গভীর অরণ্যে এক রাত
বাসুদেব দাশ
শীতকালের এক সন্ধ্যায় তান্ত্রিক তারা শঙ্কর,হাবু ও গবু তিন জন বসে আছে তারা শঙ্করের বৈঠক খানায়। শীত একটু বেশি পড়ায় হাবু ও গবু চাদর গায় দিয়ে এসেছে ভূতের গল্প শুনবে বলে । শীতের তীব্রতা আজ একটু সত্যি সত্যই বেশি বলে মনে হয় সকলের । একটু বাদে তারা শঙ্করের স্ত্রী মধুবালা এসে তিন কাপ চা আর একটা পাত্রে কিছুটা মুড়ি আর গরম গরম বেগুনি ভেজে দিয়ে যায় । চা মুড়ি খেতে খেতে তারা শঙ্কর বলে… “ঠগ বাছতে গা উজাড়” এই প্রবাদটা তো তোরা সবাই শুনেছিস। তাই তো ? ওরা বলে… হ্যাঁ শুনেছি । তারা শঙ্কর… এই প্রবাদের অর্থ জানিস তোরা ? হাবু… না, তারা দা। তারা শঙ্কর…শোন তাহলে আগে তোদের ঠগীদের গল্পটা বলি। কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, নির্দয় ছিল এই আপাত নিরীহ গো বেচারা নিষ্পাপ চেহারার ঠগীরা। তাদের নিপুন হাতের ছোয়ায় সেই সময় ভারতের প্রায় কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। শোনা যায় একবার এক রক্ত বীজ অশুরকে নিধন করার জন্য দেবী জগোদম্বা কালী রূপে অবতীর্ণ হয়ে অশুরের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে কিন্তু যত বার দেবী অশুরকে কোপ মারে তত বার অশুরের গা থেকে রক্ত বের হয়ে সেই রক্ত থেকে নতুন নতুন অশুরের জন্ম হতে থাকে। দেবী কিছুতেই রক্ত বীজ অশুরকে হত্যা করতে পারছিলেন না। শেষে দেবীর গা থেকে দুফোটা ঘাম পড়লে সেই ঘাম থেকে তার দুজন অনুচরের জন্ম হয়। দেবী ভবাণী সেই অনুচরদের হাতে রুমাল দেন এবং বলেন এই ত্রিশ ইঞ্চি লম্বা রুমাল দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে বিনা রক্তপাতে শত্রুদের নিধন করতে হবে। যাতে এই হত্যা কাণ্ড হয় সম্পূর্ণ রক্তপাত শূন্য । রক্তপাত হলেই আবার নতুন নতুন শত্রুর জন্ম হবে। তাদের হাতে আর থাকে কোদাল ও ছুরি। তাদের অস্র ঝিল এক খন্ড হলুদ রেশমি কাপড়ের রুমাল। তা কোনাকুনি ভাঁজ করলে ত্রিশ ইঞ্চি লম্বা হতো। রুমালের এক কোনায় একটা তামার বা রুপোর কয়েন বাঁধা থাকতো। সেই রুমাল দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে শত্রুকে হত্যা করে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে এমুন ভাবে কবর দিয়ে দিত যাতে কাক পক্ষীতেও টের না পায়। তারপর সেই কবরের উপর এক খন্ড সাদা কাপড় বিছিয়ে তার উপর বসে গুরু খেয়ে দেবী ভবাণীর জয়ধ্বনি দিত ওরা। স্থান ছেড়ে যাবার আগে কবরের উপর কাটা জাতীয় গাছ লাগিয়ে দিত যাতে শিয়াল কবর খুঁড়ে দেহ বের করতে না পারে। সেই দুই মহা মানব যুদ্ধ করে বিনা রক্ত পাতে অশুরকে পরাজিত করে। তাতে দেবী প্রসন্ন হয়ে তাদের ঠগী বৃত্তি গ্রহণ করতে উপদেশ দেন । মনে করা হয় সেই দুই মহা মানবই ঠগীদের প্রথম পূর্ব পুরুষ। কাক ডাকলে বা কাক যদি গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে গিয়ে বসে তাতে ঠগীরা মনে করে দেবী ভবাণী শিকারের আদেশ দিয়েছেন। এরপর ঘুঘু পাখি বা ডাহুক যদি ডাকে তাতে মনে করা হতো শিকার কাছে এসে গেছে আর যদি শিয়াল ডাকতো তবে মনে করা হতো যে দেবী কাজ শেষ করে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। এই ঠগীরা কোন পথিকের দল বা কোন তীর্থ যাত্রীর দল বা ব্যবসায়ীদেরকে শিকার হিসাবে বেছে নিত। প্রথমে শিকারের সঙ্গে আলাপ করে ভাব জমাতো, সহানুভূতি দেখিয়ে খাতির করে খেতে দিত। মনে হতো এদের থেকে ভালো মানুষ আর হয় না। তারপর সুযোগ বুঝে সরদারের আদেশ মতো গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করে সোনা রুপা টাকা পয়সা জামা কাপড় সব লুট করে নিয়ে পালিয়ে যেত। এটাই ছিল ঠগীদের পেশা।
