সজনেফুল (দ্বিতীয় পর্ব)
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্যামাচরণ যে একেবারেই অভাবী ঘরের ছেলে তা কিন্তু নয়। ওদের পূর্বপুরুষ ছিল গৈলার। দেশভাগের সময় চলে আসে। তবে জন্মগত আর রন্ধ্রগত শনি ওকে জর্জরিত করেছে। অনেকে আবার বলেছে “শ্যামাচরণ!তুই অষ্টম গব্বের সন্তান। তাই তোর এমন দশা। শ্যামাচরণ এসব কতবার শুনেছে। কখনও বলেছে “কী রকম কথা কও তোমারা। ভগবান কৃষ্ণ তো অষ্টম গব্বের। তার তো অমন হয় নি।
শ্যামাচরণ জন্মালে আর ওর মা মরলো। এমনিতেই মায়ের রুগ্ন শরীর তার উপরে পরপর বাচ্ছা। শ্যামাচরণ মায়ের মুখ দেখেনি। আটটা সন্তানের পিতা ওর বাপ নাটা ঝামটা খাচ্ছিল। কাজকর্ম শিকেয় উঠল। অনেক কষ্ট করে শ্যামাচরণ এর মায়ের গয়না বেচে দুকাটা জায়গা কিনে দু কুঠুরি টালির ঘর করেছিল। এখন কাজকর্মের বালাই নেই। মেয়েটার বয়স বারো হয়েছে। অত কাজ পারে না।
ওদের বাড়ির পাশেই থাকত সুবোধ ঘোষ। শ্যামাচরণ এর বাপকে কানে ফুসমন্ত্র দিলে আবার বিয়ে কর। সেই শুরু হল শ্যামাচরণ এর দুর্দশা। খেটে খেটে বাপের যক্ষা হল। সাতান্ন বছর বয়সে বাপ গেল। আর সতের গুষ্টি আবার প্রথম পক্ষ। ওই তো দুকাটা জমি। খাসজমিতে ঘর বাঁধলে শ্যামাচরণ। তার এই হাল। এখন যদি এই কেষ্ট চাটুজ্জের মনের মতো থাকতে পারে তবে রক্ষে।
এবার শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। গিন্নিমার পায়ে বাত। ব্যথা বেড়ছে। সকালে ফুল তুলতে ওঠে নি দেখে শঙ্করীর একটু চিন্তা হল। এই সাতসকালে ঠান্ডার মধ্যেও স্নান করে দাদু ঠাগমা। ওদের গৃহদেবতা তো একটা নয়। ফুল লাগে অনেক। শঙ্করী বাসি জামা ছেড়ে ফুল তুলতে লাগল। কতরকমের ফুল। শিউলিফুল এখন ছোট্ট হয়ে আসছে। নৈলে শিউলিফুল থাকলে ফুলের চিন্তা নেই। সাদা ফুল চাই ।জবা চাই। সরস্বতীর সাদাফুল। আবার মা কালীকে রক্তজবা। মনে মনে হাসে শঙ্করী। যে ঠাকুর যে ফুল চায়। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। এই সংসারে পাঁচটা আঙুল তো আর সমান নয়।
ফুল নিয়ে গিন্নিমার কাছে গেল শঙ্করী। গিন্নিমার এক মুখ হাসি। বললে “এই ঠান্ডাতে ব্যথা বাড়ে। বেশি বেলা হলে ফুল পাই না। তুই সকালে ফুল তুলে দিবি। আর পশুপতিনাথের বেলপাতার মালা গাঁথবি। দেখবি তোর ভালো ঘর হবে বর হবে”।
বড় হাঁড়িতে ভাত বসেছে বড় বাড়িতে। তিনটে বৌ কেমন মুখ বুজে কাজ করে যায়। বড় বৌ বাটনা বাটছে। আর কোলের ছেলেটা কেঁদে চলেছে এক নাগাড়ে। শঙ্করী বাচ্ছাটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে। বড় বৌ মনে মনে খুশি হয়। সেজ বৌ চা করছে। বিরাট কেটলিতে চা। এতবড়ো গুষ্টি। সবাই চা খাবে। সেজ বৌ বেশসুন্দরী। হাসিমুখ করে বললে “চা খাও শঙ্করী”।একটু পড়েই হুলুস্থূল। পাঁচুর মায়ের মায়ের দয়া হয়েছে।আজ আসবে না।
