আপন জন (পর্ব সপ্তদশ)
কাকলী ঘোষ
ওসব পোষায় বড় লোকদের। খুঁটে খুঁটে খাবে। চামচে করে এই একটুস খানি নিয়ে মুখে ফেলবে। খাবে কী ? ঢংয়েই বাঁচে না। দেখেছে তো দোলা বৌদির সব বন্ধু বান্ধব দের। যত সব উদ্ভট রান্না আর তারপর না খেতে পেরে একে ওকে চালান করা।
“ হয়ে গেছে।” রিন্টির ডাকে চমক ভাঙ্গে শিখার। আরে বেলা হয়ে গেল যে। এরপর দোলা বৌদি খুব কথা শোনাবে।
দ্রুত বেরিয়ে পড়ে শিখা। দূরত্ব বেশি নয়। একই পাড়া। গলি দিয়ে বেরিয়ে তিন চারটে বাড়ির পর। ফ্ল্যাটে থাকে বৌদি। চার তলা। লিফটে উঠে দরজা বন্ধ করতে ভয় ভয় চোখে তাকায় রিন্টি।
“ এটা কী গো?”
হেসে ফেলে শিখা। জীবনে প্রথম লিফট দেখছে মেয়েটা।
“ লিফট। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবো। সিঁড়ি ভাঙতে হবে না।”
“ পড়ে যাবে না তো?”
“ ধ্যাত। পড়ে যাবে কেন ?”
হাসতে হাসতে উত্তর দেয় শিখা। ওর নিজেরও খুব ভয় ছিল এক সময় লিফটে। একা উঠতেই পারতো না। সিঁড়ি দিয়ে উঠত। এখন শিখে নিয়েছে। আর ভয় করে না।
চারতলায় উঠে বেল টা চেপে ধরে ও।
“ বাব্বা ! আজ এত দেরী করলে?”
দরজা খুলতে খুলতে সঙ্গে রিন্টিকে দেখে থমকে যায় দোলা। তক্ষুনি কিছু বলে না।
“ একটু দেরি হয়ে গেল বৌদি। আজ কাকিমার বাড়ি তিন জন খাবে। রান্না বেশি।”
বলতে বলতে পা ধুয়ে ব্যালকনির এক কোণে রাখা শাড়িটা নিয়ে নিজের শাড়ি ছাড়তে শুরু করে শিখা। দোলা বৌদির খুব পরিষ্কার বাতিক। রাস্তার কাপড়ে রান্না ঘরে ঢুকতে দেয় না। হাত পা না ধুয়ে কিছুতে হাত দিতে দেয় না। এখানে পরে রান্না করার একটা শাড়ি রাখাই থাকে। বৌদি ই দিয়েছে। রান্না করে যাবার সময় কেচে দিয়ে যায়।
“ তোমার কাকিমার বাড়ি তো রোজই লোক।” “যা বলেছ।” শাড়িটা গুছিয়ে পরতে পরতে সায় দেয় শিখা। “ নিজেরা খায় এইটুকু। কিন্তু লোকজন এলে সে যে কী রান্নার ঘটা ! আসেও তো সব ওই জন্যই। ভালো মন্দ খাওয়া হয়।”
“ তোমার সঙ্গে ওটা কে ?”
“ তোমার বোন নাকি ?”
“ না। আমার বোন নয়। ওই আমার বরের পাড়াতুতো বোন। গ্রামে কিছু জুটছে না। বাপ মা নেই। ভাইরা দেখে না। চলবে কী করে বল তো ? তাই শহরে এসেছে কাজের আশায়। ভালো রান্না বান্না কাজকর্ম জানে। তুমি বলছিলে না তোমার কে একজন লোক চাইছিল ? তাই নিয়ে এলাম সঙ্গে করে।”
কথা বলতে বলতে দ্রুত হাত চলতে থাকে শিখার। ফ্রিজ থেকে মাছ বার করে ভিজিয়ে দেয়। সবজির ট্রে টেনে নিয়ে আসে। চা বসিয়ে দেয় তিন কাপ। এই সময় এসে বৌদিকে চা করে দিতে হয় ওর। দাদা অফিসে চলে যান সাত টায়। অফিসেই খেয়ে নেন। চা পর্যন্ত বাড়িতে খান না। একা নিজের জন্য চা বানাতে ইচ্ছে করে না বৌদির। তাই প্রথম দিন কাজে আসার পরই বলে দিয়েছিল এসেই দু কাপ চা বসাবে। আমি আর তুমি খাব। তারপর সব কাজ। আজ রিন্টি আছে বলে তিন কাপ বসালো শিখা।
“ কী রান্না হবে বৌদি ?”
“ যা ইচ্ছে কর। আজ ভাল লাগছে না কিছু।” বৌদির মুখ একটু ভার ভার কি? আগে আগে এরকম দেখলে ভয় পেত শিখা। এখন জানে বৌদির মুড ভালো নেই। এই শব্দটাও নতুন শিখেছে ও। বৌদির থেকেই শিখেছে। মাঝে মাঝে এরকম হয় বৌদির। আসলে একা এক থাকে তো সারাদিন। দাদা দিনরাত কাজে ব্যস্ত। একটা বাচ্চা কাচ্চাও নেই। ভালো লাগবে কী করে? শুধু টাকা পয়সায় কী সুখ হয়? এই যে এইটুকু সংসার। কত টুকুই বা কাজ ? রান্নার লোক রাখার কি সত্যিই দরকার ? আদৌ না। তাছাড়া বৌদির নিজেরও রান্নায় হাত আছে। কিন্তু দাদা জোর করে লোক রাখিয়েছে। অন্তত কিছুটা সময় কারুর সঙ্গে কথা বলে বৌদি ভালো থাকব তাই। মানুষটাও ভালো। দেওয়া থোয়ার লম্বা হাত। দামি দামি শাড়ি , সালোয়ার, একটু পুরোনো হয়ে গেলেই ওকে চালান করে বৌদি। শিখার হাতের ইমিটেশনের চুড়ি গুলোর রং জ্বলে গেছিল। কিনবে কিনবে বলে আর কেনাই হচ্ছিল না। ওমা ঠিক নজরে পড়েছে বৌদির। নিজে তো। ওসব পরে না। কিন্তু ছিল বোধ হয় ঘরে। হয়ত কিনেছিল কখনও। ঠিক বার করে এনে হাতে দিলো। নেব না বললে শুনবেই না।
ক্রমশ :