“শিশুদের মোবাইল আসক্তি: ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত”
ডাঃ রঞ্জন কুমার দে
আজ যে বিষয় টা নিয়ে লিখতে বসেছি তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে শুধু যে মানসিক ও শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য করে তুলছে তাই নয়, এর সুদূর প্রসারী প্রভাব আমাদেরকে দিন দিন স্বার্থপর এক অসামাজিক জীবে পরিণত করছে। আজ আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যে যেভাবে মোবাইলের প্রতি আসক্তির বিষ ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হারাবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নামক এক যন্ত্র দানব ক্রমশ গ্রাস করছে এ পৃথিবীর ভবিষ্যতকে। ছোটবেলায় একটা রচনা আমরা পড়তাম, “বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ”? আজ মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ ব্যবহার যেভাবে শিশুদের মন মানসিকতা, বিকাশ কে ব্যাহত করছে তাতে এই প্রশ্নটাই প্রকট হয়ে উঠছে। তার সমাধানের চাবিকাঠি ও কিন্তু আমাদের হাতেই আছে।
মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে কি এমন হলো যে বাচ্চা একটু মোবাইল ঘেঁটেছে বলে এভাবে রে রে করে উঠতে হবে, সামান্য মোবাইল ফোনই তো দেখছে, চুরি চামারি বা মাদকের নেশা তো করছে না। কিন্তু দুঃখিত স্যার বা ম্যাডাম, ঠিক আপনার সাথে সহমত হতে পারলাম না, যারা এই মানসিকতা পোষণ করেন তারা হয় মূর্খের রাজ্যে বসবাস করেন অথবা বলতে পারেন মোবাইল আসক্তির ক্ষতিকারক দিকটা বোঝার বোধবুদ্ধি টাই তেনারা হারিয়ে ফেলেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে যে স্মার্ট ফোনের আসক্তি বা ইন্টারনেট গেম শিশুদেরকে মাদকের থেকেও বেশি আসক্ত করে তুলছে। ভার্চ্যুয়াল এন্টারটেইনমেন্ট দেখার সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরিত হয়। এই ডোপামিন আমাদের মনে ভালো লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। আসক্তি তৈরি করে। অন্যদিকে অনবরত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়, যার ফল স্বরূপ আমাদের স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি নষ্ট হতে শুরু করে।
হাওয়ার্ড জেকবসন নামে, বুকার পুরস্কার জয়ী এক ব্রিটিশ লেখক। তার গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে টুইটার সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত, মূর্খ হয়ে যাবে, তাদের মধ্যে থেকে পড়াশুনার অভ্যাস টাই চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে,মনোযোগ চলে যাচ্ছে ওই বোকা বাক্স গুলোর পর্দায়। শুধু তাই নয় বয়স্করাও ঝুঁকে পড়ছেন ওই মোবাইল, ইন্টারনেট এর রঙিন দুনিয়ায়। গবেষণায় বলা হয়েছে যে গতবছর ৪৩ শতাংশ মানুষ কেবলমাত্র একটা বই পড়েছেন। কৈশোরের ছেলে মেয়েরা দিনের ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা স্মার্ট ফোন নিয়ে ডুবে থাকছে।
বর্তমানে বিশ্বের ৯২ শতাংশ লোকের হাতে মোবাইল ফোন আছে। এর ভেতর ৩১ শতাংশ কখনোই তাদের ফোন বন্ধ করে না। শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় ৩ গুণ। শিশুদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশের মারাত্মক স্মার্টফোন আসক্তি রয়েছে। অন্যদিকে মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে। আরও দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন মায়ের ৪ জনই সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তি সম্পর্কে অবগত নন, এবং বাকিরা অবগত কিন্তু তাদের মধ্যে একটা শ্রেণী তাদের ছেলেমেয়েদের মোবাইল আসক্তি কমাতে না পারার যন্ত্রণায় ভুগছেন, আর এক শ্রেণী সেই আসক্তি কাটাতেই চাননা।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ছাত্রছাত্রীদের একাংশ শুধু সমাজমাধ্যমই নয়, নানা অ্যাপভিত্তিক গেম, পর্নোগ্রাফি ভিডিয়ো, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার’সহ নানা খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে শুধু তাদের শারীরিক মানসিক সমস্যারই সৃষ্টি হচ্ছে না, তারা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে, স্কুলে বা পরিবারে বদলে যাচ্ছে তাদের আচার-আচরণও। কয়েক বছর আগে ‘ব্লু হোয়েল’ নামে এক অনলাইন গেমের দৌলতে বিশ্ব জুড়ে বহু তরুণ-তরুণী আত্মহননে প্ররোচিত হয়েছিল, তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এ দেশেও।
