অজপা
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
এখন মাঘের একটি অতি সাধারণ প্রকারের দ্বিপ্রহর ক্রমে শেষ হয়ে সূর্যাস্তের দিকে ঢলতে শুরু করছে । যদিও স্বয়ং বীণাপাণির সাম্বাৎসরিক পূজা মাত্র কদিন আগেই শেষ হয়েছে বলে চতুর্দিকে পরিবেশে বাসন্তিক উদ্বেলতার বেশ প্রাবল্য।
এই অনৃত কালযাপনে তাঁর যৌবনকালের কথা আজকাল থেকে থেকে মনে পড়ে বলে বার্ধক্য পদপ্রান্তে এসে ভারতচন্দ্রের পঞ্চাশৎ বর্ষের আয়ু এখনো বেশ চনমন করে ওঠে। তিনি বংশগতভাবে ব্রাহ্মণ সন্তান হলেও অহঙ্কারী অথবা কোপন স্বভাবের নন। এককালে তাঁর রচিত বাঙ্গালা কাব্যগুলির গৌড়বঙ্গালের মাটিতে বেশ সুনাম ছিল। সেইসব বিগত দিনগুলোয় স্বয়ং কৃষ্ণনগরাধীশ কৃষ্ণচন্দ্র সপার্ষদ তাঁর সভাগৃহে এমনকি সপত্নী সহ অন্দরমহলেও উপবিষ্ঠ হয়ে ভারতচন্দ্রের এক বড় নিবিষ্ট মনের শ্রোতা, বোদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষক এই তিন চরিত্রেই তাঁর অনন্য রাজকীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। এমনকি রাজার তৎকালীন সভায় প্রতিষ্ঠিত সুখ্যাত নবরত্ন সভা’র এক মানী সভ্য রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যেন স্বপ্নসম বাস্তব। আজ রাজ অনুগ্রহে লব্ধ একখানি মধ্যমাকৃতির হর্ম্যদালান ও বিঘা কতক খাসজমির দৌলতে ভারতচন্দ্র এখন একজন ধনী ও প্রতিষ্ঠিত গৃহস্থ। এই জাগতিক সম্পদে অর্জিত বিত্ত ও সামাজিক প্রভাবের বহুলতা তাকে এখনও একদা ভূরসূট নিবাসী কাব্যপিয়াসী ও প্রেমিকমনস্ক কবি অথচ দরিদ্র সেই যুবকটির সাথে প্রত্যহ দেখা করতে দেয় না ঠিকই, তবে নিভৃতাচরণের তন্মধ্য ভাবালুতায় কখনও কখনও বিগত দিনের অনেক ঘটনাই হঠাৎ করে স্মৃতিতে জাগরূক হয়ে ওঠে বলেই নিজের মায়াকলমটি থেকে অমৃততূল্য পদাক্ষরের ধারা এখনও পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায় নি।
কিছু বছর পূর্বে পলাশীর আম্রকাননে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বঙ্গাল সহ তামাম হিন্দুস্তানকে কাঁপিয়ে দিয়ে চলে গেছে তা বোধহয় কখনও অভিপ্রেত ছিল না। এখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাহী মসনদে ক্রীড়নক তূল্য মীরজাফর সহ দু’ একজন নবাব-নাজিমরা একে একে এসে বসলেও আকাশে বাতাসে কান পাতলে সাগরপার থেকে আসা ফিরিঙ্গীদের জুতোর মচমচে শব্দই ক্রমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর ভাবে ধ্বনিত