বন্ধু
ড. রঞ্জন কুমার দে
অনেকদিন ধরেই ভাবছি লেখালেখিটা শুরু করব, সেটার তাগিদটাও খুব প্রকট হয়ে উঠছিল দিন দিন। তাই কলমটা হাতে তুলেই নিলাম। কিন্তু এবার সমস্যা হল কি নিয়ে লিখবো, হাজার ভেবেও যখন পথ পেলাম না, মাথাটা ভার হতে শুরু করলো তখন, বন্ধুত্ব নিয়ে একসময়ে লেখা কিছু কথা কে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত করে উপস্থাপন করলাম।
আমার চোখে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব কে পর্যালোচনা করতে গিয়ে মনে হল শুরুতেই শুভেচ্ছা জানানো উচিৎ সেইসব প্রকৃত বন্ধুদের যারা এই স্বার্থপরতার যুগেও নিস্বার্থ ভাবে আমাদের কষ্টের মুহূর্তে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, আমাদের দুঃখের সাগরে বৈতরনী হয়ে সুখের কিনারে পৌঁছে দেয়।
একটা বহুল প্রচারিত কথা আছে না,….
“A friend in need, is a friend indeed” …….
তাহলে কি বন্ধুত্ব শুধুই একটা দরকারের সম্পর্ক?? মানছি আমার দরকারের সময় একমাত্র প্রকৃত বন্ধুই আমাদের পাশে থাকে,তাও নিজেকে কেমন একটা স্বার্থপর স্বার্থপর মনে হচ্ছে না?? আসলেই হয়তো আমরা স্বার্থপরই ।
এখন প্রশ্ন হল বন্ধুত্ব তবে কি???
বন্ধুত্ব হলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশেষ সম্পর্ক। আত্মার শক্তিশালী বন্ধন হল বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকে যেমন স্নেহ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সততা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, সমবেদনা, একে অপরের সঙ্গ, আস্থা,বিশ্বাস যোগ্যতা ,অনুভূতি প্রকাশ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত।একে অন্যের সুখে-খুশিতে লাফিয়ে ওঠার; একে অন্যের দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর। মন খুলে কথা বলা, হেসে গড়াগড়ি খাওয়া আর চূড়ান্ত পাগলামি করার একমাত্র আধার এ ‘বন্ধুত্ব’।
অর্থাৎ প্রকৃত বন্ধুত্ব পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে এক অটুট বন্ধন কে প্রকাশ করে। আমরা সবসময় শুধু ভাবি আমার বন্ধুর মধ্যে এই সবকটি গুণ থাকা চাই তবেই সে আমার বন্ধু হওয়ার যোগ্য,নয়তো নয়। কিন্তু কখনো এটা ভেবে দেখিনা, আমরা নিজেরা সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা কতটা দিতে পারি বা আমি নিজেও কি সেই ভালোবাসা বা আন্তরিকতা পাওয়ার যোগ্য, আমি নিজেই কি বন্ধু হওয়ার যোগ্য, অর্থ্যাৎ আমার মধ্যেও কি বন্ধুত্বের গুণ গুলো বর্তমান, আমিও কি সেই বন্ধু কে ততটাই আন্তরিকতা, ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করি, অর্থাৎ আমার মধ্যেও কি প্রকৃত বন্ধু হওয়ার গুন গুলো আছে ??
