রহস্যে ঘেরা সকাল
নবু
পন্টুর বয়স পাঁচ বছর। এই বয়সে শিশুরা যা হয়, পন্টুও ঠিক তাই – যেন একরাশ কৌতূহল আর বিস্ময়ে ভরা। তার ছোট্টো চোখে জোড়ায় সবসময় নতুন কিছু দেখার আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে যেন এক নতুন দিনের অভিযানে নামে। বিছানা ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে, স্কুলের পোশাক পরে তৈরি হয়ে নেয় সে। তার পরনের জামা-প্যান্ট যেন তার ছোট পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে প্রস্তুত। গলায় ঝোলানো জলের বোতল টি তার সারা দিনের সঙ্গী, আর পিঠে থাকা বইয়ের ব্যাগ টি যেন তার জ্ঞানের ভান্ডার। এই সবকিছু নিয়ে সে রোজ সকালে বাবার বাইকে চেপে রওনা দেয় স্কুলের উদ্দেশ্যে।
স্কুলে গিয়ে পন্টু যেন এক নতুন জগতে প্রবেশ করে। সেখানে কত রকমের মজার খেলা হয়! কখনও তারা সবাই মিলে কুমির সেজে হাঁটে, আবার কখনও বাঘের মতো গর্জন করে। খেলার ছলে তারা যেন নিজেদের কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। কখনও সবাই মিলে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর অভিনয় করে, যা দেখে মনে হয় যেন সত্যিই তারা আকাশে উড়ছে। পন্টুর কাছে স্কুল মানেই আনন্দ আর মজার এক রঙিন জগৎ।
কিন্তু আজকের সকালটা অন্যরকম। আজ যেন পন্টুর চেনা রুটিনের বাইরে কিছু ঘটতে চলেছে। তার মনে চাপা উত্তেজনা, নতুন কিছু জানার আগ্রহ। আজকের দিনটা গতানুগতিক দিনের মতো নয়, বরং অন্যরকম কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য।
আজ স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে পন্টু দেখল, সব কেমন যেন চুপচাপ। রোজকার মতো কোনো হইচই নেই, কোনো হাসি-ঠাট্টা নেই। গেটের পাশে একটা বাঁধানো বেঞ্চে কয়েকজন ছেলে চুপ করে বসে আছে। তাদের মুখগুলো কেমন যেন শুকনো, যেন তারা কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। পন্টু এগিয়ে গেল।
আস্তে আস্তে আরও কয়েকজন ছেলে এসে জড়ো হল সেখানে। সবাই মিলে দেখল, গেটের পাশে একটা ছেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ছেলেটার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর, চোখে কোনো আলো নেই। বাচ্চাদের দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন সে অন্য কোনো জগতে আছে।
পন্টু সাহস করে এগিয়ে গেল। তার ছোট্ট মনে ভয় একটু থাকলেও কৌতূহল টা অনেক বেশি ছিল। সে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে খুব নরম স্বরে বলল, কি ব্যাপার ভাই!?
অন্য ছেলেরা ও তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের মনেও একই প্রশ্ন। কিন্তু ছেলেটা কোন উত্তর দিল না। সে যেমন ছিল, তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। যেন সে কোনো পাথর।
স্কুলের ভেতরে যেন কেমন একটা থমথমে ভাব। রোজ যেখানে দিদিমণি দের হাসি আর ছড়ার শব্দে মুখরিত থাকত, আজ সেখানে পিন পড়লেও যেন শব্দ শোনা যায়। ক্লাস-রুম গুলো খালি, বই-খাতা গুলো এলোমেলো পড়ে আছে। পন্টু বুঝল, নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, যা তাদের সবার মন খারাপ করে দিয়েছে।
পন্টু আর তার বন্ধুরা মিলে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে লাগল।
“কি হয়েছে রে?” একজন বলল।
“আমিও তো জানি না,” পন্টু বলল।
“দিদিমণিরাও কাছে পিঠে কেউ নেই।”
তাদের মনে ভয় আর কৌতূহল দুটোই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারা আবার ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটা তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে, যেন সে কোনো রহস্য লুকিয়ে রেখেছে।
তখনই পন্টুর মনে পড়ল, কাল ক্লাসে সে দিদিমণি কে বলতে শুনে ছিল, কাল নাকি একটা নতুন ছেলে আসবে স্কুলে। তবে কি এই সেই ছেলে!? কিন্তু কেন সে এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে! আর কেনই বা আজ স্কুলে এমন নীরবতা!?
পন্টু আর তার বন্ধুরা ঠিক করল, তারা এর শেষ দেখে ছাড়বে। তারা সবাই মিলে ছেলেটার দিকে আরও একটু এগিয়ে গেল। পন্টু আবার জিজ্ঞাসা করল, ভাই, তুমি কে!? আর কেন তুমি এমন চুপ করে আছো!?
ছেলেটা ধীরে ধীরে মাথা তুলল। তার চোখগুলো যেন অন্ধকার কুঠুরির মতো। সে পন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি…আমি তোমাদের বন্ধু।”
কিন্তু ছেলেটার গলার স্বর টা যেন স্বাভাবিক নয়, কেমন যেন ভাঙা ভাঙা। তার কথা শুনে পন্টুর মনে হল, এ যেন কোনো ভূতের গল্প। পন্টু ও তার বন্ধুরা ভয়ে পিছিয়ে এল।
তখনই একজন ছেলে বলল, “মিথ্যা কথা। তুমি আমাদের বন্ধু নও। আমাদের বন্ধু হলে তুমি হাসতে।”
পন্টু দেখল, ছেলেটা যেন আরও চুপসে গেল। সে ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে ফেলল। মনে হল যেন তার কোনো কষ্ট হচ্ছে।
পন্টু এবার একটু সাহস পেল। তার মনে হল, ছেলেটা হয়তো খারাপ নয়, তবে নিশ্চয়ই কোনো কারণে সে চুপ করে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার হাত ধরল। তার ছোট্ট নরম হাত ছেলেটার রুক্ষ হাতে স্পর্শ করতেই যেন ছেলেটা কেঁপে উঠল।
পন্টু বলল, ভাই, তুমি কাঁদছো!
ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না, শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
পন্টু আর তার বন্ধুরা সবাই মিলে ছেলেটার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়াল। তারা বুঝতে পারল, ছেলেটা আসলে একা, আর হয়তো খুব দুঃখী। তারা সবাই মিলে ঠিক করল, তারা ছেলেটার মন ভালো করার চেষ্টা করবে। তারা তাকে গান শোনাবে, গল্প বলবে, আর একসাথে অনেক রকম খেলা করবে। এবার যে যার টিফিন বাক্স থেকে খাবার বের করে ছেলেটাকে দিলো, ছেলেটা গোগ্রাসে সেগুলো খেয়ে নিল। পন্টু ও তার বন্ধুর বুঝতে পারল ছেলেটার ভীষণ খিদে পেয়ে ছিল।
স্কুলের নীরবতা ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করল। বাচ্চাদের হাসি আর কলরবে আবার ভরে উঠল চারপাশ। ছেলেটা তখনও চুপ করে ছিল, তবে তার চোখে যেন একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছিল। পন্টু আর তার বন্ধুরা তাদের নতুন বন্ধুর সাথে আরও অনেক খেলার স্বপ্ন দেখতে লাগল। তারা জানত, রহস্যের সমাধান একসময় হবেই, ততদিন তারা সবাই একসাথে থাকবে।
===============X=================