টেক্সাসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অল্পবয়সিরা মোবাইল ফোনে এক বার আসক্ত হলে তা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। এতে তাদের আত্মসম্মানবোধ ও কর্মক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি, পারস্পরিক সম্পর্ক সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠছে।মোবাইল ফোনের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের এই আসক্তির পিছনে রয়েছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সমাজমাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ। অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করছেন, অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার ধূমপান ও অ্যালকোহল পানের আসক্তির থেকেও বিপজ্জনক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোন ম্যানিয়ার প্রকোপ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এখনই তা প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে স্মার্টফোন ব্যবহার আমাদের সামাজিক এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণ দক্ষতাকে প্রভাবিত করতে পারে, আমাদের ঘুম ব্যাহত করতে পারে এবং আমাদের অলস চিন্তাবিদ করে তুলতে পারে।
শিশুরাও এই ডিভাইসগুলি ক্রমশ বেশি ব্যবহার করছে, যার ফলে বিশেষজ্ঞরা বিকাশের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। JAMA পেডিয়াট্রিক্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তিন বছরের মধ্যে শিশুদের ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময় কাটানোর পরিমাণ ৫২% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশুদের মোবাইল ব্যবহার মস্তিষ্কের উপর দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব ফেলে।
আসুন দেখে নেওয়া যাক, মোবাইল আসক্তির কারণে মস্তিষ্কে যে প্রভাবগুলো দেখা যায়:
১. মোবাইল ব্যবহারের কারণে মনোযোগের অভাব হয় এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যায়।
২. অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে মানসিক চাপ বাড়ে, যা উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের অনেক নেতিবাচক স্বাস্থ্যগত পরিণতি রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মানসিক অসুস্থতা যেমন প্যানিক অ্যাটাক, বিষণ্নতা ইত্যাদি।
৩. বিভিন্ন মোবাইল থেকে নির্গত নীল আলোর তরঙ্গ মেলাটোনিন নামক হরমোনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, সার্কাডিয়ান ছন্দ নামক মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ঘুম-জাগরণ চক্রকে বিপর্যস্ত করে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, যা ঘুমের অভাব এবং মানসিক ক্লান্তি তৈরি করে।
৪. মোবাইল আসক্তি মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষমতা।গবেষকরা এই প্রভাবকে “মস্তিষ্ক নিষ্কাশন অনুমান” বলে অভিহিত করেছেন। মূলত, যদি আমরা জানি যে কোনও তথ্যের উৎস সহজেই পাওয়া যায় তবে আমাদের নিজস্ব জ্ঞানীয় সম্পদের উপর নির্ভর করার সম্ভাবনা কম থাকে। ফলস্বরূপ স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং শেখার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে।
৫. মোবাইল মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক দক্ষতার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পার। আজ আমরা কোনো কিছুর জানার বা বোঝার প্রয়োজন হলেই গুগল কাকা বা সাম্প্রতিক এ আই( AI )মামার শরণাপন্ন হই, এই অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা আমাদের মানসিক অলসতার দিকে নিয়ে চলেছে অনবরত। শিশুরা আত্মবিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলছে।
