অদৃশ্য ছায়া
নবু
অর্ণবের বয়স পাঁচ। তার জগৎটা বাবা আর মায়ের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সেই জগতে এক কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। প্রথমে সামান্য কথা কাটাকাটি, তারপর ক্রমশ চিৎকার, কান্না—অর্ণবের ছোট্ট মনে যেন ঝড় বয়ে যায়।
অর্ণব প্রথমে ভয় পেত। মায়ের আঁচল ধরে কেঁদে বলত, “মা, থামো না!” বাবা-মায়ের ঝগড়া চলত তখনও। ধীরে ধীরে ভয়টা অভ্যাসে পরিণত হল। এখন আর সে কাঁদে না, চুপ করে এক কোণে বসে থাকে। তার ছোট্ট মনে এক অদৃশ্য ছায়া গ্রাস করতে শুরু করে।
স্কুলে অর্ণব অন্যমনস্ক থাকে। শিক্ষকের কথা তার কানে যায় না। বন্ধুদের সাথে খেলতে ইচ্ছে করে না। সে যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। রাতে ঘুমাতেও তার কষ্ট হয়। মায়ের কান্নার আওয়াজ, বাবার রাগের গম্ভীর গর্জন—সব যেন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।
একদিন রাতে ঝগড়া চরমে উঠল। বাবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মা বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলেন। অর্ণব মায়ের পাশে গিয়ে বসল, মায়ের হাত ধরে আস্তে করে বলল, “মা, আর কেঁদো না।”
মা ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। কিন্তু অর্ণবের মনে তখন একটাই প্রশ্ন—কেন? কেন তাদের মধ্যে রোজ এমন হয়?
সময় গড়ায়। অর্ণব বড় হতে থাকে, কিন্তু সেই অদৃশ্য ছায়া তার পিছু ছাড়ে না। সে চাপা স্বভাবের হয়ে যায়। কারও সাথে সহজে মেশে না। নিজের আবেগ প্রকাশ করতে তার ভয় লাগে। তার মনে হয়, যদি কেউ তাকে ছেড়ে চলে যায়!
বাবা-মায়ের ঝগড়ার প্রভাব অর্ণবের পড়াশোনাতেও পড়ে। ক্লাসে তার ফল খারাপ হতে থাকে। শিক্ষকরা বলেন, “অর্ণবের মনোযোগের অভাব রয়েছে।” কিন্তু আসল কারণ কেউ বুঝতে পারে না।
এক সন্ধ্যায় অর্ণব তার মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা, কেন তোমরা রোজ ঝগড়া করো?”
মা প্রথমে চুপ করে থাকেন, তারপর ধীরে ধীরে বলেন, “বাবা, মাঝে মাঝে বড়দের মধ্যে তোমাকে নিয়ে, তোমার ভবিষ্যত্ তৈরির পথ নিয়ে মতের অমিল হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা তোমাকে ভালোবাসি না।”
অর্ণব মায়ের কথা বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, যদি তারা তাকে ভালোবাসে, তাহলে কেন রোজ ঝগড়া করে তার মনে এত কষ্ট দেয়?
অর্ণব মাকে বলে মা তুমি সেদিন বলেছিলে “যদি কাউকে ভালোবাসো তবে তার জন্য ত্যাগ করতে আগে শিখবে, তারপর ভালবাসবে। তবেই সেই ভালোবাসার মূল্য পাবে।” এটা কি ভুল কথা?
