সামাজিক গল্প
ভাবনাই ভবিষ্যৎ
নবু
একটা সাধারণ রাত। শহরের এক শেষ বাসে একজন প্রোগ্রামার অচেনা এক মানুষের সাথে পরিচিত হয়, যার জীবনে রয়েছে অজানা দিশা আর রহস্য। এই অচেনা মানুষটি তার সাথে শেয়ার করে এক অদ্ভুত পরামর্শ—কিভাবে একটি ছোট্ট আইডিয়া থেকে বড় কিছু তৈরি করা যায়। কিন্তু কি সে পরামর্শ? কিভাবে একজন সাধারণ মানুষ সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে, যখন তার হাতে শুধু অল্প কিছু টাকা আর একদম শূন্য বিনিয়োগ থাকে? একটি নির্ধারিত রাতের আলো কি সত্যিই ভবিষ্যতের পথ দেখাবে?
যদি আপনি জানতেন, আপনার কাছে শুধু একটাই সুযোগ — সেই সুযোগকে কিভাবে কাজে লাগাবেন? গল্পে মিশে রয়েছে সেই উত্তরের সন্ধান, যেখানে থাকে জীবনের অদ্ভুত মোড়, আর এক অচেনা বন্ধুর মাধ্যমে পাওয়া জীবনের নতুন দিশা। এটি শুধুমাত্র একটি গল্প নয়; এটি একটি জীবনধারা, যে জীবনের পথ বেছে নেয়া যায়…
নিশি রাতের শেষ বাসটা বেলেঘাটার মোড় থেকে কাঁপতে কাঁপতে ছাড়ল। বাসের গা ঘেঁষে ফুরফুরে হাওয়া ছুটছে, জানালার কাঁচে মাঝে মাঝেই ঝনঝন করে রুক্ষ শব্দ, আর বাসের ভেতর ফাঁকা চেয়ারগুলোয় কয়েক জন ঘুমিয়ে পড়েছে। গোটা বাসে গুনে গুনে মাত্র দু’জন যাত্রী জেগে আছে।
একজন, কাঁধে নীল ব্যাগ ঝোলানো, চশমার কাঁচে বাসের আলো-অন্ধকারে ঝিলিক খাওয়া এক তরুণ প্রোগ্রামার। মনে মনে হিসাব কষছে—কালকের কোড রিভিউয়ে কি করে বসের হাত থেকে বাঁচা যায়! চাকরির শ্বাসরুদ্ধকর নিয়মে কাঁচা ঘুম ছুটছে তার। প্রতিদিনের এই চিন্তাই তাকে নাজেহাল করে দিচ্ছে।
আরেকজন, সাদা চুলের উপর নরম আলো পড়ে এমন জ্যোতি ছড়াচ্ছে, যেন কোনো সাধু-সন্ন্যাসীর বা দাদু ঠাকুরদার সাক্ষাৎ মূর্তি। দেখে মনে হচ্ছে কোন বিদেশী মানুষ, পরনে হালকা সাধারণ পোশাক, আর মুখে এমন ছলাকলা-ভরা হাসি, দেখে মনে হয় জীবনটাকে তিনি একটু বেশি সিরিয়াসলি নেন।
বাসটা চলতে চলতে হঠাৎ একটা গোঁত্তা খেল, আর সেই সাথে ভদ্রলোকের প্রশ্ন:
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি একজন কম্পিউটার-টম্পিউটারে তুখোড় মানুষ!”
প্রোগ্রামার একটু চমকে উঠে হেসে ফেললেন। বললেন,
“হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, আমি আইটি লাইনে কাজ করি।” সরদিন আমাকে শুধু ভাবতে হয় আজকের দিনটা গেল, কিন্তু কালকের জন্য কি? এই আইটি লাইনে কাজ যারা করেন তাদের জন্য দিন রাত্রি সমান, প্রতি মূহুর্তে তাদের আপডেট থাকতে হয়। আমাদের মত মানুষের প্রতি মানুষের আকুল চাহিদা। তা পূরণ করা আমাদের দ্বায়িত্তের মধ্যে মড়ে।
ভদ্রলোক খিলখিলিয়ে হেসে বললেন,”তাই বলি! এই চশমার কাঁচে যে ধেবড়ে যওয়া দৃষ্টি, সেটা তো শুধু কোডারেরাই বহন করতে পারে।”
এদিকে প্রোগ্রামার হালকা মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলেন, “ভদ্রলোক তো দেখি মনের কথা পড়ে ফেললেন!”