৬. অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে ঘাড়, কাঁধ এবং চোখের সমস্যা হতে পারে। ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ তরুণী ব্যাক পেইন বা মেরুদণ্ডের না না সমস্যায় ভুগছেন। মেরুরজ্জুর উপর অতিরিক্ত চাপের ফলে এমনটি হচ্ছে।
৭. স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও নমনীয়তা কমে যেতে পারে
৮. স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়, যা আসক্তি তৈরি করতে পারে।
৯. আসক্তি এবং স্ট্রেস উভয়ই মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের কার্যকলাপ হ্রাস করে, যা মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে
১০. অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে এবং মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
১১. শুধু তাই নয় এই অতিরিক্ত স্ক্রীন টাইম, নিষ্ক্রিয় জীবনযাত্রার দিকে ছোটদের ঠেলে দিচ্ছে, যা স্থূলতা, হৃদরোগ এবং হাড়-পেশী সম্পর্কিত সমস্যা সহ বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে যুক্ত।
১২. মোবাইল ফোন থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসার ফলে নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের (বিশেষ করে মস্তিষ্কের টিউমার) সম্ভাবনা হতে পারে। যদিও এই বিষয়ে টি নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে।
মোবাইল ফোনের আসক্তি, যাকে প্রায়শই নোমোফোবিয়া (মোবাইল ফোন ছাড়া থাকার ভয়) বলা হয়, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মোবাইল ডিভাইসের আসক্তিকর প্রকৃতি, দৈনন্দিন কাজকর্মকে ব্যাহত করতে পারে এবং সামাজিক ও পেশাগত দায়িত্বগুলিকে ব্যাহত করতে পারে। তখন বাচ্চারা তাদের ফোন অ্যাক্সেস করতে না পারলে উদ্বেগ এবং উত্তেজনার মতো প্রত্যাহারের লক্ষণগুলি অনুভব করতে পারে, যা আসক্তিকর আচরণকে আরও শক্তিশালী করে। অধিকন্তু, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম এবং ডিজিটাল উদ্দীপনা মনোযোগ ঘাটতি হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD) এবং অন্যান্য আচরণগত ব্যাধিগুলির সাথে যুক্ত, বিশেষ করে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে।
মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকা এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে মস্তিষ্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।
একটা সময় ছিল বাচ্চারা একটা নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলতো , পড়াশুনা, স্কুলে যাওয়া,বন্ধুদের সাথে খেলা ধুলা করা। কিন্তু আজ তারা সর্বক্ষণ মোবাইলে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। কোথায় সেই নিয়মানুবর্তিতা, কোথায় সেই সময়ানুবর্তিতা। খেলা ধুলার মধ্যে দিয়ে তৈরি হওয়া লিডারশিপ স্কিল আজ আর নেই। খারাপ-ভালো সবার সাথে মিশে ভালোকে গ্রহণ আর খারাপকে বর্জনের ক্ষমতা, কোথায় সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। সব কিছুই কেমন যেনো ভার্চুয়াল দুনিয়ার চটকদারিতে হারিয়ে গেছে। বড্ড পরনির্ভর আজ আমরা।
এতো গেলো মোবাইল ফোন ব্যবহারের শারীরিক প্রভাব, এবার আসি তার সামাজিক দিকটায়, মোবাইল আসক্তির সামাজিক প্রভাব আরও সুদূর প্রসারী। মোবাইল ফোনে
অতিরিক্ত মনোযোগের কারণে বাচ্চারা তাদের পরিবার, বন্ধু এবং অন্যান্য সম্পর্কের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে না। তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর পরিবর্তে ফোনে বেশি সময় কাটায়। এর ফলে তাদের মধ্যে কথা বলার এবং একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপন করার সুযোগ কমে যায়। এর ফলে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় এবং মানসিক চাপ দেখা দেয়। দিন দিন তারা মনুষ্যত্বহীন, স্বার্থপর এক অসামাজিক জীবে পরিণত হতে শুরু করেছে।