হচ্ছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে মূর্শিদাবাদ অচিরাৎ তার গৌরব হারিয়ে ফেলছে এবং আরো দক্ষিণদেশে ভাগিরথীর পূর্ব-পশ্চিমে হুগলী, সপ্তগ্রাম ও ফরাসভাঙার কাছে ক্রমে মাথা তুলে সমৃদ্ধির চূড়ায় উঠতে চলেছেসস্বল্পখ্যাত জনপদগুলি। বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে রাজধানীতে পরিণত হওয়াটা নেহাৎ অগৌরবে নয়।
তাছাড়া এটাও অনস্বীকার্য যে এই দীর্ঘদেহী, সুগৌর ও বিড়ালাক্ষ এই অদ্ভূতদর্শন মানুষগুলোই যে সম্ভবতঃ আগামী দিনে তামাম হিন্দুস্তানের গদীতে বসতে চলেছে।
অনেকক্ষণ ধরে নিজের মনজগতের মধ্যে স্মৃতি কন্ডুয়ণ করতে করতে ভারত এসে দাঁড়ালেন নিকটবর্তী নদীটির কাছে। নদীতীরস্থ প্রান্তভাগ সামান্য জনবিরল। নদীটির একদিকে শৈবালদামের বাহুল্য চতুপার্শ্বটিকে অরণ্যবনানীর উদ্ভাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
হঠাৎ যেন কল্পদৃশ্যের মত বাস্তবতার ছোঁয়ায় ভারত দেখতে পান তাঁর এক সময়কার প্রণয়ী ঈশ্বরী নাম্নী সেই অন্ত্যজশ্রেণী নৌচালনকারিণী রমণীটি যেন তার ডিঙিটি বেয়ে চলেছে অতল সাগরের সাথে মিলনের উদ্দেশ্য নিয়ে।
অতীতের সেইসব দিনগুলিতে তখন ভারতচন্দ্র নিজভূমেও অপাঙক্তেয় কবিমনস্ক এক যুবা মাত্র। ভাগ্যের পরিহাসে এমনকি সে নিজেও যে একজন ভূরিশ্রেষ্ঠ নিবাসী জমিদারকূলতিলক সেটিও তখন আনমনে স্মরণ করতে বাধত।
কিঞ্চিৎ নালীশাক ভাজা, তিন্তিড়ির টক ও লবণ সহযোগে সামান্য অন্নপানের পর ব্যর্থকাম কবিমনস্ক সেই যুবকটির একদা অনেক অলস দ্বিপ্রহর কেটেছে চারটি সন্তানের জননী সেই নৌচালনকারিণীটির সংস্পর্শে।নিজের দারিদ্রের সাথে সতত সংগ্রামরত এবং অলস প্রকৃতির এক গঞ্জিকাসেবী ও পেশায় সাপুড়ে স্বামীকে নিয়ে ঘরে তার নিত্য অশান্তির দাপটে সে ছিল অতিষ্ঠা । সেই সব দুঃখকষ্টের থেকে ঈশ্বরী নামক নৌচালিকা নারীটির মনস্তাপ জুড়াত কবি ও প্রেমিকস্বভাব ভারতচন্দ্রের সাথে নিভৃত মিলনের পরে।
কবি ভারতচন্দ্র তার সাথে রতিরঙ্গে যে পরম সুখাবেশ পেতে অভ্যস্ত ছিলেন তার একেকটি ঝলক বিদ্যা-সুন্দর কাব্যের ছত্রে ছত্রে ধরা থাকবে আগামীদিনের পাঠককূলের উদ্দেশ্যে।
তবে এ হেন স্ত্রীলোকটির সাথে কি করে যে তার ঘনিষ্ঠতার প্রথম সূত্রপাত সে কথা যদিও আর তেমনভাবে মনে পড়েনা।
তবে এই পাটনী নারীটিকে তিনি যে আজও ভুলতে পারেন নি একথাটিও ততোধিক সত্য। তাই তো বিদ্যা-সুন্দরের মত অন্নদামঙ্গল কাব্য রচনার সময় স্বয়ং দেবী অন্নপূর্ণাকে তিনি এনে বসিয়েছেন তার নৌকায়। সেই ভাবসম্মেলনের চরম পুরষ্কারে সেই স্ত্রীলোকটি কাঠের সেঁউতিটির মত তাঁর হৃদয়টিও অষ্টাপদের বিভায় আলোকিত হয়েছে ক্রমে যা কালান্তরের সোপানে অমলিন থাকবে বলেই মনে হয়।
