লাফিং বুদ্ধ
বাসুদেব চন্দ
প্রদীপ, ডাক নাম দীপ। সুঠাম চেহারা। ছোটবেলা থেকেই শরীর চর্চা আর খেলাধুলায় বেশ আগ্রহ। পড়াশোনায়ও মোটামুটি ভালো।
বাবার একার রোজগারে মা-বাবা আর ভাই-বোনের সংসার টেনেটুনে চলে যায় আরকি। কোনোরকমে কলেজের দরজা টোপকেই চাকরি খোঁজা শুরু করে দিল দীপ। বোনের বিয়ের জন্য বাবার পাশে না দাঁড়াতে পারলে সম্মান থাকবে না!
কিন্ত উপায়টা কী! চাকরি পাওয়া তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার! অগত্যা পাশের বাড়ির অংশুর হাত ধরে ডেলিভারি বয়ের কাজে নেমে পড়ার কথা ভাবতে শুরু করল দীপ।
বাড়িতে আলোচনা হলো! বাবা সম্মতি দিলেন কি দিলেন না, ঠিক বোঝা গেল না। শুধু মাথা নীচু করে নিজের বুকটা বারবার ঘষছিলেন! দু’দিন ধরে ঠিক করে খাওয়া-দাওয়াও করেননি!
একদিন হঠাৎ নতুন একটা বাইক নিয়ে এসে খোকার হাতে চাবিটা দিয়ে বললেন-“সাবধানে চালাবে, কোনও অঘটন ঘটে গেলে তোমাদের মা’কে কিন্তু আর সামলানো যাবে না- কথাটা যেন মাথায় থাকে”!
খোকা মনে মনে ভাবলে-“মা’র দোহাই দিয়ে নিজের কষ্টটা আর কতদিন তুমি চেপে রাখবে বাবা”!
এরকম একটা কাজের কথা শোনা থেকে মা-ও সমানে কেঁদে যাচ্ছেন! চোখের সামনে পাশের বাড়ির অংশুকেই দেখছেন- “ছেলেটার সেই মিষ্টি হাসিটা আজ আর নেই”!
দীপ নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত এই “রানার”-এর কাজেই নেমে পড়ল। এ ‘রানার’ অবশ্য সে-কালের ‘রানার’এর মতো খালি পায়ে নয়, চাকা-পায়ে ছুটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল………..!
অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছে নিল। শুধু তাই-ই নয়, মন লাগিয়ে কাজ করে মালিকের প্রশংসাও কুড়তে শুরু করল! কাস্টমাররাও ওর সার্ভিসে বেশ খুশি। সুতরাং জীবনের প্রথম রোজগারটা বেশ উপভোগ করতে শুরু করল প্রদীপ!
তবে ভালো লাগছে না কেবল আয়নার সামনে দাঁড়াতে, যত দিন যাচ্ছে শরীরটা ততই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! বাইসেপ-ট্রাইসেপগুল আজকাল আর আগের মতো সেই ‘হিরো-ফিলিং’টা বোধ করায় না! গায়ের রংটাও কেমন যেন ঝলসে গেছে!
লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজেই আবার নিজেকে সান্ত্বনা দেয়-“ছেলেদের আবার গায়ের রং, উপার্জনটাই বড় কথা”!
*********তিনবছর পর********
বোনের বিয়ের জন্য ভালো পরিমান একটা টাকা জমিয়ে ফেলল প্রদীপ, মা-বাবা যা তো ভাবতেও পারেননি! খুশি হয়ে তাঁরা মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন। বোনের পছন্দের ছেলেকেই পাত্র হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য মা-বাবাকে রাজি করাবার দায়িত্বও নিল দাদা!
তাই ‘নাই নাই’ করে একদিন সানাই এসে হাজির হলো বাড়ির উঠানে! কষ্টেসৃষ্টে বাপ-বেটা মিলে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা নামিয়েই ফেলল!