এই নৃশংস ঠগীদের হাতে বেঘরে যাদের প্রাণ যেত তাদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না কোত্থাও । তারা যেন পৃথিবী থেকে উবে যেত। ত্রয়দশ শতকে উত্তর ভারতে প্রথম ঠগীদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। শপ্তম শতকে ইলোরার গুহা চিত্রে ঠগীদের হত্যা কাণ্ডের বিভিন্ন চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে। কেউ বলে ঠগীরা ভারতীয় আবার কেউ বলে ঠগীরা পারস্য থেকে মুসলমানদের সাথে এ দেশে এসেছে। জিয়া উদ্দীন বারানী টার্কি ফিরোজ শাহের মত অনুযায়ী বাংলায় ঠগীদের উৎপাত শুরু হয় ১২৯০ সাল থেকে। সেই সময় দিল্লিতে সুলতানের হাতে ১০০০ জনের মতো ঠগীদের একটা দল ধরা পরে। সুলতান সেই ঠগীদের শাস্তি না দিয়ে নদী পথে লক্ষনাবতী অর্থাৎ গৌর বা মালদহে পাঠিয়ে দেন। তারা বাঙলায় এসে খুন ও লুটপাট শুরু করে। এরা এমন নিপুন ভাবে তাদের হত্যা লীলা সমাপ্ত করতো যে তা কেউ কোন ভাবেই টের পেতো না। এই ঠগীদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, শিক সব ধর্মের মানুষই ছিল। তাদের আসল ধর্ম ছিল তারা ঠগী। মা কালী বা দেবী ভবানী ছিল এদের আরাধ্যা দেবী।
দেবী ভবানীর নির্দেশে তারা যাত্রীদের খুন করে তাদের সর্বস্য লুটপাট করতো। আর খুনের জন্য ঠগীদের কোন আফসোস বা অনুতাপ হতো না। তারা মনে করতো তারা দেবী ভবানীর নির্দেশে খুন করছে। যত খুন করতে পারবে দেবী তাদের উপর তত বেশি প্রসন্ন হবেন। ঠগীরা দল বেঁধে বাস করতো। আর এরা যে ঠগী সে কথা এরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারতো না। কোন কোন পাড়ার বসবাসকারি সবাই ঠগী ছিল। তাই সেই পাড়ায় ভালো মানুষ খুঁজতে গেলে এক জনও পাওয়া যেত না। তাই বলা হত” ঠগ বাছতে গা উজাড় “। ঠগীরা দল বেঁধে ঠগী বৃত্তির কাজ করতে বাইরে গেলে পাড়ার লোকেরা মনে করতো এরা হয়তো ব্যবসার কাজে কোথাও গেছে বা তীর্থ করতে গেছে। এদের চেহারা দেখে বা এদের সাথে কথা বলে কেউ বুঝতে পারতো না যে এরা জঘন্ন, নৃশংস ঠগী বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত আছে। ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত বছর ধরে এরা লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করেছে। তুলনা মূলক বিচারে উত্তর ভারতে এদের কার্য কলাপ বেশি প্রকট ছিল। সরদার আদেশ দিত এই বাসন মাঝ মানে খুনের তোড়জোড় কর আবার সরদার বলতো এই তামাকু লিয়ে আও মানে খুন কর। এই ভাবে বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে রামসি ভাষায় এরা নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলতো। সাধারণ মানুষ এই সব সাংকেতিক ভাষা কিছুই বুঝতে পারতো না। এই ভাবে বিয়াল মানে খুনের আদৰ্শ জায়গা, ঝিরিনি মানে খুনের চূড়ান্ত নির্দেশ। সতেরো শো থেকে আঠেরো শো শতক ধরে এই ঠগীরা লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন করেছে। এরা দল বেঁধে বাজারে, তীর্থ ক্ষেত্রে বা সারাই খানায় ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের