গিরগিটি
#মুল রচনা – আন্তন চেখফ
( Хамелеон, ইংরেজি অনুবাদে Chameleon)
দেশজ ভাবানুবাদঃ নিলয় বরণ সোম
(লেখক পি কে বিশ্বাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী , এই গল্পটি, শহীদ দীনেশ গুপ্ত ‘মেঘ ও রৌদ্র পত্রিকায় প্রথম অনুবাদ করেন , পড়ে করেন অরুন সোম , ১৯৮৬ সালে । এই অধমও কলেজের দেয়াল পত্রিকায়, ১৯৮৪ সাল নাগাদ বহু পঠিত এ গল্পটির অনুবাদ করেন বটে, তবে সে রাম, সে অয্যোধ্যার মত সেই অনুবাদও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে । এই প্রয়াসটি, গল্পটির দেশজ ভাবান্তর )
লম্বা চওড়ায়, বহরে বড় নতুন জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে ,একটা ফাইল হাতে দারোগা মিশ্রজী বাজারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন । কনস্টেবল বাঘেলা বাজেয়াপ্ত মালগুলি একটা বিরাট গানি ব্যাগে বোঝাই করে সাহেবের পেছন পেছন আসছে । বাজার খা খা করছে , জন মনিষ্যি নেই , মিশ্রজী ইন্সপেকশনে বেরোলে এমনটাই হয় । দোকানপাট , এমনকি চা মিষ্টির দোকানগুলিরও ঝাপই শুধু খোলা , কেনা বেচার চিহ্ন কিছু নেই , এমনকি ভিখারিদেরও দেখা মিলছে না ।
হঠাৎ মিশ্রর কানে একটা আওয়াজ এল –“ কুত্তা, তুই কামড়ালি তো , কামড়ে দিলি, না ? এই যে ছোকরার দল , তোরা একে পালাতে দিবি না মোটে ! যখন তখন কামড়ে দেওয়া বেআইনি !ধর ধর –ওহ !”
একটা কুকুরের গোঙানি কানে এল –আওয়াজ যেদিক থেকে আসছে মিশ্রজী সেদিকে তাকিয়ে দেখেন কাঠের গোলার মালিক আগরয়ালের উঠান থেকে একটা কুকুর তিন পায়ে ভর করে দৌড়ে আসছে; আর তার পেছনে বোতামখোলা , চক্রা বক্রা শার্ট পরা একটা লোক তাকে তাড়া করছে । একটু ঝুঁকে পড়েই লোকটা কুকুরটার একটা পা ধরে ফেলল । কুকুরটা মুখ দিয়ে আরেকবার কুই কুই আওয়াজ করতেই আবার হুঙ্কার লোকটার – একদম পালাতে দিবি না এটাকে !
এতক্ষণ ঝিমিয়ে থাকা দোকানগুলি থেকে কিছু উৎসাহী মুখের উঁকি ঝুকি শুরু হল আর কিছুক্ষনের মধ্যে এক পাল লোক যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল অকুস্থলে ।
-“স্যার মনে হচ্ছে পাবলিকের ঝামেলা, মানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি “ কনস্টেবলের গলা এবার শোনা গেল ।
মিশ্র গট গট করে হেঁটে জনতার মুখোমুখি হলেন । উঠানের ঠিক সামনে বোতাম খোলা লোকটা, তার টপ টপ করে রক্ত ঝরা আঙ্গুলটা জনতার দিকে উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।ওর মুখচোখে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে, শরীরী ভাষার উচ্চারন একটাই “এবার তোকে দেখাচ্ছি চাঁদু !”
লোকটাকে দেখে মিশ্র চিনতে পারল , ও হল প্যাটেল , বাজারে সোনার দোকান আছে ওর, পেশায় স্যাকরা ।
জড় হওয়া জনতার ঠিক মাঝখানে সামনের পা দু’টি ছড়িয়ে আসামী বসে আছে , দেখে মনে হয় দো- আঁশলা কুকুর ,নাকটা ছুঁচোল, আর পিঠে হলুদ হলুদ ছোপ ছোপ । ভয়ে কুঁকড়ে থাকা জন্তুটার চোখের দিকে তাকালে তার জল্ভরা মিনতি আর ভয়ের চিহ্ন চোখে ধরা পরবেই ।
এবার মিশ্রজী গলা চড়ালেন,“ বলি ব্যাপারটা কী ?তোরা ভিড় করছিস কেন এখানে ? তুমি আঙ্গুল উঁচিয়ে কী করছ ? এত জোরে চেঁচাচ্ছিলই বা কে ?