অর্ণবের গল্প শুধু একটি শিশুর গল্প নয়, এটি সেই সব শিশুদের গল্প যাদের শৈশব বাবা-মায়ের কলহের বিষে বিষাক্ত, জর্জরিত। বাবা-মায়ের ঝগড়া শিশুদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুদের সামনে ঝগড়া করলে তাদের মানসিক ও আবেগিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ, রাগ, হতাশা, আত্মবিশ্বাসের অভাব—এমন অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যা ভবিষ্যতে এক রোগে পরিণত হতে পারে।
অর্ণবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার শৈশবের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তার ব্যক্তিত্বের উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। সে বড় হয়েও সেই ছায়া থেকে মুক্তি পায়নি।
একদিন অর্ণব কে এক মনোবিদের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যান তার বাবা মা। মনোবিদ তার কথা মন দিয়ে শোনেন এবং বুঝতে পারেন অর্ণবের সমস্যার মূল কোথায়। তিনি অর্ণবকে সাহায্য করেন তার ভেতরের ভয় এবং রাগ মোকাবেলা করতে। ধীরে ধীরে অর্ণব বুঝতে পারে যে তার বাবা-মায়ের ঝগড়া তার নিজের কোনো দোষ নয়। সে যেমন, সে তেমন।
এই গল্পের মাধ্যমে আমরা এটাই বোঝাতে চাই যে বাবা-মায়ের উচিত শিশুদের সামনে ঝগড়া করা থেকে বিরত থাকা। তাদের মনে রাখা উচিত যে তাদের প্রতিটি কথা ও কাজ শিশুদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। একটি সুন্দর ও সুস্থ শৈশব প্রত্যেক শিশুরই অধিকার। যেটা থেকে অর্ণব বঞ্চিত হচ্ছে।
অর্ণবের মত শিশুরা নীরব দর্শক, তারা কিছুই করতে পারে না। তারা শুধু বাবা-মায়ের কাছে একটু শান্তি, একটু ভালোবাসা, একটু নিরাপদ আশ্রয় চায়।
অর্ণবের গল্প একটি সতর্কবার্তা। আসুন, আমরা আমাদের শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি, যেখানে ঝগড়া নয়, ভালোবাসা আর সহানুভূতি বিরাজ করবে।
মনোবিদের সাথে কথা বলার পর অর্ণবের বাবা-মায়ের জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। মনোবিদ তাদের বুঝিয়েছিলেন, তাদের নিজেদের মধ্যেকার কলহ শুধু তাদেরকেই কষ্ট দেয় না, বরং তাদের আদরের সন্তান অর্ণবের কোমল মনেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তিনি তাদের বুঝিয়েছিলেন, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা যা দেখে, তাই শেখে। বাবা-মায়ের ঝগড়া তাদের মনে ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, এবং চাপা স্বভাবের জন্ম দেয়।
মনোবিদের কথাগুলো তাদের হৃদয়ে গভীরভাবে স্পর্শ করলো। তারা উপলব্ধি করলেন, নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তারা তাদের সন্তানের কত বড় ক্ষতি করে চলেছেন। সেই দিন থেকে তারা প্রতিজ্ঞা করলেন, অর্ণবের সামনে আর কখনো ঝগড়া করবেন না। নিজেদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ হলে, তা শান্তভাবে, অর্ণবের আড়ালে আলোচনা করবেন।
প্রথমে তাদের কিছুটা অসুবিধা হতো। পুরোনো অভ্যাস সহজে যায় না। কিন্তু অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা নিজেদের সংযত করতেন। তারা বুঝতে পারছিলেন, তাদের সামান্য চেষ্টায় তাদের সন্তানের জীবন কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
ধীরে ধীরে তাদের মধ্যেকার সম্পর্কও উন্নত হতে লাগলো। ঝগড়া কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়লো, ভালোবাসা আরও গভীর হলো। তারা দুজনেই অর্ণবের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিতে শুরু করলেন। তার পড়াশোনা, খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা—সবকিছুর খবর রাখতেন তারা।
অর্ণবের মধ্যেও পরিবর্তন দেখা দিলো। তার সেই চাপা স্বভাব, বেখেয়ালী ভাব ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগলো। সে আবার আগের মতো হাসিখুশি হয়ে উঠলো। স্কুলে তার মনোযোগ ফিরে এলো, বন্ধুদের সাথে সে আগের মতো খেলতে শুরু করলো। তার মনে যে অদৃশ্য ছায়া পড়েছিল, তা যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো।
একদিন অর্ণব তার বাবা-মায়ের মাঝে বসে গল্প করছিলো। হাসতে হাসতে সে তার মাকে বললো, “মা, এখন আর তোমাদের ঝগড়া হয় না কেন?”
