“আমিনার প্রেম”
রণজিৎ মন্ডল
—————————-
পরাজিত শা সুজা ঔরঙ্গজেব এর ভয়ে
পলায়ন করিয়া আরাকান রাজের আতিথ্য গ্রহণ করিলেন তিন কন্যা সন্তানকে সঙ্গে লইয়া।
তিন কন্যাই যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, আরাকান রাজের ইচ্ছা হয় রাজপুত্রদের সহিত বিবাহ দিয়া তাহাদের রাণী করিয়া রাখিবে।
সেই প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় আরাকান রাজের আদেশে তাহাদের নৌকাযোগে ভ্রমণ করিবার ছলে ডুবাইয়া মারিবার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিপদের আঁচ পাইয়া সুজা তার কনিষ্ঠা কন্যা আমিনাকে জলে স্বয়ং নদী মধ্যে নিক্ষেপ করে। জেষ্ঠা কন্যা আত্মহত্যা করে ও সুজার বিশ্বস্ত কর্মচারী রহমত আলি মেজ কন্যা জুলিখাকে লইয়া পলায়ন করে।
আমিনা খরস্রোতা নদীতে এক ধীবরের জালে আটকাইয়া যায় এবং পরবর্তীতে ধীবরের গৃহে বড়ো হইয়া ওঠে।
ধীবর আমিনাকে নিজের কন্যার চেয়ে স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়া নানা কাজের উপযোগী করিয়া তোলে ,আমিনা ধীবরকে বুড়া বলিয়া সম্বোধন করিয়া নিজের পিতার মতো ভালোবাসিত।
ধীবর আমিনাকে তিন্নি বলিয়া ডাকিত।
একদিন ধীবর আমিনাকে ডাকিয়া বলিল, তোর আজ কি হইয়াছে, কাজে মন নাই কেন?
আমিনা বুড়াকে আদোর করিয়া কহিল, বুড়া “আমার দিদি আসিয়াছে” তাই ছুটি।
তোর আবার দিদি কে রে তিন্নি?
জুলিখা ঘর হইতে বাহির হইয়া বলিল “আমি!”
বৃদ্ধ ধীবর অবাক হইয়া জুলিখার কাছে আসিয়া তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল। জিজ্ঞাসা করিল ” তুই কাজ কাম কিছু জানিস?”
আমিনা বুড়াকে বলিল দিদির সব কাজ আমি করিয়া দিব।
কিন্তু ও থাকিবে কোথায়? আমিনা কহিল “আমার কাছে!”
কিন্তু খাইবে কি? আমিনা যাহোক ব্যবস্থা হইবে বলিয়া বুড়াকে তখনকার মত ভাগাইয়া দিল।
জুলিখা ছদ্মবেশে ঘুরিয়া আমিনা কি করিয়া ধীবরের বাড়িতে আসিল সব জানিল।
একদিন জুলিখা ও আমিনা নদীর তীরে এক গাছের তলায় বসিয়া নিজেদের সহিত বলিতে লাগিল ” ঈশ্বর আমাদের মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচাইয়া দুই বোনকে মিলাইয়া দিয়াছেন এজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!”
আমিনা অদূরে অবস্থিত বনাঞ্চলের দিকে চাহিয়া আনমনে বলিতে লাগিল দিদি আমি যেন নতুন পৃথিবী পাইয়াছি, এখানে সবই সুন্দর, এই নদী, বন, বুড়ার সংসার আমার খুব প্রিয়।
জুলিখা অহঙ্কারভরে বলিয়া উঠিল “ছি ছি তুই শাহজাদার ঘরের মেয়ে, কোথায় দিল্লির রাজসিংহাসন আর কোথায় ধীবরের ছোট্ট কূটির!”