ভদ্রলোক এবার একটু গম্ভীর হয়ে, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “শোনো ভাই, তোমরা সারাদিন কোড লেখো তাতেও তোমরা গাড়িব, কিন্তু আসল টাকা কামায় তারা—যারা মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। আইডিয়া থাকলেই হলো না, সেটা বিক্রি করাটাই বড় আর্ট।” তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার তোমার আইডিয়াকে এক রঙিন মোড়কে মুড়ে বিক্রি করতে।
প্রোগ্রামার কৌতূহলী হয়ে একটু সামনে ঝুঁকলেন। ভদ্রলোক কথাটা লুফে নিয়ে শুরু করলেন: “ব্যবসা মানে হচ্ছে—একটা ছোট্ট কল্পনাকে এমন সাজিয়ে পেশ করা, যেন মনে হয় এটাই জীবনের মোক্ষ। যেমন ধরো, যদি আমি বলি—এই পাউরুটির মধ্যে এমন বিশেষ খনিজ আছে, যা খেলে তুমি ইন্টারভিউতে তিনগুণ বেশি আত্মবিশ্বাসী হবে—তবে বাজারে বিক্রি বাটা হয়ে যাবে গরম গরম সিঙাড়ার মত”! শুধু লোকেরা চাইতে থাকবে। দেখবে প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে ২০% এক্সট্রা। তুমি কখনো ওজন করে দেখেছ, সত্যি এক্সট্রা আছে কিনা! না কেউ দেখে না। শুধু লেখাটা দেখে। ২০% এক্সট্রা ।
প্রোগ্রামার এবার সত্যিকারের মজা পেয়ে গেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বেস মজা করে কথা বলেন, তা আমি বলছিলাম “তাহলে কি শুধু মিথ্যে গল্প বললেই হয়ে যাবে?”
ভদ্রলোক চোখ টিপে প্রথমে হাসলেন তারপর বললেন, “মিথ্যে বলব কেন? বাস্তবের সঙ্গে একটু কল্পনার রঙ মিশিয়ে দিতে হয়। যেমন ধরো, মোবাইল অ্যাপ বানাচ্ছো—খালি ফিচার গুঁজে লাভ নেই। তার সঙ্গে একটা গল্প জুড়ে দাও। ধরো, তুমি লিখলে এই অ্যাপটা ব্যবহার করলে ‘হারিয়ে যাওয়া শৈশবের আনন্দ’ ফিরে পাওয়া যাবে। ব্যাস, দেখবে বুড়ো থেকে কাঁচা সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে!” তুমি লিখতে পার “আপনার সব প্রশ্নের উত্তর এক নিমেষে” দেখবে তার কত চাহিদা।
তুমি যদি প্রত্যেক বার ব্যবহারের জন্য মাত্র এক টাকা নাও দেখবে প্রতিদিন তোমার ইনকাম মাস মাহিনার সমান বা ছাড়িয়ে যাবে। সেদিন তোমায় সবাই বলবে তুমি একজন উদ্যোগপতি!