এতবড় একটা সংসারে বাসনের গাদা। কে মাজবে এই এঁটোকাটা। বৌদের মুখ ভার। গিন্নিমা বললে “যা না শঙ্করী। বাসনকোসন গুলো মেজে দে। খিড়কি পুকুরে নিয়ে যা মা”।
শঙ্করী গেল। বাসন মাজতে মাজতে গান ধরে
“দিশেহারা কেমন বোকা
মনটা রে।
প্রাণ পাখি মোর উড়ান যায় রে”।
আজ সবাই খুব খুশি শঙ্করীকে পেয়ে। সংসারের অনেক কাজ করে দেয় শঙ্করী। পাঁচুর মা নেই। তার সব কাজ শঙ্করীর উপরে বর্তালো। আর শঙ্করীর মনে হল এই বাড়ির সাথে তার অনেক দিনের যেন সম্পর্ক। সকালে একটা বিরাট সানকিতে আলু কসটাচ্ছে মেজ বৌ। পেঁয়াজ কুচি,লঙ্কা কুচি দিয়ে । বাসনকোসন মেজে উপুর করতেই একথালা গরম ভাত এল । বড় বৌ বললে “খেয়ে নে শঙ্করী। তার পর ঘরদোর মুছে দিস।”
শঙ্করীর মনটা হু হু করে। অমন সরু চালের ভাত। সাথে মাছভাজা,আলুমাখা। গিন্নিমা বলে “ওই দেখো। মেয়েটার কান্ড দেখো। ভাতের দিকে তাকিয়ে ভাবনা। দাঁড়া। তোকে একটু ঘি দিই। “
গিন্নিমা কাল ঘরে ঘি বানিয়েছে। এদের অঢেল দুধ। একটা ছোট্ট শিশি এগিয়ে দেয়। বলে “ভাতে একটু মেশা। খুব সোয়াদ হবে”।
শঙ্করীর মনে ভেসে ওঠে ওর ছোট্ট বোন দুটোর মুখ। খেতে গিয়েও বসে থাকে। কত বড় একটা মাছের টুকরো দিয়েছে। এদের আজ পুকুরের মাছের ভাগ এসেছে। বড় বড় দুটো বালতি ভর্তি মাছ। গিন্নিমা বললে “খেয়ে নিয়ে মাছ বেছে দিবি। আর একটা বড় রুইমাছ তোর বাড়িতে নিয়ে যাবি। বসে রৈলি কেন। খাবি তো”।
শঙ্করী লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললে ” ভাত কটা বাড়িতে নিয়ে যাবো গো ঠাকুর মা। “
গিন্নিমা বললে “অ। এখানে খেতে তোর লজ্জা বুঝি! বেশ। নিয়ে যা। আর মাছটা নিতে ভুলিস না যেন “।
শঙ্করী বাড়ির দিকে ছুটল। কত বড় একটা মাছ। ভাত টা তুলে দিলে বোনদের মুখে। মাছ এসেছে আজ বাড়িতে। যেন উৎসবের দিন আজ। কতদিন কচুভাজা,মানভাতে খেতে খেতে মনে হয়েছে এই সমাজ একরকম নয়। জলখাবারের আয়োজন হীন বিকেলে যারা চিবিয়েছে গাছের নীচে পড়ে থাকা পাকা তেঁতুল। তারা সমাজের সেই মানুষ গুলোর একজন যাদের নিরাপত্তার আবেষ্টনী নেই। আছে শুধুই হৃদয়। সকলকে আপন করতে চায়। ওর নাম শঙ্করী। স্বয়ং মা অন্নপুন্নে।এরকম কত শঙ্করীর নাম শুধুই ব্যঙ্গ করে। শ্যামাচরণ নাপিতের অশিক্ষিত বড় মেয়ে শঙ্করী আজ কোন শক্তিবলে যেন ওদের সংসারের অন্নপুন্নে হয়ে গেছে।
সব কাজ সেরে শঙ্করী খামারে গেল। কত সজনেফুল। সাদা ধবধবে। এই সাদা রঙ যেন শুভ্রতার পবিত্রতার। বাড়িতে গিয়ে রান্না করবে শঙ্করী। সজনেফুল দিয়ে বেসনবড়ির ঝাল। সাথে পাকা রুইমাছের ঝোল। তোফা খাওয়া। এক কোঁচল সজনেফুল। বাড়ি গিয়ে দেখে তার মেসো হরিপদ এসেছে। শঙ্করী বললে “এখানেই খেয়ে নেবে আজ।”
আজকাল সকলের খিদে বেড়েছে। শঙ্করীর হাতের রান্না তো নয়। যেন অমৃত।
ঘরের একপাশে হরিপদ কী যেন বলে শ্যামাচরণ কে। শঙ্করীর কানে আসে “আমার তো কিছুই নেই। খরচাপাতি কেমন করে করব”?