সাথে ভাব জমাতো। খাতির করে যাত্রীরা কে কোথায় যাবে, তাদের যাত্রা পথের গতিবিধি সব জেনে নিত। তারপর তাদের সঙ্গে মিশে যেত। তারপর সুযোগ বুঝে কাজ হাঁসিল করতো। ঠগীদের অনেক প্রকার ভেদ ছিল। যেমন ধুতরিয়া, জল ঠগী ইত্যাদি। ধুতরিয়া ঠগীরা ধুৎরো ফলের বিষ দিয়ে পথিকদের হত্যা করতো। জল ঠগীদের পাঙ্গও বলা হতো। এরা জল পথে মানুষদের হত্যা করে লুটপাট চালাতো। প্রত্যেক ঠগী দলের নিজেদের এলাকা ছিল। তারা নিজেদের মধ্যেই বিয়ে থা দিত। বংশ পরম পরায় এরা ঠগী বৃত্তি গ্রহণ করতো। সাধারণ মানুষ থেকে ঠগীদের আলাদা করা খুব কঠিন কাজ ছিল বলে সমাজ থেকে এদেরকে নির্মূল করা যাচ্ছিল না। শেষে ইংরেজ সরকার উলিয়াম হেনরি স্লিম্যানের নেতৃত্বে এই ঠগীদের দমন করতে সাক্ষম হয়।
তারা শঙ্কর… ” যুবক বয়সে একবার আমি বিরামপুর গিয়েছিলাম । সেই গ্রামের জমিদারের নায়েব পবন কয়াল আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন । জমিদার বাবুর নায়েবের বাড়ীর পাশে একটা গভীর বন ছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পর থেকে বনের মধ্যে শিয়াল ডাকতে শুরু করে। আর একটু রাত বাড়লে রাত জাগা পাখির চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। বাদুড়ের পাখার আওয়াজও শোনা যায়। অন্ধকারে পেঁচার শিকার ধরার ঝটপটানি শুনতে পাওয়া যায়। ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়ে ছিল আমার। এটা ওখানকার রোজকার ঘটনা। একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম । ” হাবু… কি অদ্ভুত ঘটনা তারা দা ? “
তারা শঙ্কর….” বনের ধারে রাস্তার পাশে একটা নর কঙ্কাল পড়ে ছিল। জন মানব হীন জায়গায় কঙ্কাল আসলো কোথা থেকে এ কথা ভাবতে ভাবতে আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে, গলা শুখিয়ে কাঠ হয়ে যায়। আমার গা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম। একটা কাঠ পিঁপড়ের কামড়ে দিলে আমার হুঁশ ফিরে আসে । দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে হাঁটতে থাকি । রাস্তায় একটা জংলী ফুলের মিষ্টি গন্ধে আমার শরীরটা অনেটা সতেজ করে দিয়েছিল। মাটির সোদা গন্ধ তেমন ভাবে আমার নাকে আর আসছিল না। যাত্রা পথ অত্যন্ত পঙ্কিল। তার মধ্যে বৃষ্টি হয়ে এঁটেল মাটির কাঁদায় পথ হাঁটা খুব দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল। যেমনি আঠা তেমন স্লিপারী পথ। যাত্রা পথটার এক দিকে ছিল ঘন বন আর তিন দিকে ছিল ধানের খেত। ধানের খেতে বৃষ্টির জল জমে ছিল। নিজেকে কোন একটা নির্জন দ্বীপে একাকী আটকে পড়া কোন নাবিকের মত মনে হচ্ছিলো।” আহঃ আমি কোথায় এসে পৌছিয়েছি ? কোথায় এসে পৌছিয়েছি সেটা বুঝতে পারছি না তবে রাস্তা যে হারিয়ে ফেলেছি সেটা বুঝতে পারছি।” একটু এগোতে দেখি রাস্তাটা একটা ডোবার মধ্যে এসে শেষ হয়ে গেছে। এরপর কোন দিকে যাবো সেটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার চোখে পড়ে সামনের দিকে একটু দূরে একটা হাল্কা আলো জ্বলছে। আলোটা আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মনের মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব জেগে উঠলো। কিছুক্ষণ পরে দেখি কয়েন জন লোক স্থানীয় কিনা জানি না আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। হাতের হ্যারিকেনটা উঁচু করে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললো “… ” তুমি কে হে বাবু সাহেব আর কোথায় যাবে ? ” ওদের চেহারা ও হাবভাব দেখে মনের মধ্যে ভয় বাড়তে থাকলো আমার । এতো রাতে এরা কারা আর কিই বা এদের উদ্দেশ্য আমি তা বুঝতে পারছিলাম না। একটা অজানা আতঙ্ক আমার শরীরের মধ্যে খেলে বেড়াতে লাগলো। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম…. আমি তারা শঙ্কর, যাবো বিরামপুর। ” জনৈক লোক..”.বিরামপুর যাবে তো এখানে কেনো বাপু ? ” আমি হাত জোর করে বললাম… ” মহারাজ আমি ভুল করে রাস্তা হারিয়ে ফেলে এখানে এসে পড়েছি । এই অন্ধকারে কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। তাই আজকের রাতটা যদি আমায় একটু থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন তো খুব উপকার হয়। ভাড়া যা লাগে আমি সেই টাকা দিয়ে দেব মহারাজ । ” ওদের এক জন বলে… টাকা ? কে নেবে টাকা ? আমাদের টাকা লাগে না ও সব তোমাদের লাগে। ” এক জন বলে.. “হরেরাম, বাবুকে সারাই খানায় নিয়ে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দে।” হরেরাম আমাকে নিয়ে সরাইখনার পথ ধরলো। হারিকেনের আলোতে হরেরামের লম্বা ছায়াটা আমার আগে আগে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো কোন একটা ভূত প্রেতের ছায়া হবে । আর তিন চার জন যারা ছিল তারা এদিক ওদিক চলে গেলো। আমি ওদের কথা বার্তা শুনে মাঝে মাঝে চমকে উঠছিলাম।’ টাকা লাগে না ‘ এ কথার অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না। ওদের বিষয়ে নানা প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে ভিড় করে আসছিলো। কোন টারই সদ উত্তর আমি পাই নি। ভয়ে ভয়ে আমি হরেরামের সাথে পথ চলতে থাকলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হরেরাম আমাকে নিয়ে একটা বিশাল বাড়ীর সামনে এসে পৌঁছায়। হরেরাম কড়া নাড়তে একটা বিরাট চেহারার লোক নাম সুগ্রীব এসে দরজা খুলে দিল। সুগ্রীবের চেহারা দেখে আমার ভড়কে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল।
সুগ্রীব…. “এ তুই কাকে নিয়ে এসেছিস হরেরাম ? ” হরেরাম…” উনি বিরামপুর যাবেন। পথ হারিয়ে এখানে এসে পড়েছেন। নিতাই মহারাজ এই সরাই খানায় ওনার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেছেন তাই আমি নিয়ে এসেছি কর্তা। ” সুগ্রীব…” ঠিক আছে তুই যা।” বাবুরাম বাবুরাম বলে সুগ্রীব চিৎকার করে ডাক দিলে একটা পনেরো ষোলো বছরের ছেলে এসে হাজির হয়। সুগ্রীব… “এই নে চাবি। দোতালার পিছন দিকের ঘরটা খুলে দে। একটু পরিষ্কার করে দিস।” ঘরে ঢুকতেই একটা আঁশটে গন্ধে আমার গা গুলিয়ে উঠলো । তবে ঘরটা বেশ সাজানো গোছানো। ফার্নিচার গুলো সব মেহগোনি কাঠের। বড় আয়নাটা সম্ববত বেলজিয়াম। একটা দেওয়ালে একটা বন্য তেজি বাইশনের তেল চিত্র। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না । আমার বমি বমি ভাব দেখে বাবুরাম বলে… “এই ঘরটা অনেক দিন বন্ধ পড়ে আছে তাই এই রকম গন্ধ বের হচ্ছে । সরাই খনার মালিক নিজে থাকতেন এই ঘরে। তাই এই ঘরটা উঁনি সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন। উনি চলে যাবার পর আর কেউ থাকে না এই ঘরে। ” তারা শঙ্কর…. “উনি এখন কোথায় থাকেন ? ” বাবুরাম… ” উনি আর নেই, ঠগীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। ” তারা শঙ্কর… ” বল কি ? ” বাবুরাম… এই সরাই খনার অনেক লোক ঐ নিষ্ঠুর ঠগীদের হাতে নির্মম ভাবে প্রাণ দিয়েছে । এক সময় এই অঞ্চলটা ঠগীদের জন্য মুক্ত অঞ্চল হয়ে উঠেছিল । ওদের অত্যাচারের কোন সীমা ছিল না। এই এলাকার মাটি খুঁরলে অনেক কবর পাওয়া যাবে। এই কবর গুলোতে যে মৃত দেহগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে সেগুলো সবই ঠগীদের দ্বারা গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যাওয়া দেহ।
বাবুরাম…”.বাবু উত্তর দিকের দরজাটা খুললে একটা বারান্দা পাবেন। বারান্দায় দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা বালতি আছে। ঐ সোজাসুজি একটা কুঁয়ো আছে নীচে। যদি জলের দরকার হয় তবে এই বালতি দিয়ে কুঁয়ো থেকে জল তুলে নেবে। বারান্দার পাশে একটা টয়লেট আছে। দরকার হলে যাবে। আর একা একা দরজা খুলে বাইরে বের হবে না যেন। ”
আমার কেমন জানি গা ছম ছম করছিলো। মনে হচ্ছিলো কেউ যেন এক জন ঘরের মধ্যে আছে। আমি তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। তাঁর পায়ের শব্দ আমার কানে লাগছে। বাবুরাম চলে যাবার পর আমি জল তুলে হাত পা ধুঁয়ে সামনের দরজা খুলে একটু দাঁড়িয়ে আছি। ঘরের মধ্যে বেশ ঘুমোট তাই হাওয়া লাগাতে দরজা খুলে দাঁড়ালাম। হঠাৎ আমার মনে হলো একটা ছায়া মূর্তি নীচ তলার পাঁচিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে আমি পরিষ্কার দেখতে পাই নি ঠিকই কিন্তু আমার ভুল দেখিনি । এরপর প্রচন্ড শব্দ করে মুহুর্মু বাজ পড়ে রাতের অন্ধকারকে ফালা ফালা করে দিতে লাগলো। মুষলধারে বৃষ্টি হলো সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়াও বইলো কিন্তু খোলা জানলা দিয়ে একটুও জল ভিতরে আসলো না। এমন কি জানলার পাল্লাও ভিজলো না। এই সব দেখে শুনে আমার পিঠের উপর দিয়ে হিম শীতল বায়ু বয়ে যেতে লাগলো। আমার শরীরটা অস্থির হয়ে উঠছিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যাচ্ছিল। বিষয়টা আমার এত অদ্ভুত লাগলো যে আমি ঘরে ঢুকে গেলাম । তারপর আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে ব্যাগে যে শুকনো খাবার ছিল তা খেয়ে নিলাম। একটা জলের বোতলে কিছুটা জল ছিল সেটা দিয়ে রাতেটা কোন মত চালিয়ে নিলাম। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তাই আর দেরি না করে শুয়ে পড়লাম। তখন রাত হয়তো দশটার কিছু বেশি হবে। তাতেই রাতটা গভীর নীরবতায় ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ পরে ঘরের বড় আয়নাটায় কার একটা ছায়া ভেসে উঠলো। প্রথমে মনে হলো আমার ছায়া। পরে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম যে না আমার ছায়া না। তারপর শুনতে পাই একটা লোক গোঙ্গাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার গলায় কেউ ফাঁস দিয়ে চেপে ধরেছে। আমি কে কে বলে চিৎকার করলাম কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। অন্ধকার আমাকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তারপর শুনতে পেলাম এক জন মহিলা ফিসফাঁস করে কাকে কি সব বলছে। ভালো করে বুঝতে পারলাম না । একটা কুচকুচে কালো বিড়াল সানসেটের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়লো। আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। যেন