আস্তে আস্তে ছেলে মেয়ে গুলো বড্ড একা হয়ে পড়ছে। বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা সব যেনো কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। আবার বাবা মায়ের কাছেও ঠিক সময় ঠিক নির্দেশিকা (guidance) না পাওয়ার ফলে তারা একদিকে যেমন খারাপ ভালোর ভেদাভেদ টা করতে পারছে না, তেমনি তারা ভার্চুয়াল জগতের চটকদারিতায় মেতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে যা তাদের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে পড়ছে। দিন দিন এইসব ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, আত্মহত্যা, অনিয়ন্ত্রিত যৌনসংযোগ ও অসামাজিক কার্যকলাপার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজেরাই নিজেদের এক অসুস্থ সমাজের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রত্যেকটা বাবা মায়ের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন, তাহলে আমার ছেলেটা বা মেয়েটার এই মোবাইল আসক্তি কাটাবো কীকরে। কিন্তু তারা এটা কি ভেবে দেখেছেন যে এই মোবাইল আসক্তির কারণ টা কি? কেনো তার বাচ্চার এই দশা ,কেনো সে তার মা বাবার থেকে মোবাইল কেই বেশি পছন্দ করে?? যতদিন না সেই সমস্যার মূলে পৌঁছাতে পারবেন, ততদিন এর সমাধানও সম্ভব নয় বলে আমার বিশ্বাস।
খুব সহজ ভাবে যদি এর পর্যালোচনা করা যায় তো খুব স্বাভাবিক কয়েকটা কারণ আমাদের চোখে পড়ে। যেমন, বাবা-মায়ের সময় না দেওয়া, খেলার মাঠের অভাব, খেলার সাথীর অভাব, স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট গেমিং-এর প্রতি আকর্ষণ।
– বাবা-মায়েরা যদি শিশুদের সাথে সময় না কাটায়, তাহলে শিশুরা স্মার্টফোন বা অন্যান্য ডিভাইসকে মনোযোগের জন্য একটি সহজ উপায় হিসেবে বেছে নেয়।
– খেলার মাঠের অভাব এবং খেলার সঙ্গীর অভাবে শিশুদের মধ্যে একঘেয়েমি তৈরি হয়, যা তাদের স্মার্টফোন বা অন্যান্য গ্যাজেটের প্রতি আসক্ত করে তোলে।
– শিশুরা স্মার্টফোনে কার্টুন দেখা বা গেম খেলার মতো বিনোদনমূলক কার্যকলাপের প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হয়, যা তাদের মোবাইল আসক্তির দিকে নিয়ে যায়।
– ডিজিটাল যুগে বেড়ে ওঠা শিশুরা প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসে, তার চটকদারী উপস্থাপনায় মেতে ওঠে ,আর শিশু মন সহজেই খারাপটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, আসক্ত হয়ে যায়।
শুধুই এইভাবে পর্যালোচনা করে যে বা যারা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করছেন বা অন্যদের কে কিছু সস্তা সমাধান আওরে দিয়ে নিজেকে বিজ্ঞ ভাবছেন, তাদের প্রতি একটাই অনুরোধ, না স্যার এতটাও নৈমিত্তিক (ক্যাজুয়াল) মানসিকতা দিয়ে এই গভীর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ভাবতে গেলে আগে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন, সমস্যার গভীরে ঢুকে আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। ভাষা গুলো কেমন যেনো কঠিন কঠিন লাগছে?? মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো কি? তাহলে আমরা একটু সহজ ভাবে বোঝার চেষ্টা করি নাহয়।একটা শিশু জন্মানোর আগেই নিশ্চয় মোবাইল হাতে নিয়ে জন্মায় না ।এরকম হলে অবশ্য ভালই হতো তাইনা, একটা নবজাতের সাথে একটা স্মার্ট ফোন বিনামূল্যে পাওয়া যেতো। যাইহোক সেই সৌভাগ্য যখন আমাদের নেই, তখন প্রশ্ন হলো শিশুর হাতে ওই বস্তুটি এলো কিভাবে । আরো একটু সোজা উদাহরণ দিয়ে বলি।
বাবা মা দুজনেই চাকুরীজীবী, শিশুটি সারাদিন ঘরে একা একা ছিল, হয়তো বা কাজের মেয়ের তত্ত্বাবধানে। অপেক্ষা করে আছে , কখন বাবা বা মা ফিরবে,একটু আদর একটু আবদার করবে।কিন্তু বাস্তব কি বলছে। হয়তো মা রান্নায় ব্যস্ত, বা টিভি তে এক আকর্ষণীয় পারিবারিক অসভ্যাতাম হা করে গিলতে ব্যস্ত, বা হয়তো ফেইসবুকে নিজের সেজেগুজে পোস্ট করা ছবিটার মন দিয়ে কমেন্ট আর লাইক গুনতে ব্যস্ত। সেই মুহূর্তে বাচ্ছা টা কেঁদে উঠলো। একগাল বিরক্তি নিয়ে ইউটিউবে একটা বহুল চর্চিত সস্তা নাচ চালিয়ে ছেলেকে ধরিয়ে দিলেই হলো, ব্যাস কান্না বন্ধ। মাও আবার মনোযোগ দিয়ে তার অকাজে মনোনিবেশ করলেন, অসীম শান্তি বিরাজ করছে ঘরে, কি সোজা না ?