শঙ্করীর মনে আশঙ্কার উদয় হয়। কী বলতে চাইছে তার মেসো অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। বুঝে উঠতে পারে না।
পরের দিন কাকভোরে উঠে শঙ্করী ফুল তোলে। তারপর ধান সেদ্ধ করার কাজে লাগে। গিন্নিমা বলে দু বস্তা ধান সেদ্ধ শুকনো করে দিলে তোকে পাঁচকেজি সরুচাল দেবো। শঙ্করী কাজ করে। ধান একভাপনা করে ঠান্ডা জলে চুবিয়ে দেয়। শ্যামাচরণ এর খাবারের অভাব ঘুচল। তার ঘরে শঙ্করী স্বয়ং উপস্থিত।
দেখতে দেখতে পৌষমাস এসে গেল। কত পিঠে পুলি হল। সবাই খেলে। শঙ্করী চাল গুঁড়িয়েছে শিলে। শঙ্করীর মুখখানা বেশ ডাগর হয়েছে। গিন্নিমা বেড়াতে যাবে সেই বীরভূম। ওখানে জয়দেব কেঁদুলির বিরাট মেলা। কত বাউল আসবে। আর ওই মেলায় কী না পাওয়া যায়।
শঙ্করীর খুব ইচ্ছা ছিল বীরভূম যাবে। গিন্নিমা বললে “তুই গেলে এখন হবে না। তোকে পরের বছর নিয়ে যাবো”।শঙ্করীর কত আগ্রহ। বললে “আচ্ছা ঠাকুর মা। ওখানে বুঝি সব বীরেরা থাকে”?
গিন্নিমার হাসি ধরে না। বলে “বীর থাকে না কাপুরুষ থাকে জানি না বাপু। তবে নাম যখন বীরভূম তখন নিশ্চিত কোনও ইতিহাস আছে বৈকি!”
কেষ্ট চাটুজ্জে বললে “ওখানকার রাজা ছিলেন বীরমল্ল। তাই অমন নাম। “
ঠাকুর আর ঠাকুরমা চলে গেল। আর শঙ্করী স্বপ্নে দেখলে এক সুঠাম যুবক, কী সুন্দর তাকে দেখতে !শঙ্করীকে ডেকে বলছে “তুমি শ্যামাচরণ পরামানিকের মেয়ে শঙ্করী তো।”?
শঙ্করীর মুখে কথা আটকে যায়। ওমা! যুবকটি শঙ্করীর হাত ধরেছে। বলছে “চলো শঙ্করী। “
শঙ্করীর ভয় হয়। বলে কোথায় যাবো? না না। আমি কোথাও যাবো না। আর তুমি কে গা”?
যুবকটি হাসল। বললে “আমাকে চিনতে পারছো না! আমি বীরভূমের রাজা গো রাজা। আমার নাম বীরমল্ল”।
শঙ্করী ঘুমের মধ্যেই না না করে। মা ধাক্কা দেয় “ও শঙ্করী! ঘুমের মধ্যে কী বিড়বিড় করিস বল দিগি?”
শঙ্করীর ঘুম ভেঙে যায়। মনে মনে হাসে। পুলক জাগে। ঠাকুর মা বলেছিল ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যিই হয়।
ইদানিং হরিপদর যাতায়াত বেড়েছে। ঘটকালি করে ও। আর শঙ্করীর বিয়ের বয়স হয়েছে। তবে ওর আগ্রহ এত কেন! নিশ্চয়ই কোনও অভিসন্ধি আছে।
শঙ্করী সেদিন ফুলকপি দিয়ে ডিম রাঁধছিল। হঠাৎই হরিপদর আবির্ভাব।
সন্ধ্যার সময় হরিপদ এসেছে দেখে একটু বিরক্ত হল শঙ্করী। আবার কী মতলব আঁটছে কে জানে। হরিপদ হাসতে হাসতে বললে “অত ডিম কোথায় পেলি রে?”
শঙ্করী জানাল সে হাঁস পুষেছে। হরিপদ বললে “আজ একজন এখানে আসবে। রাতে খাবে। বেশি করে রান্না কর দিকি”।
শঙ্করীর গা জ্বলে যায়। এই তো সবে ধন নীলমণি একটা ঘর। এরমধ্যে নিজেদের নড়বার জায়গা হয় না। তবু মুখের উপর কথা বলতে শঙ্করীর কোথায় যেন বাধে। বললে “কে আসবে গো মেসো”?
মেসো তড়িঘড়ি উত্তর দিলে “তোকে দেখতে আসবে। পছন্দ হলে একপয়সা লাগবে না। পৌষ সংক্রান্তি আজ। আগামী দোসরা মাঘ বিয়ের ভালো দিন আছে কি না’।
ফ্যালফ্যাল করে তাকায় শঙ্করী। এ কী পরীক্ষার সম্মুখে পড়ল সে। আর বাপ শ্যামাচরণ ওদের কথায় উঠছে বসছে। দাদু ঠাকুর মা কেউ নেই। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায় হরিপদ। নিশ্চয়ই ওর কিছু ফায়দা আছে।আকাশ পাতাল চিন্তার মধ্যেই পাত্র বাবাজির প্রবেশ ঘটল। বেশ রাশভারী যুবক। দেখতেও যেন ময়ূর ছাড়া কার্তিক ঠাকুর টি। কেমন কোঁচকানো চুলের বাহার। পোশাক পরিচ্ছদ বেশ মার্জিত।
(ক্রমশ)