অন্য পাড়ায় পদচারণা
বিষয় :শরৎচন্দ্র
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
‘মাঝে মাঝে গেছি বটে ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে/ ভিতরে প্রবেশ করি, সে সাধ্য ছিলনা একেবারে..’ খোদ রবীন্দ্রনাথ এ আক্ষেপ রেখে চিরসমাহিত সেই ২২শে শ্রাবণের বর্ষাদিনে।
যদিও রবীন্দ্রপরবর্তী তিনটি দশকে অন্য ধারার সাহিত্য ধীরে ধীরে মেরুদন্ডে জোর পেয়েছে। বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ একদিকে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রক্ষা করেছেন বাংলার সাথে সার্ত্র, ব্যোদলেয়ার, নীটশে কে জুড়ে আর তারও আগে অন্য একটি ধারা প্রান্তিক জনজীবনকে কলমের জোরে প্রতিষ্ঠিত করেছে তিন বন্দোপাধ্যায় -মানিক, তারাশঙ্কর আর বিভূতিভূষণ। তাঁদের প্রত্যেকের প্রক্ষেপণ আলাদা হলেও মূল কাঠামোটা প্রান্তবাসীই। এর সূত্রপাত যার কলমে প্রথম সংগঠিত বিন্যাসে তিনি হলেন শরৎচন্দ্র।
যিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রান্তিক জনজীবনে বাস না করলে এসব নিয়ে রচনা লেখায় আসল বাস্তবতা থাকেনা। সে কথা মান্য করেই কি পরবর্তীকালে ‘ বারো ঘর এক উঠোন’ – লিখতে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বস্তিতে ঘর ভাড়া করে থাকতে গিয়েছিলেন?
শরৎবাবু মহৎ সাহিত্য লিখে অযথা সময় নষ্ট করতে চাননি। বঞ্চিত ও অবাঞ্ছিত মানবমন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেছে আর সে সব জায়গায় তাঁর বর্ণিল ভাষায় কথাসাহিত্যের অক্ষরবৃত্তকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন আজীবন।
রাবীন্দ্রিক মোহবিস্তারে সতত সশ্রদ্ধ শরৎচন্দ্র নিজে লিখতে বসে গরলকে অযথা অমৃতস্বাদে মহীয়ান করতে বসেন নি। তাই “দেবদাস” উপন্যাসে তাই যেন আক্ষরিকভাবে এক ব্যর্থ যৌবনবিলাসীর মৃত্যুর দৃশ্য যখন লিখছেন তখন এক ফোঁটা জল কেবল দিতে চেয়েছেন তার ওষ্ঠাধরে, আর চেয়েছেন যেন কান্নার আবহে বরণ হোক সেই অমিতাচারের দীনতা।
আবার তিনি “শ্রীকান্তে” যেমন রাজলক্ষ্মীর মধ্যে যেমন এঁকে দিয়েছেন সুচারু প্রেমময়তার পটরাগ আবার সেই ট্রিলজির কমললতায় তাকেই শেষমেশ অধরামাধুরীর পদসংকীর্তনের আবহে ভাসিয়ে দিতেও পিছপা হন নি।
“রামের সুমতি”, “পল্লীসমাজে” নির্মোহ হয়ে উঠতে চেয়ে একইভাবে আসঙ্গ ও ঔদার্য্যে মেলে দেন ঘরোয়া জীবনের অন্তরাত্মাটকে।
অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে তাঁর ‘মহেশ’ গল্পটি সত্যিই আন্তর্জাতিক ভাবান্মেষে উজ্জ্বল। তারাশঙ্করের ‘ কালাপাহাড়’ যে মনুষ্যেতর প্রাণীটির কাহিনী বর্ণনে যেখানে দামী হয়ে ওঠে সেখানে গফুর জোলার “মহেশ” কখন যেন বাস্তবের পাশবিক অস্তিত্ব ছেড়ে আমাদের রক্তধারায় অপত্যের টানকে এনে হাজির করে।
এখানেই শরৎবাবু জিতে যান। সাপুড়ে চরিত্ররা তাঁর গল্পে আবেগ ও ঘৃণার বীণ একসাথে বাজিয়ে চলে যায় যা পরবর্তীতে “রস” গল্পে নরেন্দ্রনাথ মিত্র আর “টোপ’ গল্পে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়’ কে বাস্তবিক পটভূমিকায় লিখতে দেখি অন্য কথার অবতারণায়। ঠিক যেমন “নিশিকুটুম্ব”তে মনোজ বসু হয়ে ওঠেন শরৎ ভাবনার উত্তরধারায় স্নাত।
আবার ‘দেনাপাওনা’র নাট্যরূপ ষোড়শী’র মঞ্চউপস্থাপনার দিনে যখন দ্বিধাহীনভাবে তিনি টিকিট বিক্রীর থলিটা শিশির বাবুর থেকে উঠিয়ে নেন তরুণ পরিশ্রমী সাহিত্যসেবক শিবরাম চক্রবর্তী’কে বঞ্চিত করেই তখন আবার সেই ‘শরৎবাবু’কে অচেনা লাগে ভীষণ!