এত দিনের ঝগড়া-মারামারি-খুনসুটি, সব পিছনে ফেলে বোন চলল শ্বশুরবাড়ি! বিদায়ের সময় প্রদীপকে একবারটিও সামনে আসতে দেখা যায়নি! দাদার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বোনও আর পিছন ফিরে তাকায়নি!
***********প্রদীপের লুকোনো কথা**************
নিজের জীবনের বিশেষ একটা কথা এতদিন কাউকেই বলেনি! আসলে নিজেরই বিশ্বাস হয়নি যে সদ্য তৈরি হওয়া নতুন একটা সম্পর্ক এভাবে দানা বাঁধতে পারে!
কাজের সূত্রে নিউ আলিপুরে ‘সন্ধ্যা’ নামে একটি মেয়ের সঙ্গে ওর একদিন আলাপ হয়। বড়লোকের একমাত্র মেয়ে, তার উপর অপূর্ব সুন্দরী! প্রদীপ ওকে এড়িয়েই চলত। কিন্তু মেয়েটিই ছাড়ার পাত্রী নয়। একদিন না দেখতে পেলেই ফোন করে পাগল করে দেয়! অনেক চেষ্টা করেও প্রদীপ ওকে বোঝাতে পারেনি- “এ সম্পর্ক এগোবার নয়”!
শেষে একদিন প্রদীপকেই হার মানতে হল! এবং ওর’ও সন্ধ্যা’র মতো অবস্থা হলো, একদিন না দেখতে পেলেই কাজে ভীষণ ভুল হয়ে যায়, আর সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায় ওর খদ্দেররা! মিস্টার ডি. সুজা’র চিকেন স্যুপ ডেলিভারি হয়ে যায় রবিন চক্রবর্তী শাস্ত্রী’র- বাড়িতে, আর রবিন শাস্ত্রী’র পনীর বাটার চলে যায় মহম্মদ আনসারীর বাড়িতে! ভেবে দেখুন, খিদের পেটে পণ্ডিত’মশাই যদি চিকেন স্যুপ হাতে পান তাহলে তাঁর মনের অবস্থাটা কী হতে পারে!
এ-ঘটনা কোম্পানির কানে গিয়ে যখন পৌঁছল তখন ম্যানেজার’মশাই কাস্টমারদের কাছে ক্ষমাঠমা চেয়ে বিষয়টি ম্যানেজ করে নেন। প্রদীপের বন্ধুরাও ম্যানেজার’সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে প্রদীপের কাজটাকে কোনোরকমে টিকিয়ে রাখে!
তবে এরকম ঘটনা আর ঘটেনি, এটাই রক্ষে!
“সন্ধ্যারতি’তে” প্রদীপের পারফর্মেন্স দিনে দিনে আরও উজ্জ্বল হতে লাগল! প্রদীপ ফুরফুরে মন নিয়ে ছুটে বেড়ায় টালিগঞ্জ থেকে বালিগঞ্জ, গড়িয়া থেকে রেনিয়া! পিঠের ভারী ব্যাগটাকেও এখন অনেকটা হালকা মনে হয়! মনে হয়- সন্ধ্যাই ওর পিঠে মাথা রেখে বসে আছে, মুখে তার শান্ত-মৃদু-হাসি!
হবে নাইবা কেন, সারা মন প্রাণ জুড়েই তো আছে শুধু সন্ধ্যা! গ্রীষ্মের মধ্য আকাশে তেতে থাকা সূর্যকেও তখন জ্যোৎস্নার চাঁদ বলে মনে হয়!
এখন একটাই ভাবনা, সব কিছু দিয়ে সন্ধ্যাকে কীভাবে কাছে পাওয়া যাবে! আদৌ পাওয়া যাবে তো!?
এসব ব্যাপারে বন্ধুরাই ভরসা।
“সন্ধ্যার বাড়িতে কিছুতেই প্রদীপকে মেনে নেবে না”-এটা তো জানা কথাই! “পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই”- এই বুদ্ধিটা অনেক আগেই সন্ধ্যা দিয়েছিল, কিন্তু ভীতুরামই সাহস পায়নি, বন্ধুরা পাশে থাকায় আজ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল!