নদীতীরে পদচারণা করতে করতে ভারতচন্দ্র যেন হঠাৎ শুনতে পেলেন কোথা থেকে যেন একটি গানের সুর কানে ভাসছে। নদীবক্ষে হয়ত কোন মাঝি দিনান্তের ক্লান্তি ঘুচাতে গেয়ে উঠছে দু-এক কলি গানের কথা, এ যেন তারই বসন্ত নির্ঘোষ । এবার আর একটু সজাগ হয়ে ভারত কান পাতলেন গানটির কথাগুলি হৃদয়ঙ্গম করার উদ্দেশ্যে।
এবারে দেখতে পেলেন তাঁর শ্রবণসুখের আনন্দ বৃদ্ধি করে জলঙ্গীর বক্ষে ভেসে আসছে একখানি ডিঙি নৌকো। নৌকাটির মাঝি মধ্যবয়সী এক মুসলমান। তার পেশীবহুল হাত দু’খানির শিরা ক্রমে ফুলে ফুলে উঠছে দাঁড় টানার দীর্ঘশ্রমে। তবু এই শ্রমবহুল কাজের মধ্যেও তার কন্ঠে বাসা বেঁধে আছে মানবজীবনের মহাসঙ্গীত। আহা! ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষটির সাংগীতিক প্রতিভাকে কূর্ণিশ জানান তিনি।
” … মন তুমি কৃষিকাজ জান না/এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা…” বিস্মিত হলেন এইজন্য যে এই সংগীতটির কথা ও সুর তাঁর মিত্রবর রামপ্রসাদ সেনের এক অনন্য সৃজন।
ভারতচন্দ্র তাঁর গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকেন যে তাঁর মিত্রটি কত সহজসাধন অনন্য এক পথের পথিক। তা না হলে মানবজমিনের অনাবাদির মনস্তাপ এমন কালাকালের উর্দ্ধে উঠে ভেসে বেড়াতে পারত না।
নিজের এই কবিরঞ্জন মিত্রটির সাথে কত যে সুমধুর স্মৃতি আজও জাগরূক হয়ে আছে তা আর বলবার নয়। তার সাথে সেই প্রথম আলাপের দিনটির কথা তিনি কি ভুলতে পারবেন? মনে আছে রাজানুগ্রহে অতিথিশালায় বিশ্রামের সুযোগ পেয়েও সামান্য দধি ও চিপিটকের ফলার গ্রহণ করে সেই মায়াবী মানুষটি রাজরাজেশ্বরীর মন্দিরের চাতালে সাধারণের সাথে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়তে সেদিন দ্বিধা করেনি। এমনটি করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে স্মিত হাস্যের সাথে সে উত্তর দিয়েছিল,
” ওহে! যার মা রাজ রাজেশ্বরী আমি তার সন্তান হয়ে আমি নাটমন্দির ছেড়ে হর্ম্য দালানে গিয়ে শোব! পাগল নাকি? ”
মিত্রবরের সাথে এরকম বহু সুখস্মৃতি আজ জলঙ্গী ছাড়িয়ে ভাগিরথীর বুকে অনবরত ভেসে যাচ্ছে। কৃষ্ণনগর -কুমারহট্ট হয়ে তার গীতিমাধুরী আবিশ্ব মাতৃনামের আবহে উচ্চারিত হচ্ছে। এই না হলে সার্থকনামা পদগীতিকার!