নাহ… সে আত্ম সমালোচনা না করেই অন্যের যোগ্যতা বিচার করতেই বেশি আগ্রহী আমরা। এখানেও সেই স্বার্থপরতা। শুধু আমি পাব বন্ধুর কাছ থেকে কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারে কতজন । অনেক সময় আমরা আমাদের ঠুনকো ইগো দেখিয়ে বাহাদুরি করে বলিনা যে আমার সাথে মানিয়ে চলতে পারলে থাকো নয়তো ভাগো…. যেনারা এই attitude পোষণ করেন তারা কি ভেবে দেখেছেন যে তিনি নিজেই কোন চরিত্রের পরিচয় দিলেন, নিজেকে কেমন স্বার্থান্বেষী মনে হচ্ছে না?? নিজেই নিজের অযোগ্যতাকেই প্রমাণ করলেন না তো। যাইহোক সেই বিচার করার দায়িত্ব আপাততঃ সম্পর্কের মূল্যবোধ হীন সেইসব নির্বোধদের উপরে ন্যাস্ত করে আমরা আমাদের আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাই নাহয়। ওহ থুড়ি, বালাইশাট….. আপনি কেনো নির্বোধ হবেন, আপনি তো বুদ্ধিমান। আর একটু আধটু বুদ্ধি ধরেন বলেই না কাকে কখন বন্ধু পাতিয়ে কিভাবে ব্যবহার করে নিতে হবে তা বেশ ভালোই বোঝেন।
যাই হোক এবার আসা যাক প্রকৃত বন্ধু বলতে আমরা কাকে বুঝি। সে এমন একজন নারী বা পুরুষ যে আমাদের জীবনে সুখে দুঃখে আমাদের পাশে থাকে, আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন গুলোতে যখন আমরা দিশেহারা হয়ে বাঁচার পথ খুঁজি তখন যে মানুষটা নিজেকে বিসর্জন দিয়েও আমাদের হাতটা শক্ত করে ধরে থাকে সে আমার বন্ধু, শত বাধার মধ্যেও যে বলে ভয় কিসের, আমি তো আছি, সে আমার বন্ধু। বন্ধু মানে আস্থা, বন্ধু মানে ভরসা, বন্ধু মানে যে শক্ত কাঁধে মাথা রেখে মনের সব যন্ত্রণা গুলো কে চোখের জলে ধুয়ে ফেলা যায়।
বন্ধুত্ব অনেকটাই অন্ধকারে মোমের আলোর মত।তার স্নিগ্ধ, পবিত্র আলোয় চারিদিক আলোকিত করে রাখে, কিন্তু যে মুহূর্তে বৈদ্যুতিক আলো এসে ঘরটা ভরিয়ে দেয়, সাথে সাথেই আমরা সেই মোমের আলো কে নিভিয়ে দিয়ে অবহেলায় ফেলে দেই। বাস্তব জীবনেও আমাদের চরিত্রটাও ঠিক এইরকম।আমাদের কষ্টের মুহূর্তে পাশে থাকা মানুষ গুলোকে সুখের সময় ভুলে যেতে আমরা খুব একটা বেশি সময় নেই না, একবার ও ভেবে দেখিনা সেই অন্ধকারে সেই মানুষ গুলো মোমের মতই কতটা নিজেকে পুড়িয়ে আমাদের আলো দিয়েছে।
না সে ভেবে দেখার সময় আমার নেই, কেনই বা ভাবব, সে তো আমার বন্ধু, তার তো কাজই আমার কষ্টে পাশে থাকা, না থাকতে পারলে কিসের বন্ধু। তার পাশে থাকাও যে আমার দায়বদ্ধতা তা কিন্তু ভেবে দেখি না,।সত্যিই সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধটাই আমাদের জাগেনা, মূল্য বোধ তো অনেক বড় কথা। সেই আমরা কিনা প্রকৃত বন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে, বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নিয়ে হোয়াইটস্অ্যাপ বা ফেসবুকে বিপ্লব করে ফেলি। ভেবে দেখেছি কি, আমার নিজের মধ্যে সেই definition অনুযায়ী কি কি গুণ বর্তমান, আমি নিজেও কি বন্ধু হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার ক্ষমতা রাখি। কথায় আছে না…
” দিয়ে ধন দেখে মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ। “