প্রদীপের বাড়ির দিক থেকে কোনও অসুবিধা নেই। মা’কে সব বলা আছে। ছেলেদের ব্যাপারগুলো মায়েরা যেভাবে সামলায়!
ওদিকে সন্ধ্যা মা-বাবার চোখে ধুলো দিয়ে এক বন্ধুর স্কুটি চেপে নিউ আলিপুর থেকে সোজা বোড়াল-রক্ষিতের মোড়-এ পৌঁছে গেল!
******************তারপর যা হয়*******************
এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রদীপের মনে এখন ঝড় বইছে! সন্ধ্যার এভাবে পালিয়ে আসাটাকে ওর বাবা কিছুতেই মেনে নেবেন না!
ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মা বললেন- “এখন আর ভয় পেয়ে লাভ নেই খোকা; তোমরা দু’জনেই এ্যাডাল্ট, সিদ্ধান্ত তোমাদেরই নিতে হবে!
মায়ের কথায় অনেকটা ভরসা পেল প্রদীপ!
**********আজ ঘরে সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলল************
টুকটুকে একটা বাচ্চা বউ পেয়ে মা-ও ভীষণ খুশি! কেউই ভাবতে পারেনি যে বাড়িতে এমন একটা বউ আসবে!
ওদিকে সন্ধ্যার বাবাও ছাড়ার পাত্র নন, সরকারি অফিসে বড় পোস্টে চাকরি করেন। সুতরাং মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন! কিন্তু মামলা করেও কিছু লাভ হলো না, মেয়ে রাজি না হওয়ায় হার মানতে বাধ্য হলেন তিনি!
*****আজ প্রদীপের বাড়িতেই শুধু চাঁদ উঠেছে************
এতদিনে প্রদীপের মন শান্ত হলো! দু’জনের মাথাতে যেন জয়ের মুকুট জ্বলজ্বল করছে!
সন্ধ্যার ভয়-ভীতি-লজ্জা নেই বললেই চলে! থেকে থেকেই শাশুড়িমা’র সামনে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলে- “মা’গো তোমার ছেলেটা মস্ত একটা ভীতুরাম”!
এভাবেই মজার মজার সব কথা বলে, আর নিজেই হো হো করে হেসে ওঠে! ওকে এভাবে হাসতে দেখে বাড়ির সকলেই খুব আনন্দ পায়! মা সারাক্ষণ ভগবানের কাছে আকুত-প্রার্থনা করেন- “সন্ধ্যা যেন এভাবেই খোকার সবকিছু মেনে নিয়ে সারাজীবন আনন্দে থাকতে পারে”!
*********কিন্তু সুখের সঙ্গে অ-সুখ লেপ্টে থাকে**********
বছর খানেক ভালো-মন্দে কাটলেও, একটা সময়ে এসে প্রদীপ এবং প্রদীপের মা-বাবার সামান্য ত্রুটিও সন্ধ্যার কাছে বড় হয়ে দেখা দিতে লাগল! কোনও কিছুর সঙ্গেই আজকাল আর আপোষ করতে চাইছে না সে!
সন্তানসম্ভবা হতেই সেটা আরও বেড়ে গেল! তারওপর সন্ধ্যার বাবার একটা প্রস্তাব ওদের অশান্তিকে চরম পর্যায় পৌঁছে দিল-“সন্ধ্যা যদি প্রদীপকে নিয়ে চলে আসে তাহলে তিনি নিউ আলিপুরে একটা ফ্ল্যাট কিনে দিতে রাজি আছেন! ওদের সন্তান সেখানে ভালোভাবে মানুষ হবার সুযোগ পাবে”- এটা সন্ধ্যার মনে একেবারে গেঁথে গেল!
এ-ব্যাপারে প্রদীপের মা-বাবার কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু প্রদীপকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না! ও সঅব ছেড়ে দিতে রাজি আছে, কিন্তু মা-বাবাকে নয়!