মা হেসে অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কারণ আমরা বুঝতে পেরেছি, ঝগড়া করলে শুধু আমাদের নয়, তোমারও কষ্ট হয়। আমরা আমাদের অশান্ত মান ত্যগ করেছি, যেহেতু তোমায় আমরা সবাই ভালবাসি, আমরা বুঝেছি ভালোবাসতে গেলে আগে ত্যাগ করতে শিখতে হয়। আমরা চাই, তুমি সবসময় খুশি থাকো।”
অর্ণব তার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তার চোখেমুখে এক অনাবিল আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছিলো। সে বুঝতে পারছিলো, তার বাবা-মা তাকে কতটা ভালোবাসে।
অর্ণবের গল্প আমাদের এটাই শিক্ষা দেয় যে, বাবা-মায়ের দায়িত্ব শুধু সন্তানকে জন্ম দেওয়া আর পালন করাই নয়, তাদের দায়িত্ব সন্তানকে একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেওয়াও। তাদের নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্ক যদি মধুর হয়, তাহলে তার প্রভাব সন্তানের জীবনেও পড়ে। একটি সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ একটি শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। অর্ণবের বাবা-মা তাদের ভুল বুঝতে পেরে নিজেদের শুধরে নিয়েছিলেন বলেই অর্ণব এক সুন্দর ভবিষ্যৎ পেয়েছিলো। তাদের এই প্রচেষ্টা অন্যান্য বাবা-মায়ের জন্যেও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আগেকার মুনি ঋষিরা বলে গেছেন শিশু পালন বা শিশু মানুষ করা একটি শিল্প, মনে অশান্তি থাকলে যেমন কোন শিল্পী তার প্রকৃত শিল্পত্য প্রকাশ করতে পারে না, তেমন অশান্ত মনে কোন শিশু মানুষ করলে সে তার প্রকৃত প্রতিভা প্রকাশ করতে পারেনা। এতে সারা জীবনের জন্য উভয়কেই অশান্তি ভোগ করতে হয়।
প্রাচীন মুনি ঋষিরা শিশু পালনকে একটি শিল্প হিসেবে দেখেছেন, এবং এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। তাদের এই বাণীর মূল অর্থ হলো:
মনের শান্তি অপরিহার্য: একজন শিল্পী যেমন শান্ত ও একাগ্র চিত্তে তার শিল্প সৃষ্টি করেন, তেমনই একজন অভিভাবক ও শান্ত মন প্রয়োজন শিশুর সঠিক পরিচর্যা ও বিকাশের জন্য। মনের মধ্যে যদি অশান্তি, উদ্বেগ, বা অস্থিরতা থাকে, তাহলে তার প্রভাব শিশুর উপর একান্ত ভাবে পড়ে।
অশান্ত মনের প্রভাব: অশান্ত মনে যখন কেউ শিশু পালন করেন, তখন তার কিছু নেতিবাচক প্রভাব শিশুদের উপর পড়ে:
#আবেগিক_অস্থিরতা: অভিভাবকের মনের অস্থিরতা শিশুর মধ্যে আবেগিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। শিশু ভয়, উদ্বেগ, রাগ, এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে।
#ব্যবহারগত_সমস্যা: শিশুরা অমনোযোগী, জেদি, এবং অবাধ্য হয়ে উঠতে পারে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিতে পারে।
শারীরিক সমস্যা: মানসিক চাপের কারণে শিশুদের ঘুমের সমস্যা, পেটের সমস্যা, এবং অন্যান্য শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রতিভার বিকাশ বাধা: অশান্ত পরিবেশে শিশুদের সৃজনশীলতা এবং প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় না। তাদের মানসিক এবং আবেগিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করে।
সারাজীবনের জন্য অশান্তি: শৈশবে যে মানসিক আঘাত বা অস্থিরতা তৈরি হয়, তা অনেক সময় সারাজীবন ধরে চলতে থাকে। এই কারণে, মুনি ঋষিরা শিশু পালনের সময় অভিভাবকদের মনের শান্তির উপর এত জোর দিয়েছেন।
অর্ণবের বাবা-মা যখন ঝগড়া করতেন, তাদের মনের অশান্তি অর্ণবের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তার মধ্যে বেখেয়ালী ভাব, জেদ, এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যখন তারা মনোবিদের পরামর্শ মেনে নিয়ে নিজেদের ভুল শুধরে নিলেন, তখন অর্ণবের জীবনে শান্তি ফিরে এলো।
অতএব, শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য অভিভাবকদের নিজেদের মনের শান্তির প্রতি যত্নবান হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
—oooXXooo—