প্রকৃত বন্ধু কিন্তু ধন সম্পত্তির থেকেও অনেক অনেক বেশি দামি। সবার জীবনেই হয়তো বন্ধুত্ব কোনো না কোনো সময়ে একবার হলেও আসেন, ভগবান তাকে আমাদের কাছে পাঠান কোনো না কোনো রূপে। কখনো সে আসে স্বামী বা স্ত্রীর বেশে, কখনো বা প্রেমিক প্রেমিকার বেশে, কখনো বাবা মায়ের বেশে বা কখনো সহপাঠী বা সহকর্মীর বেশে। সবাই হয়তো বাহ্যিক সম্পর্ক গড়তে পারে কিন্তু বন্ধু হওয়ার পবিত্র মানসিকতা, পালন করার মানবিকতা খুব কম মানুষের মধ্যেই থাকে।
এই স্বার্থের পৃথিবী তে যখন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত তখন এই মানুষগুলো আমাদের ভালোর জন্য, আমাদের সুখের জন্য সব উজাড় করে দেয়, আমাদের দুঃখের মুহূর্তে পাশে থাকার বার্তা দেয়,হাত ধরে আলোর পথ দেখায়, আমরা হয়তো সেই বন্ধুত্বের যোগ্য সম্মান দিতে পারিনা বা সেই কৃতজ্ঞতা বোধ কে অস্বীকার করি, ভগবান কিন্তু আমাদের পরীক্ষা করছেন, আমরা শুধুই স্বার্থপরের মত পাওয়ার আনন্দে মেতে আছি নাকি নিজেও সেই যোগ্যতার প্রমাণ করে তাকে ভালোবাসা, আন্তরিকতা ফিরিয়ে দিচ্ছি। নয়তো আমাদের নিজের অযোগ্যতা আর স্বার্থপরতার জন্যই প্রকৃত বন্ধু কে একসময় হারিয়ে ফেলি আমরা। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে আমরা এতটাই বেইমানির অন্ধকারে ডুবে থাকি যে তাকে হারানোর জন্য তাকেই দোষারোপ করতেও ছাড়িনা আমরা।
ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত এমন অনেক বন্ধুর সংস্পর্শে আমরা এসেছি যারা কোনো না কোনো সময়ে কোনও না কোনও ভাবে আমাদের উপকার করেছে কিন্তু আজ আর তাদের আমরা মনে রাখিনি। কাউকে হয়তো স্কুল, কলেজের শেষ দিন বিদায় দিয়েছি, কাউকে বা রাস্তার মোড়ে দেখা হয়ে বলেছি, দারা আসছি একটু বাদে, না আর ফিরে যাইনি । কারোর সাথে হয়তো পথচলতি হঠাৎ দেখে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছি, হয়তো পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পেতাম, সেই মানুষটি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আমার এই বদলে যাওয়া চরিত্র টাকে বোঝার চেষ্টা করে গেছে যতক্ষণ না আমি তার চোখের আড়ালে চলে গেছি, বা ধরুন একটা সময় যার খাতা নকল করে পাশ করেছি, আজ আমি মস্তবড় অফিসার আর ভাগ্যের পরিহাসে আজ সে সামান্য মাছ বিক্রেতা, তাই তাকে বন্ধু হিসাবে পরিচয় দিতে আমি লজ্জা পাই, বা ধরুন চাকরি পাওয়ার পর যে সহকর্মী দাদার মত আমাকে আগলে রেখেছে, আমাকে সব কাজ শিখিয়েছে, আজ প্রমোশন পেয়েছি বলে এখন সেই মানুষ টাই শুধুই আমার অধস্তন কর্মী। যে মা বাবা একদিন বন্ধুর মতো আমার জীবন টা কে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে,আমাদের মানুষ করতে পদে পদে sacrifice করেছেন, আজ তারা হয় অবহেলায়, অনাদরে জীবন কাটাচ্ছেন বা হয়তো আজ তার স্থান হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।