ভাঙা বেড়ার ঘরে বেড়ে ওঠার সেই স্মৃতি আজও বিস্মৃত হয়নি- “বর্ষাকালে মা-বাবা ভাগাভাগি করে ছেলেমেয়ের গায়ের ওপর ছাতা ধরে রাত কাটিয়েছে! প্রচণ্ড গরমে নিজেরা না ঘুমিয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেছে! দিনের পর দিন নিজেরা না খেয়ে……!
সেইই মা-বাবাকে…….”!
অসম্ভব, প্রদীপ ভাবতেই পারছে না!
অবশেষে যা হবার তাই হলো-
কুঁড়ি সমেত আস্ত একটি ফুলগাছ খাবলে টেনে তুলে নিয়ে গিয়ে বসানো হলো অন্য একটি বাগানে।
******শুধু নিচে নয়, প্রদীপের চতুর্দিকে আজ অন্ধকার****
মা দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! বাবারও একই অবস্থা; কোনও রকমে বছর খানেক কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচা যায়, কাজ করার মতো মানসিক অবস্থা আজ আর নেই!
একটা ঝড় এসে সব তছনছ করে দিয়ে চলে গেছে!
মা আজকাল আর ঘরে সন্ধ্যা-প্রদীপ ধরায় না, কারোর সঙ্গে তেমন কথাও বলে না!
টিমটিমে আলোতে নিস্তেজ তিনটে প্রাণী দম দেওয়া ঘড়ির মতো নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে চলেছে……
তাতে না আছে প্রাণ, না আছে অভিব্যাক্তি! আছে শুধু নীরবতার আর্তনাদ!
ঘরে থাকতে প্রদীপের আর মন চায় না। সবকিছু ভুলে থাকার জন্য কাজের মধ্যেই ডুবে থাকে!
আজকাল বন্ধুদের সঙ্গেও খুব একটা মেলামেশা করে না, এড়িয়েই চলে!
সন্ধ্যা’র সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ তো দুরের কথা, কোনওরকম যোগাযোগও নেই! এতদিন হয়ে গেল ভুল করেও কেউ কাউকে ফোন করে একটা খবরও নেয় না!
এটাই তো স্বাভাবিক, সম্পর্কটাই যেখানে ভেঙে গেছে সেখানে……!
প্রদীপ কানাঘুষা শুনেছিল- ‘ভালো ঘর-বর দেখে সন্ধ্যার নাকি আবার বিয়ে হয়েছে’-
ঐটুকুই, আর কিছু জানার চেষ্টাও কেরেনি!
প্রদীপ মাঝে মধ্যেই বোনের বাড়িতে যায়, পুঁচকে ভাগ্নিটার সঙ্গে কেয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে মনটা একটু হালকা করে আসে। বোনও দাদার কষ্ট বুঝতে পারে! তাই সুযোগ পেলেই টিকলি’কে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে।
দাদাকে খুব করে বোঝায়- সব ভুলে গিয়ে নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে! কিন্তু দাদার সেই এএক কথা- “আমাদের মতো ছেলেদের কপালে ওসব ‘ঘর-সংসার’ লেখা নেই রে বোন! এই তো বেশ আছি, মা-বাবা আর টিকলি’কে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব”!
********পেটের দায়ে আবার রাস্তায়*********
শরীরটা ভাল নেই, অল্প কিছু অর্ডার ডেলিভারি করেই বাড়ি ফিরে যাবে। বালিগঞ্জের একটা পার্কের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে এল, সঙ্গে সঙ্গে বাইকটা থামিয়ে দিল প্রদীপ!
“কান্নার আওয়াজটা মনে হচ্ছে পার্কের ভিতর থেকেই আসছে……”!
ঠিক তাই, একটি বাচ্চা ছেলে সমানে কেঁদে যাচ্ছে, ওর আশেপাশে কেউউ নেই! প্রদীপ ছুটে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে!
“বাচ্চাটির বাড়ি নিশ্চই কাছাকাছি কোথাও হবে; মনে হয় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে এসেছিল, ভুল করে ওকে না নিয়েই বাড়ি চলে গেছে”-
ঠিক করল- লোকাল থানায় যোগাযোগ করে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। এসব ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করল- বাচ্চাটার কান্না থেমে গেছে, নরম দুটো হাত দিয়ে প্রদীপের গলা জড়িয়ে ধরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে!