মুখের সামনে হাতের মুঠোটা এনে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে লোকটা বলল , “আমি স্যার যেমন হেঁটে যাই, তেমনি যাচ্ছিলাম স্যার।,আমি সাতেও থাকি না , পাঁচেও থাকি না ।আগরয়ালজির কাঠের গোলায় আমার একটু কাজ ছিল , সেসব কথাবার্তা
বলছিলাম , কোত্থেকে এই হতচ্ছাড়া এসে আমার আঙ্গুল কামড়ে দিল !স্যার , আমি হাতের কাজ করে খাই –আমার তো মনে হচ্ছে পাক্কা এক সপ্তাহ হাত নাড়াতে পারব
না ।হাতই যদি না নাড়াতে পারি তবে আমি খাব কী ? হুজুর আপনিই এর বিচার করবেন , আপনি অর্ডার করলে ওর মালিক আমাকে ক্ষতিপূরণ দেবেই। তা ছাড়া আপনাকে আর কী বলি স্যার , আইন তো আপনি আমদের থেকে ভাল জানেন । পুরো ব্যাপারটা বেআইনী –হিংস্র জন্তুদের ছেড়ে দেওয়া আইনে নিষেধ –আজকে সব পোষা জন্তু যদি কামড়াতে শুরু করে, অবস্থা দাঁড়াবে কোথায় ?”
মিশ্রজী গলা ঝেড়ে নিয়ে স্বভাব মত একটু ভ্রু নাচিয়ে নিলেন –“বুঝতে পারছি, বুঝতে পারছি সব ! তা কুকুরটা কার? এসব সহ্য করব না –যখন তখন কুকুর ছেড়ে দেওয়া বের করে দেব । যারা আইন মানে না তাদের সবক শেখাতে হবে-দয়া মায়া করলে চলবে না। কুকুর বিড়াল ছেড়ে দিলে কত ফাইন দিতে হয় বাছাধন কে শিখিয়ে দেব জন্মের মত।“
বাঘেলা ! উনি হাঁক দিলেন , “ আমার জ্যাকেটটা একটু ধর তো !কার কুকুর এটা বের কর , ওর স্টেটমেন্ট নাও একখান । কুকুরটাকে বাঁচতে দেওয়া যায় না-পাগলা কুকুর একখানা , আরও কত লোককে কামড়াবে তার ঠিক আছে ? কার কুকুর এটা ?
জনতার ভিতর থেকে একজন বলে উঠল , এস পি সাহেবের মনে হয় !
-“ এস পি সাহেবের !বাঘেলা আমার জ্যাকেটটা একটু ধর তো, গরমও পড়েছে তেমনি !” বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে !একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না , কুকুরটা তোমাকে কামড়াল কী করে ? ও তোমার হাতের নাগাল পেল কি করে ? এই মুশকো চেহারার সঙ্গে এই ছোট্ট কুকুরটা পেরে উঠবে ? তুমি নিশ্চয়ই নিজেই নিজের আঙ্গুল পেরেক দিয়ে খুঁচিয়েছ – তোমাদের আর আমার জানতে বাকি নেই ! সবকটা হারামজাদা !”
-“স্যার ও কুকুরটার সঙ্গে মজা করার জন্য ওর নাকের সামনে সিগারেতের ডগাটা নিয়ে গেছিল ,আর ও দিয়েছে ঘ্যাঁচ করে দাঁত বসিয়ে । আজকাল তো জন্তু জানোয়ারও আগের মত বোকা নেই স্যার –আর এই প্যাটেলের মাথায় সবসময়য় শয়তানি বুদ্ধি ঘোরে !
-“একদম বানিয়ে কথা বলবি না প্রকাশ !তুই আমাকে দেখেছিস এরকম করতে ? দেখিস নি যখন, বানিয়ে বানিয়ে বলছিস কেন ? স্যার বিচক্ষণ লোক , উনি ঠিক বুঝতে পারেন কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যার জাহাজ ।আমি মিথ্যে বললে হুজুর আমায় শাস্তি দেবেন ।আর এখন যা আইন হয়েছে , আইনের চোখে সবাই সমান , আমার এক ভাই পুলিশে চাকরি করে , এসব জানি আমি …”
–
-“মুখে মুখে এত তর্ক করবে না !
কনস্টেবল বেশ বিজ্ঞের মত বলল ,” না ।এস পি সাহাবের কুকুর এটা না । সাহেবের কুকুরগুল এরকম নয় –ওগুলো হয় গ্রে হাউণ্ড নয় অ্যালসেশিয়ান
-“ঠিক বলছ তো ?”-
– “আমি অনেকটাই সিওর, স্যার !”