তবুও তাঁর অন্য সব সংবেদী কলম লিখন দেখলে অর্ডারী সাহিত্য আর শৈল্পিক সাহিত্যর বিরোধাভাস স্পষ্ট চোখে পড়লেও তাঁকে একদম এড়াবো যে সে সাধ্য কার?
‘ পথের দাবী ‘র লেখককে পন্ডিতেরা আজকাল সরিয়ে রাখলে বাংলাভাষায় বাস্তবিক সাহিত্যসাধনার ধারাটিকেই যে অস্বীকার করতে হয় সেটা ভুলে যেতে হয় আর সেটাই যেন অবধারিত হয়ে নিন্দুকদের মুখ চেপে ধরে।
তবে “শেষ প্রশ্ন” উপন্যাসে রাধারাণী দেবী একদম মসৃণ কলমে পূর্বজ শরৎদাদা’র লেখাটি শেষপর্বে লিখলেও শরৎ বাবু বোধহয় তা এতটা সুখী আঁচড়ে শেষ করতেন কি? সেটা অবশ্য কষ্টকল্পনা মিশ্রিত প্রশ্ন থেকেই যায়।
কচিপাতা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত শরৎজীবনের উন্মেষকাল নিয়ে ” নিঠুর দরদী” উপন্যাস যখন লিখতে বসেছি তখন সেই লেখকটির ছায়াসপ্তক ছাড়িয়ে মানুষ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে একটু একটু আলাপ হয়েছিল তাঁর অণ্বেষণের জন্য নির্ধারিত গম্ভীর নির্জন পথে। সেখানে কল্পচোখে দেখেছিলাম জাহাজের ডেক থেকে শুশুক দেখতে পেয়ে হাততালি দিয়ে ওঠেন রেঙ্গুন-ফেরৎ উন্মেষী শরৎচন্দ্র। সেখানে সারাজীবন ছবিতে দেখা কাঁচাপাকা চুলের সেই মানুষটি বড় আপনজনের মত হয়ে ওঠেন।
সম্প্রতি তাঁর ১৪৫ তম জন্মদিন পেরিয়ে তিনি এবারে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন সার্ধ-শতবর্ষের দিকে।
তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য বিষয়ক এই লেখায় তাঁর প্রিয় ও একইভাবে অনুপুঙ্খ স্তাবক না হয়ে বেঁচে থাকা তাঁর অতি প্রিয় অভিবাবকের কলম ধার করে বরং বলি,
” পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু/ নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প–
/যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয় /অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে/ অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার/বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে/ হার হয়েছে আমার।
কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে/ তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে /পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে/ ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে…”
কবি’র প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে কি? মহাকাল উত্তর দেবেন এই প্রশ্নের!
—oooXXooo—