এ-এক অদ্ভুত অনুভূতি! ওর স্পর্শ, গায়ের গন্ধ, হৃদস্পন্দন সব যেন জাপটে ধরার মতো, আগলে রাখার মতো! নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অসীম আনন্দ!
প্রদীপ থানার দিকে এগিয়ে চলল- যেতে যেতে বন্ধু অংশুকে ফোন করে ডেকে নিল।
ওরা দুজনে বাচ্চাটাকে নিয়ে থানায় ঢুকতেই কয়েকজন আনন্দে হই হই করে উঠল-
“ঐ তো দীপ! দীপকে পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে দীপকে….”!
একজন ছুটে এসে প্রদীপের কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
ওরা থানার ভিতরে ঢুকে অফিসারকে সব খুলে বলল। অফিসার বাচ্চাটার বাবার সঙ্গে প্রদীপদের পরিচয় করিয়ে দিতেই বাবা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঁদের কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকলেন!
থানার মধ্যে একটা জায়গায় জটলা হচ্ছে দেখে অংশু অফিসারকে জিজ্ঞেস করল-
”কী হয়েছে স্যার, ওখানে অত ভিড় কেন”?
অফিসার বললেন- “বাচ্চাটার মা কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই ডাক্তার ওঁকে দেখছেন”!
ওরা সহানুভূতি দেখিয়ে, নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে আসে।
প্রদীপ আবার ফিরে গিয়ে অফিসারকে বলে- “এটা ওর জন্য কিনেছিলাম, ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আর দেওয়া হয়নি, আপনি যদি দয়া করে…..
“বেশ তো, আপনি নিজের হাতেই দিয়ে আসুন না”।
প্রদীপ একা যেতে অস্বস্তি বোধ করল, অংশুকে সঙ্গে নিয়ে দু’পা এগোতেই বাচ্চাটার মা’কে দেখতে পেল! তখনও ওঁর জ্ঞান ফেরেনি!
ওরা দু’জন দু’জনের হাত চেপে ধরে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল, এগোতে আর সাহস পেল না! প্রদীপ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বাচ্চাটার বাবার হাতে খেলনাটা দিয়ে দিল! ভদ্রলোক খুশি হয়ে বাক্সটা খুলে বললেন- “বাঃ, চমৎকার! এ যে লাফিং বুদ্ধ”!
অংশু’র হাত ধরে প্রদীপ বেরিয়ে এল-
“আমায় একটু বাড়িতে পৌঁছে দিবি রে ভাই”?
অংশু বাইক দুটো অফিসারের হেফাজতে রেখে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল!
**********
ধুম জ্বর! পরেরদিন সকালে প্রদীপ একটু সুস্থ বোধ করল। বিছানাতে শুয়েই মায়ের হাতে চা খেতে খেতে বলল- “সন্ধ্যা কথা রেখেছে মা, ছেলের নাম রেখেছে-‘দীপ’!
“খোকা তুই আগেই যদি বুঝেছিলি, তবে দাদুভাইকে বাড়িতে নিয়ে এলি না কেন? দাদুভাইকে কি কোনওদিনও দেখতে পাব না”?
প্রদীপের দু’চোখ বেয়ে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে! কাঁপা গলায় মা’কে সান্ত্বনা দিয়ে বলল-
“আমার কাজটাই হলো, সঠিক জিনিস, সঠিক সময়ে, সঠিক লোকের হাতে পৌঁছে দেওয়া। তার অন্যথা করি কীকরে বলো দেখি”!
সেদিন মা খুব কেঁদেছিল! বাবাও কেঁদেছিল, লুকিয়ে!
তারপর থেকে অবশ্য ‘সন্ধ্যা’র “ভিতুরাম” আর কাঁদেনি! সারা জীবন প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছেলের মাথার কাছে, ‘লাফিং বুদ্ধ’ হয়ে!!!
—oooXXooo—