আমি ওর পরম শত্রু। তার চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। অত্যন্ত তীব্র ভাবে জ্বল জ্বল করছিলো তার চোখ দুটো। কিছুক্ষণ বাদে সে অন্ধকারে মিশে গেলো। একটু বাদে সব চুপ হয়ে গেলো আর কোন সারা শব্দ নেই। বাবুরাম বেশি রাতে এক বার এসে আমার খোঁজ নিয়ে গেছে। এরপর কখন যেন আমি ঘুমিয়ে পড়ি। খুব ভোর বেলা পূর্ব দিকের আকাশ লাল হবার আগেই আমি ঘুম থেকে উঠে পড়ি। মনে মনে ভাবলাম যে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখবো। কালকের রাতের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দু হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে এগিয়ে দেখি দরজা নেই, সেই বাড়ী ঘরও নেই। কোথায় সব হাওয়া হয়ে গেছে। চিহ্ন মাত্র নেই। একটা ফাঁকা জমি আর তার চার দিকে বনের মধ্যে সারি সারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের ঘনত্ব কিছুটা হাল্কা হয়ে এসেছে। আর একটু পরেই ভোরের আলো প্রকাশ পাবে। হাল্কা অন্ধকারে আমি দেখতে পেলাম যে কত গুলো অধরীরী আত্মা কবরের মধ্যে ঢুকে মিলিয়ে গেলো। আমার বুকের ভিতরটা ধরাস ধরাস করে উঠল। হৃৎপিণ্ডটা কামার শালার হাপরের দ্রুত গতিতে মতো উঠা নামা করতে লাগলো। এত ভোর বেলা কোন মানুষ জন চোখে পড়লো না। হতাশ হয়ে বসে বসে ভাবছিলাম কাল রাতের কথা। ভোরের আলো একটু ফর্সা হবার পর এক জন স্থানীয় মানুষ প্রাৎকৃত্য সারতে বনের মধ্যে আসায় আমার সাথে দেখা হলো তার। নাম মনসুর আলী। মনসুর আলীর কাছ থেকে জানলাম যে আমি যেখানটায় বসে আছি সেই জায়গাটা একটা গণ কবর। কাল রাতে আমার সঙ্গে যাদের যাদের দেখা হয়েছিল তারা সবাই অশরীরী আত্মা । অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে বলে আটকে আছে এখানে। এক কালে ঠগীরা মানুষ মেরে বনের মধ্যে এই ফাঁকা জায়গাটায় কবর দিত । তখন এখানে একটা বড় সরাই খানা ছিল। সরাই খনার মালিক, ওনার স্ত্রী, দুই পুত্র ও দুই কন্যা নিয়ে এই সরাই খানায় থাকতো। এই সরাই খনার সামনের রাস্তা দিয়ে তখন প্রচুর মানুষ আসা যাওয়া করতো। সাধারণ পথিক, তীর্থ যাত্রী, ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করতো। সেই সুবাদে এই সরাই খানায় রাত কাটাতো বহু জনই। মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো সারা বছর ধরে । খুব গমগম করতো এই সরাই খানা। এর থেকে সামান্য একটু দূরে ঘুরে বেড়াতো ঠগীরা। কাছে পিঠেই ছিল তাদের তাবু। সুযোগ বুঝে ঠগীরা সরাই খানায় ঢুকে পথিকদের সাথে মিশে গিয়ে তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের সব খবর নিয়ে নিত। তারপর পথিকরা রাস্তায় বের হলে রুমাল দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে সব লুট করে নিয়ে কবর দিয়ে দিত। এই ভাবে প্রচুর মানুষ হারিয়ে গেছে ঠগীদের আক্রমণের মধ্যে পড়ে। কোন দিন আর তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় নি। আজ সেই সরাই খনার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কালের নিয়মে মিশে গেছে প্রকৃতিতে। শোনা যায় সূর্যো ডোবার পর এখান থেকে অশরীরীরা মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। রাতের বেলা এখানে কোন মানুষ আসে না। ভূত প্রেতরাই হল্লা করে বেড়ায়।
সমাপ্ত