আমিনা হাসিয়া কহিল দিদি দিল্লির রাজসিংহাসন এর চেয়ে বুড়ার ছোট্ট কূটির, এই নদী, কৈলু গাছের ছায়া আমার অনেক প্রিয়।
তারপর আমিনা দিদিকে বলিল, দিদি আমার অনেক কাজ পড়িয়া আছে, রান্না করিতে হইবে, বুড়া আসিয়া খাইবে, ঘর গোছানো আছে, তুমি এখানে বসিতে চাইলে বসিও।
কিছু পরে জুলিখাও ঘরে ফিরিয়া গেল।
জুলিখা আমিনার কথা ভাবিয়া মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝিতে পারিল না।
বিমর্ষ মনে বসিয়া ভাবিতে লাগিল এমন সময় একটা ধূপ করিয়া শব্দ করিয়া দালিয়া পিছন হইতে আমিনা ভাবিয়া চোখ টিপিয়া ধরিল, কে কে চিৎকার শুনিয়া ভয়ে সমুখে আসিয়া নত হইয়া বলিল, তুমি তো আমিনা নও, কে তুমি?
কথা শেষ না হইতেই জুলিখা আমিনা আমিনা করিয়া হাঁক পাড়িল। আমিনা ত্রস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল কি হইয়াছে দিদি?
এই ছেলেটির এতো সাহস হইল কি করিয়া শুনি! ও আমার চোখ টিপিয়া ধরে , এতো স্পর্ধা?
দিদি তুমি ওকে ছাড়িয়া দাও , ও বনের হরিণ এর মত সহজ ও সরল। আমার অনেক কাজ করিয়া দেয়!
তার মানে তুই ওকে আগে হইতেই চিনিস!
দালিয়া এই সুযোগে পালাইয়া বাঁচিল।
পরে আমিনার সহিত জুলিখা দালিয়ার রাজকীয় সৌন্দর্য ও সুন্দর ব্যবহারের কথা বলিতে লাগিল। ইহাতে আমিনা খুব খুশি হইল না, আমিনা কহিল দিদি ও আমার অনেক ফাই ফরমাস ও হুকুম মানিয়া কাজ করিয়া দেয় ইহাতে আমি উপকৃত হই তাই বেচারিকে পাত্তা দেই , দালিয়াও আমাকে পছন্দ করে।
কিন্তু জুলিখার ইহাতে আরো সন্দেহ হইল, নিশ্চয় ইহার পিছনে অন্য রহস্য লুকাইয়া আছে। গোপনে খোঁজ লইয়া জানিল এই সেই আরাকান রাজ্যের রাজপুত্র যাহার সহিত আমাদের বিবাহের প্রস্তাব দিয়াছিল আরাকান রাজ!
পিতা সুজা রাজী না হওয়ায় সকলকে নদীতে ডুবাইয়া মারিবার নির্দেশ দিয়াছিল। কিন্তু আমিনা আরাকানের রানী হইবে ইহা কিছুতেই মানিয়া লইব না।
রাতারাতি এক গোপন ব্যবস্থা করিয়া বোন আমিনার অজ্ঞাতসারে আরাকান রাজ্যে ফিরিয়া যাইবার বন্দ্যোবস্ত করিল।
আমিনা সব জানিতে পারিয়া একটি ছুরি বুকে গুজিয়া যাত্রা করিল।
যে দালিয়া আমিনাকে এতো ভালোবাসিত তাঁহাকে বোনের নিকট হইতে ছিনাইয়া লইবার কৌশলে আমিনা ঠিক করিল ও জীবন রাখিবে না।
যখন আরাকানে পৌঁছাইয়া দালিয়ার গলায় মালা পরাইতে উদ্যত হইল জুলিখা , আমিনাকে দালিয়া বলিল, এ কি করিলে আমিনা ? আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, তবে কি তুমি আমাকে চাও নাই? না না আমার দিদির পছন্দ তোমাকে তাই দিদিকে দান করিলাম আমার সুপ্ত প্রেম যা শুধুই তোমার জন্য আমার মনে সঞ্চিত
রাখিয়াছিলাম, বলিয়া বুকে গুজিয়া রাখা ছুরি দিয়া নিজেকে আত্মাহুতি দিল আমিনা। আমিনার ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী আজও অমর হইয়া রহিয়াছে।
—oooXXooo—