– “ ঠিকই বলছ মনে হয় !এস পি সাহেবের কুকুরগুলো কত দামী, ভাল জাতের কুকুর, আর এটা ? চেহারাটা দেখ একবার ! বিচ্ছিরি , দেশি কুত্তার মত চেহারা !এরকম কুকুর সাহেব্ রা পোষে ? পাগল নাকি ! হত দিল্লি কি বম্বের রাস্তা , কী হত আন্দাজ আছে তোদের ? আইন কানুন নিয়ে কেউ ভাবত না , এক মিনিটে এটাকে নিকেশ করে ছাড়ত !প্যাটেল, তুমি ব্যাপারটা ছেড়ে দেবে না একদম ! মালিকের একটা শিক্ষা হওয়া উচিত ! এ ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে …”
কনস্টেবল আবার একটু ভেবে বলল , “স্যার , এটা কিন্তু এস পি সাহেবের হতেও পারে । চেহারা দেখে কি সব সময় বোঝা যায় ? মনে হয় যেন পরশু দিন স্যারের বাগানে এরকম একটা কুকুর খেলা করছিল ।“
-হ্যাঁ হ্যাঁ , এস পি সাহেবের, এস পি সাহেবের , জনতার মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল ।
-“বাঘেলা! জ্যাকেটটা আবার একটু দাও তো ! দমকা হাওয়ায় কেমন শীত শীত করছে ! কুকুরটাকে নিয়ে তুমি এস পি সাহবের কাছেই যাও , স্যারকেই জিজ্ঞাসা কর । বলে দিও , আমি একে খুঁজে পেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি ! আর ওঁদের বলে দিও এরকম করে রাস্তায় ছেড়ে না দিতে । হয়ত বেশ দামি জাতের কুকুর এটা , তবে প্যাটেলের মত এক একটা শয়তান যদি ওর নাকে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা দেয় ,বেচারার অবস্থা কী হবে ভাবতে পারছ ? কুকুর খুব শৌখিন প্রানি –যে সে নাকি! !আর এবার তোমায়, হ্যাঁ তোমাকেই বলছি , আঙ্গুল উঠিয়ে ওই নাটক বন্ধ কর তো ! যা হয়েছে তোমার দোষেই হয়েছে , বদমাশ কোথাকার !এই যে এস পি সাহাবের আর্দালি আসছে , ওকেই জিজ্ঞাসা করি !এই যে গিরিধারি ! এদিকে একটু তাকাও !দ্যাখ তো , এই কুকুরটা তোমাদের কিনা ?”
-“আমাদের ? কস্মিনকালেও আমদের এরকম কুকুর ছিল না !
-“আর জিজ্ঞাসাবাদ করার দরকার নেই । বোঝাই যাচ্ছে এটা রাস্তার কুকুর ।এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করে সময় নষ্ট করে আর কাজ নেই । বেওয়ারিশ কুকুর একটা , একে খতম করে ফেললেই হয় !”
-এটা আমাদের নয়, তবে এস পি সাহবের ভাইয়ের ।উনি কিছুক্ষন আগেই এসেছেন ,এটা বরজিস জাতের কুকুর । আমাদের সাহেব এরকম কুকুর পছন্দ করেন না ।কিন্তু ওঁর ভাইয়ের খুব প্রিয় …”
– কী বললে? এস পি সাহেবের ভাই এসেছেন ? তার মানে পুস্কর স্যার ?
একগাল হেসে ইন্সপেক্টর বললেন , “ দ্যাখ কাণ্ড, পুস্কর স্যার এসেছেন আর আমি জানি না !থাকবেন উনি ?”
-“আজকের রাত টুকু !”
-ভেবে দেখ কী অবস্থা !স্যারের ভাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা হলে বেশ হত । আচ্ছা এটা ওঁর কুকুর ?”
এবার কুকুরটার দিকে ঘুরে মিশ্রর বাণী, “ কেমন দুষ্টু মিষ্টি চেহারা ! আরে আরে , ওই লোকটার হাতে তুমি কামড়ে দিয়েছ ? এসো এসো , আর ভয় পেতে হবে না ! দস্যিটা রাগও দেখাচ্ছে – কিউট বাচ্চা একটা !”
গিরিধারি কুকুরটার নাম ধরে ডেকে ওকে নিয়ে চলে গেল । জনতা এবার প্যাটেলের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল।
-“তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে এবার !দারোগা সাহেব তার ভারি জ্যাকেটটা ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলেন ।
—oooXXooo—