ক্ষুধা-রূপেণ সংস্থিতা
—————————–
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আজ অষ্টমীতিথি।রায়বাড়িতে হাঁকডাকের সীমা নেই। আড়াইশ বছরে পড়ল এবার পুজো। সেই কোম্পানীর আমল থেকে নিমকমহালের দেওয়ানী করে সর্বেশ্বর রায় পুজো চালু করেন। এঅঞ্চলের একমাত্র হেরিটেজ পুজো।
যদিও শরিকে শরিকে ইদানীং দশ টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে এই রায়পরিবার,তাও এসময়টা দেশ- বিদেশ থেকে যে কজন উৎসাহী পরিজন এখনও আসে সে কজনেই আসর জমজমাট।
……
গঙ্গার ওপারে গ্রাম জোয়ালপুর। সেখান থেকে আসে ঢাক বাজাতে আসে মদন মুচি। তিনপুরুষ ধরে এরাই ঢাক বাজিয়ে আসছে। আগে সঙ্গে বড় ছেলে লকাই আসত কাঁসর বাজাতে। এবারে যার জায়গায় তার ভাই অন্তি এসেছে ওর বাপের সাথে। ফি বছর দুটো কাপড় আর নগদ দুহাজার টাকায় খুশী মুখে তারা গাঁয়ে ফিরবে বে তাদের মুখে শরতের আলো ঝলকে উঠছে।
……
সন্ধিপুজো এবার দুপুর আড়াইটেয়! প্রবীণ পুরোহিত বৃদ্ধ ষষ্ঠীপদ ভটচাজ মশাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তার। যদিও আজ তাঁর শরীরটা একেবারে জুত নেই। সকাল থেকেই মনোঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটছে।
বিশ বচ্ছর পুজো করছেন রায়বাড়ির কোনও দিন এমন হয়নি। সবাই বলে তাঁর পুজোয় সন্ধিপূজার ক্ষণে দেবীমূর্তিতে প্রাণ আসে !
অন্তি এতবড় পুজোর আয়োজন আগে দেখেনি।এত্ত লোকজন, দামী দামী পোষাক, খাবারের ছড়াছড়ি সে কল্পনাও করতে পারেনা। এসব দেখে আর তার মা’কে মনে পড়ে। মা’ যখন ছিল তখন গরাস তুলে তাকে ভাত খাইয়ে দিত। গত বর্ষায় সাপে কাটল আর টুক করে মরে গেল তার মা।
……
সকাল থেকে ঢাক বাজিয়ে বাপ ব্যাটায় ক্লান্ত হয়ে জিরোয়। আজ বড্ড ভীড়। ভোগ খাওয়ানোর সময় ওদের ডাকতে ভুলে যায় পুজো বাড়ির লোকজন।
সেই সকালে কটা লুচি আর বোঁদে খেয়ে দুপুর গড়াতে পেটে আগুন জ্বলে অন্তির।
ডেনমার্ক থেকে বড়তরফের ছোট মেয়ে – জামাই আজ । তাই সেই নিয়ে সবাই মেতে আছে। বাড়ির মেয়ে কতটা সাহেব হয়ে গেছে আর কতটা ঘরের ঝি হয়ে রয়ে গেছে সেটাতেই সবার আগ্রহের কারণ দমকে দমকে শোরগোল তুলছে।
……
একশো পিদিম জ্বেলে ক্রমে সন্ধিপূজা আরম্ভ হয়। প্রতিবছর এসময় সুষুম্নাপথে টের পান ভটচাজ মশাই কুন্ডলিনীর জাগৃতি। মা’ আসেন ক্ষণিক পলের জন্য। প্রসাদীফুল প্রতিবার পড়ে মূর্তি থেকে আশীর্বাদ স্বরূপ। কিন্তু আজ কেন সে তালে লয়ে মিলছেনা তাঁর ! তবে কি কোন ত্রুটি রয়ে গেল দেবীপূজায়?
সাময়িক বিরতিতে অন্তি চুপিচুপি বাইরে আসে। লোকচক্ষুর জটলা ছেড়ে তার বুভুক্ষু মন তাকে নিয়ে যায় ভাঁড়ারের দিকে।
ভেতরবাড়িতে সব বারকোশগুলি চলে যাওয়ায় আপাতত পড়ে থাকা অল্পকিছু ভোগের অবশিষ্টমাত্র সে দ্বিরুক্তি না করে খিদের চোট মুখে তুলে নেয় তৃপ্তিতে।
……
ওদিকে হঠাৎ গুঞ্জন ধ্বনিত হয়। পুজোবাড়ীতে শোরগোল ওঠে বিদেশ ফেরৎ কন্যার সপরিবারে আগমন নির্ঘোষে। ঠিক তখনই ভটচাজ মশাইও সুষুম্নায় চাঞ্চল্য অনুভব করেন ! অন্তিও তৃপ্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে দেবীকে দেখে ক্ষুধানিবৃত্তির পর ।
মুহূর্তের লহমায় দশপ্রহরণধারিণী দুর্গাপ্রতিমাটিও যেন সপরিবারে হেসে ওঠেন প্রাণের আগম মহিমায়।
নিয়মমতো জবাফুলও পড়ে একটি।
ভটচাজ মশাই এবারে নিশ্চিন্তে বাকি পুজো সম্পন্ন করেন।
……
অন্তি ঘোর লাগা চোখে এই প্রথমবার দেবীমূর্তির আড়ালে প্রথমবার তার সহাস্যবদনা ও অকালমৃতা মা এর মুখচ্ছবিটি ভেসে উঠতে দেখে!
—oooXXooo—