বাস তখন উল্টোডাঙা ক্রস করছিল। বাইরের অন্ধকারে দোকানের নামের সাইনবোর্ড গুলো মাঝে মাঝে ঝিলিক মারছে—ঠিক যেন রাতের রাজপথও এই রহস্যময় কথোপকথনের অংশ করে নিচ্ছে নিজেকে।
ভদ্রলোক আরও বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা কি জানো? বাজারে যা নেই, সেটা বানিয়ে দাও, অথচ মানুষের চাহিদা আছে। “যেমন চায়না করে থাকে”। মানুষ তার দরকার নেই জেনেও কৌতূহলে কিনে নেবে। যেমন, ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শরীরচর্চা’ করানোর ম্যাট্রেস বানালে কেমন হয় বলো? সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে আটপৌরে রামদেবের বদলে নিজেকে মডেল মশাই ভাববে!” এয়াই কে ব্যবহার করে সমস্ত পৃথিবীর রান্নার রেসিপি যোগ করে দাও, দেখবে অধিকাংশ মানুষ তোমার অ্যাপ ডাউন লোড করেছে। ব্যাস তোমার কেল্লা ফতে। এবার বুদ্ধি দিয়ে তাকে প্রতি মাসে আপডেট করে দাও।
আবার এটাও করতে পার, এমন একটা কোচিং সেন্টার বা স্কুল যেখানে বিশেষ কয়েকটা সাবজেক্ট ছাড়া সমস্ত কিছুর প্রযুক্তি সেখান হবে। সেখান থেকে যারা পাস করে বের হবে তারা কোনদিন চাকরি চাইবে না বরং চাকরি দেবে। দেখবে বেকার সমস্যা বেকররাই মিটিয়ে ফেলবে। অপেক্ষা শুধু তাদের ধরিয়ে দেওয়া।
প্রোগ্রামার তো মুগ্ধ! এই ব্যতিক্রমী গুরু যেন তাকে জীবনের নতুন গতিপথ শিখিয়ে দিচ্ছেন।
ঠিক তখন বাসটা একটা গর্তে পড়ে ঝাঁকুনি মারলো। প্রোগ্রামার সামলে উঠে দেখলেন—ভদ্রলোক নেই! যেন বাতাসে মিলিয়ে গেলেন।
তিনি ছুটে জানালার বাইরে তাকালেন। অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে শুধু কিছু অস্পষ্ট আলো। রাস্তার ধারে উড়তে থাকা একটা ভেজা পোস্টার চোখে পড়লো। তাতে লেখা—”তোমার ভাবনাই তোমার ভবিষ্যৎ! এখনই শুরু করো!”
প্রোগ্রামার হেসে উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন, “হয়তো সত্যি, আমার ছোট্ট আইডিয়াটাই একদিন বিশাল কিছু হবে… হয়তো এই রাতই ছিল আমার জীবনের আসল টার্নিং পয়েন্ট।”
বাস এগিয়ে চলল, আর নতুন একটা স্বপ্ন, নতুন একটা সাহস বুকের মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠলো। সে বন্ধু বান্ধব, প্রেমিক প্রেমিকা সব কিছু দিনের জন্য ভুলে যেতে শুরু করল। শুধু কাজ আর কাজ।
বাস থেকে নেমে প্রোগ্রামার হাঁটতে হাঁটতে নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাটের দিকে এগোলেন। রাতের শহর এখন ঘুমাতে চাইছে, কিন্তু তার মনের মধ্যে একেবারে উল্টো ব্যাপার। মাথার ভেতর যেন রঙ-বেরঙের বেলুন উড়ছে—প্রতিটা বেলুনে একটা করে আইডিয়া!
“ছোট্ট একটা আইডিয়া… বড় ব্যবসা… গল্পের মোড়কে বিক্রি…”—এই কথাগুলো তার মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকটা নাগরদোলার মত।
ঘরে ঢুকেই সে খাতা-কলম বের করলো। লিখতে শুরু করলো—
“একটা অ্যাপ, যেখানে মানুষ নিজের ছোট ছোট সাফল্য রেকর্ড করতে পারবে। যেমন, আজ এক গ্লাস জল কম খরচ করলাম, বা পাঁচ মিনিট বাড়তি হাঁটলাম… ছোট্ট জয়গুলো একত্র করে মানুষকে বড় স্বপ্ন দেখতে সাহস দেবে!”
আথবা ধরুন আগামী পরীক্ষায় তোমার সম্ভাব্য প্রশ্ন – সঙ্গে উত্তর দশ রকম ভাবে লেখা। তুমি যেটা খুশ নিতে পারো। প্রত্যেকটা লেখায় তথ্য দিয়ে ঠাসা ও নির্ভুল।
চোখেমুখে যখন তোমার আলোর ঝলকানি। সে মনে মনে ভাবল, “এর নাম দেব… ‘ছোট জয়’। একটা একটা ছোট জয়, মিলিয়ে হবে বিশাল সাফল্য!”