তাই তো একজন বিধর্মী নৌচালকের কন্ঠে যে একটু আগে শুনতে পেয়েছেন রামপ্রসাদী মহাগীতের সার্থক অভিবাসন। ধন্য কবি রামপ্রসাদ! ধন্য ! এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে মন চায় না যে তাঁর এ হেন মিত্রটি আজ আর মরপৃথিবীতে বেঁচে নেই।
এমনকি তাদের কিছুদিন আগে দেখা দেশকালের সামগ্রিকতায় যে আজ একটা বড় মাপের বদল ঘটে চলেছে সেখানে সবটাই যেন ভীষণ নতুন রকমের।
ভারত বোঝেন এমনটা হওয়াই তো বাস্তবিক। রাজছত্র-শাসক-গরিমা এসব তো যুগে যুগে বদল হয়ে এসেছে। সাকিন কৃষ্ণনগর ছাড়িয়ে অজস্র জনপদের আয়নায় একমাত্র যাঁর মুখচ্ছবি কেবল অম্লান রয়ে গেছে তিনি হলেন স্বয়ং মহাকাল, একমাত্র সংসারে তাঁরই কোন বদল ঘটে নি।
রামপ্রসাদ তার সমস্ত জীবন ধরে সেই অধরামাধুরীর রূপসন্ধান করে গেছে বলে তার শাক্তপদাবলী এত জনপ্রিয়।
নদীর নিকটে একটি শ্মশানঘাটের অবস্থান । স্থানটি নির্জনপ্রায় বলে বেতসলতার জঙ্গলে তাকে আরো ঝুপসি দেখতে লাগে। ভারতচন্দ্র শ্মশানাচারী নন, তবুও আজ যেন ওইদিকের নির্জনতা তাঁকে যেন বড় টানছে। ঘাটটির দিকে দু-তিন পা আরো এগোলেই অন্তর্জলি ব্যবস্থার জন্য নির্মিত একখানি জীর্ণপ্রায় ঘাট ও তাকে ঘিরে রয়েছে একখানি খোড়ো চাতাল যা জীবিত সঙ্গীদের বিশ্রামের স্থান। তিনি ভাবলেন ওইটুকু অবধি হেঁটে আসার পর ফেরার পথ ধরলেই চলবে।
শ্মশানভূমিতে আজ এখনও পর্যন্ত কোন মৃতদেহ বা মরণাপন্ন কোন মানুষ এসে পৌঁছয় নি বলে এলাকাটিতে এক অদ্ভূত ধরণের স্তব্ধতা বিরাজ করছে।
ভারতচন্দ্র যন্ত্রচালিতের মত সেইদিকে অগ্রসর হলেন। টের পেলেন যে ক্রমে সূর্যের তেজ নিভে আসছে। আর কিছুক্ষণ পরেই চরাচর আবৃত করে মায়াবী সন্ধ্যা তার বেণীবন্ধন উন্মুক্ত করে ছড়িয়ে দিতে শুরু করবে তমিশ্রার রূপটান।
– ‘ এমন দিন কি হবে তারা! যবে তারা তারা তারা বলে মুদবো তারা আঁখিপাতে ‘ এই গানটি অতি সুমিষ্ট স্বরে কোথা হতে যেন আচম্বিতে ভেসে আসায় ভারত যেন একটু সচকিত হয়ে উঠলেন।
এই প্রান্তিক শ্মশানে কে এমন ভাবমদির কন্ঠে মাতৃনাম করছে? খানিকক্ষণ আগে যেন সমস্ত এলাকাটাই জনশূন্য বলেই তো মনে হচ্ছিল!