আবার ধরুন বাবা বাড়ি ঢুকে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন , অফিসের সব কাজ বাড়িতে নিয়ে এসেছেন, ভাবটা যেনো পৃথিবীর সব দায়িত্ব তার ঘাড়ে, বা ধরুন একটু বন্ধুদের সাথে একটা ইন্টারেস্টিং চ্যাট চলছে, ছেলে এসে বলল , বাবা চলো একটু খেলব। বাবা আতকে উঠে মা কে ডাকলেন, দেখছ না আমি কত ব্যস্ত, একটু ছেলেটাকে ধরতে ও পারছোনা। হয়তো দু-এক কথায় শুরু হলো কে কত ব্যস্ত তার ফিরিস্তি ! ছেলে বুঝল আমি কত অবাঞ্ছিত। একটু বুদ্ধিমান বাবা আবার খুব ভালো ম্যানেজ করতে পারেন। সোনা বাবা আমার ক্রিকেট খেলবে, এইতো খেলো বলেই মোবাইল গেমটা ধরিয়ে দিলেন, কি সহজ বলুন তো !
একটা সময় ছিল বাচ্ছা খেতে চাইছে না, তাকে গল্প বলে ভুলিয়ে খাওয়াতে হতো, এখন আর এত বকবক করার সময় নেই, টিভি টা চালিয়ে দাও, অথবা মোবাইল টা ধরিয়ে দাও, কেল্লা ফতে, বাচ্চাও গোগ্রাসে খেয়ে নেবে সব। বাচ্ছা কে ভোলানোর জন্য একসময় ছিল ঠাকুমার ঝুলি, ছিল লাঠিওলা দাদু যারা তাদের জন্য একজন বিশেষ বন্ধু, শিক্ষক এবং পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন। তারা তাদের জীবনে আনন্দ, জ্ঞান এবং নিরাপত্তা প্রদান করে, যা তাদের মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে সাহায্য করে। শিশুদের একাকিত্ব দুর করতেন।
কিন্তু কোথায় গেলো বলুন তো এইসব বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী গুলো। স্বামী স্ত্রী বড় চাকুরে, মাস গেলে মোটা মাইনে, গাড়ী বাড়ি সব হয়েছে, নিজেদের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে লোক দেখানো ঠাট বাট বেড়েছে দুশো আনা,মস্ত বড় ফ্ল্যাটে তথাকথিত সভ্য সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে সমস্ত আয়োজন হয়েছে, একেবারে ভরা সংসার যাকে বলে আরকি। কিন্তু কি আশ্চর্যের কথা দেখুন তো দেখি, সেখানে এই সব প্রাণীদের আর কোনো অস্তিত্বই নেই। সত্যিই তো কোথায় গেলেন বলুন তো তারা। চিন্তা নেই তারা একেবারে আবুলুপ্ত হয়ে যাননি ,তারা আছেন বৃদ্ধাশ্রম নামক এক চিরিয়াখানায়। বা ধরুন অযত্নে একা পরে আছেন অন্য কোনো বাড়িতে।
হ্যাঁ স্যার ঠিকই বলেছেন এত ব্যস্ত জীবন ,সেখানে ঘরের মধ্যে নিজের ছেলেমেয়ে কি করছে তারই খবর রাখার সময় নেই সেখানে ঐসব অকাজের মানুষদের কথা কীকরে মনে থাকবে বলুন তো। নানা সরি দাদা মনে থাকে, তবে সেটা যতক্ষন তারা আমার বাড়িতে ছেলেমেয়েকে দেখভালের কাজে নিযুক্ত থাকেন, ততক্ষণ আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বা ধরুন মাঝে মাঝে আমার দরকার পড়লে হাত পাতবো, আর ওনারা দরাজ হস্তে নিজেদের সব পুঁজি দিয়ে দেবেন। তবে সাবধান পুঁজি বা গতর দিয়ে শ্রম না দিলে কিন্তু আমিও চিনব না তাদের।
যাইহোক আলোচনাটা এইসব বেঈমানদের নিয়ে না করে বরং মূল কথায় ফেরা যাক নাহয়। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এইসব ধান্দাবাজদের ছেলেমেয়েরাই সবথেকে বেশি বিপথে চালিত হয়, অমানুষ তৈরি হয়। হ্যাঁ স্যার ধান্দা বাজই বটে, আমার ভাষা প্রয়োগের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী, তবু আমি নিরূপায়। যার নিজের শিক্ষা দিক্ষাতেই এত ঘাটতি, সে বা তারা তাদের ছেলেমেয়েকে যে প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক। ফলস্বরূপ তাদের ছেলেমেয়ে আরও বেশি করে এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার মোহে পড়ে ভেসে যাচ্ছে।