পরদিন সকালে, ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতেই ফোনে প্রোটোটাইপ বানানো শুরু করলো। অফিসের কাজের ফাঁকে, লুকিয়ে-চুরিয়ে নিজস্ব ‘প্রজেক্ট ছোট জয়’ এ সময় দিল। এমনকি লাঞ্চের সময় সহকর্মীদের মধ্যেও একটু আধটু ঝাড়লো আইডিয়ার কথা।
কিছুদিনের মধ্যেই টুকটাক করে একটা মজার, ঝকঝকে অ্যাপ বানিয়ে ফেলল। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে রিলিজ করলো।
হঠাৎই দেখা গেল—মানুষ পাগলের মতো রেজিস্ট্রেশন করছে! কেউ লিখছে—”আজ ছাদে উঠে সূর্যোদয় দেখলাম”, কেউ লিখছে—”প্রথমবার রান্না করলাম—বাসনপত্র না ভেঙেই!”
অ্যাপে সবার হাসিমুখের ছোট ছোট গল্প জমতে শুরু করল। ঠিক যেমন বাগানে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটায় নতুন নতুন কুঁড়ি ফোটে।
এদিকে, মনের মধ্যে সেই অচেনা রাতের ভদ্রলোকের কথা বারবার ভেসে উঠছে। প্রোগ্রামার মনে মনে ভাবলো—”ভদ্রলোক যদি আজ থাকতেন, তবে নিশ্চয় বলতেন, ‘দেখেছো তো? স্বপ্নের দাম দাও, পৃথিবী তোমাকে মাথায় তুলে নেবে!'”
একদিন সকালে, জানালার ধারে বসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ একটা ইমেইল এল। খুলে দেখে, এক নামী বিনিয়োগকারী সংস্থা তার অ্যাপে বিনিয়োগ করতে চায়! চোখ কচলে আবার পড়ল—সত্যি, ভুল দেখছে নাত।
পরদিনের সকালটা যেন দুধে ভেজানো রোদে গা ভাসানোর মতন। বন্ধু-বান্ধব, অফিসের কলিগ—সবাই এসে হইচই শুরু করল। কেউ বলল—”তোকে তো এখন বস বলতে হবে!” কেউ বলল—”চা-তরকারির টাকাটা এখন থেকে তোর পকেটে দেব!”
ছোট একটা চা পার্টির আয়োজন হল। কাঁচের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা চা, পাউরুটি-আলুর চপ, আর অসংখ্য হাসির গল্পে ভরে উঠল ঘরটা। বন্ধুরা তাকে মাঝখানে বসিয়ে মাথায় ছাতা ধরলো—সিম্বলিক ভাবে রাজা বানিয়ে দিল।
সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো—”জয় হোক আমাদের ছোট জয়ের!”
প্রোগ্রামার সেই মুহূর্তে, গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চোখ বন্ধ করে মনে মনে সেই রহস্যময় ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনি যেখানে থাকুন, শুনতে পাচ্ছেন তো? আমার ছোট্ট জয় আজ সত্যি হলো!”
আরও আশ্চর্যের কথা—চা দোকানের পাশের পুরনো পানের দোকানের দেয়ালে, অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে থাকা একটা সাইনবোর্ড চোখ পড়লো—”বিশ্বাস করো, তোমার ভাবনাই তোমার ভবিষ্যৎ!”
ভেতরে ভেতরে হাসতে হাসতে সে ভাবলো, “এই শহরটা হয়তো মাঝরাতে এখনও কিছু পুরনো জাদু বয়ে আনে।”
বাসের সেই রাতের দেখা-অচেনা মানুষ? হয়তো তিনি কোনো জাদুকর, হয়তো কোনো সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ, অথবা… হয়তো ভবিষ্যতেরই এক নিঃশব্দ বার্তাবাহক।
শহর তখন রোদে ঝলমল করছে। আর তার বুকের ভেতর একরাশ আনন্দ, সাহস আর হাজারটা নতুন আইডিয়া নিয়ে একটা নতুন সকাল শুরু হচ্ছে।
—oooXXooo—