নিজের কাব্যপ্রতিভার সুখ্যাতির কথা ভেবে কিছুক্ষণ যেন আপনমনেই হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলেন। সমস্ত জীবন ধরে কি আর এমন কাব্য রচনা করলেন কবি ভারতচন্দ্র ! কই রামপ্রসাদের গীতিসুষমার মত তা সাধারণ্যে এমন ভাবে তো পৌঁছায়নি।
একটু আগে শোনা নৌচালকটি যে কিনা আদতে বিধর্মী তার কন্ঠেও রামপ্রসাদী সংগীত আবার নির্জন শ্মশানেও কেউ যেন সেই রামপ্রসাদের পদলালিত্য বহন করে আনছে মাতৃনামের আবহে। কই – ‘লটাপট জটাজুট সংঘট্ট গঙ্গা/ কলক্কল টলটল তলোত্তল তরঙ্গা ‘ এই পদটি তো আর তেমন ভাবে আর শ্রুত হয়না। বিদ্যা-সুন্দরের তর্জা অথবা অন্নদামঙ্গল বিদগ্ধ জনের মুখে সুস্বীকৃত হলেও সুবৃহৎ জনমানসে কি আদৌ কোন প্রভাব রাখতে পেরেছে? নিজেকে হঠাৎ যেন অতি ক্ষুদ্র এক পদ গীতিকার বলে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে।
আধো আলো আঁধারি শ্মশানভূমির মাটিতে হঠাৎ যেন দূরাগত একটি ছায়ামূর্তি দ্রষ্ট হল। মধ্যমাকৃতির এক প্রৌঢ়বয়সী একটি মানুষের ছায়া ওটি।
বোঝা যাচ্ছে অযত্নলালিত পারিপাট্যে মানুষটি কিসের যেন খোঁজ করতে করতে ভারতচন্দ্রের দিকে ধীরে ধীরে স্খলিত চরণে এগিয়ে আসছে। মাঝেমধ্যে উদাত্ত কন্ঠে সে উচ্চারণ করছে শাক্তপদাবলীর একেকটি সুবিখ্যাত গীতবাহারের নমুনা।
ভারতচন্দ্রের মনে হতে লাগল যে সম্পূর্ণ তাঁকেই উপেক্ষা করে সমকালীন রামপ্রসাদের গান গাইতে গাইতে সে যেন প্রতিক্ষণে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে তিনি নিজে বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বশংবদ স্তাবকের দল আজ ভারতচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠতর কবি হিসাবে স্বীকার করলেও আদতে শ্রেষ্ঠতর কবির চেয়েও শ্রেষ্ঠতম কবির সৃজনই বঙ্গালের আকাশবাতাসে আজও মথিত হয়।
দুঃখের বিষয় এই যে ভবসংসারের সেই স্বীকৃতিটি ভারতচন্দ্রের কাছে ‘নিশার স্বপনসম ‘ অধরা যেমনটা তিনি নিজেই লিখে গেছেন অতীতে।
যৌবনে যদিও ভারত কখনও প্রিয়মিত্রবর প্রসাদের প্রতি সামান্যতম ঈর্ষাটুকুও করেন নি তবুও জীবনসায়াহ্নের পথে চলতে গিয়ে আজ যেন বারেবারে প্রসাদী পদামৃতের জনপ্রিয়তা তাঁকেও অর্বাচীনের মত বারংবার আহত করছে।
লোকটি আর একটু কাছে এগিয়ে আসতে এতক্ষণে ভারতচন্দ্র তাকে এবার স্পষ্ট দেখতে পেলেন। শ্মশ্রুগুম্ফবহুল মধ্যমাকৃতির এই পুরুষটির পরণে মলিন রক্তাম্বর যা সামান্য জীর্ণ ও স্থানে স্থানে ছিন্ন হওয়ার গ্রন্থিবদ্ধ। মনে হল লোকটি তদ্ভাবে বসত করে এবং এখানে নির্জনে আগম-নিগমাদি শাস্ত্র চর্চা করে।
এমত পরিবেশে ভারতচন্দ্র হঠাৎ এসে পড়ায় হয়ত তন্ত্রাচারী কাপালিকটির গূহ্য সাধনে বিঘ্ন ঘটিয়ে ফেলেছেন নিজের অজান্তে। নিশ্চুপে ভারতচন্দ্র এতক্ষণে গৃহাভিমুখী পথের দিকে পা বাড়াতেই শুনতে পেলেন উন্মাদ সাধকটির কন্ঠের সহাস্য স্ফূর্তির আমেজ। এবারে যেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে সে বলে উঠল,
” যত শোন কর্ণপুটে, সকলই মায়ের মন্ত্র বটে ।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী, বর্ণে বর্ণে নাম ধরে ॥
কৌতুকে রামপ্রসাদ রটে, ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে ।
ওরে, আহার কর, মনে করো, আহুতি দেই শ্যামা মা’রে ”
এরপর সেই উন্মাদ গান গাইতে গাইতে পরম যত্নে মাথায় তুলে নিল একখানি ভগ্নপ্রায় মৃৎভান্ড বা দেবীঘটের অবশেষ। তারপর স্খলিত পায়ে ধীরে সে এগিয়ে যেতে থাকল নদীর পূর্বাস্য জলরাশি লক্ষ্য করে। সেইসময় নতুন উদ্যমে তার কন্ঠে আবার ধ্বনিত হল নতুন করে মাতৃনামের অপ্রচলিত আখর,
” অজপা হইলে সাঙ্গ, কোথা তব রবে রঙ্গ,
সকলই হইলে ভঙ্গ, ভবানীরে না ভাবিয়ে ।
চলনে দ্বিগুণ ক্ষয়, ততোধিক নিদ্রায় হয়,
বিনয়ে রামপ্রসাদ কয়, ততোধিক সঙ্গমসময়ে !”