আচ্ছা আবার একটু অন্যভাবে ভেবে দেখুন তো, একটা সময় ছিল বাচ্চাদের সময় কাটানোর পন্থা ছিল, মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করা, মাঠ না থাকলেও কারাম,লুডো হাজারো অপশন,বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারা,অকারণে হাহা-হিহি করে মেতে থাকা, একে অন্যের টিফিন কেড়ে খাওয়া, মারপিট করে আবার গলা ধরে ঘুরে বেড়ানো।তার ভালো মন্দ, সুখ দুঃখ সবকিছুর সাথী ছিল বন্ধু। দূর্ভাগ্য বসত এরাও আজ অবলুপ্তির পথে। আজকের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোনো বন্ধু নেই , কেনো নেই বলুন তো?? তার জন্যেও যে আমাদের মত অতি শিক্ষিত মা বাবাই দায়ী। এর সাথে মিসবি না, ওর সাথে খেলবি না,স্কুলে গিয়ে ওর পাশে বসবি না, একদম নিজের টিফিন কাউকে দিবি না, পরীক্ষার খাতা লুকিয়ে লিখবি নাহলে পাশের মেয়েটা তোরটা দেখে নেবে, এরকম হাজারো বারণ। খেলার মাঠে গেলেও পিঠে একটা বাগ ধরিয়ে দাও,আর একটাই মন্ত্র তোমাকে শচীন টেন্ডুলকার হতেই হবে ।কেমন যেনো মেকানিকাল,কোনো সতস্ফূর্ততা নেই। তাদের কে পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ক্লাসের বেঞ্চে পাশে বসে থাকা মেয়েটা বা ছেলেটা তাদের এর তাদের বন্ধু নয়, সুখ দুঃখের সাথী নয়, তার একটাই পরিচয়, সে কম্পিটিটর,সে তোমার শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বী। তাহলে সেই ছোট্ট শিশুটি তার মনের কথা কাকে বলবে, তার একাকীত্বের সাথী কেই বা হবে। চিন্তা নেই বাবা, হাতে এসে গেছে স্মার্ট ফোন, ফেসবুক, টুইটার। এক লোভলীয় দুনিয়া,যার মধ্যে ডুবে গেলে সব কিছুই ভুলে থাকা যায়। এ যেনো সেই প্রেমিকা ধোঁকা দিয়েছে, তাই মদের পেয়ালায় ডুবে গিয়ে মনের সব দুঃখ কে ধুয়ে দাও। একার জগত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে তারা আরো আরও একালসুটে, স্বার্থপর, অসামাজিক জীবে পরিণত হচ্ছে তা বোঝার বিবেক বোধ কি আমাদের আছে।
কোভিডের পরবর্তী সময়ে শিশুদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি যেন আরও বেড়ে গিয়েছে। তার একটা বড় কারণ অনলাইন ক্লাস, আজকাল যেনো একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। কোন স্কুল কতটা অনলাইন সাপোর্ট দিচ্ছে তার উপর সেই স্কুলের স্ট্যাটাস নির্ভর করে। একটা সময় ছিল আমরা ভালো শিক্ষক খুঁজে বেড়াতাম, যারা আমাদের শিক্ষার ভিত টা তৈরি করে দিত। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষা প্রদানের ধরণ টাও পালটে গেছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে একটা সময় ছিল যখন নতুন কিছু জানতে গেলে আমাদের নতুন নতুন বই পড়তে হতো, কষ্ট করে পড়াশুনা করতে হতো, মাস্টার মহাশয়দের সাহায্য নিতে হতো। এখন তো মোবাইলে একটা ক্লিক করলেই সব ফুটে উঠছে। এর যেমন ভালো দিক টা আছে তেমনি আজকাল সব এত সহজ লভ্য হয়ে যাওয়ায় খেটে অর্জন করার গুরুত্ব টাই হারিয়ে যাচ্ছে ,কেমন যেনো অলস হয়ে পড়ছে সবাই ।একটা অংক করতে না পারলে আমরা সারাটা দিন ভাবতাম কীকরে এর সমাধান করব, আর এখন দেখুন নকল বুদ্ধিমত্তার ( Artificial intelligence) দৌলতে নিমেষের মধ্যে সমাধান, বুদ্ধিগুলো অব্যবহারে কেমন যেনো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে ,মস্তিষ্কের ভাবনা চিন্তার বিকাশটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাড়িতে থাকলেই কখনও পড়াশোনা করার জন্য কিংবা কখনও গেম খেলার জন্য কখনও আবার ইউটিউব দেখার জন্য তাঁরা ফোনে মুখ গুঁজে বসে থাকছে। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলা কিংবা খেলার বদলে মোবাইলের স্ক্রিনেই তাদের নজর থাকছে সর্ব ক্ষণ। কর্মব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে বাবা মা সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেননা,ফলে নিজের সুবিধার্থে অভিভাবকরাই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ফোন, ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ। এই অবস্থাতেই তারা মোবাইলের প্রতি এতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে যে, তার কুপ্রভাব পড়ছে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর। অভিভাবকদের এমন সামান্য ভুল শিশুর জীবনে বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
তাহলে কি শিশুদের হাত থেকে মোবাইল ফোন কে সরিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। অবশ্যই আছে বৈকি। কিন্তু তার জন্য সবার আগে আমাদের কে দৈনন্দিন জীবনে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, ভাবনা চিন্তার উন্নতি ঘটাতে হবে, আত্ম শুদ্ধির উপায় গুলো কে বাস্তবায়ন করতে হবে। আসুন দেখে নেওয়া যাক শিশুকে স্মার্ট ফোন আসক্তি থেকে করে নিয়ে আসার উপায় গুলো কি কি।
– শিশুর স্মার্টফোনের আসক্তি কাটাতে হলে শত ব্যস্ততার মাঝেও আপনাকে ওর জন্য সময় বার করে নিতে হবে। – – সন্তানের হাতে স্মার্ট ডিভাইস তুলে দিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন না। ওর জন্য প্রতিদিন দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখুন। ওই সময়ে শিশুর মনের কথা শুনুন, শিশুর সঙ্গে খেলুন, ওর সঙ্গে গল্প করুন। প্রয়োজনে ওকে গল্প পড়েও শোনাতে পারেন। ওর মন অন্য দিকে ঘোরাতে আপনাকেই উদ্যোগী হয়ে উঠতে হবে। মাঝেমাঝে ওকে নিয়ে বেড়াতে যান, ওর সঙ্গে সময় কাটান।
– ওকে বই কিনে দিন।বাচ্চার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন। তাহলে টিভি, মোবাইল বা ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে অনেক সহজেই বাচ্চাকে দূরে রাখা যায়। শুধু তাই নয় বই পড়ার মধ্যে দিয়ে বাচ্চার মধ্যে আত্ম নির্ভরশীলতা বাড়বে।, মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটবে।
– বাচ্চাদের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করুন। আজকাল বেশিরভাগই ছোট পরিবার। তাই বন্ধু ও পরিজনহীন বাড়িতে টিভিকেই তারা পরম বন্ধু করে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মা-বাবা দুজনই চাকরিজীবী। অফিস শেষ করে বিকালে বাচ্চার জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্টিভিটির পরিকল্পনা করুন। যেমন- ছবি আঁকা, নাচ, গান, আবৃত্তি, মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট শেখানো। এভাবে সমবয়সি বাচ্চাদের সঙ্গে সময়ও কাটাতে পারবে, ওদের একাকিত্বও ঘুচবে।
-অনেক সময় বিভিন্ন কার্টুন ক্যারেক্টারের মারপিট বা মোবাইল গেমের কার ক্র্যাশিং খেলা বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত ঘটায়। তারা অতিরিক্ত হাইপার অ্যাক্টিভ বা অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। তাই লক্ষ রাখুন, কী ধরনের প্রোগ্রাম বাচ্চারা দেখছে। সে ক্ষেত্রে বাচ্চার পাশে বসে ওকে সঠিক ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন।
– বাচ্চাদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিন সময় মেপে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার বাড়ির এমন একটি জায়গায় রাখুন, যাতে তা বড়দের চোখের সামনে থাকে। তাতে বাচ্চারা কী ধরনের বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে নাড়াচাড়া করছে তা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
