দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে সবে লেখার টেবিলে বসতে যাচ্ছি দেখি কিলবিল করছে দুটো কালো কালো বিড়ালছানা। কদিন ধরেই মাদী বিড়ালটা ঘরের ভেতর আসা যাওয়া করছিল। এই কারণেই বোধহয়। আর বাচ্চা দিল তো দিল সেই আমার টেবিলেই। গা ঘিনঘিন করে উঠল।একবার ভাবলাম মিলিকে ডেকে দেখাই।পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল ও বেচারীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সময় পায় কোথায় যে এসব দিকে নজর রাখবে? মেয়েকে নিয়েই তো জেরবার। একটা দিনও ভালো থাকে না মেয়েটা। জন্ম থেকেই অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা লাগার ধাত। ডাক্তার, ওষুধ লেগেই আছে সর্বক্ষণ। মিলি যেন তুলোয় মুড়ে রাখে মেয়েকে তবুও পেরে ওঠে না। আমি বাবা হয়ে শুধু ওই ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কীই বা করি? বাচ্চা দুটোকে তুলে এনে বাইরে ফেলে দিলাম। ভেবেছিলাম মা বিড়ালটা এসে তুলে নিয়ে যাবে। যেমন যায়। ততক্ষণ থাক। কিন্তু চোখের পলকে একটা কাক এসে মুখে করে নিয়ে চলে গেল একটাকে। চমকে গেলাম। ছুটে সেটাকে তাড়াতে যেতে অন্য দিক থেকে আর একটা নেমে এসে বাকীটাকেও তুলে নিয়ে গেল। বোকার মত চেয়ে রইলাম। মরে গেল বাচ্চাগুলো ! এতটাও ভাবতে পারিনি। মিলিকে আর কিছু বললাম না। খামোখা ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু মনটা ভীষন বিক্ষিপ্ত হয়ে রইল। এই ঘটনার পর সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। মা বিড়ালটা আসে যায়। আমার টেবিলের দিকে তাকিয়ে কাঁদে। কখনো কখনো আমার অনুপস্থিতির সুযোগে টেবিলে উঠেও খোঁজে। খুব অস্বস্তিতে ভরে যায় মনটা। মিলি মাঝে মাঝে বলে , “বিড়ালটা বাচ্চাগুলো কোথায় রেখেছে আর খুঁজে পাচ্ছে না জানো? খালি ঘুরে ঘুরে কাঁদে। বিড়ালের কান্না ভালো না। অমঙ্গল হয়।” ধমকে থামিয়ে দিলাম ওকে। তারপর অফিসের কাজে কদিনের জন্য ভুবনেশ্বর চলে গেলাম। মেয়েটার শরীর ভালো নয়। মিলি একা। কিন্তু উপায় নেই। যেতেই হল। তারপর যা হয়। কাজের চাপে ঘটনাটা ভুলে গেলাম। মনের ভারও কখন যেন লঘু হতে হতে মিলিয়েই গেল। দিব্যি চলছিল। হঠাৎ ফিরে আসার দিন দুয়েক আগে মিলির ফোন। মেয়ের শরীর ভীষন খারাপ। বুকে বীভৎস ভাবে কফ বসে গেছে। ডাক্তার বলছেন ডবল নিউমোনিয়া। আমি যেন যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসি। বুকের মধ্যে কী এক অজানা ভয় খামচে ধরল। হঠাৎ কী করে এত বাড়াবাড়ি হল মেয়ের? এই তো দুদিন আগেও কথা বললাম ! কই কিছু বুঝিনি তো ! কোনরকমে কাজ গুছিয়ে বাড়ি চলে এলাম।এসে দেখি মেয়ে বিছানায় মিশে গেছে একেবারে। ভয়ংকর নিশ্বাসের কষ্ট! ডাক্তার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কোন কথা দিতে পারছেন না। নার্সিং হোমে ভর্তি করতে পরামর্শ দিয়েছেন। মিলি একা। কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। আমারই অপেক্ষায় আছে। রুগ্ন নির্জীব মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা যেন মনে হল মেয়ে নয় বিছানায় গা এলিয়ে পড়ে আছে ওই কালো কালো লিকলিকে বিড়াল ছানা দুটো। শিউরে উঠলাম ভয়ে। চোখ কচলে তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেই মা বিড়ালটা। তার সবুজ চোখ আমার ওপর ন্যস্ত। কী আছে ও চোখে? জিঘাংসা? না কি পৈশাচিক কোন উল্লাস? ও কি আমার সেই অনিচ্ছাকৃত পাপের শাস্তি দিতে চায়? সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মিলি জ্ঞান হারিয়েছে। মাথার মধ্যে কী যেন একটা সশব্দে ফেটে গেল। দু হাত জড়ো করে মনে মনে বলে উঠলাম, “ হে মার্জার জননী। ক্ষমা কর। আমার অনিচ্ছাকৃত পাপের শাস্তি ওই ছোট্ট মেয়েটাকে দিও না।” কখন কী অবস্থায় ছিলাম বলতে পারব না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কি না তাও জানি না। চোখ মেলতে দেখি মিলির হাসিমুখ। “ ওঠো। শুনছো। মেয়ে ভালো আছে।” মেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে। কিন্তু বিড়ালটাকে আর দেখতে পাই না।