হো হো’ করে হেসে উঠে যুবক উত্তর দেয়- -বোকা ছেলে, তুমি সত্যিই কিচ্ছু জানো না, কিচ্ছু চেনো না তুমি! রাজার ঘর অমন গাঁয়ে-গঞ্জে হতে যাবে কোন দুঃখে শুনি! আমাদের রাজার প্রাসাদ স্বর্গের থেকেও সুন্দর, যা তুমি স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না! সেসব বলব খন অন্য একদিন। এখন বলো দেখি- তোমার দাদু কেমন দেখতে?
-তুমি আমার দাদুকে চেনো না বুঝি! তাকে তো চেনে পৃথিবীর সব জন! তিনি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর তাঁর কথা!
-তাই বুঝি? বেশ, চলো তাহলে, আজই তোমাকে তোমার দাদুর কাছে নিয়ে যাব। কিন্তু যাবটা কোথায়, তুমি তো তা-ই জানো না!
-ওই যে বললাম- পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়, শামলী নদীর ধারে। সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়ায়। লাল শাড়ি পরে….
-হায় পোড়াকপাল, তুমি তো দেখছি ‘পাঁচমুড়া পাহাড় আর শ্যামলী নদী ছাড়া কিছুই জানো না? তবে তুমি ছেলেটা খুব ভালো! তোমার নাম কী ভাই?
-আমার নাম অমল।
-আমি বলি কী অমল, তুমি তোমার দাদুকে ভুলে যাও। কষ্ট পেয়ে কী করবে বলো, কেউ কি চিরকাল বেঁচে থাকে! একদিন না একদিন সবাইকেই চলে যেত হয়!
-কিন্তু আমার দাদু তো এখনও আছে, আমি তাঁকে চোখে দেখতে পাচ্ছি না- এই যা!
-ওটা তোমার ভুল ধারণা। তারথেকে বরং….
ছুটে গিয়ে রথ থেকে একটা পুতুল নিয়ে এসে অমলের হাতে দিয়ে বলে- -এটা তুমি তোমার শোবার ঘরে মাথার কাছে রেখে দিয়ো। আমাদের রাজার আদলে গড়া এই পুতুলের মহিমা তুমি জানো না ভাই! এই পুতুল ফেরি করে আমি অনেককিছু পেয়েছি! অবশ্য পুতুল না বেচলেও কিছু এসে যায় না। সারাজীবন বিনা পরিশ্রমেই কাটিয়ে দিতে পারি!
-ছি ছি, এসব তো মহা পাপ! আমার মা বলে- যে উপার্জনে ঘামের গন্ধ নেই সে কাজ অতি মন্দ, তাতে আনন্দ নেই! এমন কাজ যিনি করেন লোকে তাঁকে ঘৃণা করে! তুমি এক্ষুণি এ-কাজ ছেড়ে দাও!
যুবকটি খানিক্ষণ নিশ্চুপ থাকে, তারপর অমলের হাতের ওপর হাত রেখে বলে-
-আমার মা-ও তো ঠিক একই কথা বলে! জানো অমল, কতদিন হয়ে গেল, মা আমার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না! তোমাকে দেখে কেন যেন আমার খুব আপন মনে হয়! মনে হয়- তুমি…… জানি না কী মনে হয়!
-আমারও ঠিক তাই মনে হয়। কিন্তু আজ যে তোমায় অনেক দেরি করিয়ে দিলাম গো দাদা।
-কিচ্ছু দেরি হয়নি, আমার কোনো লোকসান হয়নি ভাই! ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে যে এত সুখ তা আজ তোমার কাছে শিখে নিলাম।
যুবক রথে উঠে পথ পরিবর্তন করল, তা দেখে অমল জিজ্ঞেস করল-
“তুমি ওদিকে কোথায় যাচ্ছ গোওওও, আর পুতুল বেচবে নাআআআ..…”?
“রাজার রথ রাজাকে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি গোওওও…. তারপর যাব তোমার দাদুকে খুঁজতেএএএ…….. কাল ঠিক এই সময় তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবেএএএ…….”!
“সত্যি বলছোওওও”?
“সত্যি সত্যি সত্যিইইই….”!
*****************
সেদিন অমল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল, দাদুকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না! ভোরের দিকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেও জানে না-
★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★
পূব-আকাশের হাত ধরে শিউলি বিছানো পথে হেঁটে চলেছেন এক বৃদ্ধ…… সেই আগের মতো দু’হাত পিছনে রেখে, সামনে কিছুটা ঝুঁকে। দাড়িগোঁফ সব একই আছে; বয়সটাই শুধু এগিয়ে গেছে! মুখে সেই উচ্চারিত বাণী, বলিষ্ঠ তাঁর পদধ্বনি! পিছনে তাঁর অগণিত ভক্ত-ভিড়, এ-যেন রাবণে বধিতে চলিছেন অ-যোদ্ধা রঘুবীর!
ওঁর আগমনে জেগে উঠল গোটা বিশ্ব; গর্জে উঠল আকাশ, কম্পিত হলো রাজার প্রাসাদ! ‘শ্যামলী’র জলরাশি কুণ্ডলি পাকিয়ে আছড়ে পড়ল পাহাড় হতে পাহাড়ে! এই দ্বন্দ্ব ছন্দবদ্ধ হয়ে রচিত হলো স্বরলিপি, পুনঃউচ্চারিত হলো বিকিকিনির সেই মধুর সুর!