– বাচ্চার খাওয়ানোর সময় বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে কোনো ধরনের ডিভাইস দেখার অভ্যাস রাখবেন না। বরং গল্প বলুন। তাতে বাচ্চা অনেক ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবে, নতুন বিষয় সম্পর্কে শিখবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে মন বিক্ষিপ্ত থাকবে না।
– শিশুদের ঘরে কাজে ব্যস্ত রাখতে পারেন। বিশেষ করে মায়েরা এ কাজটি করতে পারেন। আপনার সন্তানকে ছোট ছোট কাজে সহযোগিতা করা শেখাতে পারেন। এতে আপনার সন্তান ঘরের কাজের প্রতি আগ্রহী হবে এবং মোবাইল আসক্তি থেকে সরে আসবে।
– আপনি যদি খুব বেশি মোবাইলের প্রতি আসক্ত হন, আপনাকে সন্তানও আপনার দেখাদেখি সেটাই করবে। তাই আগে আপনার নিজের আসক্তি দূর করুন। শিশুর সামনে কাজের প্রয়োজন ছাড়া অযথা ফোন ব্যবহার করবেন না।
– শিশু যদি অনলাইনে ক্লাস করে, তা হলে ইন্টারনেটে আর কী করছে সে, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া স্মার্টফোন থেকে আপত্তিকর ওয়েবসাইটগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে ইন্টারনেট প্রোভাইডারদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে কিছু Software আছে তা দিয়েও এগুলো করা যায়।
– বাচ্চার কাছে সবকিছু সহজলভ্য করে দেবেন না,ওনার সামর্থ্য আছে বলেই তাকে ন চাইতেই আই ফোন দিয়ে নিজের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হবে টা কিন্তু একেবারেই নয়।
– প্রযুক্তির সুবিধা-অসুবিধা দু’টি দিকই সন্তানকে বোঝাতে। প্রযুক্তির ভাল-মন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করুন সন্তানদের সঙ্গে। অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কী বিপদ হতে পারে, সে সব নিয়ে খোলামেলা কথা বলুন।
– সর্বোপরি নিজের বাচ্চাকে সামাজিক জীব হয়ে বাচতে সেখানে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক গুলোকে আন্তরিতার সাথে বজায় রাখুন যাতে সবার মাঝে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটে। একটা বাচ্চার স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য দাদু, ঠাকুমা, কাকা, মামা, বন্ধুবান্ধব প্রত্যেকটা সম্পর্কের নিজস্ব কিছু অবদান আছে, যা শুধুমাত্র বাবা মায়ের দ্বারা কোনোদিনও সম্ভব নয়। ওদেরকে সবার থেকে আলাদা করে একটা অসামাজিক, স্বার্থপর জীবে পরিণত করবেন না দয়া করে। তাই আজ হয়তো কোথাও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে। নিজেদের কেও শুধরে নেয়ার প্রয়োজন আছে। নিজেদের ভাবনা চিন্তার বিকাশ ঘটাতে না পারলে হয়তো আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে সঠিক পথ দেখাতে পারবো না হয়তো।
তাই পরিশেষে বলি একটি সুন্দর আধুনিক জীবন ও সুস্থ স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পেতে হলে আসুন, আগে আমাদের মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নিজেদের সচেতন হতে হবে। এরপর দল-মত এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষকে এগিয়ে ভবিষ্যৎ আসন্ন সংকটের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতার লক্ষে এক গন-আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই মোবাইলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
—oooXXooo—