সবার জীবনেই হয়তো বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের মতই এমন একটা মানুষ, এমন একটা সত্যিকারের বন্ধুর প্রয়োজন যে আপনাকে ভালোবাসবে, যত্ন করবে, হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও আপনার খোঁজ নিতে ভুলবে না, কোনো অজুহাত দিয়ে পালাবে না আপনাকে priority দেবে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক একটা পবিত্র সম্পর্ক ,সেটা শুধুই আমার একার নয়, আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে,আমার কষ্টে সে যেমন আমার পাশে থাকবে, ,তার কষ্টের মুহূর্তেও আমিও ততটাই তার পাশে থাকবো।কোনো অবস্থাতেই, কোনো অজুহাতেই আমার পালিয়ে যাওয়াটা বা আমার সুখে তাকে ভুলে যাওয়াটা, আমার পাপ বা বন্ধুত্বের সম্পর্কের প্রতি আমার বেইমানি বা বিশ্বাস ঘাতকতাকেই প্রকাশ করে। তাই প্রকৃত বন্ধু কে পেয়ে পারলে তাকে ধরে রাখুন, নিজের যোগ্যতা দিয়ে তাকেও আগলে রাখুন, এই পৃথিবীতে এই ধরণের প্রাণীরা আজ বড়ই দুর্লভ।
সম্পর্ক তৈরী করা যতোটা সোজা,হাত পেতে স্বার্থপরের মতো পাওয়া টা তার থেকেও সোজা কিন্তু সেই সম্পর্কের মূল্য দেওয়া অনেক অনেক কঠিন, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা আরও কঠিন । তাই আজকের দিনে সেই মানুষ গুলোর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সময় এসেছে, যারা কারোর স্বামী বা স্ত্রী বা প্রেমিক বা প্রেমিকা বা সহকর্মী বা অন্য কোনো বেশে অনবরত প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়ে চলেছে। উল্টো দিকের মানুষটার অযোগ্যতা ,স্বার্থপরতা সত্ত্বেও তার পাশে থাকার চেষ্টা করে যায় অনবরত। তবেই না আমরাও নিজেদের কে বন্ধুত্বের যোগ্য করে তুলতে পারবো।ভালো থাকুক সেই মানুষ গুলোও যারা না পাওয়ার যন্ত্রণা বুকে চেপে সম্পর্কের পবিত্রতা কে বজায় রেখে চলেছে।
ছোটবেলায় একটা সংস্কৃত শ্লোক পড়েছিলাম, যেটা উল্লেখ না করলে হয়তো পুরো আলোচনা টাই বৃথা….
” উৎসবে ব্যসনে চৈব
দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ
যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।।”
অর্থাৎ উৎসব সময়ে, বিপৎকালে,দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, বিচারালয়ে ও শ্মশানে যে সাহায্য করে সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
সত্যিকারের বন্ধুর সংজ্ঞাটা না হয় আমরা আজ আত্ম সমালোচনার মধ্যে দিয়েই বিচার করে দেখি প্রকৃত বন্ধুত্ব বজায় রাখতে আমাদের নিজেদের কর্তব্য টা কি, আমার নিজের মধ্যেও কি উপরিউক্ত গুণ গুলো বর্তমান…বন্ধুত্বের আসল সার্থকতা তো দেওয়ার মধ্যে, শুধুই পাওয়ার মধ্যে নয়, এই ছোট্ট উপলদ্ধি যার নেই, সে কোনোদিনই কারোর বন্ধু হতে পারে না।
তাই আজ, যে মানুষ গুলো বিভিন্ন সম্পর্কের বেশে আপনার কষ্টের মুহূর্তে আন্তরিক ভাবে আপনার বা আমার পাশে থাকার চেষ্টা করেন, তাদের কে সম্মান জানিয়ে পারলে একবার অন্তত তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন, তাদের শ্রদ্ধা জানান, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একবার নিজেকেও প্রমাণ করুন তবেই আজকের আলোচনা টা স্বার্থক হয়ে উঠবে।
Those who supports us in happiness that is relationship.
And the one who supports us in sorrow is an angel.
অর্থাৎ যে ব্যক্তির সঙ্গে আমরা আনন্দে সম্পর্ক বজায় রাখি সে আমার পরিবার পরিজন কিন্তু যে ব্যক্তি আমাদের দুঃখের ভাগ নিয়ে পাশে দাঁড়ায়, তাঁরা দেবদূতের মতো”।
—oooXXooo—