জলঙ্গীর জলরাশিতে ততোক্ষণে জোয়ার এসেছে। সেই উন্মাদটির প্রবল অট্টহাসি ক্রমে মিলিয়ে যেতে লাগল জলঙ্গীর জলে। সবকিছু বোঝার আগেই তিনি টের পাচ্ছেন যে এই দৃশ্যের অবতারণা যেন শ্মশানভূমির সাথে ভারতচন্দ্রের মনোজগতে এনে দিচ্ছে এক অন্য স্বাদের অনুভব ।
মনে হচ্ছে যেন এক বিশাল শিশু যেন মরজগতের অভিজ্ঞানস্বরূপ পরমানন্দে মাতৃনাম করতে করতে তাঁকেই যেন প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে অনন্য সমর্পণের সার্থকতা।
সেখানে রাজা-প্রজা-পন্ডিত-মূর্খ সবাই সমান। সেই কালাকালের উর্দ্ধে যে পরমাপ্রকৃতি সদা জাগরূক তাঁর কাছে ইহজগতের সমস্ত ধনরত্ন এমনকি মনের আপাত সংকীর্ণতাকেও সমর্পণ না করতে পারলে যে ক্ষয়, তা যেন কখনোই আর পূরণ হবার নয়।
দু’চোখে টলটলে মুক্তদানার মত উদ্গত অশ্রুধারায় ভারতচন্দ্র বুঝতে পারলেন অন্তরমহলের আহ্বান। এইমাত্র তিনি এক নতুন জীবনের পথে পরিক্রমণে অভিনিবেশ করতে চলেছেন। সেই সামান্য জীবনের ভাঁড়ারে যেটুকু পূণ্য সঞ্চয় তাঁর বাকী আয়ুস্কালে অবশিষ্ট আছে তার জন্য আগামীকাল থেকেই সচেষ্ট হবেন তিনি। যদিও সেই মহানন্দের পথের হদিশ তিনি সম্পূর্ণভাবে না জানলেও সংশয়হীনভাবেই এই পরমধন স্বরূপ ভাব-তহবিলের খাজাঞ্চী হিসাবে অসূয়াবিহীন ভারতচন্দ্র নিয়োগ করবেন তাঁর সেই সতীর্থ কালীপদের ভান্ডারী মিত্রবর রামপ্রসাদ সেন’এর স্মৃতিকেই।
ভারতচন্দ্র এতক্ষণের ভারমুক্তিতে প্রফুল্ল হয়ে উঠে নিজেই এবারে গেয়ে উঠলেন,
” ডুব দেরে মন কালী বলে
হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে,”
ধন্যবাদান্তে :
সীতাংশু মৈত্র
নিলয় বরণ সোম
ডাক্তার রক্তিম মুখার্জ্জী
—oooXXooo—